পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ২৭
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
কাটখোলা
বাড়িতে
থাকলে কান্তেশ্বরের খাওয়া নিয়ে বড্ড প্যাকনা। আজ ঘুম থেকে উঠেই মাছ মারার
বাই উঠেছে। চা খেয়েই জাল হাতে বেরিয়ে পড়েছে সঙ্গে খলুই। যথারীতি পড়াশুনা
শিকেয় তুলে ছেলে-মেয়ে দুটোও পিছু নিয়েছে। বসমতী কিছুক্ষণ একা একাই গজগজ
করল। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এখন প্রায় সব ডোবাই শুকিয়ে গেছে। দু-একটা
ডোবায় সামান্য জল আছে। ওগুলোতেই ছেলে-পিলেরা হাত দিয়ে চ্যাং, টাকী, শিঙি
ধরে মাঝে মাঝে। কান্তেশ্বর গতবছর একটা জাল বানিয়ে নিয়েছে। ওটা দিয়ে মাঝে
মাঝে এখানে ওখানে ছাপ মারে।
বেশিক্ষণ লাগল না হৈ
হৈ করে ফিরতে। মাছ পেয়েছে অল্পই। তবে সব বড় বড় পুঁটি। বাপের পাল্লায় পড়ে
বাচ্চাগুলো একটা মুড়ি মুখে তোলেনি। দুধটুকু চোঁ চোঁ করে এক নিঃশ্বাসে খেয়েই
পালিয়েছে। এখন মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে পেট চুঁই চূঁই করছে। বসমতী বাইরের
উনুনে কড়াই বসিয়ে ছোট ছোট দেশি আলু গোটা ধুয়ে এনে শুকনো খোলায় চড়িয়ে দেয়।
আঁচ কম রাখে। মেয়েকে বলে পাটকাঠি দিয়ে আলুগুলো মাঝে মাঝে নেড়ে দিতে। ওখানে
কটা কাঁচা লংকাও দিয়ে দেয়। পোউআ হোক একসাথে। বলে, নিজে বড় বড় পুঁটিমাছ
আঁশসুদ্ধ গোটা ধুয়ে আনে। পাটকাঠি দিয়ে উল্টে পাল্টে দিতে দিতেই আলুগুলো নরম
হয়ে আসে। একদম সেদ্ধ হলে মাছগুলোও ওরকম শুকনো খোলায় অল্প আঁচে বসিয়ে দেয়।
এপিঠ ওপিঠ করে মাছ সেদ্ধ হলে নামিয়ে নেয়। মাছের গা থেকে আলতো করে সব আঁশ
আপনা থেকেই উঠে আসে, খুব বেশি কসরৎ করতে হয় না, নাড়ি ভুঁড়িগুলোও আলগা হয়ে
থাকে, ফেলতে অসুবিধা হল না। আলুর খোসা ফেলে নুন, লংকা পোড়া, কাঁচা তেল দিয়ে
মেখে রেখে মাছটাও আলাদা নুন, তেলে মেখে নেয়। সবাইকে ছোট ছোট থালায় চিঁড়ে
দিয়ে উঠোনেই খেতে বসিয়ে দেয়। মেয়ে বলে,
"মা, বাইগোন ছুবিন্নাই কেনে?"
মেয়েটা বড্ড বেগুনপোড়া খেতে ভালোবাসে। বসমতী আলতো গলায় বলে,
"বাইগোনে নাই মাবো। আজি এলায় তোর বাবা হাট থাকি আনিবে, সেলা আইতোত খাইস।"
খাওয়ার
পাট চুকতে না চুকতেই দিন প্রায় দুপুরের দিকে গড়িয়ে গেল। কটা লাফা শাক তুলে
নিয়ে এসে বাড়ি ঢুকতে যাবে কান্না-কাটি চেঁচামেচির আওয়াজে বসমতী একটু
থমকাল। সুকারুর বউ কান্না করছে। কী হয়েছে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে গিয়ে দেখে
সুকারুর বউয়ের খাসিটা কাটা হচ্ছে আর সুকারুর বউ গলা তুলে মরন কান্না
কাঁদছে। ওকে দেখে কান্নার বেগ বেড়ে গেল।
"দিদিও, কী সর্বনাশটা হইল ক তো মোর। "
"কী হইসে? ধান খাইসে?"
