দাঁড়াবার জায়গা/সাতাশ
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
লোকটা
কালো, ছিপছিপে। অনেকটা লম্বা। গায়ে কালো রঙের ফুল স্লিভ জামা আর কালো
প্যান্ট। মাথায় চুলের বাবড়ি। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে।
চোখ দুটো অসম্ভব উজ্জ্বল। দারুণ আকৰ্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। অনৰ্গল কথা বলে
চলেছে। তাকে ঘিরে একটা বৃত্তের চারপাশে নানা বয়সের মানুষ বসে আছে। তাদের
পেছনে বাকিরা দাঁড়িয়ে। দু-তিনটে সারিতে শেষের দিকে যারা সকলেই দীৰ্ঘদেহী।
ফলে, বৃত্তের বাইরের দিকে দাঁড়িয়ে প্ৰায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অতএব, ভিড়
ঠেলে সামনে আসতে হয়েছে। বৃত্তের মাঝখানে মাটিতে পড়ে আছে একটা কালো রঙের
ব্যাগ, বেশ বড়সড়। হাত দুয়েক দূরে একটা কাঠের বাক্স, বহু ব্যবহারে কালচে
হয়ে এসেছে। সেই বাক্সের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা আছে একটা কালো মতন পুতুল, বা ওই
রকম কিছু। পুতুলটার লিকলিকে শরীর মূলত কালো সুতো দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে
প্যাঁচানো। চোখে পুঁতি বসানো মনে হয়। পুতুলের পা থেকে মাথা অবধি আট-দশ
ইঞ্চি হবে হয়ত। বিস্ময় নিয়ে মুগ্ধ চোখে সব দেখছি। লোকটা তার সামনে বসে থাকা
একজনকে একটা লেবু কিনে আনতে বলে তার হাতে পয়সা গুঁজে দিলো। লোকটা ছুটে
গিয়ে লেবু নিয়ে এল। লোকটা কখনও হিন্দি বলছে, কখনও বাংলা বলছে, হঠাৎ হঠাৎ
দুয়েকটা ইংরেজি বাক্যও বলছে। সে ব্যাগ থেকে একটা ধারালো চকচকে ছুরি বের
করল। লেবুটাকে আড়াআড়ি কেটে একটা টুকরো উপুড় করে মাটিতে ঠেসে ধরে কী কী
সব আওড়াতে থাকল। একজনকে বলল, লেবুর টুকরোর ওপরে আঙুল দিয়ে চেপে ধরতে। একজন
তার নিৰ্দেশ শুনে লেবুর টুকরোর ওপরে তৰ্জনী ছুঁইয়ে রাখল। লোকটা এবারে
নিৰ্দেশ দিল লেবুর টুকরোর ওপরে একটু বেশি চাপ দিতে। আর, কী বিস্ময়, কী
বিস্ময়! লেবুর টুকরোর নীচ থেকে তীব্ৰ বেগে বেরিয়ে আসতে থাকল আগুনের লকলকে
শিখা। এই শিখা অনেকটা ঝালাই মিস্ত্ৰির কাজের সময় যেমন ঠিকরে বেরিয়ে আসে,
তেমনই। সেই সঙ্গে ঘন ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠতে থাকল। সকলের চোখ তখন
বিস্ফারিত। এরপরেই লোকটা বেশ চেঁচিয়ে ঘোষণা করল, ‘বাচ্চালোগ দূর হটো’। আমরা
কয়েকজন হুড়মুড় করে ভিড় ঠেলে বেরচ্ছি। পেছনে লোকটার আওয়াজ পেলাম, ‘এরপর
আমার মুখে আর কিছু আটকাবে না। যার পোষাবে থাকবেন, যার পোষাবে না, চলে যান’।
আমাদের
চলে যাওয়াটা কোনও ব্যাপারই নয়। কারণ, ভিড় ঠেলে বাইরে আসতেই ভালুকের নাচ!
