পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ২৬
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
ঘিস ঘিসা ঘিসা ঘিস
গ্রামের
রাত তাও আবার শীতের রাত। সন্ধ্যা হতে না হতেই নিঝুম। ভ্যান চালানো নগেন
গান গাইতে গাইতে আর হর্ণ দিতে দিতে বাড়ি ঢোকার পর রাতটা যেন আরো চুপ হয়ে
গেল। ঝোপে-ঝাড়ে থোকা থোকা অন্ধকার। এখন ফিরবে রতন। হাড়িয়া খেয়ে বকতে বকতে।
তারপর বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই শুরু হবে চিৎকার-চেঁচামেচি। চারদিক নিস্তব্ধ
বলে আওয়াজটা কানে বেশি বাজে। আর একজন ফেরে রাত করে। কিন্তু সে অনেক রাত।
কোনো কোনো দিন দুজন একসঙ্গে হাঁটতে থাকে। অভয় আর বীরেন। গোটা পাড়া ঘুমিয়ে
নিঝুম হলে এরা দুজন কারো ডারিয়া ঘর থেকে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফেরে। অভয়ের বাঁশি
আর বীরেনের দোতারা যেন পরস্পরের সঙ্গে গভীর আলাপে মগ্ন তখন। অভয় আর
বীরেনের বাড়ি এক রাস্তায় নয়। বীরেন মাঝে মাঝেই অভয়কে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার
উল্টো পথে একা একা বাড়ি ফেরে। তবে সেটা কেউ চোখে দেখে না, অনোভব করে।
দোতারা-বাঁশি একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এলেও একটা সময় বাঁশি নিশ্চুপ হয়ে যায়,
একটা দোতারা থার সাথে অস্পষ্ট মানুষের গলার গুনগুন একা ফিরতে থাকে।
এই
দুই দলের মাঝের ফাঁকটায় দুপাশের গাছপালা কাঁপিয়ে, ভাঙা পিচ রাস্তার ধুলো
উড়িয়ে ইটভাটার ট্রাক এসে হাটখোলায় ঢোকে। সারাদিন কাজ শেষে ক্লান্ত,
বিধ্বস্ত মানুষগুলোকে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। একটু হালকা কোলাহল। সামান্য
দু-একটা কথা-বার্তা, হাসি-মস্করা শেষে ক্লান্ত পাগুলো যে যার বাড়ির দিকে
এগোয়।
"কি করেন মাও? বাবা আইচ্চে?"
সুন্দরমণি শোয়ার ঘরের একপাশ লাগোয়া গোয়াল ঘরে কিছু একটা করছিল, কুপি জ্বলছে। ওখান থেকেই উত্তর দেয়,
"না করং কোনো, অ্যায় যে বাছুরটা বান্দির নাগে, থাকির ঘরত নিগাং। দড়িখান
খাটো করি বান্দিলো ক্যাং করি বা নাগাল পায়। সেদিন আইতোত বাছুরে দুধ খায়া
নিসে, ছেকিরে পাই নাই। তারপর থাকি থাকির ঘরতে বান্দি থং। কেনে তে আসিলেন?"
