সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
35.চা-ডুবুরী-৩৫/সুকান্ত নাহা

35.চা-ডুবুরী-৩৫/সুকান্ত নাহা

34.চা-ডুবুরী-৩৪/সুকান্ত নাহা

34.চা-ডুবুরী-৩৪/সুকান্ত নাহা

33.চা-ডুবুরী-৩৩/সুকান্ত নাহা

33.চা-ডুবুরী-৩৩/সুকান্ত নাহা

32.চা-ডুবুরী-৩২/সুকান্ত নাহা

32.চা-ডুবুরী-৩২/সুকান্ত নাহা

31.চা-ডুবুরী-৩১/সুকান্ত নাহা

31.চা-ডুবুরী-৩১/সুকান্ত নাহা

30.চা-ডুবুরী-৩০/সুকান্ত নাহা

30.চা-ডুবুরী-৩০/সুকান্ত নাহা

29.চা-ডুবুরী-২৯/সুকান্ত নাহা

29.চা-ডুবুরী-২৯/সুকান্ত নাহা

28.চা-ডুবুরী-২৮/সুকান্ত নাহা

28.চা-ডুবুরী-২৮/সুকান্ত নাহা

27.চা-ডুবুরী-২৭/সুকান্ত নাহা

27.চা-ডুবুরী-২৭/সুকান্ত নাহা

26.চা-ডুবুরী-২৬/সুকান্ত নাহা

26.চা-ডুবুরী-২৬/সুকান্ত নাহা

25.চা-ডুবুরী-২৫/সুকান্ত নাহা

25.চা-ডুবুরী-২৫/সুকান্ত নাহা

24.চা-ডুবুরী-২৪/সুকান্ত নাহা

24.চা-ডুবুরী-২৪/সুকান্ত নাহা

23.চা-ডুবুরী-২৩/সুকান্ত নাহা

23.চা-ডুবুরী-২৩/সুকান্ত নাহা

22.চা-ডুবুরী-২২/সুকান্ত নাহা

22.চা-ডুবুরী-২২/সুকান্ত নাহা

21.চা-ডুবুরী-২১/সুকান্ত নাহা

21.চা-ডুবুরী-২১/সুকান্ত নাহা

20.চা-ডুবুরী-২০/সুকান্ত নাহা

20.চা-ডুবুরী-২০/সুকান্ত নাহা

19.চা-ডুবুরী-১৯/সুকান্ত নাহা

19.চা-ডুবুরী-১৯/সুকান্ত নাহা

18.চা-ডুবুরী-১৮/সুকান্ত নাহা

18.চা-ডুবুরী-১৮/সুকান্ত নাহা

17.চা-ডুবুরী-১৭/সুকান্ত নাহা

17.চা-ডুবুরী-১৭/সুকান্ত নাহা

16.চা-ডুবুরী-১৬/সুকান্ত নাহা

16.চা-ডুবুরী-১৬/সুকান্ত নাহা

15.চা-ডুবুরী-১৫/সুকান্ত নাহা

15.চা-ডুবুরী-১৫/সুকান্ত নাহা

14.চা-ডুবুরী-১৪/সুকান্ত নাহা

14.চা-ডুবুরী-১৪/সুকান্ত নাহা

13.চা-ডুবুরী-১৩/সুকান্ত নাহা

13.চা-ডুবুরী-১৩/সুকান্ত নাহা

12.চা-ডুবুরী-১২/সুকান্ত নাহা

12.চা-ডুবুরী-১২/সুকান্ত নাহা

11.চা-ডুবুরী-১১/সুকান্ত নাহা

11.চা-ডুবুরী-১১/সুকান্ত নাহা

10.চা-ডুবুরি-১০/সুকান্ত নাহা

10.চা-ডুবুরি-১০/সুকান্ত নাহা

9.চা-ডুবুরি-৯/সুকান্ত নাহা

9.চা-ডুবুরি-৯/সুকান্ত নাহা

8.চা-ডুবুরি-৮/সুকান্ত নাহা

8.চা-ডুবুরি-৮/সুকান্ত নাহা

7.চা-ডুবুরি-৭/সুকান্ত নাহা

7.চা-ডুবুরি-৭/সুকান্ত নাহা

6.চা-ডুবুরি-৬/সুকান্ত নাহা

6.চা-ডুবুরি-৬/সুকান্ত নাহা

5.চা-ডুবুরি-৫/সুকান্ত নাহা

5.চা-ডুবুরি-৫/সুকান্ত নাহা

4.চা-ডুবুরি-৪/সুকান্ত নাহা

4.চা-ডুবুরি-৪/সুকান্ত নাহা

3.চা-ডুবুরি-৩/সুকান্ত নাহা

3.চা-ডুবুরি-৩/সুকান্ত নাহা

2.চা-ডুবুরি-২/সুকান্ত নাহা

2.চা-ডুবুরি-২/সুকান্ত নাহা

1.চা-ডুবুরি-১/সুকান্ত নাহা

1.চা-ডুবুরি-১/সুকান্ত নাহা

07-December,2022 - Wednesday ✍️ By- সুকান্ত নাহা 465

চা-ডুবুরী-২৭/সুকান্ত নাহা

চা-ডুবুরি/ পর্ব : ২৭
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^
                             
দুলে ওঠা নোনামাটি
---------------------------

কলকাতায় ফিরে যাওয়ার পর সুবর্ণর দৈনন্দিন ব্যস্ততার ফাঁকে টুকরো কাগজের মতো শ্রাবস্তী উড়ে এসেছে এলোমেলো। উড়ে এসে মনের উঠোন ছুঁয়ে ফের হারিয়ে গেছে দিকশূন্য হাওয়ায়। কখনও বা বৃষ্টিভেজা বাতাসে বুনো লতার মতো দোল খেয়েছে। শুকনো পাতায় চকিত জল ঝরিয়ে পরক্ষণেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। তবু সেই রাতের পর শ্রাবস্তী সুবর্ণর সামনে এক উত্তর-না-জানা হেঁয়ালি প্রশ্নচিহ্ণের মত রয়ে গেছে। কখনও মনে হয়েছে শ্রাবস্তী যেন এক বর্ণময় প্রজাপতির মতো ডানার বিভঙ্গে সম্মোহিত করে টেনে নিয়ে গেছিল অদ্ভুত এক প্রহেলিকাময় বৃত্তের বাইরে। অন্তর্বৃত্তে যে প্রহেলিকা ঢাকা রহস্যপথ সুবর্ণর কাছে ভীষণ অচেনা। এই প্রথম খুব কাছ থেকে সুবর্ণ এমন একটি নারীকে দেখল, যে নারী ব্যতিক্রমী চেতনার মানবী। তবু বুকের ভেতরে কোথাও যেন তার একটি কপাটবন্ধ অভিমানী ঘর রয়েছে । যে ঘরের দরজায় ঝুলে থাকা তালা আজও কোনও অদ্বিতীয় চাবির স্পর্শে কেঁপে ওঠেনি। সেই প্রার্থিত স্পর্শের আশায় বয়ে গেছে তার তিন দশকের তৃষিত যাপন। সেই যাপনক্লান্ত শরীর ও মন একদিন ঠিক খুঁজে পায় সমাজ নির্ধারিত চেনাছকের বাইরে এক অন্যতর ভালোবাসা। নিজের মতো করে চাওয়া সেই ভালোবাসাতেই হয়ত ছিল তার মুক্তির আনন্দ। 

