পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ২৫
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
নয়া খাওয়া
হেমন্তের
সকাল তখনো ভালো করে জেগে ওঠেনি । শীতকাঁটা গায়ে জবুজবু হয়ে আছে।
দুব্বোঘাস, লাউপাতা, শিমফুল -সবখানে টুপটুপে শিশির। একটা ঘোর ঘোর আলো ফোটার
সময়টায় কুয়োতে বালতিতে জলের বিচিত্র আওয়াজে জেগে উঠল দিন। যেন খোলস ভেঙে
আড়মোড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল ঠান্ডা উঠোনটা। বসমতী বালতিতে গোবর গুলে সারা উঠোনে
ছড়িয়ে ঝাঁটা দিয়ে ঝড়াৎ ঝড়াৎ করে উঠোন ঝাঁট দিতে লাগল। তার সাথে সাথে সারা
উঠোনে ঝাঁটা দিয়েই ঠিকমতো গোবরজলটা ছড়িয়ে দিতে লাগল। আর আলাদা করে উঠোন
লেপার দরকার হয় না এতে। কাল সন্ধ্যাতেই গোবর জমা করে রেখেছিল একটা ভাঙা
বালতিতে। এত সকালে কি করে গোবর পাবে? স্নান না করে বাড়ির বৌ -এর গোয়াল ঘরে
ঢোকার নিয়ম নেই।
কান্তেশ্বরের ঘুম যথেষ্ট গভীর হলেও
এত উচ্চকিত আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙে যায়। খালি গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বাইরে
বেরিয়ে আসে। হাই তুলতে তুলতে ঘুমঘুম ভার ভার গলায় বলে,
"সোমায়টা কি পালাছে, অ্যাত সাকালে কাজোত ধইচ্চেন?"
বসমতী সে কথার উত্তর না দিয়ে বলে,
"মুখ ধও, নন, এখিনা সামটিয়া গাও ধচোং, করং সেলা চা পানি। তাবৎ ওত্তি থাকি কোনেক হাঁটি আইসো। দেহাটা এলায় ঝরঝরা নাইগবে।"
আগের দিন রাতের খাওয়া শেষ করেই রান্না ঘর পুরোটাই লেপে রেখেছে, বিকালে ডারিয়া ঘর,শোবার ঘর। উঠোনটাই শুধু বাকী ছিল।
কুয়ো
থেকে ধোঁয়া ওঠা জল ঝুপ ঝুপ গায়ে ঢালতে থাকে আর হি হি করে কাঁপতে থাকে
বসমতী। তাতে কী! কাঁপতে কাঁপতেই কুয়োপাড় ঘেরা বাঁশের বেড়ার গায়ে লাগানো
তক্তা থেকে আদ্ধেক করে কেটে রাখা সজিমাটি সাবানটা হাতে নেয়। ভালো করে গায়ে
মাথায় ঘষে স্নান করে।
উনুনে খড়ি গুঁজে তিন ঠেঙাটা
বসিয়ে চায়ের জল চড়ায়। ছেলে-মেয়েরা ওঠেনি এখনও। চা নামিয়ে ঠেঙাটা সরিয়ে
দুধটা বসিয়ে দেয়। আজ উপোস। শুধু চা খাবে একটু। অঘ্রাণের পয়লা তারিখেই বরাবর
নবান্ন করে বসমতী। কান্তেশ্বর চা খেয়ে কলা গাছ কেটে সুন্দর গোলমতো করে
বানিয়ে নিয়ে আসে। ওটাকে আসলে ম্যান্ডো বলে।রসবালারও সকাল সকাল স্নান সারা।
ওকে দেখে বসমতী বলে,
"চা খাবুতে বানা।"
রসবালা মাথা নাড়ে। কিন্তু কান্তেশ্বর ছাড়বে কেন! অতি উৎসাহে বলে ফেলল,
"নে নে বানা বানা। টুটিটা শুকি যাছে।"
বাচ্চাগুলোর আজকে পড়াশুনার নামগন্ধ নেই। বাবার পায়ে পায়ে ঘুরছে আর অজস্র প্রশ্নে মাথা খালাপ করে দিচ্ছে।
"হিটা কি বাবা? হিটাক কি কয়?"
"হিটা ম্যান্ডো মাও। তোর মাও যে ধানের আগ নিবে, হিটাত করি আনিবে।"
"কেনে তে ম্যান্ডো নাগে। ধান কাটা হইলে না মানষি তে এংকরি মাথাত আনে!"
"আজি যে পূজা মাও। আজি এংকরি আনা যায় না।"
"কেনে যায় না বাবা?"
