চা-ডুবুরী-২৮/সুকান্ত নাহা
চা-ডুবুরি/পর্ব : ২৮
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^
ছুটির বাঁশি
*************
সুগন্ধি কাপড়ে জড়ানো সত্যপ্রিয়র বেশ কিছু সুখস্মৃতি রয়েছে। আনন্দের, সাফল্যের এবং প্রাপ্তিরও। কিন্তু মানুষের জীবনে আকাশলীনা সুখের ইমারতগুলো ছোট ছোট দুঃখকুয়াশায় বারবার ঢাকা পড়ে যায়। সত্যপ্রিয়র জীবনের সুখস্মৃতিগুলোও তেমনই। বিষাদবাক্সের ভেতর দুঃখবোধের নিচে দিনের পর দিন দমচাপা হয়ে পড়ে থাকতে থাকতে যেন মরে যাচ্ছিল । ধুলো ঝেড়ে সেসব ফিরে দেখার ইচ্ছেটাই ফুরিয়ে গেছে তাঁর। তবু যদি কেউ কখনও সুখস্মৃতি উস্কে দেয়, মুনিয়া পাখির মতো ছোট ছোট সুখপাখিগুলো বেরিয়ে আসে। উড়ে এসে বসে পড়ে বুকের দাঁড়ে। দোল খায় কিচিরমিচির শব্দে। কিছুক্ষণের জন্য ভুলিয়ে দেয় জীবনের অনন্ত শূন্যতা।
বিকেল নাগাদ সুবর্ণর ফোনটা এসেছিল। ছেলের পরীক্ষার পর স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে দার্জিলিং গেছে । সঙ্গে বাবাকেও নিয়ে গেছে। সুধাময়বাবু নাকি দার্জিলিং গিয়ে খুব খুশি। সত্যপ্রিয়র মনে হয় বাবার খুশি যেন ছেলের ভেতরেও সঞ্চারিত হয়েছে। সুবর্ণর গলার স্বরের উচ্ছাসটুকুই সেটা বলে দেয়,
" ....রিস্ক নিয়ে চলে এলাম কাকাবাবু । ভয় পাচ্ছিলাম বাবা অসুস্থ না হয়ে পড়েন। কিন্তু এখানে এসে তো দেখছি উল্টোটা। বাবা দারুণ মুডে আছেন! ম্যাল ছেড়ে উঠতেই চাইছেন না। আর অদ্ভুত একটা ব্যাপার, হঠাৎ করে মেমরিটাও যেন ফিরে পেয়েছেন ! আগে যদিও একবারই দার্জিলিং এসেছেন। তবু দু'চারটে নাম এখনও দেখছি মনে আছে। লাডেন লা রোড, চৌরাস্তা, কেভেন্টারস, পদ্মজা নাইডু পার্ক এমনকি আজকে হঠাৎ দুম করে একটা রাস্তা দেখিয়ে বলেন কিনা, 'এই যে দেখো... এইখানে... ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবিবাবু পাইপ টানতে টানতে ডায়লগ বলেছিলেন, 'আমি তো অবাক! পাহাড়ের জলহাওয়া কি ম্যাজিক করেছে বাবার ওপর...!"
সত্যপ্রিয় শুনে যেন বেশ আনন্দ অনুভব করেন-" তাই তো দেখছি ! আসলে কি জানো ঘরে থাকতে থাকতে অনেক সময় এমনিতেই স্মৃতিতে ধুলো জমে যায়। বাইরে বের হলে মনের সাথে মস্তিষ্কটাও সতেজ হয়ে ওঠে। বেশ ভাল খবর। তবে ঠান্ডা কেমন দার্জিলিংয়ে? "
-" দিনে তেমন নেই। বাইরে একটা হাফ সোয়েটার হলেই চলে যায়। রাতের দিকে শুধু কম্বল গায়ে দিতে হয়। "
সুবর্ণর কথাগুলো শুনে অনেক কথাই মনে পড়ছিল সত্যপ্রিয়র। সালটা উনিশশো আটান্ন উনষাট হবে। তখনও বিয়ে হয়নি। কাজলিডাঙা ফ্যাক্টরিতে চাকরি পাওয়ার পরের বছরেই ফেব্রুয়ারি মাসে বন্ধুরা মিলে একবার দার্জিলিং যাওয়া হয়েছিল। বড় আনন্দ হয়েছিল সেবার। তখন ফেব্রুয়ারি মার্চেও দার্জিলিংএ বেশ ঠান্ডা থাকত। চা বাগানে বার্ষিক ছুটি নেওয়ায় মাসটাই তো হল ফেব্রুয়ারি। তবে এখন বাবুরা কেউ কেউ ফেব্রুয়ারিতে ছুটি না গিয়ে সেটা জমিয়ে রাখে। বছরে অন্যসময় প্রয়োজনমতো ছুটি নেয়। নিয়ে তারা ট্যূরে যায়। দিল্লি,জয়পুর,হিমাচল,দক্ষিণভারত। নিদেন কাছেপিঠে সিকিম, দীঘা, মন্দারমণি, শঙ্করপুর। এখন বাবুদের কিছুটা হলেও বেতন বেড়েছে। ভ্রমণের ভাতা বেড়েছে। সবচাইতে বড় কথা বাবুদের সকলেরই এখন একমুঠো পরিবার। দায়দায়িত্ব কম। তারা আগাম হোটেল বুক করে, দুমাস আগে ট্রেনের টিকিট কাটে। তারপর পুরোদস্তুর পরিকল্পনা করে ঘর ছেড়ে বের হয়। ভ্রমণে গিয়ে তারা ছবি তোলে। ফেসবুকে ছবি দেয়। সবকিছু বদলে যাচ্ছে।
