আমি এক যাযাবর-২৬/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর (পর্ব ২৬)
শৌভিক কুন্ডা
জোড়পুখুরি থেকে মানেভঞ্জন সাড়ে আট কিলোমিটার মতো। কতই আর সময় লাগবে, মনে মনে এমন ভেবে নিয়ে বেশ এলিয়ে বসলাম। কিন্তু শুরুর ঐ ব্যাকরেস্টে হেলান দেওয়াটুকুই সার। তারপর গোটা রাস্তায় আমরা জাম্পিং জ্যাক! রাস্তা নাম বটে, কিন্তু মনে হতে লাগলো কোথাও পুকুর, কোথাও চষা খেত, কোথাও ঝর্ণাস্রোত, এঁকেবেঁকে তারাই আমাদের পথ করে দিচ্ছে! অতএব কুড়ি মিনিটের রাস্তা পাহাড়ি অঙ্কে শেষ হ'ল ঘন্টা দেড়েক যন্ত্রণার পর। মানেভঞ্জন বাজার পৌঁছনোর একটু আগেই এসএসবির ক্যাম্প, চেকপোস্ট আর আমাদের ডানদিকে উঁচু কাঁটাতারের বেড়া বুঝিয়ে দিলো ওপারে নেপাল। দু চারটে পাখি দিব্যি উড়ে উড়ে এপার ওপার করছে। সীমান্তরক্ষীদের ভ্রুক্ষেপ থাকে না ওদের ক্ষেত্রে!
বাজারে আমাদের নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার দাদা ফিরে চললেন শিলিগুড়ি। দুপাশ থেকে দোকানগুলো চেপে আরো সরু করে দিয়েছে এমনিতেই ঘিঞ্জি রাস্তাটাকে। এরপরই জমে উঠলো। রাস্তায় যাকেই জিজ্ঞেস করি মাজুয়া যাওয়ার গাড়ি কোথায় পাবো, উত্তর সেই একটাই, "ইঁহা সে তো নেহি মিলেগা।" একজন দোকানি সামান্য আশা জাগিয়ে বললেন সকালে যে গাড়িটা দারজিলিং গেছে, সেটা ফিরবে এ পথেই। আরও দু চারজন সায় দিলেন। ভাবলাম গাড়ির হদিশ পাওয়া গেল! কিন্তু পরের প্রশ্নের উত্তরে দোকানি জানালেন "আভি আ যায়েগা", একই প্রশ্নে আরেকজন জানালেন "সায়েদ এক ঘন্টা", আরও একজনের বক্তব্য "চার-পাঁচ বাজে তক"! একমেবাদ্বিতীয়ম এ গাড়ির সময়সূচির এই আনপ্রেডিক্টেবিলিটির কথা দিয়েই এ লেখাটির প্রথম পর্বে গীত গেয়েছিলাম, না?
দোকানিবাবুর "আভি"তে কিছুক্ষণের ভরসা। ইতিমধ্যে উৎপলদা সে দোকান থেকে ক্যান্ডি কিনে আমার দিকেও বাড়িয়ে দিলো ক'টা। সুগারবৃদ্ধির ভাবনায় খাবো-কি-খাবো-না'র দ্বিধা কাটিয়ে মুখে একটা ফেলতেই, আহ! দারুণ স্বাদ, সবচেয়ে বড়ো কথা, এমন কিছুই মিষ্টি নয়। প্যাকেটের ছবি এবং লেখা বললো এটি ভুট্টাদানা দিয়ে তৈরি।
" আভি"র আশায় আধ ঘন্টা মতো সময় মিথ্যে খরচ করে ছোট গাড়ি একটা রিজার্ভ করতেই হল। কিলোমিটার পাঁচেক আরো, মাজুয়া। মাঝে বেশ অনেকটা জুড়ে রাস্তার হাল খুবই খারাপ, ফলে আধঘন্টার বেশিই লাগলো। বাঁহাতে ওপরদিকে বিছিয়ে যেতে থাকা জঙ্গুলে সবুজ চত্বর, সামনে লোহার গেট। চালক জানালেন "আ গয়া"। বাইরে ঝাপুর-ঝুপুর বৃষ্টি। চালকের টানা হর্ণ ওপর থেকে নামিয়ে আনলো অভিজিৎ কে। অরণ্যবাসে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক। ছাতা আমাদের হাতে দিয়ে জোর করেই সামানপত্র (দুজনের মাত্র দুটো, হাল্কা) তুলে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। আর গেট দিয়ে ভেতরে কিছুটা ঢুকতেই, আঁকাবাঁকা পাথুরে পথে হাঁটতে হাঁটতে কেমন একটা গন্ধ চারিয়ে গেল ভেতর বুকে। ছেলেবেলার গন্ধ, বহুদিন পর বৃষ্টিধোওয়া সবুজের