প্রজাপতিটা উড়ে এসে ফের পাখা দোলাতে লেগেছিল কনফার্ম না করা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটার ওপর। সেই মুহুর্তে সুবর্ণ তার স্মৃতিছায়ায় ঘেরা স্কুল বাড়িটার বাইরে একান্তে গাছের ছায়ায় বাইকে হেলান দিয়ে বসে মোবাইল স্ক্রল করছিল । করতে গিয়েই চোখটা আটকে যায় । দুদিন কেটে যাওয়ার পরেও রিকোয়েস্টটা কনফার্ম করা হয়নি। অথচ কেন এমন হল! রিকোয়েস্টটা পেয়েই তো গ্রহণ করা যেত। তবু কেন আটচল্লিশটা ঘন্টা প্রতীক্ষায় রেখে দেয়া তাকে! এর পেছনে কি কোনও দ্বিধা কাজ করছে! নাকি কোথাও একটা চাপা অস্বস্তি রয়েছে। বেপরোয়া ধরনের একটি মেয়ে যে খুব সহজেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারে নিঃসংকোচে, সেই ভাললাগা সুগন্ধি মৃদু বাতাসই কি ঝড় হয়ে উঠতে পারে জীবনে! ওলটপালট করে দিতে পারে তূর্ণার সাথে তার এতদিনের নিবীড় বন্ধন! সেই ভেবে? নাকি সেই রাতে শ্রাবস্তীর অকপট স্বীকারোক্তি শুনে সহসা প্রচন্ড ঝাঁকুনি লাগার ট্রমা কাটিয়ে উঠতে না পারাটাও একটি কারণ। পরক্ষণেই সুবর্ণর  মনে হয় এসব আসলে কিছুই নয়, মোদ্দা কারণ হচ্ছে গড়পড়তা বিবাহিত মধ্যবিত্তের আটপৌরে মানসিকতার সেফ-জোন ছেড়ে বেরিয়ে এসে একটি মেয়ের সহজ বন্ধুত্বকে গ্রহণ করার সাহসটাই হয়ত তার নেই। কোথাও কি সেই দোলাচলটাই তবে মনের ভেতর পেন্ডুলামের মতো দুলে চলেছিল দুদিন যাবৎ! 

ভাবতে ভাবতেই সুবর্ণ আঙুল ছোঁয়ায় শ্রাবস্তীর ফেসবুক প্রোফাইলে। লেখাপড়ার শুরুটা আসামে। তারপর পুরোটাই প্রায় কলকাতায়। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের পর কলকাতা ও ভুবনেশ্বরে কিছুকাল অস্থায়ী  শিক্ষকতা শেষে বর্তমানে কলকাতার  একটি নামি কলেজে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা। টাইমলাইন জুড়ে চমৎকার কিছু ল্যান্ডস্কেপ, আর বিচিত্র পেশার সব মানুষের ছবি। এছাড়াও সাম্প্রতিক পাহাড় ভ্রমণের কিছু ছবি। ফটো-আপলোডে নিজের ছবি বলতে কেবল মাত্র দুটি। একটি সহাস্য অর্ধাবয়ব, যেটা প্রোফাইলে। অন্যটায় পাশে একটি মেয়ে। এ যে নির্ঘাত সেই মেয়ে, সুবর্ণর বুঝতে অসুবিধা হয় না। যে  তাকে একদিন 'জাগিয়ে' তুলতে পেরেছিল সত্যিকার ভালবাসা দিয়ে। সেই জাগিয়ে তোলা কি শুধুমাত্রই শারীরিক! নাকি মনও ছিল তাতে। আর ছিলই যদি তবে মেয়েটি ওকে ছেড়েই বা গেল কেন। তবে কি শ্রাবস্তী একতরফাই তাকে ভীষণ ভাবে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল!  আর সে কারণেই কি বস্তুগ্রাহ্য জীবনের বলয় থেকে হারিয়ে গেলেও পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি গ্রাহ্যহীনতার এই অলীক পৃষ্ঠা থেকে। নানান প্রশ্ন বেচাল ভোমরার মতো ঠোক্কর দিতে থাকে সুবর্ণর মনের দেয়ালে। 

চলে যাওয়ার দিন ন্যান্সি শ্রাবস্তীকে ছেড়ে আসতে গেছিল নিউ মাল জংশনে। ন্যান্সির সাথে ওর সুন্দর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ক'দিনেই। পরকে দ্রুত আপন করার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে মেয়েটার। ন্যান্সিও চট করে মিশে যেতে পারে। যেকারণে খুব সহজেই তারা বন্ধু হতে পেরেছে। ওকে সঙ্গে নিয়ে শ্রাবস্তী সেদিন কিছু কেনাকাটা করেছিল । ফিরে এসে রাতে সুবর্ণকে ফোন করে ন্যান্সি, 

-" আঙ্কল, শ্রাবস্তীদি আপনার জন্য একটি গিফট পাঠিয়েছেন। কাল নিয়ে আসব। "

পরদিন প্যাকেটটা হাতে পৌঁছয় সুবর্ণর। গোল্ড প্লেটেড ধাতুর তৈরি সুন্দর এক বুদ্ধ মূর্তি। শান্ত, সমাহিত, ধ্যানমগ্ন। খানিক বাদে টেক্সট মেসেজটাও ঢোকে,

