স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/পর্ব :২৫
রণজিৎ কুমার মিত্র
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
'ফুল দেব ফল দেব, পাখির কুজন দেব' - উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের
ক্যাম্পাস জুড়ে রয়েছে এমন উদাত্ত আহ্বান। অসামান্য ঋতুরঙ্গের শরিক
ক্যাম্পাসের মানুষজনেরা । ফুল-ফলের গায়ে কখনো খেলে যায় রৌদ্রছায়া, কখনো
বর্ষা-বসন্ত আসে, তখন সত্যিই মন ভরে যায় সৃজনী আনন্দে। এসবে যে মজেছেন
কতজন লেখায় রেখায়, ছবি তোলায়, কত মানুষ যে রেখে দিয়েছেন সেই সব তাদের
নিজের নিজের স্মৃতির ঝাঁপিতে - "ফেলে আসা সেই দিনগুলোর দিকে চোখ ফেরালেই
মনে হয় প্রাণমন পূর্ণ করে দিয়েছিল সেই বিরলতম দিনরাত যখন আশ্রয় পেয়েছিল
উত্তর বাংলার অবিমিশ্র প্রকৃতির একেবারে অন্দরমহলে ।বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর
প্রকৃতির উদার দাক্ষিণ্য ভরা ....... শালের মঞ্জরী ডাক দিয়ে যেত
মৌমাছিদের। গাছে গাছে গেয়ে চলত কোকিল মনের আনন্দে। বসন্ত সমাগম হত
ক্যাম্পাসে ...... বর্ষার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে কদম ফুলের গন্ধে। গেস্ট
হাউসের পুকুর আর মাগুরমারির মাঝখানের ব্যবধান মুছে সবটাই জলময়। ওদিকে
ক্ষণে ক্ষণে পাহাড়ের রং বদল। মাথা ছাড়িয়ে বেড়ে চলে অফিসপাড়ার মাঠের
লেবু ঘাস। নীল আকাশ আবার বেরিয়ে আসে। সাদা মেঘের ভেলা ভাসে আকাশে। গেস্ট
হাউসের গেটে শিউলি গাছ ভরে ওঠে ফুল সাজে। শিশির ভেজা নীল অপরাজিতা দোলে
বেড়ার গায়ে।" (স্মৃতি জাগানিয়া/ পুলিন দাস)
অশ্রুকুমার
সিকদার লিখেছেন - "ছাত্রদের তিরস্কার করে, ভালোবেসে, সহকর্মীদের সঙ্গে
বন্ধুত্ব করে, শাল কুঞ্জের সৌন্দর্যে মনকে স্নিগ্ধ করে, দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘার
দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কেটে গেল আমার জীবনে পঁচিশ বছর।"
এ
ভাবেই ষাট বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের কত রূপ যে কত জন এঁকেছেন তার মনের
নিজস্ব রং মিশিয়ে! কতভাবেই যে ধরা পড়েছে এই প্রকৃতি আর মানুষের
ভালোবাসার বন্ধন। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর প্রকৃতির অকৃপণ দাক্ষিণ্যে ভরপুর।
মানুষের হস্তক্ষেপ কোথাও কোথাও পড়েছে তৈরি হয়েছে নতুন বন-উপবন। এই
প্রকৃতির মধ্যে যে প্রীতি স্নিগ্ধ সুস্থতা রয়েছে তার কোথাও একটু ঘাটতি
হয়নি। কবেকার লাগানো চারাগাছ ডালপালা বিস্তার করে ক্রমশ বেড়ে উঠেছে
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। শাল-পলাশ এখনো ছায়া দেয়। সেই শীর্ণ লচকা নদীটি
একেবারে হারিয়ে যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টির সবুজ গরিমা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে
নতুন নতুন উদ্যানসৃষ্টিতে। ক্যাম্পাসের সূর্য বিকেল গড়াতে গড়াতে যখন
দিগন্ত রেখাকে ছোঁয় তখন আকাশ জুড়ে চলে রঙের খেলা। যে খেলা এখনো চলছে।
অপূর্ব অসাধারন এই মায়ার খেলা।
বিশ্ববিদ্যালয়টি
আজ সত্যিই উদ্যান শোভিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য পশ্চিমবঙ্গের
রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডুর নামাঙ্কিত পদ্মজা পার্কে গড়ে উঠেছে C O F A M
উদ্যান । এছাড়া 'ভূমি লক্ষী' সোশ্যাল ফরেস্ট্রি, মেডিসিনাল প্লান্ট
ইত্যাদি ছাড়াও গড়ে উঠেছে চা বাগান, রাবার বাগান। টি সাইন্স-এর মতো
গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। প্রশাসনিক ভবন ও লাইব্রেরির সামনের ফুল বাগান ছিল
দেখবার মতো, ইদানিং পরিচর্যার অভাবে সেই রূপসৌন্দর্য অনেকটাই ম্লান, তবুও
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যতটুকু আছে তা এখনো যথেষ্ট
আকর্ষণীয়। চারপাশের কংক্রিটের জঙ্গল আর জনবিস্ফোরণ-এর মধ্যে প্রায় তিনশ
একরের এই সবুজ প্রান্তরের সবুজ গরিমা রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলেই
মনোযোগী। এখানকার উদ্যানগুলির গাছে গাছে, রবীন্দ্র-ভানু মঞ্চের পেছনের
জলাভূমিতে কত যে পাখি আসে, বাসা বাঁধে, বহু পাখির অস্থায়ী ঠিকানা হয়ে
যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক,
ছাত্র-ছাত্রী-অধ্যাপক-গবেষকরা অনেকেই এই পক্ষীপ্রেমে মজে আছেন। তারা পক্ষী
পর্যবেক্ষণ বা প্রকৃতি প্রেমে একেক জন সেলিম আলী না হলেও নিখাদ
ভালোবাসা মুগ্ধতায় ক্যাম্পাসের পক্ষী জীবন নিয়ে নীরবে চর্চা করে
চলেছেন। অধ্যাপক আশিস নন্দ রসায়ন বিভাগের সুপরিচিত অধ্যাপক। যিনি আমাদের
জলপাইগুড়ির ছেলে, অনুজপ্রতিম এই অধ্যাপক আমার বিশেষ ভালোবাসার জন।
ব্যক্তিগত নানা বিপর্যয়ের মধ্যেও আশিসকে দেখেছি ক্যামেরা হাতে নিয়ে
ক্যাম্পাসের বনে-বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়াতে, ক্যামেরাবন্দি করতে! আশিস দুর্লভ
প্রজাতির পাখি আর কীটপতঙ্গর ছবি তোলে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ
ইত্যাদি প্রযুক্তির দৌলতে সেই সব ছবি আমাদের সামনে এসেছে বহুবার। এমন
ধারার অধ্যাপক, ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক, আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকেই আছেন
যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র্য নিয়ে নিয়মিত চর্চা করেন।
ভালোবাসায়- মমতায় সব সংরক্ষণ করতে চান। এরকম অনেকেই আছেন যাদের সবার
কথা এই স্মৃতিকথায় উল্লেখ করা গেল না।
মেগাপোলিস
শিলিগুড়ি থেকে বাগডোগরার মাঝখানে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের
ক্যাম্পাসে বহু পাখিরা স্থায়ী অস্থায়ী ভাবে বাসা বাঁধে, বিচরণ করে। জুলজি
ডিপার্টমেন্ট-এর অধ্যাপক ডক্টর আনন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর গবেষক
ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ক্যাম্পাসে পক্ষী পর্যবেক্ষণের নানা দিক তুলে ধরে
একটি গাইড বুক রচনা করেছেন-
Guide to the Birds of North Bengal University Campus by Ananda Mukhopadhya,
Ritesh Biswa , Sangita Khewa ( Subba), Anjali
Prasad and Kumar Basnet . University of North Bengal, Registrar, 2012.
এক
কথায় উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখিদের অসাধারণ একটি গাইডবুক। পাখির
নাম সহ তালিকা ও চিত্র সম্বলিত পক্ষীপ্রেম মমতায় মাখানো আকর্ষণীয় একটি
বই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইটিকে উৎসর্গ করা হয়েছে
জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন ডেপুটি ডিরেক্টর ও বিশিষ্ট পক্ষী
প্রেমিক, পক্ষিবিদ ডক্টর অজিত কুমার মুখোপাধ্যায়কে ।
অধ্যাপক
ডক্টর আনন্দ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই দলটি ক্যাম্পাসে প্রায় ৮১টি
প্রজাতির পাখির সন্ধান পেয়েছেন। আমার কাছে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এই বইটি।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেবার সময় আমাদের গ্রন্থাগার বিভাগের
সহকর্মীরা ভালোবেসে এই বইটি আমাকে উপহার
দিয়েছিলেন।
সযত্নে বইটি আমার কাছে রক্ষিত আছে। ভালো লাগে বইটির পাখিদের ছবি ও তাদের
সম্পর্কে তথ্য জানতে। বইটির মুখবন্ধ থেকে সামান্য অংশ উদ্ধৃত করছি যাতে
বইটি সম্পর্কে ধারণা হতে পারে- "This Guidebook is an attempt to document
the birds that visit and are still surviving in the 'Oasis' of North
Bengal University campus. The book with brief descriptions and Bio-Notes
on 81 Bird species sighted by a bunch of bird lovers attached to the
Department of zoology of The University of North Bengal along with some
additional information collected from
their
colleagues would hopefully be utilized by a large cross-section of
people, that would include the visitors, students, nature lovers, campus
residents, eco-tourists and
Orinthologists."
