শালসিঁড়ি ২৭/বিমল দেবনাথ
শালসিঁড়ি ২৭
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
অফিসার’স রেস্ট শেডের লাল গুলমোহর গাছটা ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে। বিছানার মাথার দিকের জানালা থেকে গাছটাকে মাটি থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যায়। গাছটির তলার অনেকটা জায়গা ফুলের পাপড়ি পড়ে সবুজ মাঠ লাল হয়ে গ্যাছে। জানালার পিছনে ওয়াইড এ্যাঙ্গেলে হরেক রকমের সবুজের ব্যাকড্রপে লাল গুলমোহর গাছটিকে মোটেও ভাল লাগে না বিকাশের। কে বলেছে লাল রঙ শক্তি, উৎসাহ, স্ফূর্তি ও পরাক্রমের প্রতীক! এই রঙ আগুনের মতো লকলক করছে। সব আশা ইচ্ছা যেন পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে। তার উপর পাকা বিকালে কোথা থেকে উড়ে এসে ফুলে ভরা পাতাহীন নেড়া ডালে বসে একটা হাঁড়িচাঁচা পাখি। ডাকে বিশ্রী ভাবে। মন খারাপ হলে বোধহয় ইষ্টিকুটুম পাখি বুঝতে পারে। কাছে এসে মিষ্টি করে ডাকে না। বন্ধু কি ভালোবাসে কাঁচা ঘায়ে খোঁচা দিতে! উড়ে এসে বসে একটা টেইলরবার্ড। কেন যে মানুষ পাখিদের এই রকমের নাম দেয়! ছেঁড়া মনকে তো সেলাই করতে পারে না বরং ছেঁড়া মনের ফাঁক ফোঁকরে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে ব্যথা বাড়িয়ে দেয়। টেবিলের উপর রাখা ক্যামেরাটাকে বিরক্তিকর লাগে- বিকাশের। ক্যামেরাটিকে যেমন তেমন করে ঢুকিয়ে রাখে ব্যাগে।
গত সোমবার অফিসের কাজে সদরে গিয়েছিল। সেই সুযোগে জীবনের প্রথম মাইনে বা ইনকাম নিয়ে আজ - শুক্রবার বাড়ি যাবার আগাম অনুমতি নিয়ে রেখেছিল। সাথে শনি রবি দুই দিন সরকারি ছুটি। সোমবার সোমত্ত সকালে আবার কাজে যোগ দেবার কথা। সকাল সকাল ভি আই পি গুছিয়ে উঠে যায় বাসে। যে বাস যায় শিশু সকালে সেটাই ফিরে আসে শেষ বিকালে। এই বাস চৌমাথা বন্দরে চেঞ্জ করে দুপুরে বাড়ি পৌঁছে, মাকে চমক দেবে। বিকাশের মনে পড়ে ছোট বেলায় শোনা কথা- চৌ-মাথা সর্বনাশা। ওখানে যেতে নেই যখন তখন। কেউ জানে না কী হয়ে যায় কখন। সত্যি ছোট বেলাটা কত মিষ্টি ছিল। যেখানে মানা সেখানে দুরন্ত বালক-বালিকাদের থাকে বেশি আনাগোনা। কত কী কথা মনে পড়ে… বিকাশ মনে মনে হেসে ওঠে মুক্তো ঝিনুকের মতো। সতর্ক ভাবে রাস্তা পার হয়ে বাড়ির গাড়িতে উঠতে যাবে… পিছনে একটা গাড়ী পি… পি… করছে। বিকাশ চকিতে পিছনে ফিরে দ্যাখে সদরের সাহেবের গাড়ি। গাড়ির মাথায় চলছে লাল বাতির ঝলকানি। স্টাফ নেমে এসে ভি আই পি টা তুলে নেয়, বলে- সাহেব ডাকছে, গাড়িতে।