তবে সেসময়ের ছবিটাই ছিল অন্যরকম। সত্যপ্রিয়র মনে পড়ে বসন্ত সমাগমে চা-বাগানের মানুষ নিয়ম করে তখন 'সাল-ছুটি'তে যেতই। সেই চিত্রটি ছিল বড় বিচিত্র। সাল-ছুটি ছিল চা -বাগানের মানুষের কাছে যেন বহু প্রতিক্ষার পর পাওয়া একপশলা বৃষ্টির মতো। প্রকৃতি যদিও আজও তার নিয়মটুকু বদলায়নি। শেষবসন্তে নতুন পাতা আসার ঠিক প্রাকমুহুর্তে আজও চা গাছগুলো শীতঘুমের চাদরটুকু গায়ে টেনে নিয়ে শেষবারের মতো তলানি ঘুমটুকু সেরে নেয়। বাৎসরিক ঝাড়পোঁছ, জরুরি মেরামতপর্ব শেষে তেল-মবিল-চর্বি চর্চিত কারখানার কলকব্জা গুলো প্রস্তুত হয়ে বসে থাকে পাতার অপেক্ষায়। এই সময়টাতেই শ্রমিক, কর্মচারী থেকে শুরু করে ম্যানেজাররাও পাতা-মরশুম-এর যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মনের কলকব্জায় তেল দিয়ে ঝরঝরে হতে একঘেয়ে জীবনের ঘেরাটোপ কেটে বেরিয়ে পড়ে বহির্জগতের টানে।
একসময় ইউরোপীয়ান সাহেবরা এই বসন্ত সমাগমেই 'লিভ'এ যেতেন তাদের হোমল্যান্ডে। প্রতিবছর অবশ্য তারা যেতে পারতেন না। কেননা জাহাজে চেপে যেতে আসতেই তাদের মাসকাবার হয়ে যেত। বাবুরা অ্যানুয়াল-লিভে যেতেন ফিনফিনে ধূতি পাঞ্জাবি, পাম-শ্যু অথবা ট্রাউজারের ওপর হাওয়াই সার্টে সুসজ্জিত হয়ে। ঘোমটা টানা স্ত্রীকে বগলদাবা করে তারা যেতেন জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, কুচবিহার, আলিপুর, রায়গঞ্জ, বড় জোর কোলকাতা, নদীয়া কিংবা কৃষ্ণনগর। যারা তখন ''প্রথমটি এখনই নয়, তিনটির পর কক্ষনো নয়" মার্কা সরকারি লাল ত্রিকোণের সতর্কবাণী অনুসরণ করেছিলেন তারা বছর বারোর পুঁটি, সাতের বুড়ি আর কোলের খোকনকে সঙ্গে নিয়ে সস্ত্রীক বেরিয়ে পড়তেন। সঙ্গে তাদের থাকত চামড়ার জাবদা স্যুটকেশ এবং অনিবার্য হোল্ডল। তার সাথে ল্যাংবোট মার্কা কর্তার প্যান্ট কেটে বানানো কাপড়ের ঢাউস একখান্ বাজারের ব্যাগ। তাতে থাকতো গাছের কলাটা, মুলোটা, কচুটা এবং অবধারিতভাবে কয়েক পোঁটলা স্বজনতুষ্ট-চা-পাতা। যা পেলে আত্মীয় স্বজনদের খুশির অবধি থাকত না। যারা এক দাগ প্রাচীন অর্থাৎ হারাধন গোত্রের বাবু, তারা অধিকাংশই 'পতির পূণ্যে সতীর পুণ্য' এই আপ্তবাক্য জপে গিন্নির জিম্মায় ফুটবল টিম জমা রেখে চট করে ঝোলা কাঁধে একাই তিন তিনেকের জন্য একবার কামাক্ষ্যাটা সেরে আসতেন। খরচ আর হ্যাপা দুটোই বেঁচে যেত। আর যাদের তখনও কাঁটাতারের ওপারে হ্যাচকা টানে ছিঁড়ে আনা চোদ্দো আনা শেকড়ের দু' আনা অবশিষ্ট ছিল, ছিল ভাগ্যে শরিকী ভাগের শিকে ছিঁড়ে কিঞ্চিৎ প্রাপ্তির বিন্দুমাত্র আশা, সেই সকল ফিকিরি জ্যাঠামশায়, কাকাবাবুরা পাসপোর্ট ভিসা করে এই সাল-ছুটিতেই পেতে রেখে আসা ইঁটের বাৎসরিক নবীকরণটা সেরে নিতেন।