"ঠাকুর আগ হবে"
মেয়ে
বোধহয় সবেমাত্র বলতে যাচ্ছিল "কেনে ঠাকুর আগ হবে" -তার আগেই রসবালা ডাক
দেয়। কান্তেশ্বরের শেষের উত্তরটার সুরেই বোঝা যায় উত্তর দিতে দিতে বেচারা
ক্লান্ত। রসবালা বাপ-বেটির কথা মন দিয়ে শুনছিল। এবার ডেকে বলে,
"আয় তো মাও এদি। ফুলের ঢোনাটা নেক তো। মোর হাতোত ধরেছে কে না।"
চা খেয়ে কান্তেশ্বর কাস্তে হাতে বের হয়। রসবালা বলে,
"থাউকখেনে দা। আইসেছে না বড়বাউ, পাত-পটুয়ালা কাটিবে এলায়। কতলা মানষিক কইসেন।"
পূজার জিনিসপত্র নিতে নিতে বসমতী উত্তর দেয়,
"নাই কই বেশি মানষিক। টারি বাড়িতে খালি বুড়া কয়টাক, ছাওয়ালাক আর অগলে বগলে দুই একঘর না কইলে চলে না, তাকে কয়া আইচ্চে।"
ম্যান্ডোটা
একটা চকচকে কাঁসার থালার উপর বসিয়ে মাথায় নেয় বসমতী। রসবালা কান্তেশ্বরের
কাছ থেকে কাস্তেটা নিয়ে হাতে নেয়। তারপর উলু দিতে দিতে বসমতী আর রসবালা
মাঠের দিকে যায়। দুজনেই স্নান করে ক্ষারে কাচা পরিস্কার শাড়ি পড়েছে।
ছেলেমেয়ে দুটো লাফাতে লাফাতে আগে আগে চলেছে। বকা দিয়েও থামানো যাচ্ছে না।
নিজেদের ক্ষেতের কোণটায় এসে থামল বসমতী। প্রথমে পুজো দিল ভক্তি ভরে। তারপর
কাস্তে দিয়ে একগুচ্ছ শিষ কেটে নিয়ে কাঁসার থালায় বসানো কলাগাছের উপরের খোলা
বা ঢোনা দিয়ে বানানো ম্যান্ডোটায় রেখে আবার উলু দিতে দিতে বাড়ির পথে
এগোলো।
রসবালা বলে,
"মুই
একেদিনে নয়া না খাইম। ধানে পাকে নাই হামার। কাঁচাতে আগোত 'ধানের আগ' নিম,
তার পাছে নয়া খাইতে খাইতে অগন মাসখানের শেষাশেষি যাবে।"
বসমতী বলে,
"নয়া খাবার জইন্যে না চাইট্টা ধান আগুরি গাড়ির নাগে।"
ঠাকুর
ঘরে ম্যান্ডোটা রেখে বসমতী, রসবালা দুজনেই পুজোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন
ধানের চিঁড়ে, দই, কলা, বাতাসা কলার পাতায় সাজিয়ে নেয়। উলু আর শাঁখের আওয়াজে
কেমন একটা মন ভালো করা পরিবেশ। এই করতেই বেলা গড়িয়ে যায়। দুপুরবেলাটা দই
চিঁড়ে খেয়েই কেটে যায়। কান্তেশ্বর বেলাবেলি হাটের দিকে রওনা দিয়ে দেয়।
ওকে বেরোতে দেখে সুন্দরমণি বলে,
"হ, তোমার হাটুয়া যে এলাইতে হাট বিরাইসে।"
বসমতীর মেয়েই চটজলদি উত্তর দেয়,
"আজি যে হামা নয়া খাচি জেটাই। মোর বাবা মোটা মাছ আনিবে। তোমা কুনদিন খাবেন?"
সুন্দরমণি হাসে। দস্তার জগে করে দ্যধ দিতে এসেছে। ওর মার হাতে জগটা দিতে দিতে বলে,
"হামার যে জমিয়ে নাই মাও। কী নয়া খামু। গোটায় বছরটা কিনি খাই মাও, আর
এশোনের শিলওলা চাউল। কামড়াইতে দাঁত এখেরে টেঙা হয়া যায়। হামার কাজ না
কইল্লে ভাত নাই! নয়া খাবেন তোমরা।"
বসমতী জগটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বলে,
"ছাওয়া দুইটাক ধরি তুই কোনেক জোগোতে আসিস। কোনেক হাতাপাতি করি দিস। কালি দাদাক যায়া কয়া আচ্চুঙ, কয় নাই।"
সুন্দরমণি হাসে। বলে,
"তোর দাদা না কইল। তে মুই কছোং সোগায় যামু এখেরে?"
