পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ২৮
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
একঝোপা ছিটিপিন
"বাড়িত আচিস মাই?"
বাসন মাজতে মাজতে গলাটা উঁচু করে উত্তর দেয় বসমতী,
"আছোং বারে। কায় ডেকান ওত্তি বইসো কোনেক। ভারালা মাঞ্জি নিগাং।"
বাসনগুলো মেজে এনে দেখে মালতীর মা বসে।
"সাকালে কি খাইলেন তে?"
বসমতী গলায় একটা প্রচ্ছন্ন আনন্দের সঙ্গে তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলে,
"ওই তো সাকালে উঠি মাছ মারির গেইসে ছাওয়ায় পোওয়ায়। আনিল কয়টা পুঁটি মাছ।
তাকে বলে কাঠখোলা খায়। এইলা ভেজাল দি। আলু কাঠখোলা কল্লুং, মাছ কাঠখোলা
কল্লুং, মরুচ কাঠখোলা কল্লুং, মাখিলুং - এইলা ঝামেলায় সার।"
কান্তেশ্বর এত ফিরিস্তি শুনে পান চিবোতে চিবোতে বলে,
"খালি হামারে জইন্যে ঝামেলায় সার করিল, উয়ায় তো খাইলেক কে না।"
"কি দিয়া খাইলেন, চুড়া?" মালতীর মা বিতর্ক এড়ানোর চেষ্টা করে। বসমতী ছাড়বে কেন? সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁজিয়ে ওঠে,
"না খাইম কেনে? করিমকে তে খাইম না?"
তারপর মালতীর মার দিকে তাকিয়ে বলে,
"কেনে আসিলু তে দি?"
"আসিলুঙ এখেনা দোরকারোত। তে তোমরা দোনটা মানষি যে ঝোগড়া করেছেন!"
বসমতী মালতীর মার কথায় হাসে। বলে,
"হামার এইলা ঝোগড়ার কাথা থো ওত্তি। প্যাটখেনা ভরিল তে ওই তো মুকখান দিয়া এলা আও বেরাছে।"
মালতীর মা বসমতীকে সমর্থন করে।
"হয় কে না তে। ব্যাটেছাওয়া মানষি বাড়িত নইলে আও। ইচির বিচিত আও
বেকরাবে। তোর দাদা আরো ঘুমটি ঘুমটি আও বেকরাবে, নাই কাথা পুছিবে। মোর
একোসোমায়তে এখেরে তাও উঠে।"
কান্তেশ্বর এসব কথা শুনে গামছাটা ঘাড়ে ফেলে বাইরের উঠোনের দিকে যেতে যেতে বলে,
"অ্যায় মুই চল্লুঙ। দেখিরে ঝুনি না পাছেন তে পাছোত এলায় চান্দে বেড়ান।"
বসমতী ফুট কাটে,
"যাছোং, একটা ঢোল গালাত বান্দিম এলায়, হাটে হাটে বাজাইম আর চান্দাইম। কোটে গেল ফেন্নাটা বারে। আনো কনেক বাড়ি ঘুরিয়া।"
কান্তেশ্বর
কোনোদিনই ঝগড়ায় জিততে পারে না। হাসতে হাসতে বেরিয়ে ডারিয়া ঘরটায় গিয়ে
বাঁশের চাংরাটায় বসে। ওখানে বসে থাকলেই দুই-একটা মানুষের নাগাল হয়।
কথা-বার্তায় ছুটির দিনটা ভালোয় কাটে। মাঝে একবার গরু-ছাগলগুলো দেখে আসতে
হবে। বসমতী এক ঝলক বাইরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"কেনে আসিলু তে দি?"
"আসিলুং, তোরেঠে। একখান ভাল কাপড়া আছে তে দে তো। ফাকাই মড়াটা একটা ঘরের আল্লাপ আনিসে তে আজি বলে আইসে।"
বসমতী অবাক হয়। তাও জিজ্ঞেস করে,
"কায় কায় আসিবে? চেংরাও আসিবে?"
মালতীর মা আস্তে করে বলে,
"চেংরা না আসিবে বলে। চেংরার বাপ, পিসা আর মামা না কায় আসিবে বলে। ইমার
পছন্দ হলে সেলা চেংরা আসিবে উয়ার বন্দু টন্দুক ধরি। আলদা করি। এলা না
ওইলায় চল। আগোত তো বাপ পছন্দ করিসে তে কতা দিয়ায় গেইসে। এলকার চেংরা! নিজে
না দেখিলে না করে বিয়াও।"
"হুটা না হয়। তে একদি ওইটায় ভাল। নিজে দেকি যাবে, পরে আর কবার না পাবে যে ভোর মনতে খায় নাই। কেমন কইনা আইনচেন।"
বসমতী উত্তর দেয়। তারপর বলে,
"তে মাইকে আনির পালু হয়! উয়ার এলা কুখান পছন্দ হয় না হয়!"