ওপাশে নাগরদোলা। একটু দূরে জেমিনি সাৰ্কাসের তাঁবু। আমরা মাঠের মাঝখানে।
তার চারপাশে চোখ ধাঁধানো সব আয়োজন। মৃত্যুকূপ, স্বপনকুমারের জাদু, সারি
সারি খাবারের দোকান। কত কত খেলনার দোকান। ডুগডুগি, বাঁশিওয়ালাদের মোহন
আহ্বান। কত্ত মানুষ ঘোরাফেরা করছে। কেউ কোথাও যাচ্ছে না, সকলেই এদিক থেকে
ওদিকে অথবা ওদিক থেকে এদিকে ক্ৰমাগত হেঁটে চলেছে। আমরা কয়েকজনও হাঁটছি।
হাঁটু অবধি ধুলো। কিসের পরোয়া! কিন্তু স্কুলের নিঃশব্দ আহ্বান উপেক্ষা
অসম্ভব। অতএব, গুটি গুটি স্কুলে। রাসমেলার মাঠের ওপারেই তো স্কুল। আর,
স্কুলের দুপাশের দুই গেটের বাইরেই তো রাসমেলার দোকানপাট, সহস্ৰ মানুষের
ভিড়। সে এক উৎসব। চারপাশে মাইকের তারস্বরে চিৎকার। কোনও মাইকে হয়ত গান
বাজছে, কোনও মাইকে নানা ঘোষণা। একাধিক জায়গায় লটারির দোকান। পঁচিশ পয়সার
বিনিময়ে বন্দুক দিয়ে বেলুন তাক করার মজা।
মেলার
মাঠের গায়ে নৃপেন্দ্ৰনারায়ণ স্কুল, তার পাশে, সামনে কত দোকান। সামনের দিকে
ডুগডুগি বানাচ্ছে কিছু অদ্ভুত মানুষ। তারা অদ্ভুত পোশাক আশাকে সজ্জিত।
ছোট্ট তাঁবুতে তাদের ঘরসংসার। শুনেছি, লোকগুলো যাযাবর। তারা সারা বছরই ঘুরে
ঘুরে বেড়ায়, মেলা থেকে মেলায়, এক হাট থেকে অন্য হাটে। পথেই নাকি তাদের
জীবন। ইস, এরকম একটা জীবন যদি সম্ভব হতো! মনে পড়ে যায়, ‘ইহার চেয়ে হতেম
যদি আরব বেদুইন’। কল্পনার চোখে জীবন্ত হয়ে উঠত মরুভূমি, খেজুর গাছ, উটের
সারি, মরীচিকা। অদ্ভুত, রঙিন পোশাকে সজ্জিত যাযাবরদের মেয়েরা কী ভীষণ রঙিন।
হাত ভৰ্তি রঙিন চুড়ি। পায়ে তাদের রুপোর ভারী মল। লাল-সবুজ-মেরুন-হলুদ
রঙের জামা তাদের গায়ে। তাদের ঘাগড়ার ঢেউয়ে, নাকের গয়নার ঝিলিকে কেঁপে উঠত
আমাদের বিশ্বভুবন। কী যে ভাল লাগত তাদের। তারা নিজেদের মধ্যে গভীর মনোযোগে
কথা বলত, হাসত, হাসতে হাসতে ঢলে পড়ত পরস্পরের গায়ে। কী কথা হতো তাদের
মধ্যে সে এক রহস্য, সে রহস্যের হদিশ পাইনি কখনও। আমাদেরই সমবয়সী মেয়েগুলো
কেমন স্বাধীন। সারা দেশ তারা ঘুরে বেড়ায় বছর ভর। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমরা
তাদের দেখতাম। হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে যেত, তখন তাদের কাজলকালো আয়ত উজ্জ্বল
চোখগুলো আমাদের জরিপ করত। অনেকের মধ্যে কাউকে বিশেষ মনে হতো। তার প্ৰতি হয়ত
মনোযোগ বেড়ে যেত। তখন সেই বিশেষের হাসিতে নেশা লাগত। হালকা হাসির রেখা
ফুটে উঠত আর গালে টোল পড়ত তার, দুচোখে কৌতুক। তারা কী এখনও মেলায় মেলায়
ঘুরে বেড়াচ্ছে? অথবা, এতদিনে সন্তানসন্ততি নিয়ে তারা থিতু হয়েছে কি? কী
জানি! তারা কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে আমাদের কৈশোর, হারিয়ে
গেছে সেই সব স্বপ্নের দিন, স্বপ্নের কাল।
লক্ষ্মী
পূৰ্ণিমার ঠিক পরেই রাসপূৰ্ণিমা। রাসপূৰ্ণিমাতেই রাস উৎসব। সেই সময়ের
কোচবিহারে রাসের উৎসবকে কেন্দ্ৰ করে মেলা – সে এক বিশাল আয়োজন। সে-সময়ে