-"বন্ধুত্বের স্মৃতিচিহ্ণ হিসেবে আশা করি ওটা গ্রহণ করবেন। সেদিন রাতে আপনাকে বড় বিব্রত করেছি। আসলে সেই রাতের পরিবেশটাই বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল আমার সাথে। ওরকম একটা পরিবেশে আপনার মত বিশ্বস্ত কাউকে পেয়ে নিজেকে সেদিন সামলাতে পারিনি।  কাউকে না বলতে পারা কথাগুলো উজাড় করে দিয়ে হালকা হতে চেয়েছিলাম আপনার কাছে। আমি লজ্জিত। পারলে ক্ষমা করে দেবেন। আপনার সহযোগিতা মনে থাকবে চিরদিন। ভাল থাকবেন। আর হ্যাঁ, আপনার জন্মস্থান সেই সুন্দরী স্বপ্নপুর, এখনও চোখে ভাসছে। স্বপ্নপুর সত্যিই স্বপ্নের মতো। কত না-বলা-কথা জমে রয়েছে স্বপ্নপুরের বুকে। লিখুন না, স্বপ্নপুরের ইতিহাসের ওপর একটি উপন্যাস। সত্যি বলছি, খুব সুন্দর হবে। যদি কখনও আবার যাই, সঙ্গে টেন্ট ক্যারি করব। একটি জোৎস্নালোকিত রাত কাটিয়ে আসব স্বপ্নপুরের বুকে, জলঢাকার তীরে। সঙ্গে আপনি থাকবেন তো? ঘাবড়াবেন না, অবশ্যই বৌদিকেও সাথে নেব...। ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাব। যদি আমাকে বন্ধু করার যোগ্য মনে করেন তবেই গ্রহণ করবেন।"  প্রত্যুত্তরে ছোট্ট একটা ধন্যবাদ জানানো ছাড়া আর কিছু লেখেনি সুবর্ণ। পরদিন শ্রাবস্তী কলকাতায় ফিরে যায়। ওকে ট্রেনে তুলে দিয়ে স্টেশন থেকেই বিজন তালুকদারের ফোন করে, 

" সুবর্ণ, কী হল ভাই! তোমার ওখান থেকে ফেরার পর থেকে তো দেখলাম শ্রাবস্তীর মুখে কেবল তোমারই প্রশংসা।  আমার তো ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না হে। আমিও তো কত হেল্প করলাম।কই, আমার কথা তো কাউকে বলেছে বলে শুনিনি। " বলেই হালকা হাসির দমকা হাওয়া ছড়িয়ে দিয়ে বিজনদা ফের বলতে থাকেন, 

"যাক গে, যেটা বলছিলাম শোনো, এইমাত্র ওকে ট্রেনে তুলে দিলাম। তুমি যাদের যাদের কাছে ওকে নিয়ে গেছিলে, যেটুকু তথ্য ও পেয়েছে সেগুলো নাকি ওর খুব কাজে লাগবে। তোমাকে স্পেশাল থ্যাংকস জানিয়ে বলে গেল মেসেজটা কনভে করে দিতে। ওকে বলেছিলাম, সেটা তো তুমিও করতে পারতে। বলে কিনা, আপনি করে দিলে ব্যাপারটা আরো গ্রেসফুল হবে। এনিওয়ে, তোমাকে তাই জানিয়ে দিলাম। ভাল থেকো। পরে কথা হবে।" এটুকু বলেই কলটা কেটে দেন সেদিন বিজনদা। 

ওয়ার্নিং বেল শোনা গেল। স্কুল গেটের বাইরে অভিভাবকদের ভীড়টা ফের থর বাঁধতে শুরু করেছে। তূর্যকে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দিতে এসে কদিন ধরে এই নাটকটাই চোখে পড়ছে সুবর্ণর। সকালে যতক্ষণ না ছেলেগুলো পরীক্ষার হলে ঢুকছে এক একজন অভিভাবক, বিশেষত অভিভাবিকাদের দেখে মনে হচ্ছে যেন দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে ছেলে তাদের জেলে যাচ্ছে।  পরীক্ষা শেষ হওয়ার ফাইনাল বেল পড়ার আগমুহূর্তে তারাই আবার গেটের ওপর এমনভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে যেন   যুদ্ধজয় করে ফিরে আসছে ছেলে। কতক্ষণে কে কার আগে ছেলেকে  দেখতে পাবে তার প্রতিযোগিতা চলে। খুব অস্বস্তিকর মনে হয় সুবর্ণর পুরো ব্যাপারটা। এদের মতো অতটা ওভার- কনসার্নড সে হয়ে উঠতে পারল না কোনও দিনই। যে কারণে কিঞ্চিৎ অনুযোগ রয়েছে তূর্ণার তার প্রতি। মাঝে মাঝেই যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, 

-" অন্য বাবাদের দেখি, ছেলেমেয়েদের জন্য কতটা চিন্তা করে...কত কেয়ারিং, কত ডেডিকেটেড তারা। আর তুমি...স্রেফ টাকার যোগানটুকু দিয়েই খালাস। ব্যস, সব দায় দায়িত্ব শেষ।"

অভিযোগগুলো শুনতে শুনতে ভোঁতা হয়ে গেছে। এখন আর তেমন খোঁচা লাগে না। ছেলের মাধ্যমিকের আগে ছুটি নিয়ে এসে এতদিন বাড়িতে বসে থাকাটাও অর্থহীন মনে হয়েছিল সুবর্ণর । পরীক্ষা তো ছেলে দেবে। সে তো নয়! তাছাড়া তূর্য ভাল ছাত্র। পরীক্ষার প্রস্তুতিও করেছে  ভাল। মানসিক দিক থেকেও যথেষ্ট শক্তপোক্ত। সুবর্ণ তাই ভেবেছিল একটানা ছুটি না নিয়ে মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবে। কিন্তু সে ইচ্ছে প্রকাশ করার আগেই তূর্ণার ফোন চলে এসেছিল। আর এসেছিল একেবারে মোক্ষম সময়ে। সেদিনের সেই রাত পুইয়ে সকাল হতে না হতেই। অফিসে বেরোনোর আগে সুবর্ণ তখন সবেমাত্র কাপে চা নিয়ে বসেছে। তূর্ণার গলায় ছিল অদ্ভুত শীতলতা। সুবর্ণ জানে এই শীতলতাই বড় বিপজ্জনক। সুবর্ণর মনের হদিশ আর স্নায়ুতন্ত্রের আদ্যন্ত জেরক্স কপি কোনোভাবে ওর হাতে চলে এলেই এমনটা হয়। নিজের ওপর একশো শতাংশ আস্থা রেখে এবারে ঠিক 'দুসরা' ফেলবে তূর্ণা, সুবর্ণ জানে। প্রথম ডেলিভারিটা নিরীহ হলেও ঘূর্ণি যথেষ্টই ছিল, 

"- কাল রাতে ফোন বন্ধ রেখেছিলে কেন? "

-" ও-হ্যাঁ, আসলে চার্জ ছিল না। কখন যে পকেটে থাকতে থাকতে বন্ধ হয়ে গেছিল টের পাইনি। "

-" তাহলে রাত পৌনে দুটো নাগাদ ফের নেটওয়ার্কে এসেছিলে কিভাবে?"