গাড়িটা ঘুরে গেল বনের দিকে। চাকুরি পাওয়ার পর প্রথম গ্রামে… প্রথম বাড়িতে আসার আনন্দ শিলার মতো ঝরে পড়ে আকাশ থেকে বুকের ছাদে। প্রথম স্বপ্ন আর প্রেম ফিরে আসে না আবার। বিকাশকে যেন হঠাৎ বোবায় পায়। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। শরীরটা পাথর হয়ে যায়। ভাবে- কী হারিয়ে কী পেলাম… কী পেয়ে কী হারালাম… যুবক বিকাশের মাথা ঘুরে যায়। পরে বুঝতে পারে …সাহেবের পাশে বসে সাহেবের সাথে বন টহলে যাবার খবর আর টি (RT)তে উড়ে যাবার পর অনেকের মাথা ঘুরে যায়। আত্মশ্লাঘার টুঁটি চেপে বিকাশ অভিমানে, উপেক্ষায় মনে মনে বলে- বনে যারা কাজ করে আইনত তারা সবাই অফিসার… পরাধীন অফিসার… বিকাশ অনাদরের হাসি হাসে- ভাঁটফুলের মতো।
- বিকাশ…
- হ্যাঁ স্যার।
- তোমার পাশে বন ভালো করে দেখবে।
- স্যার।
গাড়ি ছুটে চলে বনের বজরী ছড়ানো কাঁচা রাস্তায়। ঘুরে ঘুরে পিছিয়ে যায় গাছ লতা পাতা। হেঁটে হেঁটে আসে বনের ক্যাম্প, বিট অফিস। সাহেব ডিউটির খাতা দ্যাখে; সুন্দর হরফে নোংরা খাতায় পরামর্শ লেখে…
- বিকাশ খেয়াল রাখবে আমি কি লিখছি, কী ভাবে লিখছি।
- স্যার।
গাড়ি আবার ছুটতে শুরু করে। মাঝে মধ্যে ঝুঁকে পড়া গাছের ডাল গাড়ির উইন্ডস্কীনে বাড়ি মারছে। সেই আচমকা বাড়ি দেখে বিকাশ চমকে উঠে- রিফ্লেক্সে। যৌবনের তেজ দ্যাখে, ধীর স্থির গম্ভীর সাহেব মনে হয় স্মিত হাসে। অনেকক্ষণ গাড়ি চলার পর গাড়িটা বনের ভিতর থামে।
- বিকাশ, গাড়ি থেকে নাম।
- স্যার! বিকাশের মনে হয়, ওর মনের ভিতরে অনেকগুলো ডাহুক ডেকে ওঠে। অজানা ভয় জমে ওঠে মনে। এই ভয় বিকাশ হজম করে নেয় হাঁসের মতো।
- বল, এটা কী ধরণের বন।
- স্যার, এটা তো প্ল্যান্টেশন। সেগুন গাছের।
- উঠে এস।
গাড়ি আবার ছুটে চলে, নদীর পাড় ধরে। বনের মধ্যে নদীর পাড়ে বাঁধ নেই, স্পার নেই। বনে নদী খোলা আকাশে মুক্ত পাখির মতো। প্রতি বছর পাড় ভাঙে গড়ে। এখন আর এই রকম মুক্ত নদী দেখা যায় না। বনের বাইরে নদী বাঁধা বাঁধে। মানুষ ঠিক করে দেয় নদীর জীবন! বনের বাইরে নদী যে পরাধীন মানুষের মতো। নদীর সাথে যা ইচ্ছা ব্যবহার করে। কেউ পাড় কাটে কেউ বুক ভাঙে। অভিমানে নদীর জীবন- জল চলে যায় মাটির গভীরে। বনে নদী কত সুন্দর। এখনো বর্ষা আসতে মাস দুই বাকি। তবু নদী কথা বলে-কল কল। কচি সবুজ কাশ দুরন্ত বালকের মতো হাওয়ায় ছোটে- এদিক ওদিক।
নদীর পাড়ের রাস্তা সাপের মতো। যারা শুধু শহর বা গ্রামের রাস্তা দেখেছে তারা বনে নদীর পাড়ের রাস্তার সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পারবে না। নদী পাড়ের রাস্তাকে রাস্তা না বলে বলা যায় নদী ও বনের অস্থায়ী সীমানা রেখা। গাড়ি চলতে থাকে দোলনার মতো দুলতে দুলতে। দুলতে দুলতে মনে হল সাপের মুখ থেকে বেরিয়ে গ্যাছে। গাড়িটা আবার ছুটতে লাগলো। কিছুক্ষণ ছোটার পর ঘন অন্ধকার বনে আবার থামল। আবার গম্ভীর গলা ভেসে এলো। “ বিকাশ”। এতক্ষণ একসাথে গাড়িতে বসে আছে, ঘুরছে- কোন বিশেষ কথা নেই, স্নেহ প্রশ্ন নেই, একটা আড়ষ্টতা ঘিরে রাখে বিকাশ কে। আড়ষ্টতার জাল ছিঁড়ে শেষবার গাড়ি থেকে নামার অভিজ্ঞতায় ভয় গলিয়ে বিকাশ বলে-
- স্যার!
