চা-ডুবুরী-২৯/সুকান্ত নাহা
চা-ডুবুরি/পর্ব : ২৯
সুকান্ত নাহা
*****************
চিঠি
------
রাত প্রায় ন'টা নাগাদ ফোনটা এসেছিল। তারপর থেকে রাত যত বাড়ে অস্বস্তিকর কৌতূহলটা তাড়া করে সত্যপ্রিয়কে। সকালে ঘুম ভাঙতেই সেটা ফের পিছু নেয়। ছেলেটা বলেছিল সকাল দশটা নাগাদ আসবে। এখন বাজে আটটা। সত্যপ্রিয়র মনটা ছটফট করতে থাকে। কে ছেলেটি ! পূর্ব পরিচিত? আত্মীয়দের মধ্যে কেউ ? কিন্তু সে সম্ভাবনা যে নিতান্তই ক্ষীণ! গত একবছরে এ বাড়িতে সত্যপ্রিয়র খোঁজ নিতে তেমন কেউ আসে নি। ঘনিষ্ঠ দু একজন ছাড়া এখন আর কেউ সত্যপ্রিয়র খোঁজখবর করে না। নিজের পরিচয় গোপন রাখলেও ছেলেটি কিন্তু বেশ আন্তরিকতার সাথেই 'জেঠু' সম্বোধন করে বলেছিল,
-" আমি কিংশুক। আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার বাবাকে আপনি চিনতেন। নামটা এখুনি বলছি না। তবে বাবার একটি চিঠি আপনার হাতে তুলে দিতে চাই। যদি অনুমতি দেন তো কাল সকাল দশটা নাগাদ একবার যেতে চাই আপনার কাছে..."
সত্যপ্রিয় চুপ থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর খুব ধীর কন্ঠস্বরে বলেন, 'ঠিক আছে, এসো। তবে একটা কথা জিজ্ঞেস না করে যে পারছি না, তুমি আমার নম্বর পেলে কোথায়?'
'বাবার ডায়েরিতে আপনার একটি ল্যান্ডলাইন নাম্বার ছিল। ওটা দেখলাম ডেড। তারপর বাবার এক বন্ধুর নাম্বার খুঁজে পাই। যিনি এখন শিলিগুড়িতে থাকেন। তাঁর সাথে শেষদিন পর্যন্ত বাবার যোগাযোগ ছিল। তাঁকে ফোন করেই আপনার নম্বরটা পেয়ে যাই।'
এটুকু বলেই আর কথা বাড়ায়নি ছেলেটি। কথার ফাঁকে শুধু বলেছিল, সে কলকাতায় থাকে। কদিনের জন্য বন্ধুবান্ধব সহ ফ্যামিলি ট্যূরে ডুয়ার্স বেড়াতে এসেছে । কাছাকাছি একটি বনবাংলোয় এসে উঠেছে। ব্যস অতটুকুই। এর বেশি সে আর কিছু বলেনি। বাবার নামটা জিজ্ঞেস করার আগেই ছেলেটি ফোন রেখে দেয়। সত্যপ্রিয়র কেন যেন মনে হয় ইচ্ছে করেই ছেলেটি অমন করল। কৌতূহল জিইয়ে রাখল। কিন্তু কেন ! অনেকের এমন অভ্যেস থাকে তুচ্ছ জিনিসকেও চাপা দিয়ে মানুষের কৌতূহল অযথা বাড়িয়ে তোলে। তবে ছেলেটির একটি কথা সত্যপ্রিয়র কান এড়ায়নি, 'শেষ দিন পর্যন্ত।' তার মানে কি ওর বাবা নেই! কে ওর বাবা! কর্মজীবনে এমন অনেককেই তো সত্যপ্রিয় চিনতেন। নামটা বললে অন্তত এই অস্বস্তিটা থাকত না।
যাক গে, আর তো মাত্র ঘন্টাদুয়েক। তারপরেই তো সে আসবে। তখনই সব জানা হয়ে যাবে। অযথা মনের ওপর চাপ বাড়ানোর দরকারটা কী! সত্যপ্রিয় মনকে সংযত করে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেন না। বরং আরো অনেক চিন্তা মনের ভেতর দ্রুত ডালপালা ছড়িয়ে আকাশ ছুঁতে থাকে। কলকাতায় পরিচিত বলতে তো এক ছোট মেয়ে ও তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন। তারা তো এভাবে পরিচয় গোপন করে নিশ্চয়ই আসবে না! নিজের তরফেরও তেমন কেউ নেই যারা আসতে পারে। নিজের বলতে দাদা বিশ্বপ্রিয় তো কবেই বীরপাড়া হাইওয়ের ওপর রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। তার কিছুদিন বাদেই বৌদি ডুয়ার্স ছেড়ে চলে যায় বারাসাতে ভাইদের কাছে । দাদা মারা যাওয়ার কয়েকমাসের ভেতর জীবন্মৃত মা-ও চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। মায়ের শ্রাদ্ধে দু একজন আত্মীয় পরিজন তবু এসেছিলেন। সেই শেষ। তারপর থেকে আত্মীয়স্বজনদের আর দেখা যায়নি। সবাই দূরে সরে গেছে।
তাহলে আর কে হতে পারে? একের পর এক বুদ্বুদের মত প্রশ্নগুলো ফুলে উঠে ফেটে পড়তে থাকে। পরেশ কিংবা রমেনের ছেলেরা কেউ...? পরেশের তো ছেলে নেই। মেয়ে। বিয়ে হয়ে গেছে। পরেশ নিজেও বহুকাল আগে গত হয়েছে। বীরপাড়া এক্সচেঞ্জ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন পরেশের সাথে যোগাযোগ ছিল। রমেন বাঁকুড়ার ওদিকে কোথাও থাকে বলে জানা ছিল। তবে কি রমেনের ছেলে? কিন্তু শেষ যেবার কথা হয়েছিল রমেন বলেছিল ওর স্ত্রী মারা গেছে। ছেলে-বউয়ের সাথে বনিবনা নেই। আলাদা থাকে। নিজে রান্না করে খায়। তার ছেলে তো আসতেই পারে না। শিলিগুড়িতে পরিতোষ থাকে। দলসিংপাড়া বাগানের মালবাবু পরিতোষ। ইউনিয়নের এক্সিকিউটিভ মেম্বার ছিল। তার কাছে সত্যপ্রিয়র ফোন নম্বর আছে। এছাড়াও কাজলিডাঙার মলয়, অনিল। কাঞ্চনপুরের প্রবীর। এরা থাকে শিলিগুড়িতে। কেউ বাড়ি করেছে, কেউ ফ্ল্যাটে। এদেরই কারও কাছ থেকে হয়তো ছেলেটি সত্যপ্রিয়র ফোন নাম্বার পেয়েছে। এত ব্যগ্র কেন সে আসার জন্য? শুধুই কি দেখতে আসা,নাকি অন্য কোনও কারণ রয়েছে? কী একটা চিঠির কথা বলছিল যেন... বাবার চিঠি...চিঠি কেন? আজকের যুগে কেউ কি চিঠি লেখে! নাঃ ছেলেটা বড় অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে গতরাত থেকে।
ভাবতে ভাবতে অনেকক্ষণ আগে ভুটকুর দিয়ে যাওয়া ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিয়ে রেডিওর নব' টা ঘোরাতে থাকেন সত্যপ্রিয়। ঘোরাতে ঘোরাতে মনের মতো অনুষ্ঠান না পেয়ে বন্ধ করে দেন। দিয়ে ফের অস্থির পায়ে বারান্দায় এসে বসেন। বারান্দার নীচে ফুল বাগানে সাত সকালেই কড়া রোদের অস্তিত্ব অনুভব করেন সত্যপ্রিয়। গ্রীষ্ম এসে গেছে। অদূরে বড় রাস্তাটার দুপাশ দিয়ে সারিবদ্ধ যে প্রাচীন কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, অমলতাসেরা বহুকাল জড়াজড়ি করে বেঁচে ছিল তারা আজ আর নেই। থাকলে এই গ্রীষ্মেও ওরা বুকের পাঁজর ফাটিয়ে ফুলে ফুলে ভরে তুলতো শাখাপ্রশাখা। বারান্দায় বসে গাছগুলোর দিকে তাকালেই মনের ভেতরটাও ছেয়ে যেত ফুলে। ফোর-লেন হাইওয়েটা তৈরির হওয়ার সময় গাছগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। ক্রেন দিয়ে রাতারাতি তুলে সরিয়ে নেয়া হয়েছে গাছেদের মৃতদেহ। কেউ কোনও প্রতিবাদ করেনি। সত্যপ্রিয় কেবল একটি পত্রিকায় ঐ হতভাগ্য গাছগুলোর স্মৃতিতে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। প্রাচীন বনস্পতিদের হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে ওটাই ছিল সত্যপ্রিয়র প্রতিবাদ । শব্দে, অক্ষরে ঝরে পড়া চোখের জল। রাস্তার দু পাশটা এখন শূন্য। খাঁ খাঁ করে। প্রখর রোদে ঝলসে যায় রাস্তার বুক। ছায়াহীন পথ ক্লান্ত করে পথচারীদের। সত্যপ্রিয়কে অবশ্য এসব কিছুই দেখতে হয় না। মসৃণ ছায়ানিবিড় রাস্তাটার শ্রীহীন রূপ না দেখতে পাওয়াটাই যেন তাঁর কাছে স্বস্তির কারণ।
বারান্দায় বসেও শান্তি পান না সত্যপ্রিয়। এলোমেলো চিন্তাগুলো আজ সকাল থেকে পিছু নিয়েছে। এমন এক একটা দিন আসে যেদিন হঠাৎ করে কিছু ফোন এসে সত্যপ্রিয়র মনের স্থির জলে ঢিল ফেলে যায়। বৃত্তাকার ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে থাকে বুকের ভেতর। তখন মনটা বড় উচাটন হয়ে ওঠে। একবার স্মৃতি উতলা হলে কাউকে সেই স্মৃতির অংশভাগী করে তুলতে না পারলে মনটা ছটফট করে। যেমন গত পরশু সুবর্ণ ফোন করে জানায় দার্জিলিং থেকে ফিরে সে পুরো পরিবার নিয়ে চলে এসেছে নীলপাহাড়িতে। ছেলের রেজাল্ট বের হওয়ার আগে কিছুদিন ওরা একসাথে বাগানেই থাকবে। তারপর যাবে কলকাতায়। ছেলেকে ভর্তি করতে। এই ফাঁকে ও উপন্যাসটা শেষ করতে চায়। অনেকটা এগিয়েও থমকে ছিল লেখাটা এতদিন। প্রিয়জন কাছে থাকায় নিশ্চিন্ত হয়ে এবারে কিছুদিন অন্তত লেখার দিকে মনোনিবেশ করতে পারবে। সত্যপ্রিয়র জীবনের আরো কিছু কথা জানতে চেয়ে ও বলেছিল,