মারাত্মক ডেলিভারি। ডিপ ডিফেন্স না হলে নির্ঘাত বোল্ড। তড়িঘড়ি ব্যাকফুটে গিয়ে ব্যাট নামিয়ে ডেলিভারি নির্বিষ করার চেষ্টা করে সুবর্ণ, " বা-বা, তুমি তো দেখছি রীতিমত গোয়েন্দা দীপককুমারের মতো জেরা করছ ! "

-" অতটা নামিয়ে ফেলো না! শার্লক হোমস বললে খুশি হতাম।" 

নড়বড়ে স্ট্রোকে কোনোমতে ঠেকানো গেছে ভেবে সুবর্ণ বলে, 
-" আসলে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ঘড়ি দেখব বলে বালিশের পাশে  ফোনটা খুঁজতে গিয়ে দেখি চার্জ নেই। তাড়াতাড়ি উঠে চার্জে বসাই। তখনই হয়ত..."

-" এই না বললে, পকেটে ছিল। বালিশের পাশে গেল কখন! " শীতলতম অ্যান্টার্কটিক বাতাস বয়ে গেল যেন অপর প্রান্তে। 

-" ঐ তো...ইয়ে, মানে পাশে যেমন থাকে আর কি...খুঁজতে গিয়ে মনে পড়লো ফোনটা পকেটেই রয়ে গেছে। উঠে গিয়ে পকেট থেকে বের... "

কথা পুরো বেরোনোর আগেই  তূর্ণা বলে ফেলে, " কবে আসছ? পরশু থেকে ছেলের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে মনে আছে তো? নাকি সেটুকুও ভুলে মেরেছ? " পুনরায় সেই শীতল সংলাপ। তবে এবারে প্রসঙ্গ ঘুরে গিয়ে একটু চাপমুক্ত হতেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে কোন রিস্ক না নিয়েই স্ট্রেট ব্যাটে খেলে সুবর্ণ, " হ্যাঁ, যাব তো। আজকেই ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিচ্ছি। পারলে আজ, নয়তো কাল বিকেলের মধ্যে পৌঁছচ্ছিই...আচ্ছা,শোনো বাবা কেমন আছে গো? " প্রাণপণে হাওয়ার গতি বদলানোর চেষ্টা করে সুবর্ণ। 

-" যাক, বাবার কথা মনে রেখেছ  তাহলে...দুদিন ধরে তো সময়মতো ফোনটাও করোনি। "

নতুন আরেকটা স্পেল শুরু হতে যাচ্ছিল দেখে সত্বর খেলা শেষ করতে সুবর্ণ মরিয়া হয়ে উঠে বলে, " শোনো, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি বেরোচ্ছি। ছুটি গ্রান্ট হলে জানাব, কেমন..." বলেই কল-কাট। 

আসার আগে ছেলেকে ফোন করে সুবর্ণ জানতে পেরেছিল  তার নিজের স্মৃতি জড়ানো স্কুলেই ছেলের সিট পড়েছে। একমুহূর্ত না ভেবে তূর্যকে বলেছিল, " চিন্তা করিস না। রোজ তোকে সেন্টারে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। "

ছেলে যেন একটু অবাক হয়, " কিন্তু বাবা, আমার তো সাইকেল রয়েছে! আমি পারব চলে যেতে। "

-" সে জানি। কিন্তু এবার আমি বাইকটা নিয়ে যাব। রোজ তোকে একবার করে নিয়ে যাব, একবার আনতে যাব। ওটা আমার স্কুল।সব চেনা আমার। ওখানে আমার এক বন্ধু, ঐ স্কুলের টিচার ঐ স্কুলেই আমরা একসাথে পড়তাম। ওকেও বলে রাখব। তবে হ্যাঁ, মাকে বাইকের যাচ্ছি একথা বলিস না যেন। জানলে এদ্দূর থেকে বাইক চালিয়ে যেতেই দেবে না। "

-" কিন্তু বাবা... " 
-" কোনও কিন্তু নয়, আমি যাচ্ছি, দ্যাটস অল। " সুবর্ণ বেশ জোর দিয়ে বলেছিল ছেলেকে। 

এই সুযোগে কদিন ছোটবেলার স্মৃতিজড়ানো স্কুলে ফের যাতায়াতের  সুযোগ হয়েছে সুবর্ণর। ছেলেকে পৌঁছে দিয়ে হাতে ঘন্টা তিনেক সময় রয়ে যায়। এই ফাঁকে বন্ধুদের ফোন করে খোঁজ নেয় সুবর্ণ,কে কেমন আছে। সকলেই দুপুরে এই সময়টায় কাজে ব্যস্ত থাকে। সান্ধ্যঠেকে দেখা করার কাতর আহ্বান জানায় ওরা। জানালেও আগের মতো দেখা করার সেই উদগ্র ইচ্ছেটা আর জাগে না। মনে হয়, এই তো বেশ, সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইলে কথোপকথনের ভেতরেই  ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব বাঁচিয়ে রাখুক ফেলে আসা অতীতে " বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না' -র সেই ঝলমলে দিনগুলো। দেখা করতে কেন যে অনীহা জাগে, কে জানে! চা-বাগানের বদ্ধ পরিবেশে থেকে থেকেই কি মনট মরে গেছে! সুবর্ণর মনে কোথায় যেন ভাগ্যের প্রতি চাপা অভিমান জাগে। কেননা একমাত্র সে ছাড়া প্রায় সব বন্ধুরাই রয়ে গেছে ভালবাসার এই শহরটাতে। কেউ চাকরি, কেউ ব্যবসা, কেউ বা শুধু ছাত্র পড়িয়েই দিব্যি ভাল রোজগারও করছে। একমাত্র সুবর্ণই ছিটকে গেছে বান্ধব-বৃত্তের বাইরে। 