রোজ হাজিরার শ্রমিকদের অবশ্য সারাবছর কোনও ছুটি নেই। বছরভর প্রাণপাত খেটে এই সময়টাতেই ওরা দশ বারো দিনের সবেতন যে "সাল ছুটি" টা পায় সেটা ওদের হকের অর্জন। সেই ক'টা ছুটি ট্যাঁকে গুঁজে ওরা সপরিবার মাথায় "মোঠরি-ঝোলা", কোলেকাঁখে ছৌয়ামন (বাচ্চা)দের লেপ্টে নিয়ে "মৈমান"(অতিথি) যায়। কাছেপিঠে চা বাগানে তাদের জাইত-গুতিয়া (জ্ঞাতিগুষ্টি) দের কাছে। ডুয়ার্সে সেসময় গাড়ির সংখ্যা ছিল কম। গুটিকয়েক হাতেগোনা বাস, হাটবাস যেগুলো হাটবার ছাড়া অন্যদিন লাইনে চলতো, মানুষের ভীড়ে সেসবে ওঠাই ছিল দায়। বাসের মাথায়, পা-দানিতে, পেছনের সিঁড়িতে ঝুলে-ঝুলে মানুষ 'মৈমান' যেত। পূব থেকে পশ্চিম ডুয়ার্স। শহরমুখো তারা বড় একটা হতো না। পূবের যাত্রী যারা তারা কালচিনি, হাসিমারা,বীরপাড়া মাদারিহাট স্টপেজ নেমেই আটিয়াবাড়ি, সাতালি, বিচ, দলমোর, তাশাটি, দলগাঁ,দলসিংপাড়া, ভার্ণাবাড়ি, ধওলা, কোহিনুর এমনতর নানান দিশায় পা বাড়াতো। আর যারা পশ্চিমে নাগরাকাটা, মেটেলি, চালসা, মাল, ওদলাবাড়ি হয়ে বাগ্রাকোট স্টপেজে নামার যাত্রী তাদের গন্তব্য হয়তো জিতি, কুর্তি, নয়াসাইলি, হিলা, কিংবা ওধারে মেটেলি, কিলকোট, চালৌনি,জুরন্তি হয়ে রাণিচেরা ডামডিম,এলেনবাড়ি, লিসরিভার, এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য গন্তব্যে।
সাল-ছুটির ভীড়বাসে সফর করা তখন ছিল এক দর্শনীয় চিত্তির। এখনও কদাচিৎ চোখে পড়ে। তবে সত্যপ্রিয় বহুবার জলপাইগুড়ি, কিংবা শিলিগুড়ি আসা যাওয়ার পথে সাল-ছুটির 'বাস-রঙ্গ'র সাক্ষী থেকেছেন। যাত্রী নামবে। গাড়ি থেমেছে। গাড়ি আগাপাস্তলা বাদুড়ঝোলা। রাঙামাটি বাগানের সমধিঘরে (কুটুমবাড়ি) দিনকয়েক জবরদস্ত খাতিরদারি পেয়ে গ্রাসমোড় বাগানের বুধু ওরাওঁ ও তার সহধর্মিনী রতিও দুজনেই হাঁড়িয়ার মৌতাতে রঙিন হয়ে 'ছৌয়াপুতা', মোঠরি-ঝোলা সমেত ঘরে ফিরছিল। গেটকিপার আগে থেকেই নামার যাত্রীদের উদ্দেশ্যে তাড়া মারছিল গেটের কাছে আসতে। কিন্তু ভীড় উজিয়ে টলোমলো পায়ে বুধু ও তার পরিবার কিছুতেই এগোতে পারছিল না। বুধু এগোয় তো রতিও বসে পড়ে। রতিও ওঠে তো পাশের যাত্রীর গায়ে গড়িয়ে পড়ে বুধু। ধোপদূরস্ত যাত্রীরা বিরক্ত। হাঁড়িয়ার ঝাঁঝালো গন্ধে তিতিবিরক্ত যাত্রীরা কন্ডাকটরের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে থাকে এমন মাতাল যাত্রী গাড়িতে তোলার জন্য। সহৃদয় দু একজন বুধুকে টেনে তুলে এগোনোর রাস্তা করে দিলেও বুধু অ্যান্ড কোং দু পা এগোতে গেলে এক পা পেছোতে হয়, এই নীতিতে এগোচ্ছে। ওদিকে গেটের কাছাকাছি যারা ছিল তারা ততক্ষণে নেমে পড়েছে। গেটকিপার দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে শেষে দু আঙুল মুখে পুরে সিটি মেরে তুমুল বিরক্তিতে থাপ্পড় কষিয়ে দিল বাসের গায়ে। ওটাই সিগন্যাল। ড্রাইভার সাহেবও সিগন্যাল শুনে তৎক্ষণাৎ ক্যারক্যার করে গাড়ি গিয়ারে ফেলে দিল। গাড়ি এগোতে শুরু করে দিল ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে। ব্যস, আর যায় কোথায়। গাড়ি নড়েচড়ে উঠতেই ভেতর থেকে বেখাপ্পা-গলার-গেঞ্জি'তে আটকে যাওয়া হুমদো-মাথার মত বুধু পরিত্রাহী চিৎকার শুরু করে দেয়, " হামিন উতরবু, হামিন উতরবু...