-" অনেকটা লেখার পর মনে হল আপনার জীবনের দুঃখের কথাগুলোই বারবার উঠে এসেছে। কত আনন্দের, সুখের মুহুর্তও তো ছিল আপনাদের জীবনে। মাঝে মাঝে কথাপ্রসঙ্গে আপনার মুখে উঠে এসেছে আপনার স্ত্রী মানে কাকিমার কথা। আমি তাঁকে একবারই দেখেছি। যেবার 'মাদল' পত্রিকা প্রকাশের আগে আমরা প্রায় জনা দশেক মানুষ জড়ো হয়েছিলাম আপনার বাড়িতে। কাকিমা যত্ন করে আমাদের দুপুরে খাইয়েছিলেন। সেদিনও অনুভব করেছি এবং তার পরেও যেটুকু আভাস পেয়েছি আপনার কথায় তাতে বুঝেছি তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল আপনার। মনে হয়েছে কাকিমা কোথাও যেন আপনার প্রেরণা ছিলেন। গর্ব ছিল আপনার উনাকে নিয়ে। একদিন তাঁর কথা শুনতে চাই আপনার মুখে।"
এই যে ছোট ছোট কথা, এগুলোই বড় স্মৃতিকাতর করে তোলে সত্যপ্রিয়কে। অনুভূতি জাগিয়ে তুলে ভীষণভাবে আলোড়িত করে অন্তরমহল। কাবেরী - এই তিনটি অক্ষর যে সত্যপ্রিয়র বুকের পাথরে খোদাই করা এক স্পর্শকাতর পরিসরের নাম। সারাদিনে অজস্রবার যে ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ পরিসর থেকে উঠে আসা বকুলগন্ধী বাতাস মনটা উন্মনা করে দিয়ে চলে যায়। তারপর রাত যখন গভীর হয় সত্যপ্রিয় নিঃশব্দে হৃদগহীনে সীমানাঘেরা সেই নিভৃত ছায়াপরিসরে প্রবেশ করেন। যেখানে ঝরে থাকে অজস্র স্মৃতির বকুল, কামিনী, রজনীগন্ধা। সেগুলো দিয়ে সত্যপ্রিয় গেঁথে তোলেন বর্ণময় মালা। মালা গাঁথেন, ছিঁড়ে ফেলেন, ছড়িয়ে দেন বুকের ভেতর। আবার সেগুলো দুহাতে কুড়িয়ে নিতে গিয়ে লক্ষ্য করেন বিস্রস্ত ফুলের ভিড়ে ছড়িয়ে আছে তাঁর নিজেরই হাতে লেখা বেশ কিছু ছেঁড়া তমসুকের পাতা। সেগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে কাবেরীর প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসে মাথা।
সত্যপ্রিয় ভেবে পান না কীভাবে প্রস্তুত করবেন নিজেকে কাবেরীর কথাগুলো বলার জন্য? কোথা থেকে শুরু করবেন। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই যে মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতে অসুস্থ শ্বশুর আর শাশুড়ি ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে পায় নি। তাদের সেবা শুশ্রূষা করতেই যার অনেকগুলো বছর কেটে গেছিল, সেই সদ্যবিবাহিতা মেয়েটির তিতিক্ষার কথা শুধু কি ভাষায় বোঝানো সম্ভব? স্বামী ছাড়া বাড়িতে যে মেয়েটির কথা মনের বলার মতো দ্বিতীয় কেউ ছিল না, কখন কাছের মানুষটা ঘরে ফিরবে অপেক্ষা করে করে যে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়ত, তার যন্ত্রণার কথা কোন শব্দে তিনি ব্যাখ্যা দেবেন? কাজপাগল স্বামী কাজের নেশায় কোনোদিন হয়তো ভুলেই যেতেন স্ত্রীর কথা। স্বামীর নাইট ডিউটি পড়লে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে যে যুবতী মেয়েটি ঘরের একান্তে নিদ্রাহীন পড়ে থাকত জড়োসড়ো হয়ে তার অসহায়তার কথা কোন আখরে তিনি ফুটিয়ে তুলবেন! অথচ এত কিছু সহ্য করেও কোনও অভিযোগ ফুটে উঠতে না কাবেরীর মুখে। শ্বশুর-শাশুড়ি গত হওয়ার পর সেই যে শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরেছিল তারপর থেকে যতটা পেরেছিল সে সত্যপ্রিয়কে সাংসারিক বিষয়ে কোনও ধকল নিতে দেয়নি। বড় ছেলে প্রবালের আকস্মিক মৃত্যুর পর সত্যপ্রিয় যখন দিশেহারা, কাজেকর্মে মন বসছে না কিছুতেই, থেকে থেকে পাগলের মতো হয়ে উঠছেন তখন মায়ের বুকভাঙা হাহাকার আড়াল করে কাবেরী পাশে দাঁড়িয়েছিল স্বামীর। মনে সাহস জুগিয়ে নতুন করে তাঁকে উঠে দাঁড়াতে উচ্চারণ করেছিল মন্ত্রের মতো কয়েকটি মূল্যবান কথা, "কেন তুমি এভাবে ভেঙে পড়ছ? সবকিছু তো শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের আরো তিন সন্তান রয়েছে। তাদের নিয়েই তো এখন আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। তুমি তোমার অফিস, ইউনিয়নের কাজ, সাহিত্যচর্চা এসবে নিজেকে আরো বেশি করে জড়িয়ে ফেলো। কষ্টটা ভুলে থাকতে পারবে। সংসারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। দেখবে ধীরে ধীরে তুমি আবার আগের মতো হয়ে উঠেছ।"
কথাগুলো সেদিন যে কি ভীষণ শক্তি জুগিয়েছিল মনে, ভাবলে আজও সত্যপ্রিয়র গর্ব বোধ হয় । যোগ্য সহধর্মিণীর মতো কথা বলেছিল সেদিন কাবেরী। সেদিনের পর থেকে অফিস, ইউনিয়ন আর বাড়ি। বাড়ি ফিরে সে যত রাতই হোক কিছুক্ষণ বই হাতে না নিলে হত না। এই সময়টাতেই দেশ বিদেশের সাহিত্যে একের পর এক পড়ে ফেলতে শুরু করেন সত্যপ্রিয়। এমনও দিন গেছে নাইট ডিউটি শেষে ভোররাতে বাড়ি ফিরে না ঘুমিয়ে লাইট জ্বেলে বই নিয়ে বসেছেন। কাবেরী এই বাড়াবাড়িটা সহ্য করত না। বলত, " সারারাত ডিউটি করে এসেই বই নিয়ে বসলে! এভাবে করলে শরীরের সাথে সাথে চোখটাও খাবে এবারে।" তখন কথা শোনেননি। এখন মনে হয় কাবেরীর কথাগুলো শুনে চললে হয়তো আজ চোখটা হারাতে হত না।
সপ্তাহে একটা দিন রবিবার, সেই দিনটাও বরাদ্দ ছিল ইউনিয়নের কাজে। সকালে কোনও মতে বাজারটা ফেলে দিয়ে মুখে কিছু গুঁজেই ছুটতে হতো বীরপাড়ার ইউনিয়ন অফিসে। পরবর্তীতে যেতে হত সেন্ট্রাল অফিস চালসায়। সারাদিন মিটিং শেষে কোনও দিন হয়ত সভাপতি বরুণবাবু বললেন, "সত্যদা চলুন তো আজ অমুক চা বাগানে। একজন স্টাফকে ম্যানেজার শো-কজ করেছে। ব্যাপারটা একটু দেখে আসি চলুন।" ব্যস, গাড়ি নিয়ে ছুটতে হত সেই বাগানে। সেখানে একটি কেসের মীমাংসা করতে গিয়ে বসতে হত অন্যান্য স্টাফদের সঙ্গেও। তাদের অভাব অভিযোগ শুনতে হত। সত্যপ্রিয় তখন দলগাঁ সাব-ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি। তাঁর এলাকায় কোনও বাগানের কর্মচারী বিপদে পড়লে কিংবা কর্তৃপক্ষের দ্বারা হেনস্থার শিকার হলে কর্মচারীরা তাঁর কাছেই ছুটে আসত। তাঁকে সুরাহা করতে হতো সেসব সমস্যার। এক এক রোববারে মিটিং সেরে বাড়ি ফিরতে গভীর রাত হতো। কখনও ফ্যাক্টরি ডিউটি সেরেই বেরিয়ে যেতেন ইউনিয়নের কাজে কাউকে কিছু না জানিয়েই। সত্তরের দশক। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির সাথে চা-বাগানেও তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বের রাশ ধরে রাখতে ডান এবং বামপন্থী ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। বামপন্থীরা ধীরে ধীরে প্রতিপত্তি বাড়াচ্ছে ডুয়ার্সের চা-বলয়ে। সেই অস্থির রাজনৈতিক টাগ-অফ-ওয়ারের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চা কর্মচারীদের একমাত্র বৃহৎ অরাজনৈতিক সংঘটনকে দলীয় রাজনীতির আঁচ থেকে বাঁচিয়ে কাজ করাটাই ছিল দুস্কর। সভাপতি বরুন