বসমতী
বুঝতে পারে কোনোভাবে দড়ি ছিঁড়ে পাকা ধান খেয়ে আধমড়া হয়ে ছটফট করছে ছাগলটা।
এখন মেরে ফেলা ছাড়া ঊপায় নেই। সুকারুর বউ কেঁদেই চলেছে ইনিয়ে বিনিয়ে।
"বাইষ্যাখানোত, কেমন জল গেইল বারে, নিজে কাঁটোলের পাত পাড়েয়া খোয়াসুং।"
একটু থেমে আবার কাঁদে,
"একজোড়া কানের টাব বানের চান্দালুং ছাগল ব্যাচেয়া। ছাওয়াটার না জুতা নাই,
জুতা একজোড়া কিনিলুং হয়। মোর সব শ্যাষ হয়া গেইল বারে। একখান জীব পুষিয়া
যদি সংসারের একটা আওসান না হয় তে পুষিয়া মোর কি হইল!"
এবার
সুকারু এক ধমকে বউকে চুপ করায়। ওর মনটাও ভালো নেই। বাড়িতে কাটা হল, এখন
এভাবেই বাড়ি বাড়ি মাংস দিয়ে বিক্রি করতে হবে। কিন্তু সুকারু জানে অর্ধেক
টাকাই উঠবে না। প্রসঙ্গ পালটাতে বসমতীর দিকে বলে,
"দাদা কোটে? কি করেছে?"
বসমতী ঠোঁট উল্টে বলে,
"ওই তো, মাছের কাটখোলা দিয়া চুড়া খায়া বসি আছে। আছে না, বাড়িতে আছে।"
সুকারু ইতস্তত করে বলে,
"দাদাক ক। নিগাউক এককেজি। এতলা মসং কোটে বেচাং।"
বসমতী বলে,
"মোকে দে। ভাল চায়া দিস। কাঁটালা না দিস। ছাওয়ালা চবেরে না পায়।"
কলার
পাতায় সাবধানে মুড়ে সুতলি দিয়ে বেঁধে যত্ন করে মাংসটা বসমতীর হাতে তুলে
দিল বুধেশ্বর। বুধেশ্বরই একটু ছাগল-টাগল কাটে সবখানে। মাংস নিয়ে ফেরার পথে
রসবালার সঙ্গে দেখা। বসমতীকে দেখে বলে,
"আনলু দি? কতলা নিলু?"
বসমতী টেনে টেনে বলে,
"নিলুং এককেজিয়ে। হামাক কি আর কম দেয়? তোর দাদাক সোগায় জানে কেমন খাউ।"
আসলে অন্যদের তুলনায় তাদের কেনার ক্ষমতা বেশি আছে, এই বিষয়টা বসমতী সযত্নে এড়িয়ে গেল।
"হুটা না হয়। তে দাদা তেমন কামাইও না করে!"
তারপর একটু থেমে বলে,
"কায় কাটেছে, বুধেশ্বর না বোছোর আইনসে?"
বসমতী বলে,
"বুধেশ্বরে কাটিল। চামড়াখান, ভুন্ডিটা নিবে এলায়। বেচাবে কোনোঠে। ওখিনায় উয়ার লাভ!"
রসবালা মনটা খারাপ করে বলে,
"কষ্ট করি মানষি করি এলা কী হইল দ্যাখ তো দি।"
বসমতী বলে,
"দড়িখান বোদায় পোচকোটা নাইগসে, দ্যাখে নাই।"
"পোচকোটা তো নাইকসে। তে জমি নাই। পাটাপুটা করে না। হামার না অল্প এক
হাফাল নিগাইসে একদিন। ওখিনায় কী হয়? মইদ্যতে দড়ি না পাল্টালে!"
