বাগানিয়া জার্নাল – তৃতীয় ভাগ
পর্ব।। নয়।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
সে সময়ে ভারত সরকারের নীতি ছিল যে আসাম চা নিয়ে যাবতীয় পরীক্ষামূলক কাজকর্ম করে তাকে বাজারে দাঁড় করিয়ে বাকী কাজ অর্থাৎ বাণিজ্যিক ভাবে চা-চাষের কাজ ব্যক্তি-মালিকানার হাতে তুলে দেবে। এজন্য যা যা আরও সাহায্য করা দরকার সেসব কাজটাও তারা করবে।
ফলে এখন, আসাম চায়ের পরীক্ষামূলক ফলাফলে তৃপ্ত হয়ে, তারা দেশের বণিকদের ডেকে বলল – আমরা যা করার করে দিয়েছি।এখন আপনারা ডিব্রুগড়, টিংগ্রী এবং নাগা পর্বতের চারপাশের এইসব সফল চা-বাগানগুলো দেখুন। এবং নিজেরা বাণিজ্যিক ভাবে চা-চাষের কথা ভাবুন।
অর্থাৎ সোজা কথায় চা-চাষের জন্য বণিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার কথা বলল।
কিন্তু বললে কি হবে- বাণিজ্যিক ভাবে চা চাষের জন্য তো তিনটে জিনিষ লাগবেই - পুঁজি, জমি আর শ্রমিক।তার কী হবে!!!
আগেই বলা হয়েছে যে উচ্চ-আসাম তখন মূলত সিংফোদের , মাটকদের আর রাজা পুরন্দরের অধীনে ছিল। ফলে বৃটিশদের কাছে এই চা-অঞ্চল তখনও বিদেশ। বৃটিশরা সেখানে তখন ভারত সরকারের এক রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং কিছু সৈন্য বসিয়ে রেখেছে – ওখানে ব্যবসারত ইউরোপিয়ানদের দেখভালের জন্য, বিপদে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু চা-চাষের জন্য নিজেদের কব্জায় জমি লাগবে প্রচুর। তা পাওয়া যাবে কী ভাবে। ফলে এবার সে পথে এগিয়ে চলার পালা।
১৮৩৯ সালে চুক্তিভঙ্গের অপরাধে রাজা পুরন্দর সিং-কে হটিয়ে বৃটিশরা ইংল্যান্ডের রাণীর নামে শিবসাগর এবং লখিমপুর জেলা বৃটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করে নিল। ফলে উচ্চ-আসামের জমি এল বৃটিশরাজের হাতের মুঠোয়।
ভারতে চা-চাষের লক্ষ্যে ১৮৩৯ সালে কলকাতার কয়েকজন পুঁজিপতি , সরকারি সম্মতিতে, তৈরি করে ‘বেঙ্গল টি এ্যাসোসিয়েশান’। তারমধ্যে ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর ( রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর্দা) এবং প্রসন্ন কুমার ঠাকুর এবং দেশি-বিদেশি আরও কিছু মানুষ। ওদিকে সেবছরই ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনে একই উদ্দেশ্যে তৈরি হল ‘দি আসাম কোম্পানী’ নামে এক জয়েন্ট স্টক কোম্পানী – যার প্রাথমিক পুঁজি (Capital) ধরা হল পাঁচ লক্ষ পাউন্ড।
উদ্দেশ্য একই হওয়ায় এবং যেহেতু চা-ব্যবসার জন্য বড় পুঁজির প্রয়োজন – ফলে অচিরেই, কিছু শর্ত সাপেক্ষে, ‘বেঙ্গল টি এ্যাসোসিয়েশান’ মিশে গেল ‘দি আসাম কোম্পানীর ‘ সঙ্গে।
সরকার পরীক্ষামূলক ভাবে এতদিন যে চা তৈরি করেছে তার কাঁচামাল (চা-পাতা) সব সংগ্রহ করা হত প্রাকৃতিক ভাবে ইতিউতি গজিয়ে ওঠা চা-জঙ্গল থেকে। সেসব জঙ্গলের অবাঞ্ছিত ডাল-পালা কেটে, গাছের তলা পরিষ্কার করে, চা-গাছগুলোকে তিন ফুট উচ্চতায় ছেঁটে, কোথাও জঙ্গল তারজাল দিয়ে ঘিরে তাকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হত। অর্থাৎ নিজেরা নতুন করে কোন চা-বাগান তৈরি করে নি- শুধু কিছু ছোটখাটো নার্সারি ছাড়া – তা ও মূলত চিনা চারা দিয়ে তৈরি।
তখন অনেক পুঁজিপতিই সরকারকে বলেছিল যে সরকার তার চা-জঙ্গলগুলো তাদের দিয়ে দিক এবং চা-চাষ ও বাণিজ্যের অধিকার তাদের জন্য একচেটিয়া (monopoly) করে দিক। কিন্তু সরকার তাতে রাজি ছিল না।
এখন ‘দি আসাম কোম্পানী’ তৈরি হবার পর তারা সরকারের কাছে চা-চাষের জন্য তাদের নামে জমি দিতে বলল। কিন্তু সে সময়ে একে তো সদ্য নিজেদের অধিকারে নেওয়া উচ্চ-আসামের জমি-নীতি তখনও নির্দিষ্ট হয় নি, তারওপর স্থানীয় সিংফো ও নাগাদের সঙ্গেও সম্পর্কের কিছু অনিশ্চয়তা রয়ে গ্যাছে।১৮৩৯ সালে খামতি জনজাতিরা বিদ্রোহ করেছিল। তাতে কর্নেল হোয়াইটের মৃত্যু হয় এবং সাদিয়ার সামরিক ছাউনি প্রায় ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়।
