নেপুচাপুর চা বাগান
নেপুচাপুর চা বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^
লাটাগুড়ির নেওড়া মোড় থেকে নিজের গাড়িতেই লাটাগুড়ি-রাজাডাঙ্গা-মালবাজার রোড হয়ে এসেছিলাম কুমলাইতে। তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে যাবার ফলে পাশেই নেপুচাপুর বাগানটা ঘুরে যাবার পরিকল্পনা করলাম। রাজাডাঙ্গা মালবাজার রোড ধরে লাটাগুড়ি থেকে ১৩ কিমি গেলেই নেপুচাপুর চা বাগান। মালবাজার থেকে আসতে গেলে মালবাজার সুভাষ মোড় থেকে রাজাডাঙ্গা রোড হয়ে তেসিমলা, হায়হায়পাথার চা বাগান অতিক্রম করে রাজাডাঙ্গা হয়ে ১৭ কিমি পথ। পাশেই কুমলাই, বেতগুড়ি, চা বাগান। নেপুচাপুর
থেকে বেতগুড়ি যেতে গেলে কবরস্থান, বেতগুড়ি সিএনআই চার্চ হয়ে বেতগুড়ি টি গার্ডেন ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে। তাই বেতগুড়ি চা বাগিচা সফরের পরিকল্পনাও ছকে নিলাম একেবারে। মালবাজার থেকে নেপুচাপুর আসতে গেলে হায়হায়পাথার চা বাগান পড়ে। এটার বর্তমান নাম রাজা চা বাগান। শীতের আলসে দুপুরে গাড়ি চালানোর মজাই আলাদা। তবে রাস্তার ভাঙ্গাচোরা অবস্থা এবং মাঝেমধ্যে সঙ্কীর্ণ দশাতে একটু ভয়েভয়েই চালাতে হচ্ছিল। কারণ এসব রাস্তাতে গাড়ি চালানোতে মজার সঙ্গে ভয়ও জড়িয়ে থাকে। কোন অবলা বাছ্রর অথবা ছাগলছানা হাইজাম্প দিয়ে যেকোন সময়ে চলে আসতে পারে গাড়ির ওপরে, অথবা একঝাঁক হাঁস বা মুরগী নিধন হয়ে গেলে দফা সারা। পথে দেখলাম বাগিচাগুলিতে কাটিং এবং প্রুনিং চলছে। উত্তরবঙ্গের চা বাগানের পরিচালন কর্তৃপক্ষ চায়ের গুণগত মান আরও উন্নত করবার পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য শীতকালে ভালো করে কাটিং ও প্রুনিং করে। কারণ প্রুনিং সম্পন্ন হলে বর্ষার পর চা গাছে আশানুরূপ পাতা আসে। অভিজ্ঞতার নিরীখে চা বাগানের ম্যানেজমেন্ট এবং টি বোর্ড দেখছেন গুণগত ভালো মানের চা হলে চায়ের দাম একাধারে যেমন ভালো পাওয়া যায়, তেমনি চা বিপণনের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না। চা বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রুনিং-এর কাজ সঠিকভাবে করা হলে চা বাগানগুলিতে উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন দিশা দেখতে পাবেন মালিকপক্ষ। তাই আজকের বাগিচা সফরের এই শীতের মরসুমে কাটিং এবং প্রুনিং সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।
তবে নেপুচাপুর বাগিচাতে সিনিয়র ম্যানেজারের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম চা বাগিচাতে ইদানীং আপরুটিং ও রিপ্ল্যান্টিং এর কাজে ভর্তুকি বন্ধ। তবে ভর্তুকি এবং বাগান পরিচর্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করার আগে বাগিচার পরিচয়টা একটু দিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। মালবাজার মহকুমার একটি অত্যন্ত পুরনো চা বাগান নেপুচাপুর চা কোম্পানি গত