এ ডাইবর গাড়ি রুক... গাড়ি রুক... গাড়ি রুক...এ ডাইবর।" কেউ হয়ত তখন গেটকিপার স্টাইলে বাসের ছাদে সবেগে চাঁটি কষিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে "পসিঞ্জর হ্যায়... উতরেগা..পসিঞ্জর.. গাড়ি রোকো... গাড়ি রোকো" হল্লা শুনে দাঁত কিড়মিড় করে ড্রাইভার ব্রেক কষলো অনেকটা এগিয়ে গিয়ে। ততক্ষণে এর পায়ের বুড়ো আঙুল মাড়িয়ে, তাকে কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে বহু কসরৎ সেরে বুধু তার পরিবার সমেত অবশেষে ল্যান্ড করলো মাটিতে। কন্ডাক্টরও পেছন পেছন তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। নেমেই মাথাগুনে হাত বাড়ায়- "ভাড়া নিকাল্"
-"দে-লো জুন ভাড়া" ( দিয়েছি তো ভাড়া) রতিও টলতে টলতে বলে।
-"দুঠো বাচ্চাকা ভাড়া কৌন দেগা? জলদি নিকাল্, দেরি হো রহা হ্যায়।"- কন্ডাক্টর তাড়া মারে।
-" বাচ্চাকর ভি ভাড়া লাগি কি কা! " বাচ্চাদের ও ভাড়া লাগবে? বুধু ধনুকের মত বেঁকতে বেঁকতে হঠাৎ মেরুদন্ড সোজা করে।
-" হাঁ, লাগি। তিন সালকা উপর ভাড়া লাগি। দু বাচ্চা কা দুই-দুই চার রপিয়া, নিকাল্। "
-" মোকে বুরবাক সোইছিস কি কা? আগে মোকে তোর রেট-কাগজ দিখা । দিখা মোকে। ফির মোয় ভাড়া দেবু। " ভিজিলেন্স ইনসপেক্টরের মতো কোমরে হাত রেখে দুলতে দুলতে হাতের তেলো ছড়িয়ে রেট চার্ট দেখতে চায় বুধু। কন্ডাক্টরের চোয়াল ঝুলে পড়ে। হাসবে না কাঁদবে বুঝে পায় না।
-" হামিনকে হিনে লাইনকে ছোইড় দেলে । ইখন উতনা দূর জায়েক লে ভাড়া কে হর দেওয়ি।" (আমাদের এতদূর এনে নামালে। এখন অদ্দূর পর্যন্ত যাওয়ার ভাড়া কে দেবে)। রতিও পেছন থেকে বাচ্চা দুটোকে আগলে তাল ঠোকে।
বউয়ের সাপোর্ট পেয়ে ধনুকের টানটান ছিলার মতো এবারে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় বুধু,
-"চল্ গাড়ি বেক্ কর। বাগান ইস্টপিজ তক হামিনকে লেইকে ছোড়। ফিন ভাড়া মিলি। '' তুড়ি মেরে রীতিমতো কমান্ডিং টোনে গাড়ি ব্যাক করার কথা বলে বুধু। শর্ত দেয় গাড়ি ঘুরিয়ে বাগানের স্টপেজ পর্যন্ত নিয়ে গেলে তবেই ভাড়া দেবে। বিষ-নেই-বুধু'র কুলোপানা চক্কর দেখে হকচকিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে কন্ডাক্টর। ওদিকে দেরি দেখে যাত্রীরা ক্রমশই উত্তেজিত হতে থাকে। গাড়ি ছাড়তে বলে। ড্রাইভার সিটে বসেই কন্ডাক্টরের উদ্দেশ্যে চেঁচাতে শুরু করে দেয়। শেষমেশ বাধ্য হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে বুধুর দিকে দু চারটে যুৎসই গালাগাল ছুঁড়ে দিয়েই গাড়িতে উঠে পড়ে কন্ডাক্টর। গাড়ি সচল হয়। ক্ষেপে উঠে বুধু তেড়ে এগোতে গিয়ে পড়ে যায় ধূলোয়। সিঁড়িতে ঝোলা বাদুড়গুলো তখন পেছন ফিরে দাঁত কেলিয়ে হাসে। গায়ের ধুলো ছেড়ে চটপট উঠে পড়তে চায় বুধু। উঠতে গিয়ে শরীরটা ফের সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয়। বাদুড়দের বিদ্রূপাত্মক