- গাড়ি থেকে নাম।
- স্যার।
- এটা কী ধরণের বন।
- ন্যাচারাল স্যার।
- শোন আমি বিশেষ কারণে চলে যাচ্ছি। একটু আগে গিয়ে আমি বাঁ দিকে ঘুরে যাব। তোমার ভি আই পি তোমার রেস্ট শেডে নামিয়ে দেব। তুমি বাঁদিক না ধরে সোজা হেঁটে তোমার বিটে চলে যাও। পৌঁছে আর টি (RT)তে আমাকে খবর দেবে। আমার গাড়ির কোড জান?- চিক্রাসি ওয়ান।
নিমেষে গাড়িটি হারিয়ে গেল গহন বনের ভিতরে। বিকাশ ভাবে- গত এক মাস ধরে কাবু তো এই বনে নিয়ে আসেনি। জীবনে এই প্রথম এক মুহূর্তে একাকীত্বের তির বিঁধল বিকাশকে। এত দিন নিজের আপন, চেনা জানা কেউ না থাকলেও কাবুরা থাকতো ঘিরে ঘিরে- একাকী লাগতোনা। এখন গভীর বনের ভিতরে কেউ নেই, চারদিক কেমন গা ছমছম ভাব। চারদিক কেমন যেন ভৌতিক অন্ধকার। এই বনের রং কেমন যেন কালো সবুজ। সোমত্ত সকালেও সূর্য রশ্মি ঢুকছে বল্লমের ফলার মতো। কোন পাখির ডাক নেই। শুধু চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার কর্কশ কম্পন। ভেসে আসে মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি। বিকাশ জানে- এই গহন বনে ওকে এখন সাহায্য করার জন্য কোন দেব দেবী আসবেনা। এই ঘণ্টা ধ্বনি কিছু ঝিঁঝিঁ পোকার একনিষ্ঠ কম্পন। হঠাৎ একটি কী পাখি যেন বিকাশের মুখের সামনে দিয়ে বনে গাছের ফাঁকে ফাঁকে ডজ করতে করতে ফড়ফড় করে উড়ে যায়। বিকাশ আঁতকে উঠে বলে উঠে “মা”। ভাবে- এটা কী পাখি, এটা যে মারাদোনার থেকেও ভালো ডজ করে। পরে জেনে ছিল ওটা রাজ ঘুঘু। ঢালে নিউট্রালে রাখা গাড়ির মতো কখন বিকাশ হাঁটতে শুরু করে নিজেই বুঝতে পারেনি। বিকাশ হাঁটতে থাকে সাথে হাঁটে গাছ বন। বিকাশকে অনুসরণ করে গাছের ফাঁক দিয়ে ধেয়ে আসে গনগনে সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি ফলা। অন্ধকার বনে দিনের বেলায় মাকড়সার জালে মাঝে মধ্যে মৃদুজেগে ওঠে রামধনুর অনেকগুলো রঙ। মাকড়সার জালগুলো মাঝে মধ্যে বিকাশের মুখমণ্ডলে লেগে ছিঁড়ে যায়। জালের আঠালো সুতো লেগে যায় চোখে মুখে। হলুদ কালো বড় উড স্পাইডার ঝুলতে থাকে গাছের ডাল থেকে ছেঁড়া জাল বুকে নিয়ে। একটা গাড়ি বিকাশের এই কয় দিনের সব স্বপ্ন -জাল ছিঁড়ে দিয়েছে। বিকাশ এখন উড স্পাইডারের মতো ঝুলতে ঝুলতে এগিয়ে চলে। বিকাশের মনে হয় শারীরিক কষ্টের মধ্যে একটা মাদকতা আছে। নির্জন বনে একা একা আশঙ্কার মধ্যে দ্রুত হাঁটার কষ্ট মনের কষ্টকে দমিয়ে রাখে। কাবু বলতো দুপুরে গভীর বনে বুনোরা বিশ্রাম করে। বিকাশের ভয় করে – যদি অজান্তে বিশ্রামরত কোন বুনো প্রাণীকে বিরক্ত করে ফেলে। বিরক্ত বুনো প্রাণী যদি প্রাণঘাতী আক্রমণ করে… বিকাশ কী