দাঁড়াবার জায়গা/পঁচিশ
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
দুটো
খেলা আমাদের খুব প্রিয় ছিল, একটা হাডুডু, আরেকটা দাড়িয়াবান্ধা। হাড়ুডু
যে কবাডি বা কোথাও তার নাম হুতুতু, সেটা অবশ্য তখন জানতাম না। এই হাডুডু
মূলত গ্রামীণ খেলা বলেই এ খেলার সঙ্গে শহুরে ছেলেমেয়েদের তেমন পরিচয় ঘটে
ওঠেনি তখন অবধিও। পরে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে কবাডি জায়গা করে নিলে তার
ব্যাপক পরিচিতি গড়ে ওঠে।
হাডুডু
এবং দাড়িয়াবান্ধা আমি, আমরা খেলেছি ক্লাস টেন অবধি। এ খেলার সুবিধে হলো
কোনও উপকরণ দরকার নেই। প্রয়োজন শুধু কয়েকজন খেলোয়াড় আর এক খণ্ড উঠোন।
সেরকম উঠোন আমাদের এলাকায় অনেক ছিল। তবে, খেলার জন্য আমাদের বাড়ির লাগোয়া
অন্তত দুটো জমি ছিল। স্কুল থেকে ফিরে সেখানে আমরা, পাড়ার সমবয়সী
ছেলেমেয়েরা খেলায় মত্ত হয়ে যেতাম। একটা কোর্টকে দু-ভাগে ভাগ করা হতো।
একেকটি ভাগ ছিল একেক দলের দখলে। দুটো দল দুপাশে দাঁড়াত। এক দলের একজন
খেলোয়াড় মুখে ‘দম’ দিতে দিতে প্রতিপক্ষের এলাকায় ঢুকে পড়ত। এই ‘দম’ থাকা
অবস্থায় প্রতিপক্ষের কাউকে স্পর্শ করে দৌড়ে নিজের এলাকায় ঢুকে পড়লেই যাকে
ছোঁয়া হয়েছে সে ‘মরে’ যেত, মানে দল থেকে বাদ পড়ত। কিন্তু প্রতিপক্ষের
খেলোয়াড়রা তাকে ধরে আটকে রাখলে একসময় ‘দম’ ফুরিয়ে যেত এবং সে তখন বাদ পড়ে
যেত। খুবই উত্তেজনাকর এই খেলায় সবচেয়ে সুবিধে পেত যাদের গায়ে জোর বেশি।
কারণ, প্রতিপক্ষের হাতে ধরা পড়ার পর হুটোপাটি করে বেরিয়ে আসতে পারলে
প্রতিপক্ষের অনেকে একসঙ্গে ‘মরে’ যেত। আমাদের নানা রকম ‘দম’ ছিল। সেটা মুখে
ক্রমাগত, বিরতিহীন সশব্দে উচ্চারণ করে যেতে হতো। যেমন ছিল ‘চু কিত কিত কিত
কিত...’। হঠাৎ একদিন একজন কোত্থেকে একটা নতুন ‘দম’ শিখে এলো। এমন সে ‘দম’
যে আর ফুরোয় না! সত্যি বলতে কি, সে দম কখনই ফুরোবার নয়! সে আমদানি করেছিল
‘আহ্, উহ্, আমড়ি গাছের চামরি চুহ্’! বাক্যটাই এমন যে, অনবরত উচ্চারণ করে
গেলেও প্রশ্বাসের কোনও সমস্যাই হয় না। ফলে, প্রতিপক্ষের কাছে পর্যুদস্ত
হবার প্রশ্নই নেই! এনিয়ে অনেকেই নানা প্রশ্ন তুললে, সে এবারে নতুন করে শুরু
করল ‘আহ্, উহ্, হলদি বাটা কাইয়া গু’! কায়দা সেই একই! এখানেও দম ফুরোবার
প্রশ্নই নেই!
আমরা সকলে
আলোচনা করে একদিন রুখে দাঁড়ালাম। সকলের সিদ্ধান্ত, এরকম কোনও ‘দম’ চলবে
না। এতে নতুন ‘দমের’ আমদানিকারক একেবারেই দমে গেল। সে আর কখনই আমাদের সঙ্গে
খেলায় অংশ নেয়নি। শুধু হাডুডু নয়, কোনও খেলাতেই সে আর আমাদের সঙ্গে থাকত
না। এই খেলোয়াড়টি সে-ই যে একসময় আমার প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালে অদ্ভুত এক
খেলার নামে আমার সব কটি লাটিম জিতে নিয়েছিল! অনেক পরে ভেবে দেখেছি, তার
ভেতরে একটা অসরল মন শৈশব থেকে বরাবরই সক্রিয় ছিল। কেমন একটা অপরাধপ্রবণতা
দেখেছি তার মধ্যে খুব কম বয়সেই। আমার আঁকা ছবি বহুবার সে নষ্ট করে দিয়েছে।
মাটি দিয়ে তৈরি মূর্তি ভেঙে দিয়েছে। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে দেখেছি লাটাইয়ের
কাছে সে হাত দিয়ে ঘুড়ির সুতো টেনে ছিঁড়ে দৌড়ে পালিয়েছে। এসব সে করত যখন
সামনে আর কেউ থাকত না। তবে, একথা স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের সেই সময়ের
অত্যন্ত ক্ষুদ্র গণ্ডিতে বদ্ধ জীবনে সে অনেক নতুন নতুন খেলার আমদানিও
করেছে। শুধু মার্বেলেরই কত রকমের খেলা! সেসবের নাম ভুলে গেছি এতদিনে।
দাড়িয়াবান্ধা
খেলায় অবশ্য বড়রাও প্রায়ই অংশ নিত। প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালে দলে
খেলোয়াড় সংখ্যা বিজোড় হয়ে গেলে, আমার অংশ নেবার সুযোগ হতো না। খেলোয়াড়
সংখ্যা বেশি হয়ে গেলেও আমরা একটু ছোটরা বাদ পড়ে যেতাম। তখন কোর্টের বাইরে
দাঁড়িয়ে আমরা অন্যদের খেলা দেখতাম। তাতে অবশ্য আমাদের আনন্দ কম হতো না।
বরং, বড়রা যেভাবে ছুটোছুটি করে খেলত তাতে আমরা বিস্মিত হতাম। একদিনের কথা
খুব মনে আছে। শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। সকলের গায়েই জামা। আমার গায়েও জামা, তবে,
ওপরের একটা ছাড়া সব বোতাম বেপাত্তা! ফলে, দৌড়লে সেই জামা পেছন দিকে
উড়তে থাকে, লাট খায়। তো, আমি একে একে খোপ কাটা ঘরগুলো পেরিয়ে যাচ্ছি
দুরন্ত গতিতে। হঠাৎ মহাদেবদা (এঁর কথা আগে একবার বলেছি। পাড়ায় এক বাড়িতে
ভাড়া থাকতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁদের পরিবারের বাকি সব
সদস্য চলে আসেন। মহাদেবদার এক ভাই আমাদের কুটুদা, রঞ্জিৎ দেব, মড়াপোড়া
দীঘির পাড়ে তিনি প্রিন্টিং প্রেস বসিয়েছিলেন, একথা একবার উল্লেখ করেছি।
সেই যে, আমার প্রথম কবিতার বইটা ছাপা হয়েছিল যাঁর প্রেসে) চিৎকার চেঁচামেচি
জুড়ে দিলেন। কী হয়েছে? না, আমাকে তিনি ছুঁয়ে দিয়েছেন এবং আমি ‘মোর’!
কিন্তু, সত্যিটা হলো, আমার গায়ে তাঁর হাতের কোনও স্পর্শই হয়নি। ফলে, আমি
জোর আপত্তি করে চলেছি। তিনি দাবি করলেন, আমার জামায় লেগেছে তাঁর আঙুলের
ছোঁয়া! আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম, ‘জামা কি শরীর’? যুক্তিটা যথেষ্ট জোরালো
বলেই আমার মনে হয়েছিল। কিন্তু মহাদেবদা কীভাবে যেন বাকিদের সম্মতি আদায়
করে নিলেন! সকলেই মেনে নিল, জামায় স্পর্শ হলেও ‘মোর’! আমি মেনে নিতে
পারছিলাম না। কয়েকজন বলল, ‘তাহলে তোকে খেলতে হবে না’। আমি সঙ্গে সঙ্গেই
খেলা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। মহাদেবদা মুখে যাই বলুন, আমার জামাতেও তাঁর আঙুলের
স্পর্শ হয়নি আমি নিশ্চিত। ফলে, ক্ষুব্ধ হয়ে খেলা থেকে বেরিয়ে এলাম। পরে
কেউ কেউ মহাদেবদার দাবিটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলে তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন!
সেদিন লক্ষ্য করেছিলাম, বয়সে বড় হলেই কেউ সত্যবাদী হবে এমন নিশ্চয়তা নেই।
পরবর্তীতে সারা জীবন জুড়ে এর সপক্ষে অসংখ্য উদাহরণ পেয়েছি। ছোট হোক বা
বড় – স্বার্থসিদ্ধির প্রশ্নে সব বয়সী মানুষ নির্দ্বিধায়, নির্বিকারভাবে
অসত্য উচ্চারণ করে।
আমাদের
একটা ছোট পুকুর মতো ছিল, আমরা বলতাম পাগার (‘পগার পার’ কথাটা মনে পড়ে
যাচ্ছে। পাগার থেকেই কি পগার? জানি না।)। সেখানে আমাদের শৈশব-কৈশোরের অনেক
গল্প লুকিয়ে আছে। অনেক পরে সেই পুকুর বা পাগার মাটি দিয়ে বুঁজিয়ে ফেলা হলে
আমাদের গল্পগুলোও মাটিচাপা পড়ে যায়। এত বছর বাদে, একটু একটু করে ধুসর হয়ে
আসা স্মৃতিতে কিছু কিছু ঘটনা এখনও বেশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। একদিন, তখন ক্লাস
ওয়ান, আমি আর শ্যামা তুমুল মারপিট করে বাড়ি মাথায় তুলেছি, একেবারে ধাঁই
ধপাধপ! পরস্পরকে বেদম প্রহার, কিল চড় ঘুসি লাথি – যে যেমন পারে (স্বীকার
করা ভালো, শৈশব-কৈশোরে আমার নিজস্ব বৃত্তে সুকুমার, পরিশীলিত মনোবৃত্তির
তেমন প্রসার দেখিনি! সহনশীলতাও সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল। বরং অনেক বেশি
চর্চা দেখেছি হিংসার, লোলুপতার। পুরো এলাকাটা ছিল আলোকোজ্জ্বল পৃথিবী থেকে
অনেক দূরে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতোই। সেটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি জেনকিন্স
স্কুলে পড়াকালে শহরের উজ্জ্বলতায় উঁকিঝুঁকির সুযোগে। ভাগ্যিস দেখেছিলাম,
নইলে জীবনের মহত্তর দিকগুলো হয়ত অনাবিষ্কৃতই থেকে যেত)। একটা পর্বে শ্যামা
যথারীতি ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিলে আমি প্রমাদ গনি। আমি জানিই, এরপর অনেক
কিছুই আমার কপালে অপেক্ষা করছে! ইতিমধ্যেই মা এসে আমাদের দুটোকেই ধরার
চেষ্টা করছে। আমরা তার হাত ফসকে পিছলে পিছলে সরে যাচ্ছি। বাইরে তখন
মুষলধারে বৃষ্টি। আগের রাতেও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। সকালে কমে এসেছিল
বৃষ্টি, তখনই দেখেছি, পুকুরে শাপলা ফুটে আছে। শাপলার মসৃণ চকচকে গোল পাতার
ওপরে চুপচাপ বসে আছে একটা মাকড়সা। কিছুক্ষণের বিরতির পর ফের শুরু হয়েছে
বৃষ্টি। সেকারণেই আমরা ঘরের ভেতরে। আর, এরই মধ্যে দু-ভাইবোনের তুমুল লড়াই!
কেউ হার মানতে রাজি নই!
