আমি এক যাযাবর-৩/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর/৩
শৌভিক কুন্ডা
তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে। আমরা দু'জন, আবীর, বাজু, বুলকি-টুপসি, আর বান্টি। বুলকিরা পড়াশোনার জন্য জলপাইগুড়িতে থাকলেও, ওদের মা, আমাদের কাকীমা, জয়ন্তী হাইস্কুলের মিতু দিদিমণি ওখানেই থিতু তখন । পরবর্তীতে জলপাইগুড়ি হয়ে তিনি না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। হুজুগ, যদি তা-ই বলি, তুলেছিল যতদূর মনে পড়ে, বাজুই। অবশ্য হুজুগই বা বলি কেন, ততদিনে তো ক্যামেরা নিয়ে লাটাগুড়ি, চাপরামারি, সামসিং, সুনতালেখোলা পর্ব পেরিয়ে এসেছি। সুতরাং বাজুর প্রস্তাব লুফে নেওয়া হয়েছিল। তখন জয়ন্তীতে প্রাইভেট লজ একটিও নেই, আমাদের মফস্বলেও মোবাইল ফোন অলীক, ইসিবির অবকাশের বুকিং কলকাতা থেকে, অনলাইন নামটাই ভাসে নি বাতাসে, বনদপ্তরের বাংলো পাওয়া শিবেরও অসাধ্য! সবেধন নীলমণি পি এইচ ইর বাংলো, তার বুকিং পাওয়াও মহা হ্যাপা। জয়ন্তী তথা আলিপুরদুয়ার ডিএফডির অধীন যে কোনো এলাকাতেই খুব কড়াকড়ি। কেএলও পর্ব মাঝ আকাশে গনগনে। এমন অবস্থায় ক্যামেরার কাজ করা যাবে কি না, সে সংশয় বুকে নিয়েই রওনা হয়েছিলাম। সঙ্গে জলপাইগুড়ির সে সময়কার ফিল্ড পাবলিসিটি অফিসার বন্ধুবর চার্বাকের দেওয়া একটি সরকারি প্যাডে হাতেলেখা পরিচয়পত্র। রাজাভাতখাওয়া আসতে না আসতেই ট্রাইপড, ক্যামেরা, হ্যান্ড রিফ্লেকটর বের করে এমন হাবভাব আমাদের, যেন হাটারি, আফ্রিকান সাফারির মতো ছবি হামেশাই তৈরী করছি! যাইহোক, সেসব অস্ত্র সম্বল করে, বুকিং আছে কি নেই সে প্রশ্নই তুলতে না দিয়ে গম্ভীরমুখে চার্বাকের ঐ লম্বা ইংরেজি চিঠি বাংলোরক্ষকের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। বোতামছেঁড়া শার্ট আর হাফ লুঙ্গির রক্ষকপ্রবর সে চিঠি থেকে একটিই চিহ্ন উদ্ধার করতে পেরেছিলো, সেটা হ'ল অশোক স্তম্ভ। ব্যস, বাস্তিল দুর্গ, থুড়ি, পি এইচ ই বাংলো আমাদের!