তারপর একটু থেমে বলে,
"পানিকুমড়া খাবু? কি দিয়া আন্দিবু মসং? খাবু তে কাটোং একটা। তোমা একফালা, হামরা একফালা।"
বসমতী বলে,
"দে তে। একেবারে নিগাং। মোর আর দুয়েটা আছে। থুসুং, হুস্কিল মুস্কিল মসং
টসং খাইলে নাগে। দুইটার না চেনা করি দিসুং। তুই চেনা করিচিস ঝোন?"
রসবালা বলে,
"করচুং না। তে যে খাউ হামার উয়ার বাবার। মূলা-বাইগোন আন্দির চান্দাইলে
কবে, ওঠে কয়টা চেনা ফেলে দ্যান। খাবার ভাল হবে এলায়। এইলা আপরুক মোঙ্গা
জিনিস, দিনাও খাইলে নয়?"
বসমতী হাসে। নতুন নতুন
মূলা-আলু-বেগুন দিয়ে চালকুমড়ার চেনা দারুণ লাগে। অন্যান্য সব্জিতেও চেনা
দেয় কেউ কেউ, কিন্তু এই সব্জিটার মতো এথ স্বাদ যেন হয় না। যখন ঘরে রাখা
চুনপড়া চালকুমড়াগুলো শেষ হবে তখন অনেকে চালকুমড়ার চেনা মাংসে ফেলে দেয়। কত
যে খাওয়ার কায়দা জানে লোকে! আসলে মাংস তো হয় সেই কালেভদ্রে কোন বা দিন!
বসমতীর ছেলে-মেয়েদুটোর মাংসে আলু ছাড়া চলে না, ওর শ্বশুরমশায় আবার খাসির
মাংস চালকুমড়া ছাড়া খেতেন না। বাড়িতে না থাকলে কারো না কারো কাছ থেকে
চেয়ে-চিন্তে ঠিক জোগাড় করে আনতেন। বুড়ি রেগে যেত।
বাড়ি ঢুকেই কান্তেশ্বরকে বলে,
"সাইকোলখান ধরি যাও তো, পচ্চিমটারির গনেশের বাপ বাবাক কনেক কয়া আইসো।"
তারপর একটু থেমে বলে,
"নানাগে। আখাটা ধরে কনেক চা করি দ্যাং, খায়া একেবারে সাইকোলোত করি ধরি
আইসো। বুড়াটার গাও পাও ধুতে দেরি হলে নন কনেক বসি। বুড়া মানষি, গাও ধুবে,
ঠাকুরোক ফুলজল দিবে, তবে সে না আসিবে। নন কনেক।"
কান্তেশ্বর আশ্চর্য হয়ে বলে,
"অত দূরকার মানষি এখেরে পচ্চিমটারি! কেনে? খাবার চাইসে? আগোত অবইশ্য ডোকসা জ্যাটো খুব আচ্চিল হামার বাড়ি। তে এলা বাবায় নাই!"
বসমতী
কুয়োর পাড়ে বালতির তুলে রাখা জল ঢেলে নিয়ে হাতে পায়ে দিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে।
মাংসটা তখনও একহাতে ধরাই। দ্রুত নামিয়ে গামলায় রেখে উনুনে খড়ি চাপায়।
সিন্ডা দিয়ে আগুন ধরিয়ে চায়ের জল চড়ায়। তারপর বলে,
"মাইর সতে, অসবালার সতে সেদিন কনেক পচ্চিমটারি গেলুং তে ওদি ঢুকিলি। নাই বুড়াটার দেহাটা পড়ি গেইসে। ক্যামতোন মানষিটা আছিল।"
কান্তেশ্বর মৃদু স্বরে বলে,
"এলা বেটার মইদ্যত খায়। কায় এলা ক্যামন দ্যাখে তে হোবে না।"
বসমতী ঝামড়ে ওঠে।
"তোমরা ওইলা কাথা না কন তো। না দ্যাখে তে কী! বস হইসে না এলা। মানষি কী চিরকালটায় একে মতোন থাকে?"
কান্তেশ্বর তাড়াতাড়ি ভুল শুধরে বলে,
"না হয় সেই কছং। এলকার চেংরালা তো বিয়াও করি ড্যার দিনোতে ব্যাগোল হয়!"