এই ঘটনার জন্য তখন ব্রুসকে আরও নতুন চা-অঞ্চল খোঁজা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছিল এবং ব্রুস ও তার সহকারীদের প্রাথমিক আত্মরক্ষার জন্য কিছু অস্ত্রশস্ত্রের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।কেননা ব্রুসের আবিষ্কার করা বেশীরভাগ চা-জঙ্গলই ছিল সিংফো এবং নাগাদের অঞ্চলে।
ফলে নতুন জমি দেবার পরিবর্তে সরকার আসাম কোম্পানীকে তার নিজের অধীনে থাকা সমস্ত চা-জঙ্গলের দুই-তৃতীয়াংশ এবং নিজস্ব কার্যালয়গুলো দশবছরের জন্য বিনা ভাড়ায় দিয়ে দিল। সরকার নিজের কাছে দিনজান এবং চাবুয়ার দুটো ছোট নার্সারি শুধু রেখে দেয় – যেগুলো শুধুমাত্র চা-শিক্ষানবিশদের জন্য এবং পরীক্ষামূলক কাজের জন্য ব্যবহার করা হবে যাতে আরও উন্নত চা গাছ তৈরি করা যায়।
সরকারের নিজস্ব কার্যালয় বলতে তখন কোন দালান-কোঠা ছিল না; সব ছিল কাঁচা বাঁশের কাঠামোর ওপর কাদামাটি লেপা চাটাই-এর বেড়া আর খড়ের চালা।এর ভিতরেই চা তৈরি করা হত।
চা-জঙ্গল নিজেদের নামে পাওয়ার পর কোম্পানী তাদের প্রধান অফিস স্থাপন করে নাজিরা-তে। এবং জে ডাব্লু মাস্টার্স (J.W.Masters) বলে তার একজন বরিষ্ঠ আধিকারিককে (Senior Officer) সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করে। এরপর কোম্পানী সরকারের কাছে চার্লস ব্রুসকে পাবার জন্য দরবার করে – কেননা তখনও পর্যন্ত একমাত্র ব্রুসই জানতো কী করে চা-গাছ পরিচর্যা করতে হয় এবং কেমন করে চা বানাতে হয়।
পয়লা মার্চ,১৮৪০-এ ব্রুস আসাম কোম্পানিতে যোগ দেন। সরকারি চা-বাগানগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রুসের এক সহকারি মি.ডুফিল্ডকে (Mr. Duffield)। ব্রুস জয়পুরকে কেন্দ্র করে মাটক এবং সিংফো অঞ্চলের চা-জঙ্গল – যাকে এখন থেকে বলা হতে লাগল কোম্পানীর ‘উত্তর বিভাগ’ (Northern Division)- দেখাশুনার দায়িত্ব পেলেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে । আর গাব্রু পর্বত অঞ্চলের চা-জঙ্গল (ভূতপূর্ব রাজা পুরন্দরের রাজ্য) ইত্যাদিকে – যাকে এখন বলা হতে লাগল ‘দক্ষিণ বিভাগ’- তার সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হল মাস্টার্সকে। এছাড়া নাগা পর্বত অঞ্চলের চা-জঙ্গল – এখন পূর্ব বিভাগ – এর দায়িত্ব দেওয়া হল জে পি পার্কার ( J P Parker) বলে আর এক ইউরোপীয়ানকে। এত ভাগাভাগির কারণ চা-জঙ্গলগুলোর মধ্যেকার দূরত্ব এবং যোগাযোগের অপ্রতুলতা।
এই প্রস্তুতির ভিতর দিয়ে ‘দি আসাম কোম্পানী’-র হাত ধরে শুরু হল ভারতীয় চা-শিল্পের বাণিজ্যিক যাত্রা। সেই হিসেবে সূচনাকাল ১৮৩৯-৪০ খৃষ্টাব্দ ধরা যায়।
ভারতীয় চা আবিষ্কারের শুরুতে যে ভারতীয় শিষ্ট মানুষটির কথা উঠে এসেছিল, বলা হয় যার কাছ থেকে রবার্ট ব্রুস সিংফোদের চা ‘ফালাপ’-এর খবর জেনেছিলেন, সেই মনিরাম দত্ত বরুয়া বড় ভান্ডারী বৃটিশদের খুব কাছের লোক ছিলেন এবং স্থানীয় জনজাতিদের সঙ্গে গোলমালের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতেন।১৮৩৯ সালে তিনি আসাম কোম্পানীতে যোগদান করেন ‘দেওয়ান’ (জমি-প্রতিনিধি) হিসেবে – যার জন্য পরবর্তী কালে তার পরিচিতি হয় ‘মনিরাম দেওয়ান’।
কিন্তু কোম্পানীর সঙ্গে মতবিরোধ এবং তার তীব্র স্বদেশী-চেতনার কারণে ১৮৪৫ সালে কোম্পানী ছেড়ে তিনি নিজেই তৈরি করেন জোরহাটের কাছে সিন্নামারা (Cinnamara) চা বাগান এবং শিবসাগর জেলার সুফ্রাই-এর কাছে সেংলাং (Senglung) চা বাগান - প্রথম ভারতীয়র চা বাগান যা ১৮৫৮ পর্যন্ত অত্যন্ত সফল ভাবে চলেছিল। কিন্তু ইউরোপীয়ানদের বোধহয় তা সহ্য হল না। তারা ছুতো খুঁজতে লাগল। অবশেষে বৃটিশরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করার অপরাধ দেখিয়ে ১৮৫৮ সালে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং তার বাগানদুটো সমেত সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
ভারতীয় চা শিল্পের সেই প্রথম ভারতীয় শিল্পপতি মনিরাম দেওয়ানের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে আপাতত এখানেই শেষ হল বাগানিয়া জার্নাল।
-------------------------------------------------------
ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া...