দত্ত আর সম্পাদক শ্যামলেন্দু দাসের মতো শক্ত মেরুদন্ডের মানুষ না থাকলে সংঘঠনটাই হয়ত ভেঙে যেত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পরোক্ষে কত না চাপ সৃষ্টি করেছে চা-শিল্পে সর্ববৃহৎ কর্মচারীদের এই সংঘঠনটিকে ভাঙতে। পেছন থেকে মালিকরাও মদত যুগিয়ে গেছে। আঘাতও এসেছে। কিন্তু কেউ পারেনি। আজও সেই সংঘঠন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও কানে আসে কর্মচারীদের স্বার্থে সংগঠনের লড়ে যাওয়ার কথা। শুনে মনটা ভরে যায় আনন্দে।
সে সময় রোজই প্রায় কোনও না কোনও বাগান থেকে অশান্তির খবর আসত। কর্তৃপক্ষের সাথে কর্মচারীদের নানান বিরোধের লেগেই থাকতো। যে কারণে ইউনিয়ন নেতাদের সক্রিয় থাকতেই হত। বীরপাড়ার ইউনিয়ন অফিসে বসেই চিঠিপত্র লিখে টাইপ করে সেগুলো পরদিন সংশ্লিষ্ট চা বাগানে পৌঁছে দেওয়া এসব কাজ সত্যপ্রিয়কেই করতে হতো। এহেন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ডুবে থাকা, সাংসারিক বিষয়ে উদাসীনতা সব মেনে নিয়েছিল কাবেরী। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, কার কী লাগবে সব জোগাড় করে দেওয়া থেকে শুরু করে মায় দরকার পড়লে বাজারে গিয়ে জিনিসপত্র কেনাকাটাও করতে হত কাবেরীকে। কে জানে হয়ত এসবের মধ্যে সে নিজেও হয়ত ভুলে থাকত সন্তান হারানোর দুঃখ।
সাংসারিক বিষয়ে উদাসীনতার কথা মনে পড়তেই সেই রবিবার টার কথা মনে পড়ে যায় সত্যপ্রিয়র। ইউনিয়নের মুখপত্র সবুজকন্ঠ' সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব তখন সত্যপ্রিয়র কাঁধে। আত্মপ্রকাশের বছরটায় সাদামাঠা হলেও পরের বছর থেকে মুখপত্রটির নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চা বিষয়ক মূল্যবান প্রবন্ধ, তথ্যপূর্ণ লেখায় ভরে উঠতে থাকে সবুজকন্ঠ'র পাতা। শিলিগুড়ি থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় রিভিউ বের হয় সবুজকন্ঠ'র। উচ্চ প্রশংসিত হয় পত্রিকাটি। প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে নিঃশেষ হয়ে যেত সবুজকন্ঠ'র প্রতিটি কপি। পত্রিকাটিকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে তোলার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করতেন তখন সত্যপ্রিয়। লেখা সংগ্রহের জন্য বিশিষ্ট মানুষজনের কাছে গিয়ে দেখা করা, লেখা যোগাড় করা, প্রেসে লেখা জমা দেওয়া, প্রচ্ছদ সংগ্রহ করা, প্রূফ দেখা সব কাজ একাই করতে হত তাঁকে। এক আধবার কাবেরীও হাত লাগিয়েছে প্রূফ দেখায়। শুধু সবুজকন্ঠ'ই নয়, এরপর চা-বাগানের সাহিত্য পত্রিকা ' মাদল' কাঞ্চনপুরের দুর্গাপুজোয় টানা দশ বছর একাদিক্রমে প্রকাশিত শারদ-পত্রিকা 'আলোর ভুবন' প্রকাশের সময়েও নানান জায়গায় ছোটাছুটি করতে হতো সত্যপ্রিয়কে। এরকমই সময় এক রবিবার বাজারে গেছেন সত্যপ্রিয়। বাস স্ট্যান্ডে দেখা হলো পরিচিত একজনের সাথে। ভদ্রলোক সাহিত্যানুরাগী। কথায় কথায় জানালেন তিনি একজন প্রাবন্ধিককে চেনেন যাঁর কাছে গেলে চা-বিষয়ক তথ্যপূর্ণ ভাল লেখা পেতে পারেন সত্যপ্রিয়। প্রাবন্ধিক ভদ্রলোক জলপাইগুড়ি শহরে থাকেন। একটু বাদেই যে বাস আসছে তাতে চাইলে সত্যপ্রিয়ও যেতে পারেন তার সাথে। গেলে তিনি পরিচয় করিয়ে দেবেন সেই ভদ্রলোকের সাথে। সেসময় সবুজকন্ঠ'র জন্য ভাল লেখা সংগ্রহের জন্য যেখানে খুশি যেতে রাজি ছিলেন সত্যপ্রিয়। শ্যামলেন্দুবাবু তাঁর ওপরেই স্যুভেনিরের সব দায়িত্ব দিয়ে বলেছিলেন, "টাকা কিংবা অন্যান্য সাহায্যের জন্য ভাববেন না সত্যবাবু,আপনি শুধু দেখবেন পত্রিকার মান যাতে খারাপ না হয়।"
এক মুহুর্ত ভাবেননি সত্যপ্রিয়। রাজি হয়ে গেলেন যেতে। ওদিকে বাড়িতে খবর দেওয়ারও সময় নেই। বাস এসে পড়েছে। তড়িঘড়ি এক পরিচিত দোকানির কাছে ব্যাগ, বাজারের লিস্টি সব জমা রেখে বলে গেলেন বাড়ি পৌঁছে দিতে। বলেই সেই ভদ্রলোকের সাথে উঠে বসলেন বাসে। বিকেলে যখন হাসিমুখে বাড়ি ফিরে এলেন লেখা পাওয়ার সম্মতি আদায় করে, কাবেরীর চোখ মুখে তখন নীরব অভিমানী মেঘ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। সেই মেঘ কখনও জল ঝরাত না, ভেজাতো না বৃষ্টিতে, বিদ্যুৎ ঝলক ঝলসে উঠত না মেঘের ফাঁকে। কালো মেঘ শুধু জমা হয়ে বেশ কিছুক্ষণ ছেয়ে থাকতো আকাশ। তারপর কখন যে নীরবে মেঘগুলো বাতাসের পিঠে ভর করে মিলিয়েও যেত দিগন্তের সীমানা পেরিয়ে সত্যপ্রিয় কখনো টেরও পেতেন না।
-" বাবু একটা লোক আপনাকে ডাকতেসে।" ভুটকুর কথায় তন্দ্রা কেটে যায় সত্যপ্রিয়র। বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে চোখ লেগে এসেছিল বলে ঘরে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়েছিলেন সত্যপ্রিয়।
-" বসতে বল্, আমি আসছি। "
বলে একটু বাদে ধীরপায়ে লাঠি ভর করে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দু পায়ে কারোর স্পর্শ অনুভব করেন সত্যপ্রিয়। বাইরের আলোয় চোখ দুটো কুঁচকে আবছা দৃষ্টির ভেতর দিয়ে সত্যপ্রিয় একটি অবয়বকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। মাঝারি উচ্চতার একটি মানুষ। বয়সটা সঠিক ঠাহর করে উঠতে না পারলেও যুবক বলেই মনে হয়।
-"কে?" স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটা বেরিয়ে আসে সত্যপ্রিয়র মুখ থেকে।
- "আপনি আগে বসুন জেঠু। তারপর সব বলছি।" বলে ছেলেটি হাতটা ধরে সত্যপ্রিয়কে বসতে সাহায্য করে।
-" ঠিক আছে... ঠিক আছে...আমি পারব। তুমি বোসো।" সত্যপ্রিয় সন্তর্পণে বেতের চেয়ারটায় বসতে বসতে বলেন।
-"তোমার নাম তো সেদিন বললে, কিংশুক। তাই তো?" সত্যপ্রিয় বলেন।
-"আজ্ঞে হ্যাঁ। "
-" কিন্তু তুমি তো ভাই আমাকে খুব চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে। ভেঙে কিছুই বলো নি। আমি তো ভেবেই চলেছি তখন থেকে... "
-" সরি জেঠু, আপনাকে ফোনে সব কথা বলিনি। পরিতোষকাকুর কাছে শুনলাম আপনি অসুস্থ। তাই আপনি কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন ভেবে বাবার নামটাও ইচ্ছে করেই বলিনি। চিঠিটা দিতে তো আসতেই হত। ভাবলাম এসেই না হয় সব বলব। "
-"কে তোমার বাবা?" সত্যপ্রিয় এবারে সরাসরি জানতে চান।
-" আজ্ঞে, বিমান সাহা। শীতলপুর চা বাগানের স্টোর কিপার ছিলেন।"
নামটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান সত্যপ্রিয়। স্মৃতির সেলুলয়েডে আজও পরিস্কার সেই ঘটনাটা চকিতে প্রোজেক্টরের আলোয় যেন সচল হয়ে ওঠে। জনা ছয়-সাতেক সদস্য যারা সংগঠনের দীর্ঘদিনের সদস্য হঠাৎ বিনা প্ররোচনায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল সেদিন। বিমান সাহা ছিল তাদের অন্যতম। বেশ কিছুদিন যাবৎ একটি বিষয় নিয়ে মিটিংএ আলোচনা চলাকালীন তারা কয়েকজন উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত ভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। সংগঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সম্মতির বিরুদ্ধে গিয়ে বারবার