শালসিঁড়ি-২৯
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
- রেস্পন্ডিং কন্ট্রোল… নিলয় বলে।
- বনবস্তিতে একটি হাতি মরে পড়ে আছে।
- জিজ্ঞাসা কর দাঁত আছে কি নাই। - বিকাশ উদগ্রীব হয়ে বলে।
- ওয়াকি টকি কলিং কন্ট্রোল…
- রেস্পন্ডিং…
- দাঁত আছে?
- স্টাফ গেছে, ফিরে আসেনি। জানা গেছে দাঁত আছে।
- ওকে ওভার এন্ড আউট।
বন
অফিসের বা বনবস্তির এই এক জ্বালা। মানুষের তৈরি কোন আগাম কাজের শিডিউল সব
সময় ঠিক রাখা যায় না। এক কাজ করতে গেলে আর এক কাজ এসে পড়ে। গাছেরা নিজে
হাঁটে না হাঁটায় কত কী- কীটপতঙ্গ থেকে মানুষ। বুনো-প্রাণী হাঁটে ছোটে
ছোটায় মানুষকে। বনে বা বনসন্নিহিত গ্রামে রাতে চরে বেড়ায় রাতচরারা। দিন
বাড়ার সাথে সাথে রাতচরারা ঢুকে যায় যে যার ডেন-এ। রেখে যায় পায়ের চিহ্ন।
রাতে যে শুধু রাতচরা বুনো-প্রাণী চলে, তা নয়। কিছু মানুষও দিনচরা না হয়ে
রাতচরা হয়। ভোরে বা সকালে বনে গেলে বুনো-প্রাণীর পায়ের ছাপের সাথে
দিনচরাদেরও পায়ের ছাপ পাওয়া যায় বনে বা বনসন্নিহিত গ্রামে। দিন বাড়ার সাথে
সাথে দিনচরাদের পায়ের ছাপের চাপে হারিয়ে যায় রাতচরাদের পায়ের ছাপ। কাবু
বলতো- রাতের অন্ধকারে বনে অপরাধ বেশি হয়। সেই অপরাধ চিহ্নিত করতে হলে ভোরে
বা সকালে বন বা বনের পরিধি চেক করলে বন অপরাধ সনাক্ত করা সহজ হয়।
আপদকালীন
পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে সামলে দেবার জন্য বিকাশের একটা কোর টিম থাকে।
জীবনের সব ক্ষেত্রে এই রকমের কোর টিম খুব কার্যকর হয়। ত্যাগ বা সেবা সবার
থেকে বরফ গলা নদীর মতো বয়ে আসে না। কখনো কখনো খেজুর গাছের মতো বুক চিরে
দিতে হয়। প্রাণিত না হলে অনেকে সেবা কর্মে নিযুক্ত হয়না। সেবা পর্ণমোচী
গাছ না হয়ে চিরহরিৎ গাছের মতো হলে খুব ভালো হয়। সারা বছর পাতা ঝরবে কিন্তু
বোঝা যাবেনা। বিকাশ, নির্মলবাবু, নিলয়, তাপস, বিজয়, রাজেন প্রতিদিন সকালে
উঠে যায়। নিজেদের ফিট রাখে। প্রস্তুত থাকে সকালের প্রথম ধাক্কা সামাল দিতে।
দিনের শুরুর ধাক্কা সামলে তারপর অন্য কাজে মনোনিবেশ করে। কিন্তু তাও সম্ভব
হয় না শালসিঁড়ির দেশে।
হাতির খবরটা পাওয়ার পর থেকে