চাপা মনখারাপ বুকে নিয়ে সুবর্ণ শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্মৃতির গ্রন্থিগুলো উদ্দেশ্যেহীনভাবে ছুঁয়ে আসে। এসে বসে থাকে স্কুলের বাইরে। স্মৃতিময় স্কুল বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে পুরনো দিনগুলোর কথা ভাবে। স্কুল বিল্ডিংটা এখন আর চেনা যায় না। ঝাঁ চকচকে হয়ে উঠেছে। বাইরের বাহারি গেট থেকে শুরু করে ভেতরে প্রায় পুরোটাই আমূল বদলে গেছে। পুরোনো ঘরগুলো খুঁজে পেতে স্মৃতি হাতড়াতে হয়। হেডস্যারের ঘরের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছটা নেই। স্কুলের বাইরে সি আর পি এফ ক্যাম্পটাও উঠে গেছে নাকি ঢেরদিন আগে। স্কুলে আসতে গেলে যে ক্যাম্পটার পাশ দিয়ে আসতে হতো। চোখে পড়তো জওয়ানদের রোজকার জীবনযাত্রা। ডিউটিরত সেপাইয়ের হাতে বেয়নেট লাগানো রাইফেল, ক্যাম্পের ভেতর সারসার ক্যাম্প-কট, ঢাউস ট্রাঙ্ক, দড়িতে ঝোলানো জামাকাপড়, রান্না ঘরের বিশাল বিশাল হাঁড়ি, কড়াই, হাতা। স্কুলের কিছু সাহসি ছেলে আগ বাড়িয়ে ওদের সাথে ভাব জমাতো। প্রেয়ার-লাইন মিস করলে ক্যাম্প সংলগ্ন টিনের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হত কখন প্রার্থনা সংগীত হবে। প্রেয়ার শেষ হতেই গেটের গায়ে চৌখুপী দিয়ে সেঁধিয়ে সোজা ক্লাসরুম। পরের দিকে বাহাদুরদা চৌখুপীতে তালা মেরে রাখত। হেডস্যারের কড়া নির্দেশ ছিল। প্রায় তিন কিলোমিটার দূর থেকে কখনও হেঁটে,কখনও কারো সাইকেলের পেছনে চেপে  এসে স্কুলে ঢুকতে এক আধদিন দেরি হয়ে গেলে বিস্তর তেলমর্দন করতে হতো বিশ্বস্ত চৌকিদার বাহাদুরদাকে গেটটা খুলে দেওয়ার জন্য। 

পেছনের বিশাল খেলার মাঠটা  চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। স্কুলের মেরুদন্ড বরাবর নিচে প্রশস্ত চাতাল। ছোটখাটো অনুষ্ঠান করা যায় সেখানে। আড়ে-বহরে অনেকটাই স্বাস্থ্যবৃদ্ধি ঘটেছে স্কুলের।  ভেতরের কম্পাউন্ড জুড়ে বাহারি গাছের সমারোহ। সর্বত্র সবুজ, রঙীন এক মন-ভালো-করা প্রাচূর্যের ছোঁয়া। অথচ এই ঔজ্জ্বল্য টাই সেসময় ছিল না। তবে মাস্টার মশায়রা ছিলেন এক একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। এখন তেমন শিক্ষক কী আছে স্কুলে? খোঁজ নিয়ে জানা গেল পুরনো স্যারদের মধ্যে যে দু চারজন আছেন তারাও অবসরের দিন গুনছেন। সুবর্ণ স্কুল ছেড়ে যাওয়ার সময় তারা ছিলেন টগবগে যুবক। পুরনো স্কুল বাড়ির সেই মেটে হলুদ রঙ, সবুজ জানালা, খোলা ছাদ সব হারিয়ে গেছে। ভীষণ টানতো যে চিলেকোঠার নির্জন ঘরটা যেখানে কাউকে উঠতে দেখলেই হেডস্যার রেগে যেতেন খুব, সেই ঘরটাও হারিয়ে গেছে। আবছায়া টানেলের মত জায়গা পেরিয়ে ক্লাস সিক্সের স্যাঁতসেতে গন্ধমাখা ক্লাসরুমের দিকে যেতে হতো। ঘরটা কি আজও সেরকম আছে? খুব জানতে ইচ্ছে করে সুবর্ণর। লাইব্রেরী রুম, কেমিস্ট্রি ল্যাব, যেখানে অসাবধানে ঘন নাইট্রিক অ্যাসিডের বোতল  উল্টে  দিয়ে শ্যামল স্যারের ধমক খেতে হয়েছিল। ইলেভেন আর্টসের রুমে সোমেনবাবুর নির্দেশনায় নাটকের রিহার্সাল, পেছনের মাঠে ফুটবল...টোটনদার ড্রিবলিং...নুইনাদার গোলকিপিং, বাঁশিমুখে পৃথুল মণীষস্যারের মাঠময় ছুটোছুটি। টিফিন পিরিয়ডে গরমে ফাগুদার আইসক্রিম, শীতকালে ছোলামাখা, বনকুল, আচার। রাস্তা পেরিয়ে ওপারে দিদিমার গাছের লাল পেয়ারা। শীতকালে সামনের ক্লাব-মাঠে ক্রিকেট। লাগোয়া বেকারি থেকে পাউরুটি সেঁকার গন্ধ ভেসে আসা। শয়ে শয়ে স্মৃতি স্কুল বাড়িটাকে ঘিরে। 
একসময় স্কুলের পশ্চিম দিকে নাকি কাঠের দোতলা হস্টেল ছিল। সত্তরের অরাজকতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছিল ঘরগুলো।  মামাদের কাছে সুবর্ণর গল্প শোনা। একবার স্কুল চত্বরের বাইরে সামনের দিকের মাঠঘেঁষে নাকি একটা ফৌজি প্লেন ভেঙে পড়েছিল। দীর্ঘদিন জায়গাটা গর্ত হয়েছিল। এখন কিছুই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। 

একে একে ছেলেরা প্রায় প্রত্যেকেই হাসি হাসি মুখে বেরিয়ে আসছে বাইরে। বেশ চনমনে দেখাচ্ছে ওদের। । কেননা আজই ছিল পরীক্ষার শেষ দিন। কাল থেকে কদিনের টেনশনমুক্তি সকলের। তূর্য ইতিমধ্যে কড়ার্ করিয়ে রেখেছে, পরীক্ষা শেষ হলে হয় দার্জিলিং নয় কলকাতায় পিসির বাড়ি ঘুরিয়ে আনতে হবে। কলকাতায় এখুনি নয়। ভাল রেজাল্ট হলে তবেই পিসির বাড়ির কাছাকাছি রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি, নইলে এখানেই পুরনো স্কুলে রয়ে যেতে হবে। সেকথা সুবর্ণ বলে রেখেছে তূর্যকে । তবে দার্জিলিং ঘরের কাছেই। ভেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু বাবাকে কার কাছে রেখে যাবে সেটাও একটা চিন্তা। গেলে একদিনের জন্য ছেলেকে নিয়ে তাকেই যেতে হবে। তূর্ণার যাওয়া হবে না। যদিও ওর দুবার দার্জিলিং ঘোরা। এ যাত্রায় না যেতে পারলেও হয়ত দুঃখ পাবে না তেমন। তবু সকলে একসাথে যেতে না পারলে... 