মালতীর মা বলে,
"এঃ, দেক একখান। তোর না মেলায় তোলা কাপড়া আছে। হবে। একখান হইলে হইল।"
তারপর থেমে বলে,
"ওই তো হাঞ্জি হাঞ্জি করলুং, তাও না আইসে! উয়াক বলে সরম নাগেছে!"
"কাক সরম নাগে। নাকটা কাটি ফেলের কও।"
একা একা ডারিয়া ঘরটায় বসে থাকতে আর মন চাইল না, কান্তেশ্বর মাঝপথে এসে যোগ দিল। বসমতী মৃদুস্বরে বলে,
'মোক আর হাটে হাটে ঢোল বাজের না নাগিল, তাতে আসি পড়িল।"
মালতীর মা মুচকি হাসে একটু। তারপর বলে,
"হামারে মাইক। ওই তো উয়ার কাকিট্টে কাপড়ার বাদে আসির কছং তে না আইসে। সরম নাগে।"
বসমতী বলে,
"পড়ার বাড়ি যাবে যে হোটে সেলা নয়া মানষিলাক সরম নানাগিবে? হামাকে সরম নাগেছে!"
মাঝপথে এসে কান্তেশ্বর প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না। বলে,
"কায় আরো পড়ার বাড়ি যাবে তে ভজি?"
মালতীর মা গলায় জোর এনে বলে,
"কায় আরো! হামারে মাই? আজি না আইসেছে একটা ঘর। দেখির আসিবে দেখি শুনিয়ায় কান্দি পাগিলি হইসে। এলাং তো মানষিলা আইসে নাই!"
কান্তেশ্বর আকাশ থেকে পড়ে। বলে,
"মাইক এলাইতে বিয়াও দিবেন?"
মালতীর মা একটু বিমর্ষ হয়। মনটা খারাপ করে। তারপর নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
"এলাইতে আরো কোটে বারে। আর বচ্ছরে না জামা উড়ি হইসে। বড়ই না হইল
অনেকটায়। চেংরি ছাওয়া বাড়িত ন'লে খরচ। যত পুষিবু ততয় খালি পাইসাখান। ত্যাল
রে, ছাবন রে, ছেনো-পাউডার নাগে। চুরি-চারা, আলতা, নোকপালিশ। নানান জাকাতির
জিনিস!"
তারপর একটু দম নেয়। ভেতরের কষ্টটাকে গিলে খেতেই যেন একটু থামে। তারপর আবার বলে,
"দিলে না ফুরায় বারে। খাবার প্যাটও একটা কমে। আর অ্যায় যে জোড়ায়
জোড়ায় জামা-প্যান -হামরা অত কোটে পাই? হামার বলে কাজ না কইল্লে ভাত নাই।
কাজো তো সেমতন সোমায়টাত মিলে না। সেলা প্যাট শুকিয়া নই।"
কান্তেশ্বর মায়ের অসহায় দুঃখটা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলে,
"তে মাই হামার ভাত-শাক আন্দির পায়? একদিন পেটাইস তো, আন্দি খোয়াবে।
উয়ার কাকি ওইলা কী যে আন্দে মোজায় না হয় শাক-পিতার। মাইর হাতের আন্দোন খাইম
একদিন।"
মালতীর মা হাসে। বলে,
"আন্দে না, ভাল শাক আন্দির না পায় এলাও, মাছ, মসং আন্রদির নাই দেং
এলাং। শিকিবে আস্তে ধীরে। ছেকা, পেল্কা, আইন্না-ওইন্না সবে আন্দির পায়।
সেদিন আরো উয়ার পিসা আইচ্ছে তে ডিমা ভাজিসে আর আলুর ডাইল আন্দিসে তে খিবে
বলে ভাল হইসে। উয়ার পিসা এখেরে সামানে বাখনাছে। নিগাবে বলে কুনদিন। উয়ার
পিসাই যাবার কইসে।"
বসমতী বলে,
"মাড় ছেকির পায়?"