চিৎকার আর হাসির প্রত্যুত্তরে বুধু মাথা তুলে অমলিন হাসে। নাল গড়িয়ে পড়ে ঠোঁট বেয়ে। টলতে টলতে হাত নেড়ে বিদায় জানায় ওদের। কোনও পতন, কণামাত্র ধূলো কিছুই যেন স্পর্শ করেনা বুধুকে। কুটুমবাড়িতে কদিন ছুটি কাটিয়ে ঘরে ফেরার আনন্দে পথের যাবতীয় প্রতিকূলতা যেন হাসিমুখে উড়িয়ে দেয় চলে যাওয়া বাসের উগড়ে দেয়া বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার সাথে।
এই দৃশ্যগুলো এখন তেমন আর দেখা যায় না। ডুয়ার্স অঞ্চলে গাড়ি ঘোড়া বেড়েছে। সাটল ট্যাক্সির মত অজস্র ছোট ছোট অটো, টোটো, ম্যাজিক গাড়ি, ভ্যান চলাচল করছে। বাস হয়েছে প্রচুর। হয়েছে ট্রেণ পরিষেবা। এখন আর এই বাস-রঙ্গও তেমন দেখা যায় না। চাকরিরত অবস্থায় চালসার ইউনিয়ন অফিস থেকে ফেরার পথে দেখা এই দৃশ্য এখনও মনে পড়লে বেশ কৌতুক অনুভব করেন সত্যপ্রিয়। এই সহজ সরল মানুষ গুলোর সাথেই কেটেছে তাঁর দীর্ঘ চাকরিজীবন। আজ তাদের সাহচর্যের অভাবটুকু অনুভব করেন প্রতিনিয়ত।
অথচএই সহজ মানুষ গুলোই যখন প্রতারিত হয়, রুখে দাঁড়ায় একজোট হয়ে। অত্যাচারিকে শাস্তি দিতে হিংস্র হয়ে ওঠে। বীর বীরসা মুন্ডা থেকে আজকের শহীদ রাজেশ ওরাওঁ তার উদাহরণ।বাস-রঙ্গের কথা মনে পড়তেই সত্যপ্রিয়র মনে পড়ে যায় এমনই একটি ভয়ংকর ঘটনার কথা। একসময় এই সাল-ছুটিতে আসাম ও ডুয়ার্স থেকে প্রচুর আদিবাসী শ্রমিক শেকড়ের টানে ছুটে যেত তাদের পুর্বপুরুষের 'হোম-ল্যান্ড' রাঁচি, ছোটনাগপুর অঞ্চলে। একসময় যা ছিল বিহার রাজ্যের অন্তর্গত। ছুটিতে 'দেশের-বাড়ি' যাওয়ার ভীড় দেখে চালু হয় আসাম থেকে রাঁচি পর্যন্ত বাস পরিষেবা। সেবার কিছু শ্রমিক বানারহাট অঞ্চল থেকে গাড়িতে ওঠে। বাসের ভেতরে ভীড় থাকায় তারা উঠে পড়ে ছাদে। বাস যখন বাংলা সীমান্ত পেরিয়ে বিহারে ঢুকছে তখন রাস্তার ওপর ঝুঁকে থাকা একটি গাছের ডালে মাথায় আঘাত পায় একজন শ্রমিক। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলা হয়। সে গাড়ি থামায় না। হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলা হলে বাসের ড্রাইভার কন্ডাক্টর কোনও কথা কানে তোলে না। কিছুটা দূর গিয়ে শ্রমিকটি মারা গেলে বাসটি এমন এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে থামানো হয় যেখানে বাস কর্মচারীদের নিজেদের এলাকা। মৃতের সঙ্গী সাথিদের আবেদন নিবেদন অগ্রাহ্য করে মৃতদেহ ছুঁড়ে নদীতে ফেলে দিয়ে বাস এগিয়ে চলে। এমনকি বাসের কর্মচারীরা শ্রমিকদের শাসায় যে বিষয়টি জানাজানি হলে ফল ভাল হবে না। এমন একটি অমানবিক ঘটনা সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দেয় অসহায় শ্রমিকদের। তারা নীরবে নেমে যায় তাদের গন্তব্যে।