-" বাবা...! " তূর্যর ডাকে ফিরে তাকায় সুবর্ণ। প্রায় দৌড়ে আসছে ছেলেটা মাঠ পেরিয়ে। ওর ছুটে আসার ছবিটা বহুবছর আগেকার একটি দৃশ্য মনে করিয়ে দেয়। শেষ দিন ছিল জীবন বিজ্ঞান। পরীক্ষা চলাকালীন মা শুধু আসতে পেরেছিল একদিন পরীক্ষা কেন্দ্রে। সুধাময় আসেন নি। পরীক্ষার আগে শুধু তাঁর একটি চিঠি এসেছিল সুবর্ণর নামে। পোস্টকার্ডে। লেখা ছিল তাতে " ভাল করে পরীক্ষা দিও। মাথা ঠান্ডা রেখে। জানা প্রশ্ন গুলো আগে চেষ্টা করবে। পরীক্ষার দিনগুলোতে রাত জাগবে না। বিশেষ করে অংক পরীক্ষার আগে তো নয়ই। " এরকম বেশ কিছু উপদেশ। শেষদিন হল থেকে বেরিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে গেটের বাইরে বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এভাবেই ছুটে এসেছিল সুবর্ণ। বাবার হাতে প্রশ্নপত্র দিতেই  তিনিও ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিলেন, 

-" কেমন হল? "
-"  ভালো। কাল যাচ্ছি তো, দার্জিলিং? " প্রশ্নেটা যেন তৈরিই ছিল তূর্যর ঠোঁটের ডগায়। 
-" হবে রে বাবা...আগে কোশ্চেনটা তো দেখা...। "
তূর্য প্রশ্নপত্রটা এগিয়ে দেয়। খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে সুবর্ণ বলে, " কত থাকবে মনে হয়? "

-" ভালোই হবে। একটাও ছাড়িনি। জানো, তোমার বন্ধুর আজ গার্ড পড়েছিল আমাদের রুমে। "

- তাই। 
-" হ্যাঁ, বেশ কয়েকবার আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন কী লিখছি। পরীক্ষা শেষ হবার পর যখন খাতা নিচ্ছেন বললেন, কেমন হলো? কত থাকবে আশা করছ...? আচ্ছা উনি কী খুব ব্রিলিয়েন্ট ছিলেন, বাবা ?"

-" হঠাৎ এ কথা? " সুবর্ণ তাকায় ছেলের দিকে। 

-" না, দেখে মনে হল তাই। পড়াশোনায় ভাল বলেই তো  স্কুল টিচার হয়েছেন, তাই না ।  আচ্ছা বাবা, তোমার কত ছিল পার্সেন্টেজ মাধ্যমিকে? " তূর্যর মাঝে মাঝে এই বেয়াড়া প্রশ্নগুলো বেশ বেকায়দায় ফেলে সুবর্ণকে। 

-" ঐ আর কি... ছিল, ভালই...চল উঠে পর তাড়াতাড়ি। " প্রশ্ন এড়াতে ছেলেকে তাড়া দিয়ে বাইক স্টার্ট করে সুবর্ণ। 

-" বললে না তো? ঠিক আছে... বিগ বসকে জিজ্ঞেস করলেই সব
জানতে পারব। অবশ্য মনে আছে কিনা কে জানে। জিজ্ঞেস করলে উল্টে আমাকেই হয়ত নানান উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে পাগল করে ছাড়বে। জানো বাবা, দাদুকে দার্জিলিং নিয়ে যাব বলেছি, শুনে খুব খুশি। নিয়ে গেলে দারুণ হবে তাই না... " পেছনে বসে এক নাগাড়ে বকে যেতে থাকে তূর্য। হুঁ- হাঁ উত্তর করতে করতে বড় রাস্তার ভিড় এড়িয়ে পাড়ার অলিগলি ধরে এঁকেবেঁকে বাইক ছোটাতে থাকে সুবর্ণ। 

রাতের খাওয়া শেষ করে বালিশে হেলান দিয়ে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সিগারেট টানছিল সুবর্ণ। হলরুম ছাড়িয়ে ওপাশে সুধাময়ের ঘর। সেখানে অনেক দিন বাদে আজ দাদুর সাথে শুয়েছে তূর্য। দুজনের আজ অনেক কথা হবে। ওদের  টুকরো কথা, চাপা হাসির আওয়াজ কানে আসছে সুবর্ণর। এত কী কথা বলেন সুধাময় নাতির সাথে কে জানে। স্মৃতির ঘর যার বিপর্যস্ত নাতির সাথে কথা বলতে গেলে তার কোনও স্মৃতিসংকট দেখা দেয় না। বরং সুবর্ণ লক্ষ্য করেছে শৈশবের অনেক কথাই সুধাময় বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে পারেন। বার্ধক্যে শৈশবস্মৃতি নাকি আবার সতেজ হয়ে ফিরে আসে। হলরুমের এককোনে টমি ওর নিজের ম্যাট্রেসের ওপর শুয়ে দিব্যি নাক ডাকছে। তূর্ণা কিচেনের কাজ সেরে ঘরে আসার তোড়জোড় করছে। সামনের জানালার পর্দাটা হালকা সরানো। বাইরেটা থমথমে হয়ে ছিল এতক্ষণ। দু একবার মেঘ ডেকে উঠতেই তেড়ে হাওয়া উঠলো। পর্দা ঠেলে ঠান্ডা হাওয়া ভেতরে ঢুকে শরীরটা জুড়িয়ে দিয়ে গেল। বসন্ত যেতে না যেতেই গরম পড়েছে বেশ। শিলিগুড়িতে এসময় থেকেই পাখা  ঘুরতে শুরু করে। ডুয়ার্সের গরম পড়তে এখনও ঢের দেরী। ইদানীং তবু গরম পড়ে। আগে তো চা-বাগানে কেউ  ইলেকট্রিক পাখা কী বস্তু কেউ জানতো না। সারা বছর কম্বল গায়ে দিতে হতো। এখনও পাখা এলেও একটু বৃষ্টি হলেই চাদর গায়ে দিতে হয়। 