আমাদের
বাংলা বিভাগের পুনর্মিলন উৎসবের স্মরণিকা(২০০৮)য় আমার অনুজপ্রতিম তপন
রায় প্রধান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শালবন নিয়ে অসাধারণ একটি স্মৃতিকথা
লিখেছিলেন। তপন একাধারে সাংবাদিক, কবি কথাসাহিত্যিক, বাচিকশিল্পী। ওর
পেশাজীবন শুরু হয়েছিল বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে, পরবর্তীকালে আকাশবাণী,
দূরদর্শনের গুরুত্বপূর্ণ পদে। তপন জলপাইগুড়ি আনন্দ চন্দ্র কলেজের
প্রাক্তনী । একসময়কার ছাত্রনেতা, একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিল, তুখোড়
বক্তা ও রসিক। তপন লিখেছিল -
" এখন লিখতে গেলে কোটি শব্দ ভিড় করে আসে
এখন লিখতে গেলে রূপালি স্বপ্ন কতিপয়
অবহেলার হাত ধরে একা একা এক্কা দোক্কা খেলে।
এখন লিখতে গেলে- সেই শাল বন বীথিকায়।"
তপন
বলত শালবনকে নিয়ে বিজ্ঞাপনের একটা ব্র্যান্ডিং করলে কেমন হয়? 'যেথা সেই
চৈত্রের শালবন'! কি গভীর ভালোবাসায় তপন বলতে পেরেছিল, "বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে
আসার পর যখনি কোথাও এসেছি
তার প্রসঙ্গ আমার কথায়
অবশ্যম্ভাবী এসে দাঁড়িয়েছে, আমাদের শালবন। আমাদের কারো কারো প্রেমের
কিংবা বিপ্লবের, স্বপ্ন দেখার শালবন, মন খারাপের দুপুরে একা একা হেঁটে
বেড়ানোর শালবন, হইহই দোলের দিনে আবির মাখানোর শালবন , বেলা শেষের তেরছা
আলোয়, রজতের এলোমেলো গিটারের ছন্দে মুগ্ধ মধুছন্দার শালবন। চিরকুটে
চিরকুটে প্রেমের পদ্য গেঁথে রাখার শালবন।"
উত্তরবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সকলের মনে শালবন কোনো না কোনো
ভাবে ছায়া ফেলেছে। তবে আগেকার সেই শালবন এখন অনেকটাই বদলে গেছে। শালবনের
সীমানা এখনো কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। উপাচার্য অম্লান দত্তের সময় নির্মিত
প্যাগোডার আকারে মঞ্চটি এখন পরিত্যক্ত, ভগ্নদশায়। সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত
বিশ্বাস , শান্তিদেব ঘোষের মতো কিংবদন্তি শিল্পীরা প্যাগোডা মঞ্চে গান
গেয়েছেন। রাজ্যপাল সৈয়দ নুরুল হাসান এসেছিলেন, সমাবর্তন হয়েছিল এই
শালবনে। আরো অনেকেই এসেছেন এইখানে, এই শালবনে। ২০০৭-এর সংহতি ( উত্তরবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমিতির মুখপত্র )তে একটি কবিতা লিখেছিলাম
শালকুঞ্জকে নিয়ে। মনে আছে হলদিবাড়ি থেকে যে প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি নিউ
জলপাইগুড়ি যায়, সেই ট্রেনে কয়েকদিন আগেই বেলাকোবা স্টেশনে বোমা বিস্ফোরণ
ঘটেছিল। চারদিকের পরিস্থিতিতে খুব মন খারাপ ছিল, লাইব্রেরি কাজের ফাঁকে
একা একাই গিয়েছিলাম শালবনের দিকে। শুকনো পাতা ঝরার শব্দ শুনতে শুনতে রচিত
হয়েছিল একটি কবিতার মুহূর্ত -
"নত মুখে নেমে আসছে
বিকেলের সূর্যের আলো
ওখানে এখন কেউ নেই
শুধু পুরনো পাতার মর্মর
কাঠের সাঁকো সরে কংক্রিট
তলায় মাগুরমারী ক্ষীণ স্রোতরেখা।
সুচিত্রা মিত্র কবে যেন এখানে গেয়েছিলেন
'রোদন ভরা এ বসন্ত' ...
বসন্ত আসে এখনো
কোকিলের মিঠে সুরের মতো রিংটোনে
মেসেজের কালো অক্ষরগুলোর হাসি
কিছুতেই থামেনা।
গতকাল ছিল না কোনো কর্মখালি বিজ্ঞাপন!
পাতা জুড়ে বেলাকোবা স্টেশনে বিস্ফোরণ।
উড়ে যাচ্ছে উত্তরীয় অভিজ্ঞান
শূন্য লেটার বক্সে ধুলোর আস্তরণ ।
ই-মেল আই-ডি টা ঠিক লিখেছিস তো?
ডাল ভেঙে কোচড়ে পলাশ নিয়ে
কারা যেন দৌড়ে যায় কাফেটেরিয়ার দিকে
সেখানে বসন্ত উৎসব হবে।
ন্যাড়া পলাশ গাছগুলোকে দেখে
বুড়ো শালগাছ মুখ ভ্যাংচালো,
শালকুঞ্জে বিকেলের আলো ফুরানো।"
-----------------------------------------------------------
এই পর্বের ছবিগুলো Guide to the Birds
Of North Bengal University Campus থেকে গৃহীত।