নব্বই বছরে ডুয়ার্স অঞ্চলে তার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এবং ব্র্যান্ডের জন্য চিহ্নিত। ডুয়ার্স এলাকায় হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত, অন্যান্য চা বাগান এবং অভয়ারণ্য দ্বারা বেষ্টিত, বাগানের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা কুমলাই এবং নেওড়া নদীর জলধারা দ্বারা সিঞ্চিত নেপুচাপুর টি এস্টেট এই অঞ্চলে পরিবেশগত ভারসাম্য এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। নেপুচাপুর টি কোম্পানি লিমিটেড প্রায় নব্বই বছর আগে স্থাপিত হয়েছিল। কুমলাই নদীর সংলগ্ন প্রথম তিনটি ব্লকে চা বাগান রোপন করে চাষ শুরু হয়েছিল ১৯২৭ সালে। ৪০০.০২ হেক্টর আয়তনবিশিষ্ট নেপুচাপুর চা বাগানের ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ৩৪১.৬ হেক্টর। প্রতি হেক্টর প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ২১০০ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। ৬ জন ম্যানেজারিয়াল স্টাফ, ৪১ জন সাব স্টাফ, ১০ জন করণিক, ৫ জন ক্লারিক্যাল এবং টেকনিকাল স্টাফ এবং ৫৭৯ জন স্থায়ী শ্রমিক নিয়ে ছোট কিন্তু সমৃদ্ধ এই বাগানটি উত্তরবঙ্গের চা শিল্পের একটি বিশিষ্ট নাম। কোন কোন আর্থিক বছরে প্রায় ৫০০ জনের মতো অস্থায়ী শ্রমিক বা বিঘা শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক সংখ্যা বাৎসরিক হিসেবে তারতম্য হলেও মোটামুটি ভাবে দেড়শ থেকে দুইশ জন প্রত্যেক বছর চুক্তিভিত্তিতে বাগানে কাজ করে। সংখ্যাটা বেশির চেয়ে কম নয়। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৯৮ জন। বাগিচায় প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়নে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যের শাসকদলের ট্রেড ইউনিয়নের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলেও জয়েন্ট ফোরামও শক্তিশালী। শর্মিলা সেন ২০০১-২০২২ অর্থাৎ প্রায় ২০ বছর, শ্যামল কুমার সেন ২০০৫-২০২২ অর্থাৎ ১৭ বছর, সোহম সেন ২০০৮-২০২২ এবং মালা রায়চৌধুরী ২০১৮-২০২২ প্রায় চার বছর ধরে বোর্ডের ডিরেক্টর হিসাবে বাগান সামলাচ্ছেন। যখন ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছিলাম তখন বাগানটি টাই বা টি অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার সদস্যভুক্ত ছিল। এখন পরিবর্তন হতেও পারে।
বাগানটির নামকরণ করা হয়েছিল নেপুচা নামের প্রথম মালিকের নামে যার নামকরণের সঠিক পটভূমিকা এখন আর নিশ্চিত করা যায় না। বাগান প্রতিষ্ঠার সময় প্রাথমিক তহবিলের একটি অংশ নবাব মোকলেশ্বর রহমানের কাছ থেকে এসেছিল যাঁর সেই সময়কালে ডুয়ার্সের একাধিক স্থানীয় চা বাগান ব্যবসাতে অংশীদারিত্ব ছিল। নেপুচাপুর কারখানাটি ১৯৩১ সালে স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৩৯ সাল নাগাদ বাগানের আয়তন ৫০০ একরের বেশি