ঘরে ঢুকে তূর্ণা তার নৈশকালীন প্রসাধনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজ প্রায় দশ বারোদিন হল, আসার পর থেকে সুবর্ণ লক্ষ্য করছে তূর্ণা সেভাবে প্রাণখোলা কথা বলছে না। কোথায় যেন একটা তাল কেটেছে মনে হচ্ছে। নিজেকে প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি ব্যস্ত রাখছে। সুবর্ণ একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলেই কাজের অজুহাত দেখিয়ে সরে পড়ছে। আগেও কখনও সখনও এমন করেছে। যৌথযাপনে কোথাও অসাবধানে তালকাটলে, যা সুবর্ণর নজরে পড়ে না কিংবা সে তুচ্ছ, স্বাভাবিক বলে এড়িয়ে যেতে পারে তূর্ণা সেটা পারে না। নিজেকে দিনের পর দিন নরম অথচ দুর্ভেদ্য খোলসে মুড়ে ফেলবে তখন। কারণ জানতে চাইলেও বলবে না। কিছুদিন এভাবে চলার পর হঠাৎ  নিজেই একদিন  ভেঙে ফেলবে সেই খোলসের আস্তরণ। বহু পরে জানা যাবে সেই স্বেছানিবৃত্তির কারণ। হয়ত দেখা গেছে সুবর্ণই অজান্তে কখনও অবহেলা করেছিল। অথবা তার অপছন্দের এমন কোন কাজ করে ফেলেছিল যা আঘাত করেছিল তাকে। 

গালে ক্রিম ঘষতে ঘষতে তূর্ণা হঠাৎ বলে ওঠে " দুদিনের জন্য আমি জলপাইগুড়ি যাব। বাবার শরীরটা ভাল নেই। দেখে আসব। ছেলের পরীক্ষাও শেষ। তুমি কয়েকদিন এখানে থেকে ওদের সামলাও । আমাকে একটু ছুটি দাও এবার।"

সুবর্ণ কোনও উত্তর করে না। হাতে ছুটি আর মাত্র দুদিন। তারপর জয়েন করতেই হবে। এদিকে ছেলে শর্ত দিয়ে রেখেছে দার্জিলিং যাবে।   সুবর্ণ ভালমতই জানে তূর্ণার এই কথাগুলো নেহাৎই তাকে বিচলিত করবার নির্বিষ তির। আদতে কখনই সুধাময়কে ছেড়ে রেখে ও কোথাও যাবে না, সেটা বিলক্ষণ জানে সুবর্ণ। মা মারা যাওয়ার পর থেকে এতগুলো বছর যেখানেই গেছে, সুধাময় সঙ্গে গেছে তূর্ণার। বৃদ্ধ শ্বশুর এখন তূর্ণার আরেকটি সন্তানের মতো। অন্যদিকে নিজের সন্তানের চেয়েও সুধাময় তূর্ণার ওপর বেশি নির্ভরশীল। আপাতত তূর্ণার এই ছদ্ম উদাসীনতার কারণ জানা দরকার। খোলস ভেদ করে মনের হদিস জানতেই হবে আজ রাতে । এই নীরবতা বড় অসহ্য লাগে সুবর্ণর। 

- " তোমার কী রাত হবে ঘুমোতে, তাহলে হলরুমে গিয়ে পড়। আমি ভীষণ টায়ার্ড , আমাকে ঘুমোতে দাও। " তূর্ণার নাইট ক্রিম প্রসাধিত মুখে ফ্লূরোসেন্টের আলোটা পিছলে যাচ্ছে। মাথার চুল পেছন দিকে টানটান করে বাঁধা। পরনে স্লিভলেস গোলাপি রাত পোষাক। এতক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল তূর্ণা। এবারে বালিশটা বুকের কাছে ধরে সামনে এসে দাঁড়ায়। সরাসরি চোখের দিকে বড় বড় আয়ত চোখের স্থিরদৃষ্টি মেলে বলে, " কী হল, কী বললাম শুনতে পেলে। আমি ঘুমোব। তুমি ও ঘরে গিয়ে পড়। "

সুবর্ণ ওঠে না। মুচকি হেসে দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, " এসো, এসো সুন্দরী... আজি এই নিভৃত রজনীতে,এই দুগ্ধফেননিভ শয্যায় তোমার পরম প্রিয়তমর বাহুলগ্না হও।" 

তূর্ণার চোয়াল শক্ত হয়। কয়েক মুহুর্ত স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সুবর্ণর দিকে। তারপর বলে, "ঠিক আছে, তুমি শুয়ে থাকো এঘরে। আমি ওঘরের সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ছি। "

তূর্ণা যেতে উদ্যত হতেই ম্যাগাজিনটা ফেলে ওর বাঁ হাতটা চেপে ধরে সুবর্ণ। তূর্ণা হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে। সুবর্ণ তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা বন্ধ করে বাতিটা নিভিয়ে দেয়। আর ঠিক সেই মোক্ষম মুহুর্তে খুব কাছেই কোথাও বাজ পড়ে প্রচন্ড জোরে শব্দ করে। হাত থেকে বালিশ খসে পড়ে। চমকে উঠে তূর্ণা সুবর্ণকে জাপটে ধরে। শব্দের রেশ থেমে যেতেই বালিশটা তুলে বিছানায় উঠে উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে তূর্ণা। সুবর্ণ জানালাটা বন্ধ করে পাশে এসে শোয়। তারপর তূর্ণার উন্মুক্ত মসৃণ বাহুর ওপর হাত রেখে মুখটা কানের কাছে এনে জিজ্ঞেস করে, "তোমার কী হয়েছে, জান্?"