কিন্তু ঘটনা এখানেই থেমে থাকে না। শ্রমিকরা বাগানে ফিরে আসে। এসে তারা জোট বাঁধতে থাকে। তারা খোঁজ নিতে থাকে তলে তলে কবে সেই বাসটি আবার আসামের দিকে যাবে। একদিন তারা খবর পায় বাসটি আসামের দিকে আসছে। তারা দলবেঁধে অপেক্ষা করে ডুয়ার্সের বানারহাট থানার মোরাঘাট এলাকায় হাইওয়ের ধারে একটি নির্জন জায়গায়। গাড়িটি সেখানে পৌঁছনোর সাথে সাথে তারা গাড়িটি আটকায়। ড্রাইভার, খালাসি, ক্লিনার তিনজনকেই বাস থেকে নামিয়ে মেরে প্রায় আধমরা করে হাইওয়ে ধরে টানতে টানতে অনেকটা দূর পর্যন্ত নিয়ে এসে ফেলে রেখে দেয় রাস্তার ওপর। আহত অবস্থায় তাদের হাসপাতালে আনা হলে তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়। সহজ, সরল আদিবাসী শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার সীমা ছাড়ালে তারা যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে এই ঘটনা যেন তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যায়।
বুধু ওরাওঁ-দের মতো সহজ সরল মাটির মানুষগুলোর সংখ্যা কমে আসছে। শিক্ষা ও প্রযুক্তির আলোয় মানুষের চেতনা বেড়েছে। সহবৎ শিখে আধুনিক হয়ে উঠছে ধিরে ধিরে চা বাগানের শ্রমজীবী মানুষজন। শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত হয়ে ক্রমশ এই মানুষ গুলো সমাজের সবস্তরের মানুষের কিছুটা হলেও সম্মান অর্জন করে নিচ্ছে। এটাই আশা যোগায়। সত্যপ্রিয় স্বপ্ন দেখেন হয়ত একদিন চা বাগানের এই মানুষ গুলোর ভেতর থেকে উঠে আসবে কৃতী কেউ। যারা গর্বিত করে তুলবে তাদের সমাজকে।
পাতার ভরা মরশুম ফুরিয়ে আসে শেষ শরতে। এদিকে পুজোর ছুটির চারদিন আর ওদিকে দেওয়ালি ছুটি দিন তিনেকের। মরশুমে এই দুটিই হল বড় ছুটি চা বাগিচায়। ছুটির ভেতর পাতাগুলো নিঃসাড়ে বাড়ে। বাগান খুলতেই যেন খুলে যায় বাঁধের মুখ। হু-হু করে পাতার ঢল নামে। প্ল্যানটার্সরা যেটাকে বলে থাকেন পুজা-ফ্লাস। এই পুজা-ফ্লাস এর আয়ু অনেকটা ফ্ল্যাশ বাল্বের মত। দু-চারদিনেই শেষ। তারপর পাতা কমতে কমতে ডিসেম্বর আসতে আসতে শেষ। ডিসেম্বর পড়তেই সত্যপ্রিয় বুঝতেন বাড়ির সকলের মন উচাটন। ফ্যাক্টরির কলকব্জা খুলে মেরামতির কাজ ফুরোতেই মেয়েরা নেচে উঠতো কোথাও যাবে। একবার মালবাবুর পরিবারের সাথে মিলে ঠিক হল পুরী যাওয়া হবে।
সাল-ছুটিতে দুই পরিবার মিলে বেডিং বিছানা, স্যুটকেস বাঁধাছাদা করে চেপে বসা হয়েছিল ট্রেনে। যদিও ওসব তল্পিতল্পা বাঁধাছাদা, কী কী সঙ্গে যাবে না যাবে সেসব নিয়ে কোনও মাথাব্যাথাই ছিল না সত্যপ্রিয়র। কাবেরী নিজেই ওসব সামলে নিয়েছিল দুই মেয়েকে নিয়ে। এমনিতেই সাংসারিক বিষয়ে সত্যপ্রিয় ছিলেন চিরকাল উদাসীন। চাকরি, নিজের পড়াশোনা, ইউনিয়নের কাজ, সাহিত্য কর্ম এসবই ছিল তাঁর জগত। সংসারের সব দায়িত্ব ছিল কাবেরীর ওপর। অভ্র তখন কলেজে পড়ে। তার যাওয়া হয়নি। দিনটা এখনও বেশ মনে পড়ে সত্যপ্রিয়র। ট্রেনে চেপে যাওয়া হচ্ছে কলকাতায়। সেখান থেকে জগন্নাথ এক্সপ্রেসে চেপে যেতে হবে পুরী। যাওয়া আসার টিকিট সব মালবাবুই করে নিয়েছিলেন আগেভাগেই। এ ব্যাপারেও সত্যপ্রিয়কে কিছু চিন্তাই করতে হয় নি। এমনকি পুরীতে গিয়ে প্রথমে যে ভারত সেবাশ্রমে ওঠা হবে তারও সব ব্যবস্থা তিনি করে রেখেছিলেন।