হয়ে গিয়েছিল। ষাটের দশকে মিঃ এন সি দাশগুপ্ত চা ব্যবসাতে বিনিয়োগ শুরু করেন এবং নেতৃস্থানীয় শেয়ার হোল্ডার হিসাবে বাগিচার দায়িত্ব নেন। মিঃ দাশগুপ্ত জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করলেও কলকাতায় বসতি স্থাপন করেন। যদিও তিনি কলকাতায় কোম্পাণীর সদর দফতর স্থাপন করেছিলেন তথাপি তিনি তাঁর কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় নেপুচাপুরে কাটিয়েছিলেন বাগিচার উন্নয়নকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে। মিঃ দাশগুপ্তের অধ্যবসায় এবং নেতৃত্ব এস্টেটের ক্রমাগত উন্নতিতে সহায়ক ছিল, যার বেশিরভাগই আশি এবং নব্বইয়ের দশকে বাস্তবায়িত হয়েছিল। এই সময়কালের মধ্যে কারখানা এবং সেচের আধুনিকীকরণ হয়েছিল। বৃক্ষরোপণের জন্য এই সময়ে অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। যার ফলে এস্টেটের আকার প্রায় ৭০০ একর হয়ে যায়। এই সময়ে জলপাইগুড়িতে একটি অফিস স্থাপন করা হয় যাতে কাছাকাছি থেকে বাগানটি পরিচালনা করা যায়। ২০০৫ সালে মিঃ দাশগুপ্তের মৃত্যুতে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সেই সময় তাঁর স্ত্রী দীপালি দাশগুপ্ত কোম্পাণীর চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। চা বাগিচার নেতৃস্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সেইসময় বাগিচাতে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। পরবর্তীতে অফিসটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। বৃক্ষরোপণ, কারখানা, ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ এবং বিপণনে বেশ কিছু কৌশলগত বিনিয়োগ করা হয়েছিল যার দ্বারা নেপুচাপুর ব্র্যান্ডটি উৎপাদিত চায়ের উচ্চতর মান অর্জন করেছিল এবং এটি ছিল ডুয়ার্সের সেরা চা বাগানগুলির সমতুল্য।
নেপুচাপুর বাগিচাতে বাগানের নিজস্ব উৎপাদিত ২৪-৩০ লাখ কেজি কাঁচা চা পাতা থেকে ফ্যাক্টরিতে গড়ে ৬-৭ লাখ কেজি বিক্রয়যোগ্য চা প্রস্তুত হয় নিলাম মার্কেটের জন্য। পাশাপাশিভাবে বহিরাগত বাগান থেকে সংগৃহীত এবং কেনা কাঁচা চা পাতায় প্রস্তুত বিক্রয়যোগ্য চায়ের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কেজি। সব মিলে নেপুচাপুর চা বাগানে প্রায় ১০ লাখ কেজি ইনঅরগ্যানিক প্রকৃতির সিটিসি কোয়ালিটি চা উৎপাদিত হয়। নেপুচাপুর চা বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধন আসে নিজস্ব অর্থনৈতিক সোর্স এবং চা বিক্রি বাবদ আয় থেকে। বাগানটির লিজ হোল্ডার নেপুচাপুর টি কোম্পানি লিমিটেড। ২০১২ সালে দীপালি দাশগুপ্ত প্রয়াত হবার পর তাঁর সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে বর্তমান ম্যানেজমেন্ট এগিয়ে চলেছে। নেপুচাপুর চা বাগানে হাসপাতাল নেই। তবে ডিসপেন্সারি আছে। অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা বাঁচিয়ে রেখেছে