করবে বুঝতে পারে না। পাশে বনের ভিতরে কী যেন খসখস করছে। বিকাশ দাঁড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ বন থেকে বেরিয়ে সামনে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে পড়ে বরাহ মা আর তিন শাবক। বিকাশের মনে হয় পৃথিবীতে আর রাস্তা বলে কিছু নেই। চারদিকে অচেনা অজানা ভয়। বনে বরাহরা খুব একগুঁয়ে হয়। বনে প্রথমে বুনো শূয়রেরা বের হয়- জল খেতে। তারপর আরো যে কী কী যে এসে হাজির হবে…সবাই বলে সন্তানের বিপদে মা কী ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। বিকাশ তখন গাছের গুঁড়ি। সন্দেহ করে বরাহ-মা এগুতে থাকে বিকাশের দিকে। বিকাশ সূর্য রশ্মির আলোয় আলোকিত গইচা পাতায় মায়ের মুখ দ্যাখে। কী বুঝে কী জানি বরাহ-মা শাবকদের নিয়ে দৃঢ় চালে চলে যায় বনে। উত্তরের রাস্তা ছোট হয়ে আসে। দূরে দেখা যায় আলোর বলয়- ফাঁকা জায়গা। বিকাশ যেন ছুটে যায় আলোর বলয়ের দিকে পতঙ্গের মতো।
- একটু জল দেবে? বিকাশ বলে।
- হুম। লাও।
পাতকুয়ো থেকে জল তুলে বালতি থেকে জল ঢেলে দেয় বিকাশের হাতে। জল খেতে গিয়ে জল উঠে যায় নাকে মুখে। বিকাশ খকখক করে কেশে ওঠে। মেয়েটি খিল খিল করে হেসে ওঠে। হাসিতে দুলে উঠে যুবতির বুক, বিকাশের আকাশ। মেয়েটি ঘুরে ঢুকে যায় ঘরে। এক বনবস্তির যুবতির নিকষ কালো খোলা পিঠ হিরার মতো চিক্ চিক্ করে ওঠে দুপুরের আলোতে। বাড়ির উঠোনে অচেনা লোক দেখে জড়ো হয় আশে-পাশের লোক। কারো হাতে কুড়ুল কারো হাতে হাঁসুয়া কারো হাতে দা কারো হাতে লাঠি…
শ্রান্ত ক্লান্ত বিকাশ অবাক চোখে চারদিকে ঘুরে দ্যাখে, ভাবে- বড় অন্যায় হয়ে গ্যাছে, নির্জন দুপুরে একা যুবতি মেয়ে দেখে তার বাড়িতে ঢুকে … তৃষ্ণা কী ভয়ানক আগুনের মতো। তার উপর মেয়েটি কেমন করে হেসে ঢুকে গেল ঘরে। বিকাশের মনে হয়, হাসি সব সময় ফুল হয়ে ফুটে না - হুল হয়েও ফোটে। একটি লোক ডাকে-
- রাই, রাই ঘর থেকে বেরিয়ে আয়।
বনের গভীরে এক আদিবাসী মেয়ের নাম রাই… এতদিন যে শুনে আসছি ওদের নাম জন্ম দিনের নাম অনুসারে রাখা হয় – সোমারি, মঙ্গলি, বুধারি… বিকাশ ভাবে এই বনে চাকুরীতে আর যে কী কী চমক আছে!
- দেখ না বাবা, এই বাবুটা বাঘে তাড়া খাওয়া হরিণের মতো কেমন হাঁপাচ্ছে। জল খেতে চাইলো, জল খেতে দিলাম। খেতে পাচ্ছে না, কেমন খকখক করে কাশছে।
- অ, জড়ো হওয়া লোকগুলোর চাহনি স্বাভাবিক হয়ে যায়- সংকোষের জলের মতো। পিতা পুত্রীর পারস্পরিক বিশ্বাস পাহাড়ের মতো। বলে- ওকি আমাদের মতো বনবস্তির মানুষ যে বালতিতে জল খেতে পারবে। যা একটা বাটি নিয়ে আয়।
- আপনি কোথা থেকে এলেন?