সত্যপ্রিয়র মনে পড়ে ট্রেন চলছে, তিনি জানলার ধারে বসে একমনে পড়তে পড়তে চলেছেন প্রবোধকুমার স্যান্যালের 'মহাপ্রস্থানের পথে' বইটি। পাশেই তাঁর ও মালবাবুর পরিবার মেতে উঠেছে গল্পগজবে, হাসি-ঠাট্টায়। ফাঁকে ফাঁকে কাবেরী ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে। কখনও এক আধটা পান। সেই ফাঁকে সত্যপ্রিয়ও যোগ দিচ্ছেন তাদের আড্ডায়। তারপর ফের ডুবে যাচ্ছেন বইয়ের পাতায়। সমুদ্রপথ যাত্রী হয়েও লেখার টানে মনটা বারবার চলে যাচ্ছিল কেদারনাথ-বদ্রিনাথের পথে। দুর্গম গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে তীর্থযাত্রীদের পিছু পিছু পদব্রজে। পুরী পৌঁছনোর আগেই বইটি শেষ করে ফেলেছিলেন সত্যপ্রিয়।
ভোর হতে না হতেই পুরী স্টেশন। প্ল্যাটফর্মে নামতেই পান্ডাদের ছেঁকে ধরা। সেসব থেকে আগলে তাদের আশ্রমে নিয়ে গেলেন মালবাবুর পরিচিত পান্ডা। মালবাবু আগেও দুবার এসেছিলেন পুরীতে। তাই তার পরিচিতি বেশি। সেবাশ্রমে একদিন থাকার পর সেই পরিচিত পান্ডাই স্বর্গ দ্বারের কাছে একটি বাড়ি ভাড়া ঠিক করে দেয়। রান্নার সরঞ্জাম স্টোভ তেল সব মজুত। শুধু সেসবের ভাড়া দিলেই চলবে। দৈনিক বাড়ি ভাড়া আট টাকা।
রোজ সকালে মালবাবু বাজার করে আনেন। কাবেরী আর তার স্ত্রী মিলে রান্না করেন। মেয়েরা সেই ফাঁকে কাছাকাছি ঘুরে আসে। আর বাড়ির ছাদে বসে সমুদ্রের দিকে মুখ করে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকেন সত্যপ্রিয়। চা দিতে এসে কাবেরী বলে "বাড়িতে সুযোগ পেলেই তো বইয়ে ডুবে থাকো, বেড়াতে এসেও বই ছাড়বে না!"
সত্যপ্রিয় হেসে বলেছিলেন, "বেড়াতে যখন বেরোবো তখন তো সঙ্গে বই থাকবে না, বউ থাকবে। এখন এই অবসর টুকু নাহয় বইকেই দিই।"
- " তুমি দিব্যি বসে আছ, আর ওদিকে মালবাবু বাজার ঘাট করে আনছেন, জল তুলছেন। চক্ষু লজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, না কি?" কাবেরী মৃদু অনুযোগ করে।
-" সে, ও কিছু মনে করবে না। আমাকে বলেই এনেছে, আপনাকে কিছু করতে হবে না দাদা। আপনি শুধু সঙ্গে যাবেন। তাতেই আমাদের আনন্দ। দেখলে না আমাকে কিছু করতেই দিল না। ছেলেটা কর্মক্ষেত্রেও ভীষণ দক্ষ। "
-" তা বললে কি আর হয়, একটু তদারকিও তো করতে পার।"
-"সে তুমি তো আছই। আমার আর চিন্তা কী। এসো একটু পাশে বোসো। দেখো এখান থেকে সমুদ্রের তীর কেমন পরিস্কার দেখা যাচ্ছে দেখ।"
-" আমার সময় নেই এখন বসার। বিকেলে তো সমুদ্রের ধারে যাবই। তখনই দেখব না হয়।" বলেই কাবেরী নিচে চলে যায়।
পরদিন সকালে বাসে করে কোনারক, উদয়গিরি, খন্ডগিরি, ধবলগিরি,নন্দনকানন ঘুরতে যাওয়ার স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল রয়ে গেছে। একটি বাঙালি ট্রাভেল এজেন্সির বাসে টিকিট বুকিং করা হয়েছিল। বাস যাত্রীরাও সবাই বাঙালি। মনে আছে মালবাবু একটি টু-সিটার আসনে পাশাপাশি বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সত্যপ্রিয় আর কাবেরীকে। কাবেরী একটু লজ্জা পাচ্ছিল দেখে তিনি ঠাট্টা করে বলেছিলেন, "বৌদি, লজ্জা করবেন না। এভাবে পাশাপাশি বসে বড়জোর আলিপুরদুয়ার কি জলপাইগুড়ি গেছেন। তাও কালেভদ্রে। এমন রোমান্টিক একটা ভ্রমণে যাচ্ছেন পাশাপাশি বসে, ভাবুন তো একবার ফিলিংসটা কেমন হবে।" মেয়েদের সামনে কথাটা বলায় লজ্জা রাঙা হয়ে উঠেছিল কাবেরীর মুখ।