সোচ্চার হয়ে উঠছিল তারা। বরুণবাবু খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল তাদের উস্কিয়ে সংগঠন ভাঙতে চাইছে। বিমানদের দাবি অযৌক্তিক এবং তা মানা সম্ভব নয় বলে মিটিং-এ যখন বিবৃতি দিচ্ছেন বরুণবাবু দলবল নিয়ে ঢুকে কলার ধরে তাঁকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনে বিমান। বাধা দিতে গেলে বিমানের দলের ছেলেদের হাতে নিগৃহীত হন শ্যামলেন্দু দাস, অম্বরিষ, সুধাময়বাবু এবং আরো অনেকে। কলার ধরে টেনে বারান্দায় এনে বরুণবাবুর মুখে প্রচন্ড একটি ঘুঁষি মারে বিমান। বারান্দা থেকে ছিটকে পড়ে যান বরুণবাবু। বাধা দিতে এগিয়ে এলে সত্যপ্রিয়কে আঙুল তুলে শাসিয়েছিল বিমান। এখনও প্রতিটা কথা মনে আছে সত্যপ্রিয়র, "দালালি করবেন না বুঝেছেন...অনেক মালিকের দালালি করেছেন আপনারা...সরে যান...নাহলে আপনার গায়েও হাত উঠে যাবে বলে দিলাম।"
সেদিন সবাই মিলে না আটকালে বরুণবাবুকে আরও নিগৃহীত হতে হত। বিমানরা চলে গেলে থানায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল অনেকেই। বরুণবাবু যাননি থানায়। বলেছিলেন, "ওরা ভুল বুঝেছে। অন্যের কথায় চলছে ওরা। যেদিন ভুল ভাঙবে আমাদের কাছে ওদের ফিরে আসতেই হবে।"
বছরও ঘোরেনি। এক রবিবারের সকালে কাজলিডাঙার কোয়ার্টারে সত্যপ্রিয়র সাথে দেখা করতে এসেছিলেন একজন মাঝবয়সি ভদ্রমহিলা। তার স্বামীকে নাকি অন্যায়ভাবে সাসপেন্ড করেছে ম্যানেজার। একবার সত্যপ্রিয় যদি বিষয়টি নিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেন খুব উপকার হয়। চাকরি চলে গেলে চার ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় যাবেন বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সেই ভদ্রমহিলা। স্বামীর নাম জানতে চাইলে তিনি যার কথা বললেন শুনে আক্ষরিক অর্থে হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন সত্যপ্রিয়। তাঁকে চুপ থাকতে দেখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ভদ্রমহিলা বলেন, " উনি আসতে লজ্জা পাচ্ছেন। তাই আমাকে পাঠালেন।"
-" উনি তো আর আমাদের ইউনিয়নে নেই যতদূর জানি। যে ইউনিয়নে আছেন তারা কিছু করছে না কেন?" সত্যপ্রিয় জানতে চান।
ভদ্রমহিলা এবারে পায়ে পড়ে যান, "ওরা কিছু করছে না দাদা। বলছে ও নাকি চুরি করেছে। চোরের পাশে ওরা নেই। ওর বিশ্বাস এক আপনিই আছেন যে ওকে বাঁচাতে পারেন। দয়া করেন দাদা। কিছু একটা... "
"আহা, ঠিক আছে, আমি দেখব। আপনি উঠুন।" সত্যপ্রিয় আস্বস্ত করলে ভদ্রমহিলা নিশ্চিন্ত হয়ে উঠে বাড়ি চলে যান। পরদিন সত্যপ্রিয় শীতলপুরে গিয়ে বিমানের মুখে আদ্যোপান্ত সব শোনেন । ফ্যাক্টরির ইঞ্জিন চালানোর জন্য যে লাইট ডিজেল অয়েলের ট্যাংকার আসত সেই ট্যাংকারের তেল মেজারিং-রড দিয়ে মেপে তেল খালি করত বিমান। ম্যানেজারের কাছে খবর যায় তেলের মাপে দীর্ঘদিন ধরে হেরফের হচ্ছে। আর এটা করছে মালবাবু বিমান সাহা। ম্যানেজার ওৎ পেতে থাকেন সুযোগের। সেদিন তেল খালি করার পর চালান সই করিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিতেই, গাড়িটা যখন ফ্যাক্টরি কম্পাউন্ড ঘুরে গেটে আসে, গাড়ি আটকে দেন ম্যানেজার। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে ফের মেপে দেখেন ট্যাংক পুরোপুরি খালি হয়নি। প্রায় চার ইঞ্চির ওপর তেল রয়ে গেছে ভেতরে। অন-দ্য-স্পট সাসপেন্ড করেন তিনি বিমানকে। তারপর থেকে দিনসাতেক নিজেদের ইউনিয়নে গিয়ে হালে পানি না পেয়ে সত্যপ্রিয়র শরণাপন্ন হয় বিমান।
সব শুনে বরুণবাবুকে ঘটনাটা জানালে তিনি সত্যপ্রিয়কে কেসটা নিয়ে এগোতে বলেন। আর এও বলে দেন যে, যে করেই হোক বিমানের চাকরিটা বাঁচাতেই হবে। রাতে বাড়িতে বসে অনেক ভেবে আটঘাট বেঁধে সুসংহত ইংরেজিতে একটা চিঠি লিখলেন সত্যপ্রিয়। পরদিন বিমানকে নিয়ে শীতলপুর ম্যানেজারের চেম্বারে ঢুকে সেই চিঠি তার হাতে তুলে দেন। চিঠিতে লেখা ছিল যে বিমানের বাবা মরণাপন্ন অসুস্থ। যে কারণে মানসিকভাবে সে বিপর্যস্ত। আর সেজন্যই তেলের মাপ নিতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃত ভুলটি সে করে ফেলেছে। এ যাত্রায় পরিবারের কথা ভেবে বিমানকে যেন ক্ষমা করা হয়। আগামী দিনে এমন ভুল আর সে করবে না। চিঠিটা পড়ে ম্যানেজার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিমানকে বাইরে যেতে বলেন। তারপর সত্যপ্রিয়কে বলেন যে, তাঁকে তিনি চেনেন এবং সেজন্যই তাঁর অনুরোধে পুনরায় বিমানকে চাকরিতে রাখা হচ্ছে বটে, কিন্তু আগামী তিনবছর বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির টাকা বিমান পাবে না। এবং আবার যদি সে এমন ভুল করে তাকে তৎক্ষণাৎ চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। সেদিন সত্যপ্রিয়র চেষ্টায় চাকরি রক্ষা পায় বিমানের। কিন্তু পরবর্তীতে সত্যপ্রিয়র কানে এসেছিল তিনবছরের স্যালারি-ইনক্রিমেন্ট বন্ধ হওয়াটা নাকি বিমানের মনঃপূত হয়নি। চাকরি ফিরে পেয়ে অবশ্য ইউনিয়নে ফিরে আসা দূরে থাক কৃতজ্ঞতাটুকুও জানাতে আসেনি। তারপর কাজলিডাঙা ছেড়ে কাঞ্চনপুর চলে আসার পর আর কখনো দেখাও হয়নি বিমানের সাথে সত্যপ্রিয়র।
-" এই নিন জেঠু, বাবার চিঠি। বাবা মারা যাওয়ার সময় এটি দিয়ে আমাকে বলেছিলেন আমি যেন এটা না পড়ি। আপনার হাতে যেন তুলে দিই। এটা ধরুন।" কিংশুক চিঠি টা এগিয়ে দেয়।
-"কিন্তু এই চিঠি যে বাবা তোমাকেই পড়ে শোনাতে হবে। আমি তো চোখে দেখি না। আজ তোমার বাবা নেই। আমি বলছি, তুমি পড়ে শোনাও।" সত্যপ্রিয় বলেন।
কিংশুক খামের মুখটা ছিঁড়ে পড়তে থাকে।
"শ্রদ্ধেয় সত্যদা,
প্রনাম নেবেন। যখন এই চিঠি পাবেন তখন আমি এই পৃথিবীতে থাকব না। এই চিঠি আমার প্রায়শ্চিত্তের চিঠি বলতে পারেন। একদিন এই আমি আপনাকে অপমান করেছিলাম আর উল্টে আপনিই আমার চাকরি বাঁচিয়েছিলেন। যে হাতে বরুণদার গায়ে হাত তুলেছিলাম সেই হাত আমার একটির দুর্ঘটনায় কাটা পড়ে। অনেক পাপ করেছি আমি এ জীবনে। আপনি আমার চাকরি বাঁচান, কিন্তু সেই চাকরি বেশিদিন আমি করতে পারিনি। স্বভাব বড় খারাপ জিনিস সত্যদা। সেই খারাপ স্বভাব আমি বদলাতে পারিনি। দুবছর বাদে আবার একটি চুরির ঘটনায় জড়িয়ে আমার চাকরি যায়। ম্যানেজার আমাকে বরখাস্ত করার আগেই আমি রেজিগনেশান দিয়ে তাকে অনুরোধ করি তিনি যেন আমাকে বরখাস্ত না করেন। চাকরি ছেড়ে চলে আসি কলকাতায়। শ্বশুরবাড়ির সাহায্যে নানাভাবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। কোনভাবেই সফল হতে পারিনি। দুর্ঘটনার পর জীবনের শেষ দিনগুলো বড় কষ্টে কেটেছে। ছেলেটা মেধাবী ছিল। কষ্ট করে পড়াশোনা করে নিজের চেষ্টায় চাকরি পেয়েছে, এটাই আমার শান্তি।
পরিতোষের সাথে যোগাযোগ ছিল। তার কাছেই আপনার খবরাখবর পেতাম। আপনি দেবতুল্য। আপনার সামনে দাঁড়ানোর মুখ আমার ছিল না। অনেক অন্যায় করেছি। পারলে আমায় ক্ষমা করে দেবেন।
ইতি
বিমান।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