তখনকার জয়ন্তীতে একটিই বাস যাতায়াত করতো আলিপুরদুয়ার থেকে, রাষ্ট্রীয় পরিবহনের (এখনও সম্ভবত তাই), সকালে আসা, বিকেলে ফেরা, দিনে সাকুল্যে এই দুবার। সে বাসে বন্দুকধারী নিরাপত্তা রক্ষীরা থাকতেন। কেবল বুনো জন্তু নয়, এ পথে দিনেদুপুরেই, হ্যাঁ, আক্ষরিক, ডাকাতি হরহামেশা (এ বিষয়গুলো এখন আর নেই, সম্ভবত)! যারা আমাদের মতো ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে এ পথে হঠাৎ কখনো, অপেক্ষা থাকতো ঐ সশস্ত্র রক্ষীসহ বাসটির, রাজাভাতখাওয়া চেকপোস্ট থেকে। সময়ের হিসেব গুলিয়ে ফেলে সে সাহচর্য থেকেও বঞ্চিত ছিলাম আমরা সেবার! রাজাভাতখাওয়া থেকে বালা নদীর এপার পর্যন্ত
দশ, বালা পেরিয়ে জয়ন্তী আরো চার, এই চোদ্দ কি.মি. পথে দু'পাশ থেকে জঙ্গল চেপে ধরতে চাইছিলো।
এখন তো বালা নদীর ওপর ঝকঝকে সিমেন্ট ব্রিজ। কিন্তু সেদিনের সেতুহীন বালা পারাপারের স্মৃতি চিরকালের জন্য গেঁথে থাকবে মনে! সে অভিজ্ঞতা আরও রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছিল ভুটান পাহাড়ে বৃষ্টি হওয়ার জন্য। আমাদের ছিলো এইট-সীটার মারুতি, বাজুর গাড়ি। সে ছোট গাড়ির ক্ষমতা ছিলো না নদীর ঐ দুর্বার বহমানতাকে পেরিয়ে যাওয়ার। এপারের জঙ্গলকে পিঠে নিয়ে ওপারের সূচিভেদ্য জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। অপেক্ষা, কখন বৃষ্টি থামবে, বালা আবার ফিরবে তার শান্ত চেহারায়, পেতে দেবে অতিক্রমণীয় শরীর আবার! আর, সে প্রতীক্ষার প্রতিটি পল জুড়ে আশংকা, এই বুঝি হাড় হিম চাহনি নিয়ে বের হয়ে আসবে জঙ্গলরাজ!
জল কমলে ওপারে উঠে ফের রওনা জয়ন্তী জনপদের দিকে। চাকার নীচে পাথর সরে যায়, ভরদুপুরে এঞ্জিনের আওয়াজ ছাপিয়ে গাড়ির ভেতর ঢুকে আসে ঝিঁঝিঁর ডাক। পি.এইচ.ই বাংলোয় ঘর দখলের বে-আইনি বৃত্তান্ত তো আগেই শুনিয়েছি, এবার বরং তার পরের কথা বলি। বাংলোয় ঢুকে প্রথম যার লাল চোখ আর হাসিমাখা মুখের সাথে পরিচয় হল, তিনি হচ্ছেন নকুল মহারাজ। কুক কাম সে বাংলোর তৎকালীন সর্বেসর্বা। বুলকি-টুপসিদের জায়গাতুতো মামা, সুতরাং আমাদেরও। শুনেছি নকুলমামা ও বাংলোতে আর নেই। তাই, যাঁরা এখন ওখানে ওঠেন তাঁরা যে স্বর্গীয় রান্নার থেকে বঞ্চিত হনই, একথা জানিয়ে না রাখলে অন্যায় হবে! আমরা পৌঁছেছিলাম বেলা করে, লাঞ্চ রাস্তাতেই। দোতলার ব্যালকনিতে চায়ের কাপ নিয়ে বসতেই পথের শ্রম, আশঙ্কা সব যেন উড়ে গেল এক লহমায়। পায়ের নীচে বাংলোর পাঁচিল, তার পরই নদী, আর জয়ন্তী নদীর বুক থেকেই উঠে যাওয়া পাহাড়। সে পাহাড় আবার মুখ গুঁজেছে আকাশে! যেন বিভোর শিল্পীর তুলির টানে নীল সবুজের নানা শেডে ধরা দিয়েছে আকাশ-নদী-পাহাড় আর জঙ্গলের সমঝোতা!