- বন থেকে।
- বনে এলেন কী ভাবে?
- গাড়ি থেকে।
- গাড়ি থেকে? গাড়ি তো কুড়ি মাইল দূরে চলে। কী যে বলেন, মনে হয় আপনাকে বনে পাইছে।
- আপনার নাম কি?
- বিদ্যা মুন্ডা
বিকাশে আবার ঝটকা লাগে। বন বস্তিবাসীদের এত সুন্দর নাম। যেমন সুন্দর মানুষটির নাম তেমন সুন্দর তাদের গ্রামটি। মানুষ এই রকমই হয়- ঘোর বিপদ বা ভয়ের পর মানুষের সঙ্গ পেলে, সব সুন্দর মনে হয়- ঝড়ের পরে আকাশের মতো। আবার কিছু মানুষের ব্যবহার মানুষের মনকে এমন খারাপ করে দেয় যে সুন্দর জিনিষকে খারাপ লাগে। রাই ও বিদ্যাকে দেখে বিকাশের মন হালকা হয়ে ওঠে- পাখির পালকের মতো। বনের ভিতর বন-বস্তিটিকে খুব সুন্দর মনে হয়। গ্রামটির চারিদিকে লম্বা লম্বা গাছ। মনে হয় যেন কালো সবুজ সমুদ্রে একটা চিকন সবুজ দ্বীপ। উঠোনের আত্মীয়ের মতো ইঁটের খুঁটির উপর কাঠের ঘর। গায়ে এফ ডি ( F.D) লেখা। কিছু ঘর মোটা শাল কাঠের খুঁটির ওপর বানানো, ওতে (F.D) লেখা নেই। বিকাশ জানে যে ঘরে এফডি লেখা আছে সেগুলো বনদপ্তরের বানানো। বন দপ্তরের একটি বিভাগ আছে যারা বনবস্তির উন্নয়নের কাজ কর্ম দেখে। আর যে গুলোতে এফ ডি লেখা নেই সেগুলো বানিয়েছে নিজেরা- জনসংখ্যার চাপে। বিকাশ ভাবে- মানুষ থেকে বুনোরা ভালো; সুচারু ভাবে চেপে রাখে জনসংখ্যার চাপ। মানুষ চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে গান্ধীপোকার মতো। বিদ্যা একটা কাঠের গুঁড়ি দেখিয়ে বলে-
- আপনি বসুন।
রাই দু হাতে এক বাটি জল ধরে। বিকাশ তৃপ্তি করে জল খায়। বিদ্যা জিজ্ঞাসা করে-
- আপনার নাম কি? কোথায় যাবেন?
- বিকাশ। ফরেস্ট অফিসার। কয়েক মাসের বিট ট্রেইনিং নিচ্ছি। যাব শালবাড়ি বিটে।
- সে কী, সেটা তো এখান থেকে অনেক দূর। আপনি তো রাস্তা ভুল করেছেন। চলেন আপনাকে এখানের বিট অফিসে নিয়ে যাই। তারপর ওরা আপনাকে পাঠাই দিবে।
- ওরা নাই বাবা। ডিউটি গেছে। রাই বলে আর মিটিমিটি হাসে।
- অ- তা হলে চলেন আপনাকে পোছাই দিয়া আসি।
- না না আমি একা চলে যাব। আপনাদের যেতে হবে না। এতটা পথ যখন একা আসতে পেরেছি, এইটুকু পথ ঠিক চলে যাব।
- আপনি জানেন না তাই ভয় ডর ছাড়া চলে এসেছেন। আমরা জানি এই বনে কী আছে, কিসের ভয় আছে। আপনাকে একা যেতে দিতে পারি না। আমাদের বিটবাবু জানলে খুব বকবে। আমরা হপ্তায় একবার শালবাড়ি বিটের কাছে বাগানের হাটে বাজার করতে যাই। স্টাফ ভিলেজার এক সাথে। ফিরি একসাথে।
- কেন।
- এখানে অনেক হাতি আছে । আমাদের এই খড়বাড়ি বনবস্তির পুব দিকে নদী আছে। বিকাল হলে হাতিগুলা সব নদীতে নামে স্নান করতে আর জল খেতে। এখন তো আস্তে আস্তে হাতিগুলা বের হবে। চলুন আপনাকে দিয়ে আসি।
বিদ্যা আর আরও পাঁচ ছয় জন গ্রামবাসী বিকাশকে নিয়ে রওনা দেয়। রাই হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে বিকাশের দিকে। বিকাশের মনে হয় রাই যেন অপরূপা আর মাধুরীর যুগল রূপ। তাই এমন কালোতে আলো। উজ্জ্বল করে রাখে চার দিক। এই আলো বিকাশের মনকেও আলোকিত করে দেয়…
- বিদ্যা, আপনার নাম কে রেখেছে?