বসমতী চা ঢালতে ঢালতে আপন মনে বলে,
"না হয়। বউলা বলে ভালে দেকাশুনা করে। আদর করে। তে বস হইসে এলা।"
তারপর কান্তেশ্বরের দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
"তে সেদিন মোক দেখিয়া খিবে খুশি হইল। বাচ্চা ছাওয়ার নাখান কী কছে আর কী
না কছে। তে মোক কইল, তোমার বাড়ি যাইম একদিন বারে। তোমার হাতোত মসং খাইম।"
তারপর গলায় আকুতি মিশিয়ে বলে,
"যাও তো। ওদি এখেরে ধরি আইসো। সাইকোলোত চড়ির না পালে ভ্যান এখান ইজাভ করি
আনো। আর উমার বাড়ির কাহোকো সতে সতে আসির কন। মনটা কেমন নাগিল শুনিয়া। আগোত
বলে মাও কতোয় আন্দি খোয়াইসে।"
কান্তেশ্বরও একটু অন্যমনস্ক হয়। বলে,
"বাবার সতে খিব বন্ধু আছিল। তে মার তো ভাসুর। মার আন্দোন খিব ভাল পাইসে জ্যাটো। হর বাপ মাওটায় মোর খাড়ায় চলি গেইল।"
রান্না
প্রায় শেষ। কান্তেশ্বর একটা ভ্যানে করে বৃদ্ধ পুলেন আর ওনার এক নাতিকে
নিয়ে বাড়ি ঢোকে। বসমতী বাঁশের তৈরি খাটটায় একটা চট, তার উপর বিছানার চাদর
পেতে বসার ব্যবস্থা করেই রেখেছিল। কান্তেশ্বর বলে জ্যাটো তোমরা বইসো। মুই
গা'ত কনেক জল ঢালি খারায় আইসোছোং।"
বুদ্ধ খুশিমনে
মাথা নাড়ে। অনেকদিন পরে এ বাড়িতে আসতে পেরে খুশি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বসমতী
রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে খাবার জায়গা করে। সামনেটা পাটের ন্যাতা ভিজিয়ে মুছে
দেয়। তারপর কাঁসার গ্লাসে জল দিয়ে বড় কাঁসার থালায় ভাত, কাঁসার বাটিতে মাংস
বাড়ে। এটা ওর শ্বশুর মশায়ের, আজ নামিয়েছে। থালাটা এগিয়ে দিয়ে একটা প্রণাম
করে। শ্বশুরমশায়কেও ভাতের থালা এগিয়ে দিয়ে প্রণাম করত বসমতী। প্রণাম করে
বলে,
"বাবা খাও তো। কেমন বা হইল।"
মাথাটা বড় বলে পুলেনকে লোকে বলত ডোকসা। খুশিতে সেই বড় মাথাটা নেড়ে পুলেন বলে,
"ভালে না হইসে বারে। দেখি তো ভালে নাগেছে।"
বসমতী বলে,
"খাও বাবা। বেটি যেটে বউ সেটে। নিজের মনে করি খাও।"
ফেরার
সময় ভ্যানে তুলে দেওয়ার আগে বসমতী আর একটা প্রণাম করে গলায় আঁচল জড়িয়ে।
কান্তেশ্বরও করে। পুলেনের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। বয়সের ভারে অশক্ত শরীর
নিয়ে তিনি যে আর কখনো এই বাড়িতে আসতে নরবেন না তা বোঝেন। ধরা গলায় বলেন,
"যাং বারে বৌমা। তোমরা যান বাউর সতে। বুড়া বেটাক কনেক দেখি আইসেন। কাহো এখেনা গেইলে মনটা ভাল নাগে বারে।"
....................................................
আওসান - উপকার
খাউ - খানেওয়ালা
বোছোর - পেশাদার মাংস কাটেন যারা
পানিকুমড়া - চালকুমড়া
চেনা - চালকুমড়া লম্বা লম্বা পাতলা করে কেটে রোদে শুকিয়ে কৌটোয় ভরে রাখা হয় সারাবছর খাওয়ার জন্য।
আপরুক মোঙ্গা - মূল্যবান অথচ পরিমানে অল্প।