যত দিন গেছে, জয়ন্তীতে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের যোগান ক্রমশ সুলভ হয়ে উঠছে, শুনেছি, দেখেওছি। কিন্তু প্রথমবারের সে জয়ন্তী যেন সত্যিকারের এক দিকশূন্যপুরই! আগে থেকেই জানা ছিলো, তাই রসদ যতটা সম্ভব সাথে করে এনেছিলাম। তবু অপরাহ্নের অলসতায় বাধা জুটলো নকুলমামার হাঁকডাকে। রাতে চিকেন খেতে চাইলে এখুনি ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো স্রেফ ডাল-ভাজি আলুর দম। মামা সঙ্গে দিলেন তাঁর সহচর একদন্ত গনেশকে। জয়ন্তী চৌমাথা থেকে বাঁদিকে ঘুরে বেশ খানিকটা উজিয়ে যেখানে এসে দাঁড়ালাম, সে তো এক টিউটোরিয়াল! অল্প বয়সী মাস্টারমশাই দাওয়া থেকে নেমে এলেন। তাঁর গুটি কয়েক শিষ্য শিষ্যা পড়া থামিয়ে অবাক চোখে দেখতে লাগলো আমাদের। শিক্ষক আমাদের নিয়ে চললেন ভেতর বাড়িতে। উঠোনে বিরাট খাঁচায় কঁক কঁক করছে তারা! মাপামাপির ব্যাপার নেই, মুখ হাঁকা দরে দুটি দেশী ঝুললো গনেশের হাতে। আগামী দুদিনের যোগানও নিশ্চিত করে এবার ফেরার পথ। গনেশ এগিয়ে গেল আবছায়া ছিঁড়ে। আমাদের মাথার ওপর সূর্যাস্তের লালচে আগুণ সন্ধ্যের ঘোমটায় উঁকি দিচ্ছে। আঁকাবাঁকা মেটে পথের দুপাশে জোনাকির জ্বলানেভা শুরু হয়েছে, ঝিঁঝিদের কোরাস ঘিরে ধরছে শহুরে অনধিকারকে, আর চৌমাথার প্রাচীন মহীরুহটির রহস্য থেকে আচমকা নৈঃশব্দ ফাটিয়ে ডেকে উঠছে তক্ষক, "ট-ক্কো..... ট-ক্কো...."!
বান্টির ডাকে সন্ধ্যের চিত্রপট থেকে ছিঁড়ে ফেলতে হল নিজেকে। পায়ে পায়ে জয়ন্তী হাইস্কুলের সামনে। বিজলী হীন অন্ধকারে মুখ ঢেকেছে স্কুলবাড়ি। উল্টো মুখে কালিঝুলি মাখা চায়ের দোকান। দোকানদারও মামা, শঙ্করমামা। চা তো জয়ন্তীর জন্মলগ্ন থেকে ফুটেই চলেছে, আরেকটি উনুনে সবে আঁচ। কোনো তাড়া নেই শঙ্কর মামার। জানালেন, আজ স্পেশাল ভাজা, দেরি হবে একটু। আমরা যেন হাওয়াঘরে গিয়ে বসি ততক্ষণ। হাওয়াঘর, সার্থক নাম। ছোট্ট বাজারের পেছনে খোলা মাঠের মধ্যে গোল ঘরটা (এখন সম্ভবত এস.এস.বি ক্যাম্পের পেছনে ঢাকা পড়েছে, অথবা নেই-ই আর)! সান্ধ্য মজলিসের পক্ষে আদর্শ একেবারে। আড্ডা জমে গেল। শঙ্কর মামার পাঠানো মুচমুচে সরষে ফুল, ডুমুর-ব্যাসন ভাজা, আরো এক প্রস্ত চা সহযোগে। ফেরার পথে একবার মিতুকাকীমার বাড়ি ঢুঁ মারা, বেশ বকা জুটলো এত দেরি করে দেখা দেওয়ার জন্য। পরদিন রবিবার, দুপুরের খাওয়ার নেওতা রইলো, তারপর গুটি গুটি পায়ে হ্যারিকেন জ্বালা