বাসে সারাটা রাস্তা বড় সুন্দর সুন্দর রবীন্দ্র সংগীত, বাংলা আধুনিক,নজরুলগীতি আর ছায়াছবির গান বেজেছিল গাড়িতে। সত্যপ্রিয়র এখনো মনে আছে। আর এও মনে আছে যখন যেখানে যেখানে গাড়ি পৌঁছচ্ছে এবং যে গানগুলো বেজে উঠছে সেগুলো সেখানকার পরিবেশের সাথে ভীষণ মানানসই। যেমন গাড়ি ছাড়তেই বেজে উঠেছিল, ' এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী "। সারা রাস্তা জুড়ে বেজে চললো' চলো দূরে চলে যাই, 'এই শহর থেকে আরো অনেক দূরে' 'ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়', 'আকাশ কেন ডাকে', খরবায়ু বয় বেগে' এমন আরো অনেক অনেক মন ভরানো গান। কোনারকে পৌঁছতেই বেজে উঠলো ' আকাশভরা সূর্য তারা' 'এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু'। ধবলগিরিতে বাস থামতেই বেজে উঠল, ' নমো নমো, নমো করুণাঘন নমো হে।' ফেরার পথে সূর্য যখন ঢলে পড়েছে,সকলে একে একে উঠে পড়ছে গাড়িতে, বেজে উঠলো, ' রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও গো এবার যাওয়ার আগে'। দিনের শেষে গাড়ি ছুটে চলেছে, আর বেজে যাচ্ছে গান হেমন্তের ভরাট কন্ঠে 'দিনের শেষে ঘুমের দেশে'।
বাইরে তখন অন্ধকার নামছে। হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটছে টুরিস্ট বাস। সারাদিনের ঘোরাঘুরির ধকলে যাত্রীদের অনেকের চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছে। ঘুম নেমেছিল কাবেরীর চোখেও। ঘুমজড়ানো শরীরটা এলিয়ে পড়েছিল সত্যপ্রিয়র কাঁধের ওপর। একটি হাত সত্যপ্রিয়র কোলের ওপর। সেই হাতের ওপর হাত রেখে সত্যপ্রিয় চেয়ে আছেন বাইরে। বাইরে তখন ফিকে জোৎস্নার আলোয় সরে যাচ্ছে একে একে গ্রাম, গঞ্জ। দূরে আবছা টিলা, পাহাড়, ঝাউবন, ধানক্ষেত। নয়ানজুলির স্থির জলে ঝুঁকে পড়া একফালি চাঁদ। আর ঠিক তখনই বাতি নেভানো গাড়ির ভেতর আশ্চর্য ভাবে বেজে চলেছে 'চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার, সরসীর আরশি তে'। গানের কী অদ্ভুত সমাপতন! সত্যপ্রিয়কে অভিভূত হয়ে ভাবেন এও কি সম্ভব! তবে কি ড্রাইভার সাহেব নিজে পছন্দ করে গানগুলো বাজাচ্ছেন। কিন্তু তাই বা কি করে হবে। গানগুলো তো পরপর বেজে চলেছে। সত্যপ্রিয় কিছুই বুঝতে পারেন না কিন্তু ভীষণ উপভোগ করেন ব্যাপারটা।
রাত প্রায় নটা নাগাদ গাড়ি এসে থামলো স্বর্গদ্বারে। একে একে যাত্রীরা নামছে। সকলে ক্লান্ত অবসন্ন। অথচ মনের ভেতর আঁকা রয়ে আছে সমুদ্রের নীল জলরাশি, পাহাড়, মন্দির, বৌদ্ধ স্তূপ,গুহা, নন্দনকানন। একটা গোটা দিন একসাথে কাটানো অপরিচিত মানুষজন হয়ে উঠেছিল ক্ষণিকের আপনজন। বিদায় নেবার সময় সকলেই বিষন্ন। 'আবার দেখা হবে' বলে একে অপরকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে যখন ফিরে যাচ্ছে, বাসের ভেতরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কন্ঠে তখনও বেজে যাচ্ছ,"যখন ভাঙল মিলনমেলা...ভাঙল। "
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