টানা পনেরোদিন ধরে মেলা বসত। বড়দের মুখে শুনেছি, আগে নাকি একমাস ধরে মেলা
চলত। প্ৰত্যন্ত গ্ৰামাঞ্চল থেকে মানুষ সপরিবারে আসত গরুর গাড়িতে। গরুর
গাড়িতে তারা হাঁড়ি, কড়াই, উনুন – সব নিয়ে আসত। আমাদের শৈশব, কৈশোরেও
দেখেছি জেলখানার সামনে থেকে নৃপেন্দ্ৰনারায়ণ স্কুল অবধি রাস্তার দুপাশে
অনেক গরুর গাড়ি। সেখানেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে মাটিতে বিছানাপত্ৰ বিছিয়ে পুরো
সংসার। গরুর গাড়ির পেছন দিকে ঝুলে থাকত লণ্ঠন। আমরা দিনের বেলায় দেখেছি
বলেই সেই লণ্ঠনে আলো থাকত না। আমরা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখতাম।
কাছাকাছি বেঁধে রাখা গরুর গলায় বাঁধা ঘণ্টা থেকে মিষ্টি আওয়াজ উঠত।
সময়টা
আমাদের পক্ষে সুবিধের ছিল না। মেলার উৎসব চলাকালেই আমাদের পরীক্ষা থাকত।
তারই মধ্যে অবশ্য দু-চারদিন পেয়েও যেতাম। বাইরে রাসমেলার তুমুল হইচই, আর
আমরা তখন পরীক্ষা দিচ্ছি। ফলে, মন বসত না। কোনও রকমে পরীক্ষা শেষ করেই
বেরিয়ে পড়তাম। আমি আর তাপস সেদিন দ্ৰুত পরীক্ষা শেষ করেই মেলায় ছুটলাম।
সাধারণত না থাকলেও, সেদিন আমার পকেটে সামান্য পয়সা আছে। তাপসের পকেটে
প্ৰায়ই কিছু টাকা থাকেই, দেখেছি। বাড়ি থেকে সে নিয়মিত পকেটমানি পেত
সম্ভবত। স্কুল থেকে বেরিয়েই আমরা সোজা মেলার মাঠে ঢুকে পড়ি। পিডব্লুডি
অফিসের সামনের এক দোকান থেকে মশলাদার চানাচুর কিনে খেতে খেতে আমরা এগিয়ে
যাই। মেলার মাঠে ধুলো উড়ছে। সেই ধুলোয় আমরা ধুসরিত। মেলায় উপচে পড়ছে
ভিড়। আমরা দুই বন্ধু প্ৰায় হাত ধরাধরি করে দু সারি দোকানের মাঝ বরাবর
হেঁটে চলেছি। চোখের আর বিশ্ৰাম নেই, দৃশ্যের পর দৃশ্য পাল্টে পাল্টে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা এক জায়গায় এসে দাঁড়াই, জায়গাটা ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের
মাথার মতো। ডাইনে-বাঁয়ে চলে গেছে রাস্তা। আমাদের সামনে নাগরদোলা। তার পাশেই
মৃত্যুকূপ। ওপাশে আরেকটা নাগরদোলা, সেটা বোধহয় ছোটদের জন্য। সেটা চক্ৰের
মতো ঘোরে। আমরা সেদিকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। আমি
কোনওদিন নাগরদোলায় চড়িনি। কিন্তু, ছোটদের নাগরদোলায় চড়বার মতো বালখিল্য
ব্যাপারে আগ্ৰহ নেই। আসলে, এই অনাগ্ৰহ জোর করে প্ৰমাণের চেষ্টা আমাদের
উভয়েরই। তাপস বলল, ‘কোনওদিন নাগরদোলায় চড়েছিস’? আমি বললাম, ‘না’। ও জানাল
মাত্ৰ একবারই ও চড়েছে। ও বলল, ‘চল, ওই নাগরদোলায় চড়ি’। আমি ইতস্তত করছি।
কারণ যে নাগরদোলায় চড়বার কথা ও বলছে সেটা রীতিমতো ভীতিজনক। বিশাল একটা
চাকায় পর পর অনেকগুলো চেয়ার লাগানো। চেয়ারগুলো এমনভাবে লাগানো যে, বিশাল
চাকাটা ঘুরতে থাকলেও চেয়ারগুলো মাটির সঙ্গে খাড়াভাবে থাকে। নইলে তো চেয়ার
উল্টো হয়ে বসে থাকা মানুষগুলো পড়ে যেত।
দেখছি, আগের