বস্তিপথ পেরিয়ে বাংলোয় ফেরা। মাঝ পথে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে বান্টি কোথায় মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। ফিরলো যখন, মুখে দিগ্বিজয়ের হাসি, হাতে সুধার আধার, গুরুদক্ষিণা আর কি! বান্টি যে আমার ছাত্রও ছিলো, আমি ভেতর ঘরে গেলে টেবলে রাখা প্যাকেট থেকে সিগারেট মেরে দিত! গুরুশিষ্য এবং সাথীজন সাথে ব্যালকনিতে ঘন্টা দুয়েক। সে রাতে নকুলবাবাজির হাতের অমৃত চিকেন সহযোগে বিপুল পেট পুজোর পর ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতে খুব একটা দেরি হয় নি। বাতাসের শব্দ, জয়ন্তীর কলকল আর রাতজাগা পশুপাখির ডাক সে ঘুমের ওপর বিছিয়ে রাখছিল আরামদায়ক অলৌকিক চাদর।
রাতে বুঝি বৃষ্টি হয়েছিল। টের পাই নি অবশ্য। তবে ভোরবেলা ব্যালকনি থেকে আধোঘুম চোখ বিছিয়ে দিতে মালুম হল। ভেজা হিম ভাব বাতাসের ছোঁয়ায়, নদীর চরে শান্তিজলের ছিটে, ওপারের ভুটান পাহাড়ের বুকে শ্বেতশুভ্র মেঘবালিকাদের অলস গতি, তাদের বসনে লাগছে ঘুমভাঙা সূর্যের স্নিগ্ধ লালিমা! প্রসঙ্গত মনে পড়লো এ সময়কার চলচ্ছবিগুলোর টুকরো টুকরো নিয়ে অনুজ অনিন্দ্য শিকদার বেঁধেছিল অসামান্য একটি গান,
"দূর থেকে দেখা নীল পাহাড়। স্বপ্নের ইশারায়
ডাক দিয়ে যায় দিন প্রতিদিন
খোলা জানালায়"।
দলের কারো ঘুম ভাঙে নি তখনও। নীচের কিচেনটিতে পৌঁছে দেখি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে সে ঘরও। সুলুক-সন্ধানে চায়ের পাতা পেয়ে গেলাম। আপনা হাত জগন্নাথ। আলস্যের রেশটুকু কাটলো নিজের পরিশ্রমে গড়া এক পেয়ালা চায়ের চুমুকে। ততক্ষণে নকুল মামা এসে পৌঁছে নিজেকে এই মারে তো সেই মারে, অতিথি তদারকিতে বিঘ্ন ঘটে গেল যে! আসলে গত রাতে নাকি হাতির পাল নেমে ছিলো, সেই দেখতে গিয়ে বেশ দেরি, ঘরে ফিরেও ছোট ছেলের শরীর খারাপের দরুন বারবার ঘুম ভেঙেছে, তাই উঠতে দেরি, এইসব অনাবশ্যক কৈফিয়তের ফাঁক চুইয়ে অবশ্য তার ফোলা ফোলা লাল চোখ, সামান্য বেপথু গলা আর হালকা ঝাঁঝালো ঘ্রান আমাকে অন্য গল্প বলছিল।
যাক গে, বাকিরা ঘুম থেকে উঠলে যেন নকুল তাদের জানিয়ে দেয় যে আমি নদীর বুকে চললাম, এ বার্তা রেখে বের হলাম। পেছনবাগের ছোট্ট গেটটি খুললেই নদী, জয়ন্তীর টাটকা বাতাস। আলুথালু পাথর ডিঙিয়ে চরে নামা। দু চারটি হাঁস,মুরগী, কুকুরের এই আগন্তুককে সামান্য কৌতুহলসঙ্গ, এসব পেরোতে দেখি খাঁ খাঁ বালুচরে একা আমি। হাত কয়েক দূর থেকে আমাকে ইশারা পাঠাচ্ছে চপলা জয়ন্তী, কাঁপুনির ঢেউ তোলা বুকে। গতকালের নীল বৈভব আর নেই, এ মুহুর্তে বরং সবুজ আভাতে শরীর ঢেকেছে সে রঙ্গিলা, আর তাকে ছাড়িয়ে ঐ সবুজেরই অপার রহস্যকে স্তরে স্তরে ধরে রেখেছে দিগন্তজোড়া ভুটান পাহাড়, তার সুঠাম বিস্তার নিয়ে।