পিঠে একটা বাচ্চা, একটা কোলে। উঠোনে দাঁড়িয়ে মঙ্গলুর বউ একটু ইতস্তত করে। বলে,
"এমনি আসিলুং। বাবা আইচ্চে নাকি। ভাটাখানার গাড়িখান আজি আরো এলাও আইসে।"
সুন্দরমণি গোয়ালঘর থেকেই উত্তর দেয়,
"আজি যে শনিবার। সপ্তাকার বিল দিবে। এতলা লেবার। দেরী হবে আইসতে।"
মঙ্গলুর বউ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
"তোমার ভাতিজা বিল পায়া ওদি হাট করি চাউল টাউল, শাক পিতার আনির কাথা।
ঘরত কোনোয় নাই। ছাওয়ালা ভোকের ত্যানে আতলাছে বারে, নিন পাড়াছোং, নিন্দো না
যায়।"
সুন্দরমণি সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে বলে,
"ওদি পিঁড়াখান নিয়া কোনেক বইসো। দ্যাখো তে, এলানি ইয়ায় আরো পানাছে। ছাড়িয়ে না দে উয়ার মাক।"
কিছুক্ষণের
মধ্যে কানটা ধরে টেনে এনে গলাটা জড়িয়ে ধরে বাছুরটাকে বের করে আনে
সুন্দরমণি। লাল শক্তপোক্ত সুতো দিয়ে বাছুরের গলায় একটা বড় ঘুঙুর বাঁধা।
সেটা এখন বাছুরটির সাথে তালে-বেতালে বাজছে। বাচ্চাদুটো বড় বড় চোখ করে
বাছুরটার দিকে তাকিয়ে। সুন্দরমণি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কুপির আবছা আলোতেই
চোখ নাচিয়ে হাসে।
"কি দাদা, খেলা খেলাবু? কালি দৌড়াইস তো ইয়ার সতে, পাইন না কি?"
বাছুরটাকে শোয়ার ঘরে একপাশে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। বাচ্চা ছেলেটা ভাঙা ভাঙা কচি গলায় বলে,
"উয়ায় ওঠে থাকিবে আবো? উয়ায় কার সতে থাকিবে? উয়ায় কান্দিবে এলায়।"
সুন্দরমণি হেসে বলে,
"উয়ায় কি তোর মতোন কান্দুরা নাকি? না কান্দে।"
তারপর মঙ্গলুর বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে
"আন্দন ঘরতে যায়া বইসো তে, মুই হাতলা ধুয়া আইসোছোং, আখাত কনেক দুধ বসা আছে, ছাওয়ালাক দ্যাং, খাউক।"
মঙ্গলুর বউ ঢোকে না তবু, দাঁড়িয়েই থাকে। সুন্দরমণি পিঁড়ি পেতে ডাকে,
"আইসেক দা, বইস এঠে, বোইনো কো ডেকা।"
বাচ্চাটা
ছুটে পিঁড়িতে বসে। বসে পিঁড়িটা ধরে দুলতে থাকে। মঙ্গলুর বউ মেয়েটাকে পিঠ
থেকে নামিয়ে কোলে নেয়, নিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। রান্নাঘর আর কি, ছোট্ট চালা,
দুটো উনুন, ছোট্ট মেঝে, খেতে বসার জায়গা। সুন্দরমণি উনুনে বসানো হাঁড়ি থেকে
দুধ ঢেলে বাচ্চাদুটোকে খেতে দেয়।
"মাইঘর না খায়? তামাল্লায় যে দেছেন!"
"না খায় ওই তো, পায়া বগরি ছেল্লাইসে, বাড়িরে দুধ, খাও কেনে কোনেক বেশি
করি, দুইদিন খায়া এলা খাবারে না চায়। দুপুরকার ভাত আছিল চাইট্টা, তাকে খায়া
থাকিসে।"
"বই না পড়ে?"