বার যারা উঠেছিল তার একে একে নেমে যাচ্ছে। মানে, ফের নতুন করে লোক বসবে
সেখানে এবং ফের শুরু হবে নাগরদোলার ঘোরা। তাপস জিজ্ঞেস করল, ‘ভয় পাবি না
তো’? আমি চুপ করে থাকি। বুঝতে পারি না, কী বলা উচিত। একটু যে আগ্ৰহ হচ্ছে
না তা নয়। সঙ্গে ভীতিও কাজ করছে। একটু ইতস্তত করলেও রাজি হয়ে গেলাম। টিকিট
কেনা হলো। আমরা গেট দিয়ে ঢুকলাম ঘেরা জায়গাটায়। কিছু চেয়ার এরই মধ্যে ভরে
গেছে। একেকটা চেয়ারে দুজনের বসার আসন। চাকাটা একটু একটু করে ঘুরিয়ে মাটির
কাছে নিয়ে আসা হচ্ছে। দুজন বসার পর ফের খানিকটা ঘুরিয়ে পরের চেয়ারটাকে
মাটির কাছে নিয়ে আসা হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে আমরাও একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। সঙ্গে
সঙ্গেই একটু ঘুরিয়ে পরের চেয়ারটাকে মাটির কাছে নামিয়ে আনা হলো। এভাবে একটু
একটু করে ভরে গেল সব চেয়ার। এই প্ৰক্ৰিয়াটা চলাকালে আমরা একটু একটু করে
ওপেরর দিকে উঠে যাচ্ছিলাম। তখন নাগরদোলায় বসে দেখছিলাম আমাদের পায়ের তলায়
পুরো মেলা চত্ত্বর। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। এরই মধ্যে মেলায় দোকানে দোকানে
জ্বলে উঠেছে আলো। লাল নীল সবুজ হলুদ রঙের আশ্চৰ্য মায়ার চাদরে ঢেকে গেছে
বিস্তীৰ্ম চত্ত্বর। চারপাশে অসংখ্য মাইকের প্ৰবল চিৎকার। সহস্ৰ বাঁশির
আওয়াজে কান ঝালাপালা। অনেক ওপরে উঠে আমরা দেখছি সমগ্ৰ মেলার মাঠ।
আমরা
এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আর নিজেদের মধ্যে গল্প করছি। তাপস বেশ কয়েকবার আমাকে
সতৰ্ক করে দিয়েছে, ‘একদম ভয় পাবি না’। প্ৰথমে যতটা ভয় লাগছিল এখন ততটা
লাগছে না। বরং, ওপর থেকে অনেকটা দেখতে ভালই লাগছিল। কিন্তু, বিধি বাম।
আমাদের কপালে সুখ সইল না! দুই বন্ধু মিলে সামনের রডটা এমনভাবে ধরেছি যে মনে
হচ্ছে সেটা নড়ছে। ফলে, ফের ভয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তবু স্মাৰ্ট থাকার
চেষ্টা চলছে উভয়েরই। আর, ঠিক তখনই, হঠাৎ আবিষ্কার করা গেল ধরার রডটা
একেবারেই আমাদের হাতে এবং সেটা যেখানে লাগানো ছিল সেখানে নেই! প্ৰথমে বোধহয়
তাপসের দিকটা খুলে পড়েছে, তারপর আমার দিকটাও! ফলে, আমরা অনৰ্থক একটা রড
ধরে আছি, যেটা আমরা ছেড়ে দিলেই নীচে খসে পড়বে! সব কটা আসন ভরে গেছে বলে
নাগরদোলা ঘুরতেও শুরু করেছে। চোখ বন্ধ করে ফেলেছে তাপস। সে উচ্চস্বরে
বিরতিহীন বলে যাচ্ছে, ‘বাবা নাম কেবলম’, ‘বাবা নাম কেবলম’, ‘বাবা নাম
কেবলম’! আমি কী বলব বা আদৌ কিছু বলব কিনা বুঝতে পারছি না। মেরুদণ্ড বেয়ে
নেমে যাচ্ছে বরফের স্ৰোত। শুধু বুঝতে পারছি, ওপরে ওঠার সময় একরকম বসে থাকা
যাচ্ছে, কিন্তু যখন নেমে আসছি মনে হচ্ছে অতল গভীরে পড়ে যাচ্ছি।
আসলে, ভয় আরও গভীর ও ব্যাপক ভয়ের জন্ম দেয়। সেটা বুঝেছি কদিন পরেই ফের একবার নাগরদোলায় চড়ার পরই। ‘ভয় করলেই ভয়, নইলে কিছু না’!