বিকাশের মন আনচান করতে থাকে। কিছু দিন হল বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া
যাচ্ছে, একটা টাস্কার হান্টার এলাকায় ঘুরছে। রাতে হাতি মুভমেন্ট গাইডিং টিম
ছাড়াও টাস্কার মনিটরিং টিমও করা আছে। তবুও কোন মৃত্যুর বা অপরাধের খবর এলে
এ্যাড্রেনালিন ক্ষরণ বেড়ে যায় বিকাশের। কেন যে খবরটা এত দেরী করে এল।
এতক্ষণে জায়গাটা যে জনঅরণ্য হয়ে গেছে। কোন বিশেষ চিহ্ন পাওয়া যাবে বলে মনে
হয় না। নিলয়কে বলে-
- কনট্রোলকে বল, বুলবুল নাইনকে কল করতে।
- কী বলব স্যার।
- বল। জায়গাটিকে লাল ফিতে দিয়ে ঘিরে রেখেছে কিনা- জিজ্ঞাসা করতে।
- নির্মলবাবু।
- স্যার।
- কালকে যে হাতির দাঁতের টুকরোটা বনে পেয়েছিলাম সেটা কিন্তু নিয়ে নিতে হবে।
- স্যার।
বিকাশের
কোর টিমকে এখন থ্রি-নট থ্রি রাইফেলের বুলেটের মতো ছুটছে। দৃঢ় এবং
সুশৃঙ্খল। লক্ষ্যে অব্যর্থ। গাড়ি বন অফিস ছুঁয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলে
বনবস্তির দিকে। বনবস্তিতে মানুষের মেলা বসে গেছে, মৃত হাতিটিকে ঘিরে। কেউ
কারো কথা মানছেনা। কেউ মরা হাতিকে ফুলের মালা দিচ্ছে, কেউ সিন্দূর লাগিয়ে
দিচ্ছে কপালে। কেউ ধুপ-ধুনো দিচ্ছে পায়ের কাছে। শবদেহ ঘিরে রাখা লাল ফিতা
মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। বিকাশকে দেখে হাতির শবদেহ ছেড়ে দেয় সবাই। চারদিকে
যেন মানুষের সমুদ্র। তার মাঝখানে কোরাকেলে হাতির শব নিয়ে যেন বিকাশরা
ভাসছে। আর টি তে খবর দেওয়া হয় পোস্টমর্টেম টিমকে এবং প্রোটোকল অফিসারকে।
বিকাশ বলে-
- নির্মলবাবু, দাঁতগুলো দেখলেন।
- হ্যাঁ স্যার। দেখুন উপরের দাঁতটা ভাঙ্গা।
- দাঁতের টুকরোটা নিয়ে আসুনতো।
নির্মলবাবু
গতকাল বনে হাঁটার সময় হাতির ট্রেইলে যে দাঁতের টুকরোটা পেয়েছিল সেটা
দাঁতের ভাঙ্গা অংশের সাথে মিলিয়ে দ্যাখে। দাঁতের টুকরোটি খাপে খাপে মিলে
যায়। বিকাশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বলে-
- বেঁচে গেলেন নির্মলবাবু।
- কেন স্যার।
-
দেখুন এই হাতিটি যদি গভীর বনের ভিতরে মরে পড়ে থাকত আমরা তো হাতির শরীরে
পচন শুরু না হওয়া পর্যন্ত কোন খবর পেতাম না। আর তত দিনে যদি কেউ দাঁত কেটে
নিয়ে চলে যেত, কী হল্লাটা হত, বলুন!