শ্রমিকদেরকে। আবাসিক ভিত্তিতে একজন ডাক্তার বাগান কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় কাজ চালিয়ে নিলেও প্রশিক্ষিত নার্স না থাকার ফলে যে সমস্যা হয় তা একজন কম্পাউন্ডার এবং একজন হেলথ অ্যাটেনডেন্টকেই সামাল দিতে হয়। বাগিচায় পর্যাপ্ত ওষুধ থাকে না। মেটারনিটির জন্য রেফার করতে হয় অথবা আশা কর্মী বা স্বাস্থ্য দপ্তরের সরকারি সুযোগ সুবিধা নেওয়ার মাধ্যমে সমস্যা মেটানো হয়। ক্রেশে বাচ্চা থাকে অনেকগুলি। অ্যাটেনডেন্ট এর সংখ্যা ৭ জন। তবে সাম্প্রতিককালে ম্যানেজমেন্ট বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জগুলিকে গ্রহণ করতে, নতুন মানের চা উৎপাদন এবং চা এর গুণগত মান অর্জন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ নেপুচাপুর। সততা, স্বচ্ছতা এবং টিমওয়ার্ক বজায় রেখে চলতে নেপুচাপুর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নেপুচাপুরের স্থানীয় শ্রমিকেরা অনেকেই কারখানায় এবং নেপুচাপুরের চা বাগানের অফিসে কাজ করে। কর্মীদের সময়মতো বেতন এবং বিধিবদ্ধ সুবিধা প্রদানের বিষয়ে ম্যানেজমেন্ট সচেতন। আবাসন, স্যানিটেশন, শিক্ষা, শিশু যত্ন, চিকিৎসা পরিচর্যা, দুর্ঘটনা বীমা সব কিছু পরিষেবা দেওয়া হয়। সামাজিক কার্যকলাপ এবং খেলাধুলার ইভেন্টগুলিতে নেপুচাপুরের সুনাম আছে। প্রতি তিনমাস পরপর একজন করে কর্মী নির্বাচন করা হয় যারা ব্যতিক্রমী কাজের জন্য ম্যানেজারের কাছ থেকে পুরস্কারে সম্মানিত হয়।
বাগিচাতে শীতকালে আপরুটিং ও রিপ্ল্যান্টিং একান্তই জরুরী। এমনকি ক্ষুদ্র চায়ের মানোন্নয়নেও কাটিং প্রুনিং হয় চা বাগিচাতে। কিন্তু চা বাগিচাতে ধীরে ধীরে কাটিং এবং প্রুনিং করার জন্য যে ভর্তুকি দিত কেন্দ্রীয় সরকার তা তুলে নেওয়া হচ্ছে। নেপুচাপুর চা বাগিচার বড়বাবুর সঙ্গে ব্য্যাক্তিগত আলাপচারিতাতে জানলাম চা বাগিচাতে আপরুটিং এবং রি প্ল্যান্টিং এর অনুমতি টি বোর্ড থেকে নিতে হয়। আপরুটিং ও রিপ্ল্যান্টিংয়ের অনুমতি না মিললে বাগানের ছায়াগাছও কাটা যায় না। চা বাগানগুলি সার্ভে করার সময় জেনেছিলাম ছায়াগাছ কাটার অনুমতি বন দপ্তরের কাছ থেকে নিতে হলেও ওই দপ্তর আবার আগে নির্দিষ্ট সেকশনের চা গাছ আপরুটিং ও নিউ প্ল্যান্টেশনের জন্য টি বোর্ডের এনওসি আছে কি না সেটা যাচাই করে নেয়। যে সমস্ত বাগান আপরুটিং ও রিপ্ল্যান্টিংয়ের কাজ শুরু করতে ইচ্ছুক তাদের নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট ফর্ম্যাটে আগে টি বোর্ডের কাছে আবেদন করতে হয়। সঙ্গে দিতে হয় বাগানের যে অংশে তারা ওই কাজ করবে তার স্কেচ ম্যাপও। এরপর ফিল্ড অফিসের আধিকারিকরা পরিদর্শনে যান। তারপর রিপোর্টের ভিত্তিতে আঞ্চলিক অফিসের তরফে অনুমতি দেওয়া হয়। এই সময়টুকুর মধ্যে যে লোকসান হত সেই টাকা টি বোর্ড ভর্তুকি হিসেবে দিত। রাজ্যের চা বাগানগুলি কয়েকশো কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ টি বোর্ডের থেকে পেত। আপরুটিং, রিপ্ল্যান্টেশন, ফ্যাক্টরির যন্ত্রপাতি কেনা সহ আরও কয়েকটি খাতে টি বোর্ড বাগানগুলিতে ভরতুকি দিত। ওই ভরতুকির পরিমাণ ছিল মোট খরচের ২৫ শতাংশ। হেক্টর পিছু আপরুটিং ও নিউ প্ল্যান্টেশনের জন্য ভরতুকি বাবদ একেকটি বাগান প্রায় ৩ লক্ষ টাকার মতো পেয়ে থাকত। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় দীর্ঘ কয়েকবছর টি বোর্ড সেই টাকা বাগানগুলিকে দেয় নি। এতদিন টি বোর্ডের কাছ থেকে ওই অনুমতি না মেলায় বাগানগুলি বিপাকে পড়েছিল। বিষয়টি নিয়ে চা বাগান মালিকপক্ষ টি বোর্ডের কাছে একাধিকবার আবেদনও করে। অবেশেষে নিজেদের খরচে এই কাজ করা যেতে পারে বলে টি বোর্ড জানিয়েছে। এই নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন।
বিগত দুই তিন বছর ধরেই দেখা যাচ্ছিল নানা খাতে টি বোর্ড প্রদত্ত ভরতুকির টাকা বকেয়া পড়ে থাকছে। ক্ষুব্ধ কনসালটেটিভ কমিটি অব প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক অমিতাংশু চক্রবর্তীর প্রশ্ন ছিল টি বোর্ড চা শিল্পের কথা আদৌ ভাবে কিনা। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন নইলে কেন এভাবে আগেকার ভর্তুকির টাকা বকেয়া পড়ে থাকবে। একটা সময় চা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা টি বোর্ড তাদের ঘোষণায় জানিয়ে দিয়েছিল পুরনো চা গাছ তুলে নতুন গাছ লাগানোর কোনও অনুমতি দেওয়া হবে না। টি বোর্ডের শিলিগুড়ি জোনের উপনির্দেশক রমেশ কুজুর জানিয়েছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী আপরুটিং ও রিপ্ল্যান্টিংয়ের অনুমতি দেওয়া হবে। তবে ওই খাতে কোনো ভরতুকি মিলবে না। বোর্ড জানিয়ে দেয় বকেয়া সব ভর্তুকি না মেটানো পর্যন্ত নতুন গাছ লাগানোর আবেদনও তারা নেবে না। যদিও টি বোর্ড কর্তাদের বক্তব্য ছিল বকেয়া টাকার ভরতুকি ধাপে ধাপে দেওয়া হবে। উদ্বিগ্ন ছিল শ্রমিক সংগঠনগুলিও। চা শ্রমিকদের যৌথ মঞ্চের অন্যতম সদস্য মণিকুমার দার্নাল জানিয়েছিলেন ডুয়ার্সের পুরনো গাছগুলি না তুলে ফেললে উৎপাদন বাড়বে না। ক্ষতি হলে বাগান বন্ধ হবে, তখন মরতে হবে শ্রমিকদের। কলকাতার নিউ সেক্রেটারিয়েট ভবনে টি বোর্ড ও রাজ্যের টি ডিরেক্টরেটের বৈঠকেও বন্ধ থাকা ওই ভরতুকির বিষয়টি তুলে ধরেন টি ডিরেক্টরেটের কর্তারা। তবে টি অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার (টাই) ডুয়ার্স শাখার সম্পাদক রাম অবতার শর্মা আপরুটিংয়ের এনওসি দিতে টি বোর্ড এগিয়ে আসায় সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ নতুন চা গাছ রোপণ না করলে বাগানের উৎপাদনশীলতা ধাক্কা খায়। এমনকি গতবছর করোনাকালীন পরিস্থিতিতেও ভর্তুকি দেয় নি টি বোর্ড। ডুয়ার্স ব্র্যাঞ্চ ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের সেই সময়কার নবনিযুক্ত সচিব সঞ্জয় বাগচীর যুক্তি ছিল করোনাকালীন পরিস্থিতিতে লকডাউনে চা শিল্পে একেই অর্থনৈতিক বোঝা চেপেছে। এই বোঝা সামলাতে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গুণমানে জোর দেওয়া একান্তই প্রয়োজন ছিল। করোনাকালে সেই সম্ভাবনাতেও কোপ পড়ল।