তূর্ণা কোনও উত্তর করে না। সুবর্ণ মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, "বলবে না, কী হয়েছে?" কোনও সাড়া নেই। এবারে প্রায় জোর করে তূর্ণাকে চিৎ করে দেয় সুবর্ণ। তূর্ণার চোখ বন্ধ। ওর পাতলা ঠোঁটে,গালের পেলব ত্বকে, কপালে নেমে আসা দু এক গাছি পাতলা চুলের ফাঁকে নাইট বাল্বের নীলচে মৃদু আলো নরম হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আবছা আলোয় তূর্ণাকে ভীষণ আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিল । ওর ডানগালের প্রান্তদেশে বরাবর অর্ধবৃত্তাকারে তর্জনী বোলাতে বোলাতে ঠোঁটের ওপর আঙুলটা আনতেই তূর্ণা হাতটা চেপে ধরে। তারপর সেটা সরিয়ে দিয়ে ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করে। সুবর্ণ এবারে হাল্কা বলপ্রয়োগ করে তূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে বলে, "এরকম করছ কেন, বলবে তো কী হয়েছে? "
-" ছাড়ো, আমাকে ঘুমোতে দাও। "
-" না, আগে বল কী হয়েছে। আমার সাথে এরকম করার কারণ কী । বলতেই হবে তোমাকে,হোয়াটস রং উইথ মি! " এবারে গলার স্বরে ইচ্ছে করে ঝাঁঝ আনে সুবর্ণ তূর্ণাকে উত্যক্ত করতে। এটাই একমাত্র পথ একটু তাতিয়ে দিয়ে তূর্ণার কাছ থেকে কথা আদায় করবার। সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া ঘটে। তূর্ণা ফিরে তাকিয়ে বলে, "আগে নিজেকে  প্রশ্ন করো যে তুমি নিজের কাছে কতটুকু সৎ। তারপর জানতে এসো।"

- "মানে!" সুবর্ণ বিস্মিত সুরে বলে

-" মাঝরাতে আর নাটক করো না। শুয়ে পড়।" তূর্ণার গলার স্বরের রুক্ষতা ফুটে ওঠে। 

-" নো, নেভার। তোমাকে বলতেই হবে আমি কী এমন করেছি যে... " কথা শেষ হয় না, তূর্ণা বিছানায় উঠে বসে। তারপর সুবর্ণর চোখে সোজাসুজি দৃষ্টি রেখে বলে, " যে মানুষ স্ত্রীর সাথে মিথ্যাচার করে, তার আর যাই থাক, মেরুদণ্ড নেই। তাকে আমি কাপুরুষ বলে মনে করি।"
-" মিথ্যাচার মানে! "
-" তুমি সেদিন অতরাতে কোথায় ছিলে? আর ঐ মেয়েটি কে, যার কথা তুমি পুরোপুরি চেপে গেছ আমার কাছে? "

সুবর্ণর ভেতর এতক্ষণ ধরে ফুলতে থাকা অনুমানের বেলুনটা এবারে সশব্দে ফেটে যায়। কিছুক্ষণ তূর্ণার দিকে স্থির দৃষ্টিতে  তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চাপা গলায় হেসে উঠতে গিয়ে হাসিটা জোরে হয়ে যায়। সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে সুবর্ণ কৌতুকের স্বরে বলে, "তুমি এতকিছু জানলে কিভাবে? "

-" কেন, জেনে ফেলে খুব মুস্কিলে ফেললাম তাই তো! "
-" মুস্কিল বলে মুস্কিল, ঘোরতর মুস্কিল, দিব্যি চুপি চুপি প্রেম করছিলাম, দিলে তো সব মাটি করে! যাক গে জেনেই যখন গেছ সব বলছি। তার আগে বলো, তুমি জানলে কীভাবে?"

সুবর্ণ জানতে পারে সেই রাতে অনেকবার ফোন করে সুইচড অফ দেখে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল তূর্ণা। বাধ্য হয়ে অতরাতে ও বড়বাবু দিব্যেন্দু রায়কে ফোন করে। বড়বাবুই কেসটা জন্ডিস করে ফেলেছে। পুরো ব্যাপারটা সহজ করার বদলে একটু মশলা ছিটিয়ে মুখরোচক করে তুলেছিলেন এই বলে যে সুবর্ণকে কদিন ধরে একটি মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটি কে তা তিনি জানেন না। বিকেলে তিনি নাকি সুবর্নকে দেখেছেন মেয়েটিকে পেছনে বসিয়ে হাইওয়ে দিকে যেতে। ব্যস, তারপর থেকেই একবুক অভিমান আর একছটাক অবিশ্বাস বুকের মধ্যে এতদিন পুষে রেখে কষ্ট পেয়ে এসেছে তূর্ণা। 

বাধ্য হয়ে একে একে আদত ঘটনার শরীর থেকে সতর্ক হাতে  আবরণ খোলার সুনিপুণ স্ট্রিপ-টিজে মাতে সুবর্ণ। শুনতে শুনতে একসময় স্খলিত মাধবীলতার মতো বালিশে শরীর এলিয়ে পড়ে তূর্ণার।  সুবর্ণর আঙুলগুলো বিলি কাটতে থাকে তূর্ণার চুলে। স্তব্ধবাক তূর্ণা শুধু শুনে যায়। কোনও মন্তব্য করে না। শেষপর্যায়ে পৌঁছে একচিলতে শেষ বস্ত্রটুকু রেখে ঘটনাকে সম্পূর্ণ নিরাভরণ করে পেশ করার চূড়ান্ত অভিনয়ে যখন সুবর্ণ ব্যস্ত, হঠাৎ সে পাশ থেকে একটানা ছন্দোময়, মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়। পাশ ফিরে সুবর্ণ লক্ষ্য করে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা ক্লান্ত তূর্ণার চোখে ঘুম নেমে এসেছে। কথা থামিয়ে তূর্ণার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিশ্চিন্তে পাশ ফেরে সুবর্ণ।  ঘুমে তলিয়ে যায় মুহুর্তে। 

বাইরে তখন তুমুল শব্দে বৃষ্টি নামে। আর ঘরের নীলচে আলো আঁধারির ভেতর ঠিক তখনই অলক্ষ্যে খুলে যায় কারো দৃষ্টিকপাট। ছাদের দিকে স্থির নিবদ্ধ থাকতে থাকতে একসময় সেই  দৃষ্টিকপাটেও ছাট লাগে বৃষ্টির। অজানা মেঘের শব্দে কেঁপে ওঠে বুকে ভেতরটা। কোথাও যেন দুলে ওঠে বিশ্বাসের নোনামাটি।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri