নানা রঙের গানগুলি-২৫/শৌভিক কুন্ডা
নানা রঙের গানগুলি (২৫ এবং শেষ)
শৌভিক কুন্ডা
---------------------------------------------
থামতে জানতে হয়। থামাতে। সেই কবে সলিল চৌধুরী গেয়েছিলেন,
"এই রোকো,
পৃথিবীর গাড়িটা থামাও,
আমি নেমে যাবো,
আমার টিকিট কাটা অনেক দূরে
এ গাড়ি যাবে না,
আমি অন্য গাড়ি নেবো।" আমি অবশ্য সে অর্থে বলছি না, অন্য গাড়ি নেওয়ার ইচ্ছে নেই কোনো। কিন্তু, সহজ উঠোনে এই ধারাবাহিক লিখতে লিখতে একঘেয়েমি চলে এসেছে কিছুটা, শরীরও খুব একটা ভালো নয়। আমার চিকিৎসক ঘাড় গুঁজে লিখতে না করে দিয়েছেন। সুতরাং, আপাতত আজই শেষ পর্ব। তবে, নানা রঙের গানগুলি তো অন্তহীন পথ। পরে আবারও কখনো এ নিয়ে এই উঠোনেই ফিরে আসবো হয়তো। অন্তত, অন্য গাড়ি নয়।
আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন "প্রিয় গায়িকা/গায়ক কে?" একবচনে এর উত্তর হয় না। তবু, যদি একেবারে তেমন বাধ্যবাধকতাই থাকে, যাঁর নাম সবার আগে মনে চলে আসে, তাঁর গান প্রথম শুনি সম্ভবত সাতের দশকের মাঝামাঝি। তখন তিনি বিশ্বশ্রুত। আর আমি সদ্য শোনার মাটিতে টলমল পা রাখছি! বর্ষার দিন ছিলো। ছুটিই, নাকি স্কুল যাই নি, মনে পড়ছে না। আমাদের ভেতরউঠোনে চার ঘরের একটা টিনের চাল দেওয়া আলাদা বাড়ি ছিলো। ওটা ভাড়া দেওয়া হ'ত। তখন যাঁরা ছিলেন, সে পরিবারটিতে একটি মেয়ে, আমার থেকে কিছুটা ছোটো বয়সে, প্রায়ই ক্যাসেট চালিয়ে গান শুনতো, এবং নানা ধরনের। তো ঐ বৃষ্টির দুপুরে ওদের টিনের চালে ঝমঝম ছাপিয়েও আমার কানে ভেসে এলো মেঘডাক। খেয়াল করলাম অসম্ভব সুরেলা সেই মেঘ! কান পেতে শুনতে শুনতে, বাকি আর কিছু মনে নেই, কিন্তু ফিরে ফিরে আসা একটি চরণ আমার ভেতর বাসা বেঁধে নিলো,
"তেরে নয়নো কা জালিম
হুঁ ম্যায়......"
তখন জালিম অর্থ জানি না, হিন্দিও প্রায় না-ই, উর্দু দূর অস্ত্! আমার ক্যাসেট প্লেয়ার ছিলো না তখনও। বৃষ্টি ফুঁড়ে জিজ্ঞেস করলাম মুনকে, "কার গান রে?" উত্তর এলো, "মেহেদি হাসান।"
এরপর বহুকাল তাঁকে শুনি নি। বরং গুলাম আলিই বেশি। মাঝে পিনাজ মাসানি। জগজিৎ সিং। তালাত আজিজ। পঙ্কজ উধাস। হরিহরণ। এমনকি ভজনের জন্যই পৃথিবী যাঁকে চেনে, সেই অনুপ জালোটার গজলও (আইয়ে বারিষোঁ কা মৌসম হ্যায়, চান্দ আঙরাইয়া লে রহি হ্যায়, পেশানিয়ে হায়াত পে কুছ এয়সে পল, ইত্যাদি)!
মাঝে নিজের জীবনের থেকে সুর ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিলাম।
তারপর, একদিন আমার এখনকার চাকরিস্থলে সহকর্মী সঞ্জীবের মোবাইল থেকে সুর বাজালো মেঘস্বর।
"কুবাকু ফ্যয়লে হুয়ি বাত
সানাস আয়ে হ্যায়"!
মনে পড়লো, ঐ ক্যাসেট যুগ থেকে মোবাইলগানে পৌঁছনোর মাঝে একটা সময় স্রেফ এই স্বরটিকে জানবো বলেই নিজের চেষ্টায় উর্দু কিছুটা শিখেছিলাম! তার পর, প্রভু, আমি নষ্ট হয়ে যাই।
কিন্তু ফিরে যখন পেলাম আবার, আঁকড়ে রইলাম। হ্যাঁ, আজ অবধি।
গজল শাহেনশার কত গান কতবার যে শুনেছি, শুধু সে সব নিয়ে লিখতে গেলেই মহাভারত! প্রথম যে গজলটি তাঁকে খ্যাতির আসনে বসিয়েছিলো বলে অনেক সমালোচকের ধারণা, সেটা ১৯৬৪তে, বোধহয় আমার জন্মসালটিকে অমর করে রাখার জন্যই,
গুলোঁমে রঙ ভরে
বাদ মা নৌবাহার চলে....!
ম্যায় হোঁশ মে থা ফির, পাত্তা পাত্তা বুটা বুটা, মুহব্বৎ করনে ওয়ালে কম না হোঙ্গে, রাফতা রাফতা য়ো মেরি হাসতি কা সামান হো গ্যয়ে, হামে কোয়ি গম নহি থা, আবকে বিছরে, বাত করনি মুঝে মুশকিল, রঞ্জিশ হি সহি দিল হি দুখানে কে লিয়ে আয়ে..................
এইসব উচ্চারণ আমাকে প্রতি মুহুর্তে ছুঁয়ে থাকে। আর, যে গানটি আমার শ্বাস হয়েই বেঁচে আছে,
"জিন্দেগী মে তো সভি
প্যায়ার কিয়া করতে হ্যায়
ম্যায় তো মর কর ভি মেরি জান
তুঝে চাহুঙ্গা......",
সবসময়ই শুনতে থাকি মনে মনে।
গানটিতে একটা জায়গা আছে, মেহদি হাসান গাইছেন,
এক জারা সা গম-এ-দৌড়া কা ভি হক হ্যায় জিস পর,
ম্যায়নে ও সাঁস ভি তেরে লিয়ে রাখ ছোড়ি হ্যায়।
আমার কাঁচা বঙ্গানুবাদে এ রকমটা দাঁড়িয়েছে,
আমার দুঃখদিনে একমাত্র যার ওপর আমার অধিকার, সেই শেষ নিঃশ্বাসটিও তোমারই জন্য তোলা রইলো!
না, এই তুমি রক্তমাংসের নারী নও কেউ, নও মানসপ্রতিমাও। এই কথাগুলো আমি উচ্চারণ করতে পারি কেবলমাত্র গানের জন্য। নানা রঙের গানগুলির জন্য।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