আসল তথ্যটা জানতে পেরেছিলাম অনেক পরে। আসলে ২০১৯ সাল থেকেই খরচ কমিয়ে টি বোর্ডকে ঢেলে সাজাতে নির্দেশ দিচ্ছিল কেন্দ্র। সেই পথে হাঁটতে অর্থোডক্স চা তৈরির ভর্তুকিতে রাশ টানার পাশাপাশি কর্মী সঙ্কোচন ও বিভিন্ন রাজ্যে বোর্ডের ছ'টি দফতর বন্ধ অথবা অন্য দফতরের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল। মোদী সরকারের প্রথম দফায় টি বোর্ডের পুনর্গঠনের পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক ছড়িয়েছিল। সেই সময় কফি বা স্পাইস বোর্ডের মতো বিভিন্ন কৃষিপণ্যের জন্য একাধিক বোর্ডের বদলে সেগুলি সংযুক্তিকরণের ভাবনাও শুরু হয়। টি বোর্ডের সদর দফতর কলকাতা থেকে সরতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলে চর্চা শুরু হলেও অবশ্য কেন্দ্র পরে জানায় সে রকম কোনও ভাবনা তাদের নেই। তবে কলকাতায় সদর দফতরের কাজকর্ম অনেকটাই সঙ্কুচিত করা হয়। দফতরের ভবনের একাংশ অন্য সরকারি দফতরকে দেওয়া হয়। কর্মী ছাঁটাই না হলেও বোর্ডে নতুন নিয়োগও দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। মোদী সরকারের দ্বিতীয় দফাতে বাণিজ্য মন্ত্রক ফের সংস্থা পুনর্গঠনের নির্দেশ দেয়। জানা যায় কর্মী সংখ্যা ৩১২ থেকে কমিয়ে ২৫০ জনের মতো করা হবে। তবে কাউকে ছাঁটাই বা স্বেচ্ছাবসর দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে অন্য কোনও সংস্থায় বদলি করা হবে। মুম্বই, দিল্লি, অসমের পাশাপাশি কলকাতায় দু’টি দফতর বন্ধ করা হবে। কলকাতায় আইন ও কম্পিউটার দফতর দু'টি বন্ধ করে সেই কাজ আউটসোর্সিং করানো হবে বলে পরিকল্পনা নেওয়া হয়। টিআরএ-র চেয়ারম্যান পি কে বেজবড়ুয়ার পাশ করা তথ্য থেকে জানা যায় চা গবেষণা খাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ বছর চারেক ধরে ২৫ কোটি টাকার বদলে কমে দাঁড়িয়েছে ৯ কোটি টাকা। রাজ্যের চা উপদেষ্টা কমিটির সদস্য কৃষ্ণকুমার কল্যাণীর মন্তব্য উদ্ধৃত করে তাই বলাই যায় কেন্দ্রীয় সরকার মুখে চা শিল্পের উন্নয়নের কথা বলছে বটে, কিন্তু কার্যত নানাভাবে চা শিল্পে আর্থিক সুযোগ সুবিধা ছাঁটাই করছে। টি বোর্ডের ডেপুটি চেয়ারম্যান অরুণকুমার রায় টি-রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের (টিআরএ) বার্ষিক সভায় চা শিল্প মহলকে শুধুমাত্র বোর্ডের ভর্তুকির উপর নির্ভর না করে খরচ কমানো ও নিজেদের আয় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তুলেছে উত্তরের চা শিল্পমহল করোনাকালেও এই বেনিয়া অর্থনীতির হাত থেকে চা শিল্প মহলকে একটু স্বস্তি দেওয়া যেত না কি?
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