বসমতী হাসে।
"মানষিয়ে তোমরা চাইরখেনা। দুইটা তো ছাওয়ায়। আইসেক পছ করি।"
সন্ধ্যার
আগেই রান্না শেষ হয়। বসমতী কলার ঢোনায় করে ভাত, মাছের ঝোল, মাসকলাইয়ের
ডাল, আলো-বেগুন-মূলোর তরকারি, আর মোটা মোটা আলুভাজা বেড়ে সাজাতে থাকে। একটা
ঢোনা কান্তেশ্বরের হাতে দিয়ে বলে,
"এইটা ওদি কাউয়া, চিলা, পকি-পয়ালোক দিয়া আইসো।"
সঙ্গে
সঙ্গে বাচ্চাগুলো সবমিলে হৈ হৈ করে ঢোনা দুটো হাতে নিয়ে বাইরে গিয়ে
পাখিদের ডাকতে লাগল। কিন্তু খাওয়া তো দূরের কথা কোনো কাক-পক্ষীও ওদের ভয়ে
কাছে আসার সাহস পেল না, সব কুকুরে খেয়ে নিল। হৈ হৈ করে ফিরতেই
মাছ-ভাত-ডাল-সব্জি সাজানো আরো দুটো ঢোনা বাচ্চাদের হাতে দিয়ে বলল,
"এইলা কুকুর শিয়ালোক দিয়া আইসো।" মহা আনন্দে ঢোনা নিয়ে আবার বাইরে ছুটল
সব। চার-পাঁচটা কুকুর একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঢোনাদুটোর উপর। বসমতী চটপট ভাত
বাড়ছে ঢোনায়। এরপর বাকি থাকল মহাবীর ঠাকুর। উঠোনের এক কোণে ধানের পুঞ্জিটার
উপরে উঠে একজোড়া ঢোনা মহাবীর ঠাকুরের উদ্দেশ্যে কলাপাতা দিয়ে উপরে শিলচাপা
দিয়ে ঢেকে রাখা হল। বাচ্চাগুলোই উঠে পড়ল।মহাবীর ঠাকুর মানে হনুমান। এখন তো
আর তেনারা নেই। বাড়ির বাচ্চারাই পরদিন সকালে পেড়ে নিয়ে প্রসাদ হিসেবে খেয়ে
নেয়। বুধেশ্বরের বাপ ঢুকতে ঢুকতে বলে,
"বাউ তো যায়া কয়া আসিল। হামরা তো এলাং নয়ায় খাই নাই বারে, হামার তো পোসাদ খাওয়ায় চলিবে না!"
বসমতী তাড়াতাড়ি বলে,
"না হয় বাবা। তোমার জইন্যে আলাদা আন্দিছি। নয়া ভাত খাবার নানাগে। অসবালাটা আন্দেছে, উয়াও না না খাবে। উমরাও নয়া খায় নাই আজি।"
উপস্থিত দুই-একজন আজকে নবান্ন করলেও অনেকেরই আজকে নবান্ন হয়নি।
"হামার এলাং ধানে পাকে নাই বাহে। কাঁচাতে কাটি আনি নয়া খামু এইবার।"
বুধেশ্বরের বাপ নিশ্চিন্ত হয়ে হুঁকাটা হাতে নেয়। উঠোনেই খাবার আয়োজন।
রসবালাসকূপী, লন্ঠন ধরিয়ে উঠোনটা পরিস্কার করে চট পেতে দিতে দিতে হাঁক
পাড়ে,
"সুষেন লে, কলার পটুয়াগিলা ধুয়া আনখেনে। বিষেনটা কোটে গেল।"
"সাঞ্জোতে এখেরে খাবে তে?"
সুষেণের কথার উত্তরে লসবালা বলে,
"দিবার নানাগে তে কি, বুড়া মাটঠা মানষিলা সইঞ্জার গোড়ে গোড়ে খায় কে বাড়িত। তোমরা এলা খান নিশার আতি, পহর আতি।"
বয়স্করা
বাচ্চারা খেয়ে নিলে কান্তেশ্বর, সুষেণ-বিষেণ টর্চ নিয়ে সবাইকে বাড়ি পৌঁছে
দেয়। সব শেষে কয়েকজন মাত্র থাকে। গ্রামের রাত নিঝূম হতে হতে শান্ত হয়ে যায়
ক্রমশ। রসবালারাও বাড়ি ফিরে বুক অবধি কাঁথা টেনে ঘুমিয়ে পড়ে।
----------------------------------------------------------
ছবি : রীতা রায় ও ময়ূখ রায়