- বাবা বলেছে, আমাদের খড়বাড়ি’র বিট বাবু।
- রাই নাম কে রেখেছে ?
- আমাদের বিটবাবু।
- বাঃ আপনাদের বিটবাবুর সাথে তো আপনাদের খুব ভাব ভালোবাসা।
- হ্যাঁ। কেন হবে না। আমরা আপদে বিপদে একসাথে থাকি, এক বাজারে বাজার করি। তবে এই ভালোবাসা কতদিন আর থাকবে জানি না।
- কেন?
- গ্রামে লোক বাড়ছে। কাম বাড়ছে না। কাম না থাকাতে গাছ চুরির মতো অকাম বাড়ছে… মাঝে মধ্যে বাইর থেকে কিছু লোক আসে, জোয়ান ছেলেগুলার সাথে মিটিং করে। কথা শুনে না।
- সে তো খুব খারাপ। আপনারা এখানে কত দিন ধরে আছ?
- আমার ঠাকুরদা এসেছিল প্রথম- গাঁয়ের মণ্ডল হয়ে। এখন আমি মণ্ডল।
কথা বলতে বলতে কখন শালবাড়ি বিটে এসে গেছে বিকাশ বুঝতে পারেনি। বিদ্যা বলে-
- স্যার, ঐ শালবাড়ি বিট।
বিট অফিসে কেউ নেই। সবাই বনে গ্যাছে- ডিউটিতে। বিকাশের মনের ভিতর এক কঠিন টানাটানি চলতে থাকে। ডিউটি … ভালোবাসা… মাধুরী… মা…অপরূপা…রাই…ক্লান্ত শরীর এলিয়ে পড়ে বিছানায়…
কে যেন ভেজানো দরজা ঠেলে ঢোকে। বিকাশ উঠে বসে…
- আপনি ঠিক ঠাক ফিরে এসেছেন। যাই খবরটা দিই।
- কাকে আবার খবর দেবে।
- আর টী (R.T)-তে চিক্রাসি কন্ট্রোল জানতে চেয়েছে আপনি ফিরেছেন কিনা।
- হ্যাঁ, আমাকে খবরটা দিতে বলে ছিল। চলো আমি যাচ্ছি।
- স্যার কেমন লাগল, একা একা বনে হাঁটতে। ভয় পাননি তো? দেখবেন আজকের এই ঘটনা কোন দিন ভুলতে পারবেন না। আজকের এই অভিজ্ঞতা বহুমুখী, ভবিষ্যতে বনে অনেক কাজে লাগবে। মন খারাপে কথা না বলে বনে হাঁটবেন - মন ভাল হয়ে যাবে। কোন শব্দ না করে দাঁড়াবেন দেখবেন এই লম্বা লম্বা শাল গাছগুলো সিঁড়ি হয়ে আপনার মনের ভিতর ঢুকে যাব। সব দুঃখ কষ্ট নেমে যাবে মাটিতে। মন ভালো হয়ে যাবে। বিকাশ একবার কাবু কে দ্যাখে একবার বিট অফিসের চারপাশের লম্বা লম্বা শাল গাছগুলো দ্যাখে… সিঁড়ি শব্দটা শুনে মনে কেমন যেন চমক লাগে…
বিকাশ কোন উত্তর দেয় না। আর টি তে ডাকে- কলিং চিক্রাসি কন্ট্রোল, কলিং চিক্রাসি কন্ট্রোল…
- নির্মলবাবু, ওয়াকইটকির সাউন্ড কমিয়ে দিন। বনের কোন শব্দ শোনা যাবে না… নাক কান চোখ খোলা রেখে হাঁটতে হবে …
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