"বই না নিকলাইল। তে ওইলা পড়া না সরা। দোনোঝনে কাকার কূকুর করি নম্ফটা
নিবাইল। আগ উটি দিলুং কয়টা ধরেয়া। ভাত খায়া থাকিল এলায়। নইলে খালি
ন্যাম্ফোর ত্যাল ছোবা যাবে এলায়।"
বাচ্চাগুলোর খাওয়া শেষ হলে মঙ্গলুর বউ বাসনগুলো নিয়ে মাজতে যেতে উদ্যত হলে সুন্দরমণি থামায়।
"নোউক নোউক নোউক। মুই কালি মাঞ্জাইম। আতিত বেশি জলে আনোং নাই। সাকালে এলায় বড়বাড়ির চুয়ার পাড় নিগাইম। হামা ওঠেকারে জল খাই।"
সুন্দরমণি বাচ্চাদুটোর দিকে তাকিয়ে বলে,
"দাদারে, প্যাটটায় ভইল্লেক না। নাই দাদা, কোনোয় খাবার জিনিস নাই।"
তারপর মঙ্গলুর বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
"ভাটিবেলা করি গাইটা ছেকিরে না দে। আজিবা কুনবা পাখে দিল। না হলে তো এখিনাও দিবার না পালুং হয়।"
মঙ্গলুর
বউ অবশ্য খাবারের জন্য আসেনি। জানে সুন্দরমণিদের অবস্থা। আসলে বাড়িতে
বাচ্চাদুটো নিয়ে অস্থির লাগছিল। সময় যেন কাটছিলই না। সেজন্য এখানে এসেছে
একটু বসে থাকতে। বসে থেকে কথা বলে একঘেয়ে ভাবটা অনেকটাই কেটে গেল। শীতের
রাত ক্রমশ ঘন হচ্ছে। ওইটুকু দুধে পেট ভরেনি। বাচ্চাগুলো উসখুস করছে। এমন
সময় ভাটাখানার ট্রাক ঢোকার শব্দ পাওয়া গেল। শান্ত সমাহিত গ্রামটির বুকে
একটা সাময়িক চঞ্চলতা। কিছু লোকের অস্পষ্ট কথা-বার্তা, পায়ের শব্দে
দৃশ্যপটের সাময়িক পরিবর্তন।
মঙ্গলুর বউ মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ছেলেটার হাত ধরে বাড়ির পথ ধরল।
"টেরাকখান ঢুকিল। যাং মা। কোয়ারিখান নাগে দ্যাও।"
সুন্দরমণি উনুন ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বলে,
"যাও। নোউক কোয়ারিখান। আইসেছে কে তোমার বাপ।
মঙ্গলুর
বউ বাড়ি এসে বাচ্চাদুটো সহ রান্নাঘরে ঢোকে। পিঁড়িতে বসিয়ে হাঁড়িতে জল দিয়ে
উনুনে বসায়। ছেলেটা কিছুটা অনিশ্চিতভাবে কচি গলায় জিজ্ঞেস করে,
"ভাত আন্দিবু মা? হামরা ভাত খামু?"
মঙ্গলুর বউ এ কথাল কোনো উত্তর দেয় না। মঙ্গলু না আসা পর্যন্ত নিজেও এর উত্তর জানে না ইসলে। মঙ্গলু উঠোন থেকেই ডাক দেয়,
"ন্যাও ধর ধর। কোটে গেইলেন। মোর মাগোটা কোটে? নিন গেইসে?
"না যায়। ভোক নাগাইসে। নিন পেটাছোং, চোকুলায় না মুঞ্জে।"
মঙ্গলু এ কথার কোনো উত্তর দেয় না। পাশের বাড়ির কুয়োতে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসে।
"ঘিস ঘিসা ঘিসা ঘিস
আলু দুইটা ভাতোত দিস
মোকো কোনেক ভাগ দিস।"
মুখে
ছেলেভুলানো ছড়া, কোলে মেয়েকে তুলে নাচাতে নাচাতে রাঁধুনী রান্না করছে।
মঙ্গলু গিয়ে মেয়েকে কোলে নিতেই ছেলে মার গলা জড়িয়ে দুলে দুলে আওড়াতে থাকে,
"ঘিস ঘিসা ঘিসা ঘিস ...."
গরম
গরম ভাত থালায় ঢেলে একপাশে আলুমাখা বেগুন পোড়া আর ভোলামাছের সুঁটকি পোড়া।
সারাদিনের একটা প্রতিক্ষার অবসান এমন অসামান্য আয়োজনে শেষ হল।
................................................................
আতলাছে - অস্থির হচ্ছে
পানাছে - খেতে খেতে মুখ দিয়ে ফেনা বের করা
পায়া বগরি ছেল্লাইসে - বেশি পেয়েছে বলে ফেলে ছড়িয়ে খাওয়া
কাকার-কুকুর - ছোট ছোট ভাই-বোনের মধ্যে ঝগড়া-মারামারি
কোয়ারি - বাঁশ দিয়ে বানানো দরজা
................................................................
ছবি : ময়ূখ রায় ও রীতা রায়