- হ্যাঁ স্যার।
অনেকেই বুঝতে চায় না যে গভীর বনের ভিতর দশ ফুট দূরে বন ঝোপঝাড়ের মধ্যে কী
পড়ে আছে সেটা বোঝা যায় না। আমরা বনে যে সকল রাস্তা দিয়ে টহল করি সেই
রাস্তাগুলোর দুটোর মধ্যে দূরত্ব প্রায় দুই আড়াই কিলোমিটার।
-
ঠিক। যাক এই যাত্রায় ভাগ্য দেবী সুপ্রসন্ন ছিলেন। কিন্তু এই হাতিটির সাথে
যে হাতিটি লড়াই করেছিল সেটির কী অবস্থা, সেটাও খুঁজে দেখতে হবে। পাশের
বনঅফিসে খবর দিয়ে দিতে হবে। অপর হাতিটিও দাঁতাল ছিল।
- কী করে বুঝলেন স্যার।
- দাঁতে দাঁতে টক্কর হয়েছিল বলেই তো ভাঙ্গা দাঁতের টুকরো পাওয়া গেছে। তাছাড়া মৃত হাতির শরীরটি ভাল করে দেখুন।
নির্মলবাবু
হাতিটির চারপাশ ঘুরে দেখে। মৃত হাতিটির চার পাশে শুধু মানুষের পায়ের ছাপ।
মানুষের পায়ের ছাপেও এত বিষ যে সব ঘাস মরে সাফ। হাতির চার পাশে তেমন কিছু
বিশেষ চিহ্ন নেই। নির্মলবাবু হাতিটিকে ভালো করে দেখে বিস্ময়ে বলে-
- স্যার, দেখে যান। কেমন পেশাদার খুনির মতো হাতিটিকে দাঁত দিয়ে আঘাত করেছে অন্য হাতিটি।
-
সেটাই তো আপনাদের দেখতে বললাম। বনে বুনো-প্রাণী যে শুধু গায়ের জোরে বেঁচে
থাকে তা ঠিক নয়। ডারউইনের “সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট” তত্ত্ব সঠিক কিন্তু এই
সারভাইভালে শুধু গায়ের জোর থাকে না, থাকে বুদ্ধির প্রয়োগ।
নিলয়
তাপস তখন পানিয়াল ফলের মতো। দুইহাতের তালুতে ডলে ডলে যেমন সুস্বাদু করে
নিতে হয়, তেমনি বিকাশের অভিজ্ঞতায় ওরা অভিজ্ঞ হয়ে উঠতে চায়। বলে-
- সেটা কী স্যার।
-
দেখ বনে বুনোরা মানুষের মতো ষড়যন্ত্র করেনা। ওরা যা করে তাৎক্ষনিক ভাবে
পরিস্থিতি বিচার করে। বনে সংঘাত হয় প্রেমের জন্য বা পেটের জন্য। মানুষের
মতো প্রতিটি বিষয়ে লোভে বা হিংসায় সংঘাতে লিপ্ত হয়না। বুনোরা আসল সংঘাতের
আগে নকল সংঘাত ( Mock fight) করে একে অপরের ক্ষমতা ও বুদ্ধি পরিমাপ করে
নেয়। মোট শক্তির অনুপাত দশ-কুড়ি হলে একজন রণে ভঙ্গ দেয়। কিন্তু উনিশ-কুড়ি
হলে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। নকল লড়াই চলতে থাকে চূড়ান্ত প্রাণনাশক আঘাত
হানার অপেক্ষায়। নকল লড়াই চলতে থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ না একজন অপসারিত হয়।
এই নকল লড়াইয়ে উভয়ে অল্পস্বল্প আঘাত পায়, ক্ষত বিক্ষত হয়, রক্ত ঝরে কিন্তু
কেউ দমেনা।
- সর্বনাশ।
-
দেখ, এই বাঁ পাশে বুকের পাশ দিয়ে কেমন সঠিক ভাবে দাঁত ঢুকিয়ে দিয়েছে। একাটা
আঘাতেই হৃদপিণ্ডকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে। পুরো রক্ত গল গল করে বেরিয়ে
গ্যাছে। বাঁচার আর কোন চান্স ছিলোনা।
- হাতি কেন এই রকম সাংঘাতিক লড়াই করে।
- প্রেম এবং প্রেমের জন্য এলাকা দখল।
- একটু খুলে বলুন স্যার। নির্মলবাবু বলে।
-
নিলয় খবর নাও তো পোস্টমর্টেম টিম ও প্রোটোকল অফিসার কত দূর আছে। আর বুলবুল
নাইনের সব স্টাফ কোথায় গেল। হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম - হাতিরা মাতৃ-তান্ত্রিক
হলেও পুরুষ হাতি বহু-গামী হয়। একটি আদর্শ হাতির দলে তিন চারটি প্রজনন যোগ্য
হস্তিনী থাকে। সেই দলের সাথে মানসিক ভাবে যুক্ত থাকে একটি সবল প্রবল
প্রজনন ক্ষমতা সম্পন্ন পুরুষ হাতি। এই দলে পুরুষ হাতি জন্মালে সেই পুরুষ
হাতি প্রাপ্ত বয়স্ক হবার আগেই দল থেকে বার করে দেয় দল-নেত্রী - ইন ব্রিডিং
এড়াতে। এই বিতাড়িত পুরুষ হাতি বনে বনে ঘুরে শক্তি সঞ্চয় করে, মাঝে মাঝে নকল
লড়াই করে কায়দা কৌশল রপ্ত করে। তারপর চূড়ান্ত লড়াইয়ে নামে; দল দখল, এলাকা
দখলের জন্য। এই লড়াইয়ে কে কখন জেতে বলা যায় না। হয়তো দল থেকে বিতাড়িত কোন
পুরুষ হাতির আত্মা এখনো কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়ায় অরফিয়াসের মতো।
- স্যার, হাতিটি মনে হয় নয় ফুটের ওপর হবে। - নির্মলবাবু বলে।
নয়
ফুটের ওপর উচ্চতা হলে তো হাতিটি বেশ বড়। মনে হয় এই যাত্রায় অরফিয়াস হয়তো
তার ইউরিডাইসকে পেয়েছে। বন থেকে হন্তদন্ত করে বেরিয়ে আসে বুলবুল নাইনের
স্টাফরা। বিকাশ বলে-
- তোমরা কোথা থেকে এলে?