দুপুরের খাওয়া ছিলো মিতুকাকীমার বাড়ি। চিকেন তো ঠিকই আছে, কিন্তু সাথে ঝিরিঝিরি আলু বেগুন দিয়ে ময়া মাছের চচ্চড়ি, আহা, আজও জিভে লেগে আছে। খেতে খেতেই মিতুকাকীমার ক্ষোভ উদ্গীরণ ডিপার্টমেন্টের অসহযোগিতা বিষয়ে।
কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয়দের দড়ি টানাটানির আঁচ কিছুটা পোহাতে হয়েছিল আমাদেরও। ক্যামেরা নিয়ে গেছি, জঙ্গলের ভেতরকার চলচ্ছবি তুলতে পারমিশন প্রয়োজন। আমি আর আবীর চললাম বনদপ্তরের অফিসে। গিয়ে প্রাণে জল পেলাম, রেঞ্জার আমার পূর্বপরিচিত জলপাইগুড়িরই বাদলদা, বাদল দেবনাথ। তিনিও ঐ পান্ডব বর্জিত জায়গায় আমাকে পেয়ে মহা খুশি! তো নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয় কারো রেফারেন্স একটা দরকার হয়, আমাদের ক্ষেত্রে পরিচিতির দরুন হয়তো না হলেও চলতো। আমিই ভালো বুঝে মিতু কাকীমার নাম বলাতে বাদলদার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। আচরণও পাল্টালো যেন কিছুটা। মিত্রা দেব জয়ন্তীর "ইকো ডেভেলপমেন্ট কমিটি"র চেয়ারপার্সন। বনবিভাগের সাথে সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়! কোর এরিয়ার ছবি তোলার পারমিশন পেলাম না, তবে একজন গাইড নিয়ে সেখানে ঘুরতে যাওয়ার অধিকার মিললো। আর পরদিন বাদলদা নিজে বনবিভাগের জীপে আমাদের পুখুরি পাহাড়ে নিয়ে যাবেন ঠিক হল।
বিকেল হয়ে এসেছিলো। লুকিয়ে একটা হাত ক্যামেরা সাথে গাড়িতে চাপলাম। কিছু দূর চলতে চলতে বিকেলের আলো ঢাকা পড়তে লাগলো আদিম সব গাছের চন্দ্রাতপের ছায়ায়। বুনো বাতাবির সারি সারি গাছ দেখে সামলাতে পারলাম না। গাড়ি থামাতে বলায় গাইড নারাজ, অতএব মুশকিল আসান 'ছোট বাইরে' বাহানা। "থামাতেই হবে ভাই, নইলে গাড়িতেই হয়ে যাবে।" ব্যাজার মুখে গাইড অনুমতি দিলেন, "তাড়াতাড়ি করেন, তাড়াতাড়ি। " বান্টি নামলো এক দিক দিয়ে, আর এক দিক দিয়ে টুপসিকে নিয়ে ক্যামেরা সহ আমি। দু মিনিটের টেক, ফলন্ত বাতাবি গাছের নীচে হাতে সদ্য ছেঁড়া ফল নিয়ে টুপসির ভয়মাখা মুখের ছবি খুবই প্রাণবন্ত হয়েছিল। এরপর