গন্ধ, ঋজু কান্ডকে জড়িয়ে বাঁচা শ্যাওলার গন্ধ! যেখানে চোখ রাখি, সবুজ কেবল, নানা শেডের সবুজ ছড়িয়ে অরণ্যবাস হোমস্টের গহনে। তারই ফাঁকফোকড়ে দু' একটা কটেজ, বাড়ি, কোনোটা একতলা, কোনোটা বা দোতলা। আজ আর কোনো অতিথি নেই, জানালো অভিজিৎ। যে ঘর ইচ্ছে, আমরা পছন্দ করে নিতে পারি। ঘর বেছে তারপর স্নান। বালতি ভরা গরমজল দিয়ে গেল। আর স্নান সারতেই এতক্ষণ ভুলে থাকা ক্ষিধে চাগাড় দিয়ে উঠলো আবার। ভাত, ডাল, আলুর দম আর ডিমের ঝোল। এত বেলাতেও গরম গরম সব। সঙ্গে তাজা স্যালাড। ঘরে ফিরে ঠিক হ'ল একটু জিরিয়ে নিয়ে হাঁটতে বের হবো। সকাল থেকে তোরজোড়, প্রায় ছ'সাত ঘন্টা গাড়ি, তারও অনেকটা আবার মুড়িমশলার কৌটোয় ঝাঁকুনি খাওয়ার মত, ফলে ঐ 'একটু জিরোনো' গাঢ় ঘুমেই ডুবিয়ে দিলো। চোখ যখন খুললো, দেখি আলো অস্পষ্ট হয়ে এসেছে, আর খোলা জানালা দিয়ে কুয়াশা ঢুকে এসে দখল নিচ্ছে ঘরের!
কেবল কুয়াশা নয়, তার সাথে মিশে ভেসে আসছে অজস্র পাখির ডাক, একসাথে হট্টগোল পাকিয়ে নয়, একা একা, থেমে, ঠেকে। উৎপল'দা তখনও শুয়ে। ঘর থেকে বের হয়ে, সরু বারান্দাটা পেরিয়ে চলে গেলাম ছোট্ট চৌকো ব্যালকনিতে। বৃষ্টি তখন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে একটা বয়ে যাওয়ার শব্দ, যেন অনন্ত বহমানতার জানকারি! অরণ্যবাস হোম স্টেতে এত গাছ, এত জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে থাকা তাদের ডালপাতা, যেন একে অপরকে না ছুঁয়ে থাকতেই পারে না! তবু সেই ঠাসবুনন সবুজজাল ছিঁড়েই প্রায়, নজর পৌঁছলো, আর স্থির হয়ে গেল যে অপার্থিব কলস্রোতের কথা বলছি, তার উৎসে পৌঁছে। প্রথম ঝলকে সবুজের ফাঁকফোকর গলে একটা ঢেউ খেলানো দুধসাদা কাপড়ের টুকরো যেন। চোখ স্থির রেখে বুঝলাম, বস্তুত সেটি বহমান জলধারা, যার খুব সামান্য অংশই নজরে আসছে আমার। আন্দাজে ঠাহর পাই, খুব দূরে নয় হোমস্টে থেকে এই স্রোতোবহা। নাম আগেই জেনেছি আন্তর্জাল ঘেঁটে, স্রিয়াংখোলা। রঙ্গিতে গিয়ে মিশেছে। হয়তো সেজন্যই এ জায়গাটাকে অনেকে রঙ্গিত-মাজুয়া নামেও জানেন, স্থানীয় মানুষের মুখেও শোনা যায় এ নামটি।
গরম জামা পরে রওনা হলাম দুজনে, নদীসন্ধানে। বৃষ্টি আছে কি নেই, চত্বর গেটে পৌঁছনোর আগেই অভিজিৎ ছুটে নামলো, হাতে বড়ো ছাতা। যে কোনো সময় নামতে পারে, অতএব ছাতাটি সাথে নেওয়াই ভালো! সুন্দর মসৃণ রাস্তা নেমে গেছে গেট পেরিয়ে বাঁ হাতে। মানুষজন নেই, দুটো একটা বাড়িঘর দূরে কাছে দেখা দিচ্ছে। দশ মিনিটও হাঁটতে হয় নি, লোহার রেলিং দেওয়া ছোট্ট কংক্রিট ব্রিজে পৌঁছে গেলাম। আর থমকে গেলাম। কেবল আমরা দুজন না, সারা পৃথিবীই। যেন এখানে কোনোদিন ঘটে না কিছু, ঘটে নি আগেও। যেন স্রিয়াংখোলা ছাড়া আর কোনো স্পন্দন নেই এই ব্রহ্মান্ডে। স্রোতের গানে মিশে যাচ্ছে পাখিদের, পতঙ্গদের সঙ্গত। প্রকৃতির আধ্যাত্মিক প্রার্থনাগীত মোহমুগ্ধ করে রাখলো আমাদের, বলতে গেলে নিশ্চল পাথরই করে রাখলো, কতক্ষণ, জানি না। অনেক যুগ পেরিয়ে যেন উৎপল'দা বলে উঠলো, তা-ও অস্ফুটে, যেন আর এক মাত্রা বেশি হলেই এই চিত্রপট ছিঁড়ে ছত্রখান হয়ে যাবে, "স্বর্গ!" তখন ঝর্ণাখোলার ওপর দিয়ে কোন অচিনপুর থেকে ভেসে আসছে কুয়াশার ঝাঁক। দুধের ফেনার ওপর দিয়ে ঠাকুমার সাদাটে র্যাপার। আমরা ব্রিজ ছাড়িয়ে অল্প কিছুটা এগোলাম। রাস্তার ধারে সিমেন্ট বাঁধানো, পাতা আর শ্যাওলাজমা বসার জায়গা! জলের গান স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি এখান থেকেও, স্পষ্টতর হয়ে উঠছে বরং পাখি ও পতঙ্গেরা। এখানে কথা হয় না। তবু সে রীতি ভেঙে আলতো স্বরে বেজে উঠলো মোবাইলের রেকর্ডার, উৎপল'দার গলায় নিজের পেলব পৌর্ণমাসী কবিতারা। যেন এখানেই উচ্চারিত হওয়ার জন্য জন্ম ওদের! ইচ্ছে না থাকলেও, অন্ধকার গাঢ হচ্ছে, আরো গম্ভীর হয়ে উঠছে মেঘের দলও, অতএব ফেরার পথ ধরতেই হ'ল। আর হোম স্টে তে পা রাখতেই গরম চায়ের কাপ, যেমনটি বলা ছিলো, চিনি ছাড়া লিকার আমার, আর দুধ-চিনি রেগুলার উৎপল দার। চায়ের পালা শেষ করে জামাকাপড়ে ঘরোয়া হয়ে নেমে এলাম নীচের তলায়। ডাইনিং স্পেস লাগোয়া, দু ধাপ সিঁড়ি নেমে আড্ডাঘরে। আরো চা আর মুচমুচে ফিঙ্গার চিপসের প্লেট হাতে অভিজিৎ, সাথে কৃপাশাও। যখন ঢুকেছি অরণ্যবাসে, তখনই, ঘর পছন্দ করার সময় পরিচয় হয়েছিলো অভিজিতের এই সামান্য বড়ো দিদিটির সাথে। দুই ভাইবোনের সাথে আড্ডা জমে উঠলো।
জানলাম অভিজিৎ মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া। কোলকাতায় কলেজ। কৃপাশা দার্জিলিং লোরেটো থেকে পাশ করে সাইকোলজি নিয়ে স্পেশ্যাল স্টাডি করছিলো ব্যাঙ্গালোরে, সাথে একটা চাকরিও। প্যানডেমিক কালে দু ভাইবোনকে ওদের বাবা-মা ডেকে এনেছিলেন বাড়িতে। আর যেতে দিচ্ছেন না। বরং দুজনে মিলে এউ পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা ক'র। কথা বলে মনে হ'ল, দুজনের কারোরই এতে কোনো ক্ষোভ অথবা আক্ষেপ নেই! জীবন যে রকম, সেভাবেই জীবনকে মেনে নেওয়ার অভ্যেসটা এদের রক্তের ভেতরই বয়ে গেছে। সে কারণেই ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতো যে, সেই অভিজিৎ হাসি মুখে অতিথিদের মোট বয়ে আনে, চা করে পৌঁছে দেয় ঘরে। কৃপাশা রান্নায় তদারকি করে, ঘরের লেপ বালিশ তোষকের দেখভালের দায়িত্ব নেয়, করপোরেট চাকরি, হায়ার স্টাডির হাত ছেড়ে। আর বড়ো অল্পেই এদের সন্তুষ্টি। কেবল কৃপাশা অভিজিৎই নয়, এই সন্তুষ্টি, তৃপ্তির ছাপ পথচলতি যে দু চারজন পায়ে হাঁটা বা বাইক আরোহীর দেখা পেয়েছি, তাদের সকলেরই মুখে চোখে। সাথে সরলতার হাসি। অচেনা দু'জন আমরা, একটা শব্দও বিনিময় হ'ল না কারো সাথে, অথচ পাশ দিয়ে যে-ই যাক, মাথা ঝাঁকিয়ে, হাত নেড়ে হাসি ছুঁড়ে দিয়ে যায় এই অচিন স্বর্গপুরীতে। দূষণ আক্রান্ত নাগরিক মনও যেন সতেজ, সজীব শ্বাস নিতে স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠে, দু'দিনের জন্য হলেও।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