-
স্যার, কালকে আপনি যেখান থেকে ইঞ্জুরড হাতিকে ট্র্যাক করতে বলেছিলেন, আমরা
সেখান থেকে হাতিটির দণ্ডী ট্র্যাক করে করে এখানে এসে পড়লাম। বনের ভিতরে
ওয়াকি-টকি কাজ করছিল না। বনের ধারে এসে আর.টি-তে আপনার কথা ও হাতিটির কথা
জানতে পারলাম।
- কী দেখলে?
-
স্যার, এখান থেকে কিছুটা দূরে বনের ভিতরে গেলে দেখতে পাবেন একটা ফাঁকা
জায়গা। সেই জায়গায় হাতির পায়ের চাপে মাটি পুরোপুরি ধুলো কাদা হয়ে আছে।
মাটির মধ্যে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। তারপর দুটো হাতি এদিকে ছুটে এসেছে। পায়ের
চাপে দেখুন একটা পরিষ্কার দণ্ডী হয়ে গেছে। পুরো দণ্ডীতে মনে হয় কেউ লিটার
লিটার রক্ত ঢেলে দিয়েছে।
- কিন্তু হাতিগুলো এদিকে কেন এল। - নির্মলবাবু বলে।
-
হাতিদের স্মৃতি খুব প্রবল হয়। এই হাতিটি হয়তো শেষ বারের মতো বাঁচার মরিয়া
চেষ্টা করেছিল। হাতিটি জানতো এদিকে বনবস্তি আছে, এখানে এলে হয়তো মানুষের
বিশৃঙ্খল হস্তক্ষেপে এই প্রাণঘাতী লড়াই থেকে রেহাই পাবে।
- হাতিগুলো কি সব সময় এই রকমের প্রাণঘাতী লড়াই করে? - নিলয় জিজ্ঞাসা করে।
-
প্রজনন সক্ষম দুটি পুরুষ হাতির মধ্যে সব সময় এলাকা বা দল দখলের জন্য লড়াই
হতে পারে। কিন্তু দুটি হাতিই মস্তি অবস্থায় থাকলে লড়াই এই রকম ভয়ঙ্কর হয়ে
ওঠে।
- ঠিক, কালকের হাতিটির মস্তি ছিল। - নির্মলবাবু বলে।
-
ঠিক বলেছেন। তাপস, বুলবুল নাইনের স্টাফকে বল কাঠ যোগাড় করতে, পোস্টমর্টেম
করার পর হাতিটিকে পোড়াতে হবে যে। নির্মলবাবু আপনারা সবাই এদিকে আসুন। দেখুন
চোখের পিছনে এই ফুটো দিয়ে রস ঝরছিলো। এটা মস্তির রস। নিলয়, এই রসের গন্ধ
নাও তো। (নিলয় ঝুঁকে মস্তি রসের গন্ধ নেয়) কি কোন গন্ধ আছে?