মা
ক্রমাগত আমাদের ধরার চেষ্টা করছে, পেরে উঠছে না। পারবে কী করে, আমরা দুই
খুদে বজ্জাত, লিকলিকে শরীর নিয়ে ঘরের মেঝে, মেঝে থেকে বিছানা লাফিয়ে লাফিয়ে
ফসকে বেড়াচ্ছি! আর, এটাও যেন নতুন খেলা! নতুন খেলায় আমরা যেন মজে যাই।
আগে ছিলাম দুজন, এখন তিনজন! জমে উঠেছে আমাদের খেলা! নতুন খেলাটা আবিষ্কার
করে আমাদের সে কী উল্লাস! আনন্দে আমরা আত্মহারা। আর, এই করতে করতেই আমাদের
হাসি পেয়ে যায়। আমরা তখন দুজনেই হাসতে হাসতে ঘর থেকে উঠোনে নেমে পড়ি।
বাইরে তখন বৃষ্টি। মাথায় বৃষ্টির জল পড়লে জ্বর আসবে বলে মা আমাদের থামতে
বলে, কিন্তু শুধু কথায় ভরসা না পেয়ে আমাদের পিছুও নেয়। আমরাও দৌড়ই। আগে
শ্যামা, পেছনে আমি। শ্যামা দৌড়ে পুকুরে ঝাঁপ দেয়, ওকে ফলো করে আমিও।
তারপর, সেই পুকুরের সাত-আট ফুট জলের গভীরে পায়ের নীচে আর মাটি পাই না! আমরা
হাবুডুবু খেতে খেতে আরও দূরে সরে যেতে থাকি। আমাদের মৃত্যু অনিবার্য বুঝে
গিয়ে মা তখন পরিত্রাহী চিৎকার করছে। তারপর মা নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের
চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল ডাঙ্গায়! সে যাত্রায় বরাত জোরে বেঁচে গেছি।
এমনকি, মায়ের প্রহারের হাত থেকেও।
তখন
আমাদের বেদম প্রহারের ইচ্ছেটা মায়ের মরে গেছে। মা নিজেও হাপাচ্ছে। তার
বুকটা হাপরের মতো উঠছে নামছে। হ্যাঁ, মা দুরন্ত সাঁতার জানত। এমনকি, তার
লাঠিখেলাও দেখেছি অনেকদিন। উঠোনের মাঝখানে শাড়িটা গাছকোমড় করে বেঁধে মাকে
লাঠি নিয়ে চমৎকার কসরত করতে দেখেছি অনেকদিন। একদম লাফিয়ে লাফিয়ে, বনবন করে
লাঠি ঘোরাতে দেখেছি। আমি মাঝে মাঝে মাকে লাঠি ঘোরাতে বলতাম। মা আমার
অনুরোধে লাঠি ঘোরাত। মা জানিয়েছিল, দেশভাগের আগে, ওপারে গাইবান্ধায়
থাকাকালে কম বয়সে পাড়ার ক্লাবে ছোরা ও লাঠিখেলা শিখেছে। বিপ্লবীরা সেখানে
এসে মেয়েদের লাঠিখেলা, ছোরা চালানো শেখাতেন। আমাদের ছোট মামা, মায়ের ছোড়দা
গোপাল দেব, স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। শৈশবে আমি তাঁকে কয়েকবার দেখেছি।
কালো রং, ঘন কালো ব্যাক ব্রাশ করা চুল, চওড়া পেশল কাঁধ, বড় বড় চোখের
অদ্ভুত দৃষ্টি। আমি যখন দেখেছি তখন তাঁর অনেকটাই বয়স, সামনে একটু ঝুঁকে
চলাফেরা করতেন। মায়ের কাছেই শোনা, এক সাদা সাহেবকে গলায় রামদায়ের কোপ
মেরেছিলেন এবং ধরা পড়ে কিছুদিন জেলেও কাটাতে হয়েছে তাঁকে। আমার স্কুল
জীবনের একেবারে শুরুতে একবার প্রবল জ্বর হয়েছিল মনে আছে। মামা আমার মাথায়
হাত বুলিয়ে, সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে আমার হাতে পঁচিশ পয়সা গুঁজে দিয়েছিলেন!
তার কিছুদিন বাদেই তাঁর মৃত্যু সংবাদ এসেছিল। ফলে, আর দেখিনি তাঁকে। আমি
দীর্ঘদিন মামার দেওয়া সেই পয়সাটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু শেষ অবধি সেটার
গতি কী হয়েছিল জানি না। তবে, এখনও ছোট মামার হাতের সেই উষ্ণ স্পর্শ আমার
হাতে লেগে আছে। হঠাৎ কোনও নির্জন দুপুরে বা বর্ষণমুখর গভীর রাতে ছোট মামার
হাতের সেই স্পর্শ আমাকে ফের ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, অনুভব করতে পারি।