ওয়াচ টাওয়ার, ততক্ষণে সন্ধ্যে বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে। একটা ছোট্ট জলাশয়। গাইড জানালেন বেশিক্ষণ থাকা যাবে না, বুনোরা, বিশেষত হাতি, এসময়ই এখানে জল খেতে আসে। অল্পক্ষণের অপেক্ষায় তাদের দেখা পাই নি আমরা। ফেরার পথে কিছু দূর উজিয়ে সরু রাস্তাটা দেখি ডালপালা দিয়ে আটকানো। মতিগতিতে বুঝলাম গাইড বেশ টেনশনে। চাপা গলায় বললেন, "শব্দ করবেন না কেউ, একটু অপেক্ষা করতে হবে। হাতির পাল কাছাকাছিই আছে!" ঐ একটু অপেক্ষাই যেন অনন্তকাল! কোথাও সামান্য শব্দ হলেও চমকে চমকে উঠছি। যাই হোক গাইডমশাই অল ক্লিয়ার জানানোতে গাড়ি আবার গড়ালো।
বলতে ভুলেছি, জয়ন্তী পৌঁছনোর পর থেকেই আমরা বিদ্যুৎহীন। শুক্রবার থেকেই নাকি শুরু হয়েছে, আজ নিয়ে তিনদিন হতে চললো। এবং এখানকার জীবনাচরণে এটা খুবই স্বাভাবিক! ঠিক করলাম পরদিন আমরাই যাবো আলিপুরদুয়ার। বাদলদাকে রাজী করালাম সকালের বদলে যাতে দুপুরের খাওয়া সেরে পুখুরির প্রোগ্রাম করা যায়। ততক্ষণে বাদল দার রাগ বোধহয় কিছুটা নেমেছে, রাজী হলেন।
পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে আলিপুরের দিকে রওনা, ভাগ্য এতটাই ভালো কে জানতো, আমরা যখন বালা নদীর এ পারে, ওদিক থেকে আসা একটা ম্যাটাডোর দেখে বান্টি বললো ঐ তো ইলেক্ট্রিসিটির গাড়ি। ঠিক তাই! মাঝনদীতে দেখা হল দু পক্ষের। কাজ তো মিটে যাবে, আমরা এখন কি করি? ফিরে যাবো? বাজুরই প্রস্তাব, "চলো সান্ত্রাবাড়ি থেকে ঘুরে আসি। পনের কিলোমিটারও না তো!" অতএব চালাও পানসি সান্ত্রাবাড়ি। যেতে যেতে আটাশ বস্তির কাছাকাছি এক অদ্ভুত দৃশ্য। পাশেই নদী, সেটা বড়ো ব্যাপার নয়, কিন্তু নদীর বেড রাস্তা থেকে ওপরে! এর পরেও বহুবার আটাশ বস্তিতে ঠাঁই গেড়েছি, আমার অন্যতম প্রিয় ঠেক, কিন্তু বক্সাঝোরাকে সেবারের মত রাস্তার থেকে বেশি উচ্চতায় বয়ে যেতে দেখি নি আর। এখন সান্ত্রাবাড়ি যতটা জমজমাট তখন আদৌ তেমন ছিলো না। একটাই দোকান, মোমোর। আর রাস্তার ধারে কমলালেবু এবং ভুটানি মদের বোতলের পসরা। ওখান থেকে বক্সা ফোর্ট কিলোমিটার ছয়েক। পায়দল। মহিলাদের আপত্তিতে, বিশেষত মধুপর্ণার, সে পথে হাঁটা হয় নি সেবার। বরং ফেরার পথে বালার বুকে আর এক অভিজ্ঞতা। প্রজাপতি! এত রকম প্রজাপতি যে একসাথে থাকতে পারে, এ আমাদের কল্পনারও বাইরে। আবীর ক্যামেরা নিয়ে বুকে হেঁটে চললো সে ঝাঁকের দিকে, স্টিল তুলতে। আমার মাথায় অন্য ভাবনা এলো। টুপসিকে দৌড় করালাম ঝাঁকগুলোর ভেতর দিয়ে। হ্যান্ডিক্যাম চললো ওর পিছে! হাজার রঙের উড়ন্ত প্রজাপতিদের মধ্য দিয়ে টুপসির ছুটে চলার ছবি যখন স্লো মোশনে দেখাই লোক্যাল চ্যানেলে, প্রশংসার ঢল নেমেছিল।