- স্যার, একটা হালকা ঝাঁঝালো গন্ধ আছে।
- ঠিক। এবার এদিকে পেছনের পায়ের দিকে এসো।
- স্যার হাতির প্রস্রাবের কী ঝাঁঝালো গন্ধ। বাতাস পর্যন্ত গন্ধে ঝাঁঝালো হয়ে গ্যাছে।
- ঠিক, গতকাল বলেছিলাম হাতির মস্তির গন্ধ যেটা আমরা পাই সেটা মস্তি রসের নয়। সেটা মস্তি হাতির প্রস্রাবের গন্ধ।
- মস্তিতে থাকা হাতির জননাঙ্গ বের হয়ে থাকে আর সব সময় ইউরিন টপ টপ করে ঝরতে থকে। - নির্মলবাবু বলে
-
ঠিক দেখেছেন। মস্তিতে থাকা হাতি যে রাস্তায় যায় সেই রাস্তায় ইউরিন পড়তে
পড়তে যায়। সেই গন্ধ মানুষ পায় অন্য বুনোরা পায় অন্য হাতিরাও পায়। এই গন্ধ
মস্তি রসের গন্ধকেও ছাপিয়ে যায়।
- স্যার, বনবস্তির মণ্ডল (সর্দার) আসছে।
মণ্ডল
শব্দটা শুনলেই বিকাশের মনে কেমন একটা ভাবের উদয় হয়। বিদ্যা আর রাইয়ের কথা
মনে পড়ে। বিকাশের মনের এই নরম স্পর্শকাতর ব্যাপারটির জন্য ঠকতে হয়েছে
বনবস্তির অনেক মণ্ডলের কাছে। বিসরাম খেরোয়ার বলে-
- স্যার, এক ট্রাক কাঠ যোগাড় হয়েছে।
- ঠিক আছে আজকের মতো কাজ চলে যাবে। আচ্ছা বলতো, কালকে কি কোন হাতির খবর ছিল।
-
প্রথম রাতে হাতির কোন খবর ছিলনা। গভীর রাতে বনের দিক থেকে হাতির প্রচণ্ড
চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। বুজতে পারছিলাম ঐ চিৎকার মা হাতির বাচ্চা না দেখতে
পেয়ে যে রকম চিৎকার করে সে রকম নয়। আমাদের মনে হয়েছিল হাতিদের লড়াই হচ্ছিল।
সে তো নতুন নয়। মাঝে মধ্যেই আমরা হাতিদের লড়াইয়ের চিৎকার শুনতে পাই।
- তারপর?
-
ভোর বেলায় ওঠে দেখি, বনের পাশে একটি হাতি দাঁড়িয়ে আছে। তারপর হাতিটি আস্তে
আস্তে বনে চলে যায়। তখন এই লম্বা লম্বা বনমারা আগাছার ঝোপের জন্য বোঝা
যায়নি যে একটি হাতি মরে পড়ে আছে। কতদিন হাতির অত্যাচারে বনের ধারের
জমিগুলোতে চাষ আবাদ হয়নি। হাতিগুলো মানুষের ঘরে আক্রমণ করে। বেড়া ভেঙ্গে
ধান চাউল যা পায় নিয়ে যায়।
- হ্যাঁ, সেতো দ্যাখা যাচ্ছে। এবার হাতিটির কাছাকাছি গর্ত খোঁড়ার কাজ শুরু কর। হাতির চিতা সাজাতে হবে তো। - নির্মলবাবু বলে।
- স্যার, একটি হাতি মরে যাবার পরেও কেন অন্য হাতি দাঁড়িয়ে ছিল।
-
আহত হাতিটির তীব্র রক্ত ক্ষরণের পর দুর্বল হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, কিন্তু
প্রাণ সাথে সাথে যায়নি। হাতিটি ব্যথায় ছটফট করছিল। জয়ী হাতি আহত হাতিটির
মৃত্যু সুনিশ্চিত করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। এই লড়াইয়ে ফল একটাই - হয় মৃত্যু
নাহয় জয়। জয় যখন সুনিশ্চিত হয় তখন বিজয়ী হাতিটি বনে চলে যায়। নিলয়, মনে