"পায় তে একেবারে উবুরি দিবার না পায়। ভয় করে। মুই কং নানাগে মাও
আস্তে আস্তে শিকুক। তে ঝাক্কুয়া মানষির ভাত আন্দির না পায় এলাং।"
কান্তেশ্বর মাথা নাড়ে। তারপর বলে,
"তে কেমন। চেংরার বাড়ি-ঘর, কায় কায় আছে।"
মালতীর মা একটা নিঃশ্বাস ফেলে, তারপর বলে,
"এলাইতে হোটে কি পুছিবু। তে আছে বলে মাটি-কুটি কনেক। বাড়ির ভিটার বনখান
ধরি আড়াই বিঘা বোদায় কইল। তে হামার থাকি না আবস্তা ভালে। আর বাউটা দুই
ভাই। অ্যায় ইমরায় বলে বড়। আর বাপ-মাও। বইনি নাই। বাপ-মাও বলে গাবুরে আছে,
নাই হয় বেশি বয়স। আর বাড়ি-ঘরের কাথা কি পুছিবু বাউ। হামার যেমতন উয়ার থাকি
এখেনা ভাল বলে। চাইরটা ঘর আছে। থাকির ঘর দুইটা। একটাত গরু-ছাগল থয় আর একটাত
আন্দন। পাক-শাক। এইলায়।"
কান্তেশ্বর বুঝতে পারে খবর
ভালোই নিয়েছে আসলে। কথার মাঝখানে বসমতী তিনখানা তাঁতের শাড়ি হাতে করে বের
হয়। মালতীর মা কমলা রঙেরটা বেছে নেয়। বলে,
"এইখানে নিগাং। হামার মাই কনেক ফোস্যা আছে। কমলা অংটা বেইশ নাগিবে।"
"চা কায় করি দিবে দি? উয়ার কাকি?"
বসমতীর কথার উত্তরে মালতীর মা মুখ মোচড়ায়। গলাটা একটু তুলে বিরক্তি মিশিয়ে বলে,
"করিবে এলায়! যে হাত ফুল ফুল পাও ফুল ফুল মানষি উয়ায়! উয়ায় এলায়
মানষিক পশ্যিবে। মোর কাকিশাশুড়ি না কয়কে 'বউ বসে মোর ভালে আওসান হইল। কিসের
বউ আসিলে হাত আজারি হবে তে মোকে সবঠে নাগে।"
তারপর গলাটা স্বাভাবিক মাত্রায় এনে বলে,
"শুকারুর বউক আসির কসুং। উয়ায় এলায় মাইক কনেক সাজে-পারেও দিবার পাবে।
কুচি করি মুই আরো কাপড়ায় পিন্দির নাপাং মাই। হামরা অংকরি কোটে পিন্দিসি!
এলাকার কইনাগিলা পিন্দে। কুচি করে আর পেলেট না পালাট কয় করি আরো ছিটিপিন
নাগে। কালি না আইনসে উয়ার বাপ হাট থাকি একঝোপা ছিটিপিন।"
ওঠার
আগে কয়েকটা ভালো কাপ প্লেট নিয়ে লোকগুলো এলে একটু কান্তেশ্বরকে যাওয়ার
অনুরোধ জানিয়ে তবে ওঠে। তারপর যেতে যেতে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
"দেখিলে কি আর হবে। এইটায় পত্থম, শুরু। আরো কত আসিবে, যাবে। খালি চা-পানি, গুয়া পানের ডারডারি উঠিবে। ওইদগা খরচ।"
কান্তেশ্বরের
মনটাও খারাপ হয়। এই তো সেদিনও মেয়েটা চিৎকার করে গান গেয়ে গম ক্ষেতে পাখি
তাড়াত। দু-তিনজন মিলে ঘুরে ঘুরে নাচ করত হাত ধরাধরি করে। নিজেরাই গান করত
'আয় রে অলি কুসুম তুলি বাবুর বাগানে........'। সে মেয়েটা এখন দিনের পর দিন
আড়ষ্ট হয়ে পাত্রপক্ষের সামনে বসবে বিয়ের জন্য। কতবার সাজতে হবে, কতবার কত
পাত্রপক্ষের মূখে শুনতে হবে, 'গার অংটা আর কনেক ফোস্যা নাগিল হয়, নাকটা এত
চেপ্টা, মোটা বায় ছাওয়াটা কনেক, ভাল করি আওয়ে না কাড়ে, চুলে নাই, খোঁপাটা
আর এখেনা মোটা না হলে চলে! হামার ঝাক্কুয়া মানষি বাহে, একিনা ন্যাকপেকা
ছাওয়া হামার চলিবে না। ভাল করি ভক্তিয়ে না দিল বারে, কনেক শিকিও দ্যান নাই।
তারপর আছে দাঁতের বিচার, হাসির বিচার। পায়ের আঙুলের বিচার, হাঁটার বিচার।
সব পেরোতে পারলেও হয়ত গিয়ে ঠেকবে শেষে দেনা-পাওনায়।
........................................................
ঘুমটি ঘুমটি - খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
ফেন্না - নামের প্রতিক শব্দ। কারো নাম মুখে আনা না গেলে এইসব শব্দ ব্যবহৃত হয়।
হাঞ্জি হাঞ্জি - খুব নাছোড়বান্দা অনুরোধ
নানান জাকাতি - নানা ধরণের।
জামা উড়ি - শৈশব থেকে কিশোরীতে উত্তরণ
আওসান - আসান
হাত আজারি - হাত ফাঁকা অর্থে বিশ্রাম।
ডারডারি উঠিবে - নষ্ট হবে বা অতিরিক্ত ব্যয় বোঝায়।
ওইদগা খরচ - অতিরিক্ত বা ফালতু খরচ।