বিকেল করে পুখুরি পাহাড়। এখন যে ছবি দেখি তার সাথে সে পুখুরির কোনো মিল খুঁজে পাই না আর। বাদলদার বিভাগীয় গাড়িতে বেশির ভাগ। পেছন পেছন মারুতি এইট সিটার চালিয়ে সাজসরঞ্জাম নিয়ে বাজু, সাথে আমি, বান্টি। জয়ন্তী জনপদ ছাড়িয়ে এগোচ্ছি। রাস্তার দুপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে বনবিভাগের গুদামঘর, মাঠ, ক্ষেত। অল্পক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম জঙ্গল ঠাসা পাহাড়ের পায়ের কাছে। মসৃণ সফরের ইতি এখানেই। এর পর প্রায় ১২০০ মিটার এবরোখেবরো পাহাড়ি পথে আস্তে আস্তে ওপরে ওঠা। কিছুটা চড়াইয়ের পর গাড়িরা থামলো। যন্ত্রযানের ক্ষমতা শেষ, উঠতে হবে পায়দল। বাদল দা সাবধান করে দিলেন, যে কোনো মুহুর্তে হাতির দেখা মিলতে পারে! দুটি দল হলো। ক্যামেরাদি সরঞ্জাম সহ আমি-আবীর-বান্টি, বাকিরা বাদলদার সাথে। ঐ দলটিই চললো আগে আগে। পাকদণ্ডী বেয়ে জঙ্গল ভেদ করে ওঠা বেশ কষ্টকর। তার মধ্যে আমরা আবার পথ ভুল করে বিপত্তি ঘটিয়েছিলাম। সেল ফোনও তো নেই তখনকার সময়ে। বেশ খানিকটা সময় পর বাদলদার নির্দেশে বনবিভাগেরই এক কর্মী নেমে এসে আমাদের উদ্ধার করে সঠিক পথে নিয়ে চললেন। পুখুরির মাথায় পৌঁছে এতক্ষণের সব পরিশ্রম, মানসিক-শারীরিক, মুছে গেল। এমন জংগুলে পাহাড়ের মাথায় যে অমন টলটলে পুকুরের সম্ভার থাকতে পারে, আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিলো! মনে হয়েছিলো বাস্তব নয়, এ কোনো ম্যাজিশিয়ানের খেলা! ছোট্ট পুকুর। তার স্বচ্ছ জলে খেলা করছে, কচ্ছপ, মাছেরা। তাদের ছোঁয়া বারণ, পুখুরির জলে পা দেওয়া বারণ। বুদ্ধপূর্ণিমায় এখানে পুজো দিতে আসেন স্থানীয় মানুষেরা, বাদলদার মুখে জানলাম। আমরা সেখানে থাকতে থাকতেই ঝাঁটা, কাটারি, ঝুড়ি নিয়ে উপস্থিত হল বনবস্তির ছেলেমেয়েরা। আজ নাকি পুখুরি সাফাই অভিযান। বাদলদার ব্যবস্থাপনায়, তত্ত্বাবধানে। তার প্রাথমিক পর্বও ক্যামেরাবন্দী হল। আলো পড়ে আসছে, বাদলদার নির্দেশে আমরা নেমে এলাম জয়ন্তীতে, কাজপাগল মানুষটি রয়ে গেলেন বাচ্চাদের সাথে, পুখুরির মাথাতেই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