হচ্ছে প্রোটোকল অফিসার ও পোস্টমর্টেম টিম আসছে।
- হ্যাঁ স্যার।
- গুড আফটার নুন স্যার।
- গুড আফটারনুন।
প্রোটকল
অফিসার মৃত হাতিটি চারদিক ঘুরে দ্যাখে। হাতিটিকে উল্টানো হয়। পোস্টমর্টেম
টিম রেডি হয়। পি এম টিমে দুজন ভেটেরিনারি অফিসার থাকে। হাতির পি এম বলে
কথা। চার পাঁচ জন মিলে হাতিটিকে কেটে নাড়ীভুঁড়ি বের করলে দ্যাখা যায় যে
হৃদপিণ্ড রক্ত শূন্য। সব রক্ত বেরিয়ে গেছে আক্রমণকারী দাঁতালের দাঁতের
আঘাতের ফুটো দিয়ে। হাতিটির দাঁত বেশ বড়। দাঁত দুটি কাটতে গিয়ে হিমশিম খায়
পোস্টমর্টেম টিম। আসলে হাতির এই দাঁতটি দ্বিতীয় কৃন্তকের ( Incisor) এর
পরিবর্তিত রূপ। খুব শক্ত ভাবে আটকে থাকে মাথার খুলির সাথে। কেটে বার করা
খুব শক্ত। কিন্তু কেটে রাখতেই হবে। এই দাঁত শব দেহের সাথে পোড়ানো হয়না।
দাঁত দুটো কাটার পর মাথার পাশে, চোয়ালের দিকটা আর একটু কাটতে বলে বিকাশ।
চোয়াল কেটে ফাঁক করার পর ভিতরের দাঁত দ্যাখা যায়।
- এটা কি মাড়ির দাঁত? নিলয় জিজ্ঞাসা করে।
- হ্যাঁ, এটা মোলার। এই দাঁত দিয়েই হাতি খাদ্য চিবোয়। এই দাঁত না থাকলে হাতি প্রাকৃতিক ভাবে আস্তে আস্তে মারা যায়।
- কেন স্যার?
- না খেতে পেয়ে।
- হাতি তো শুঁড় দিয়ে খায়।
- সে ঠিক কিন্তু মুখে তুলে নেওয়া খাওয়া চিবোতে না পারার জন্য গিলতে পারেনা। নিলয় মাড়ির দাঁতের উপরে হাত দিয়ে দেখ।
- স্যার, দাঁতের অপর যে অনেক খাঁচ।
- হ্যাঁ, এই খাঁচ যত ধারালো থাকবে ঘাস লতা পাতা তত তাড়াতাড়ি পেষা যায়। আবার এই খাঁচ গুনে হাতির বয়স অনুমান করা যায়।
- স্যার, এই রকম একটি দাঁত একবার আমি বনে টহল দেবার সময় পেয়েছিলাম।
- ওখানে কি কোন হাতি মরে পড়েছিল? তাপস জিজ্ঞাসা করে।
- না তো! নির্মলবাবু বলে।
- তাহলে কোথা থেকে এল ঐ দাঁত!
-
আসলে হাতির জীবনে ছয় বার দাঁত ওঠে। হাতির দাঁত আমাদের মতো নিচ থেকে ওপরের
দিকে ওঠে না। ওঠে দাঁতের পিছনের দিকে। তারপর পিছন থেকে ঠেলে সামনের দাঁতকে
ফেলে দেয়।
পোস্টমর্টেম টিম নানা স্যাম্পল নিয়ে নেয়
নানা টেস্ট করার জন্য। বিসরাম খেরোয়াররা চিতা সাজায়, চিতায় হাতির শরীরে
কাটা অংশ তুলে দেয়… সবাই একটা একটা করে কাঠের টুকরো হাতির শরীরের ওপর দিয়ে
ঢেকে দেয় হাতির দেহাংশ। চিতার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। শালসিঁড়ির এক
বিশ্বস্ত সাথী মিশে যায় শালসিঁড়ির সাথে। রেখে যায় শালসিঁড়ির কত কথা কৃন্তক
দাঁতের হিরার মতো কল-কুন্দন (engine turning) নক্সায়। নির্মলবাবু জিজ্ঞাসা
করে-
স্যার আপনি কোন দিন গজমুক্তা দেখেছেন?