জুরান্তী চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
জুরান্তী চা বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^
চোখ জুড়ানো এক আশ্চর্য সৌন্দর্য্যখনি জুরান্তী। ডুয়ার্স রানী মেটেলি থেকে কয়েক কিলোমিটার শুধুই জুরান্তি বলবো কেন, সমগ্র ডুয়ার্স জুড়ে অসংখ্য যে সৌন্দর্যখনি তার খুব সামান্যই আমাদের চোখে ধরা পড়েছে। মাটিয়া ড্যাম, খাগরিজান, নাগরাকাটার কাছে শুল্কাপাড়া হয়ে টানাটানি নদী, ঝালং যেতে কুমাই এর নাম অনেকেই শোনেননি। জুরান্তি আমার অদেখাই থেকে যেত যদি না মেটেলি ব্লকে চা বাগানগুলোতে সার্ভে করতে যেতাম। মেটেলি বাজার থেকেই বাঁদিকে জুরান্তীর পথ।
রাস্তা মানে রাস্তার মতো কিছু। তাতে নানা প্রকারের ছোট বড় গর্ত, চড়াই এবং উতরাই। পাহাড়ের রাস্তার ক্ষুদ্র সংস্করণ। চলাই দায়। আমাদের গাড়ি নিচু। ফলে এই ছয় সাত কিলোমিটার পথ পেরোতে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। তবে মেটেলি থেকে জুরান্তীর পথটি ভারি সুন্দর। জুরান্তী পর্যন্ত জিপ, জোঙ্গা এবং কমান্ডার যেভাবেই যাক না কেন, চালসা থেকে ২৫ থেকে ৩০ জন জিপের ভেতর ঠেসে ঠেসে এবং জিপের সামনে পেছনে ওপরে নিচে বসিয়ে কিভাবে যে ড্রাইভার চালিয়ে নিয়ে যায় তা বিস্ময়ের ব্যাপার। বিশেষত হাটের দিন লোকজন এতেই অভ্যস্ত। আসলে মেটেলিতে বেশিরভাগই চা শ্রমিক। জিপগুলোও অনেক চা শ্রমিকদের। নিজেরাই ছুটির দিনে চালায়। কিছু কিছু ড্রাইভারের এটাই মূল পেশা। কিন্তু ট্যুরিজমের বাংলোটির কোন হদিস করতে পারছি না। ডুয়ার্সের যে কোন লোক বাংলা, হিন্দি, রাজবংশী, সাদরি, নেপালি এবং আরো নানা ভাষা জানে। কিন্তু আমি যেখানে বড় হয়েছি সেখানে এইসব ভাষার কোন ব্যাপারই ছিল না। তাই আদিবাসীদের সাদ্রি ভাষাটাতে আমি ততটা সরগর নই। বুঝতে পারি কিছুটা, কিন্তু বলতে পারি না। নেপালি ভাষাও ততটা সচ্ছন্দে বলতে পারি না। জুরান্তীর বাংলো খুঁজতে খুঁজতে ভাষাবিভ্রাট এর জন্য তাই ম্যানেজারের বাংলোয় গিয়ে উপস্থিত হলাম। তারপর জানলাম ম্যানেজারের বাংলো নয়, ডিরেক্টরের বাংলোটিকেই ট্যুরিজমের কাজে লাগানো হচ্ছে। ভাষা এবং পথ এই দুই বিষয়ে নিজেদের সীমাহীন অজ্ঞতা আবিষ্কার করে শেষপর্যন্ত জুরান্তী বাংলোর সঠিক হদিশ পাওয়া গেল।
শেষ রাস্তাটা ভালো এবং চা বাগানের বুক চিরে এগিয়ে গেছে। ছোট পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় বাংলোটি। ফলে রাস্তার সৌন্দর্য অনবদ্য। পাহাড়ের মাথায় একটা চওড়া সমতল। গাড়ি পার্ক করে নেমে বাংলোটি দেখেই ভাল লেগে যায়। বাগানের মালি আমাদের দেখে একটু নড়েচড়ে উঠল। রোদ্দুরে ফুলবাগানে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে পড়ল। সুন্দর বাংলোটি। ইউরোপীয়ান স্থাপত্য একেবারে স্পষ্ট। সামনে বিরাট বারান্দাতে অনেকগুলো সোফা সাজানো। তারপরে বাংলোর ভিতরে একটা সুইট আর দুটো ঘর। ঘরগুলি দেখেই আমাদের মন ভালো হয়ে গেল। প্রতি ঘরে ফায়ার প্লেস। একটি লাইব্রেরিও ছিল। কিন্তু সেটিতে যত্নের বড়ই অভাব। এখনো কিছু বই টিঁকে আছে। সব মিলিয়ে কলোনিয়াল ফ্লেভার। সব ঘর জুড়ে বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা গেল। এসে গেল গরম কফি। জানুয়ারির ডুয়ার্সে আর পাহাড়ের চুড়োয় বাতাসে দুপুরেই হাড়পাঁজরে কাঁপুনি ধরিয়েছে শীত। তাই এই কফিটা দরকার ছিল। কফির মগ হাতে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাইরে ঝলমলে রোদ। একটি বড় মাঠ। সেখানে একটা ব্যাডমিন্টন কোট। রোদ্দুরে ফুলবাগানে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে আছে বাগানের মালি। আমাদের দেখে একটু নড়েচড়ে উঠল। দূর থেকে দেখা যায় ম্যানেজারের সুন্দর কুঠি। সত্যি লোভনীয় বাংলো। অথচ আশ্চর্য রকমের জনমানবহীন এবং নির্জন। এখানে একাকী থাকা খুবই কষ্টকর। রাতে ভয় হয়। হাঁটতে হাঁটতে ওপারে গিয়ে দেখলাম একটা কামরাঙ্গা গাছ ফলে ফলে হলুদ হয়ে আছে। নিচে অজস্র পাকা কামরাঙ্গা পড়ে আছে। কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে কেউ খায় না। আমরা যত খুশি নিতে পারি। শুরু হয়ে গেল কামরাঙা পাড়ার ধূম। বাংলোর কর্মচারীরা সহযোগিতা করল। গরম জলে স্নান সেরে বসবার ঘরে গ্যাঁট হয়ে বসলাম। সব নরক গুলজার করছে। হাসিঠাট্টায় কেটে গেল সময়টা। এমন সময় দ্বিপ্রাহরিক আহারের ডাক। আয়োজন মন্দ নয়। চনমনে খিদের মুখে আমরাও মন্দ টানলাম না। দুপুরে বাইরের বারান্দায় পিঠে রোদ দিয়ে বসলাম। ভেতরে বেশিরভাগই বিশ্রাম করছে। রাত্রির আগমনকে জানান দিতে পড়ে আসছে বিকেলের রোদ।
মালবাজার সাব ডিভিশনের মেটেলি ব্লকের জুরান্তী চা বাগানটির পরিচালক গোষ্ঠী জুরান্তী টি কোম্পানি। কোম্পানির মালিকের নাম শশাংক প্রসাদ। বাগানটি ডিবিআইটিএ সংগঠনের সদস্য। বাগানে প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ২ টি। এগুলো হল এনইউপিডব্লিউ এবং পিটিডব্লিউইউ। জুরান্তী চা বাগানটির আয়তন ৭৪২.৪৬ হেক্টর। মোট চাষযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ৫১০.১৮ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে প্রতি হেক্টর জমি পিছু ২১১৮ কেজি করে চা ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয়। মোট কর্মরত শ্রমিক ১৪৫৯ জন। জুরান্তী চা বাগানে নিজস্ব চা পাতা উৎপাদনের গড় ৪৫-৫০ লাখ কেজি। ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব উৎপাদিত চা ১০-১১ লাখ কেজি। বাইরের বাগান থেকে সংগৃহীত কাঁচা পাতা ১-২ লাখ কেজি। মোট বাৎসরিক উৎপাদিত চা ১১-১২ লাখ কেজি। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাগানে ইঅরগ্যানিক সিটিসি চা উৎপাদিত হয়। শ্রমিক আবাস নির্মাণ, মেরামতি এবং রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ কোম্পানী বছরে গড়ে ৫ লাখ টাকা খরচ করে। বাগিচায় শৌচাগারের সংখ্যা ২০০ টি। বাগিচার সাব স্টাফের সংখ্যা ১৩৪ জন। করণিক ১০ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ২১ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৮৮৫। মোট জনসংখ্যা ৫৪১২ জন। স্থায়ী শ্রমিক ১২৪৩ জন। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী বিঘা শ্রমিক সংখ্যা ছিলো ৪০০ জন। কম্পিউটার অপারেটর নেই। মোট কর্মরত শ্রমিক ১৪৫৯ জন। অ-শ্রমিক সংখ্যা ৩৯৫৩ জন। বাগানটি এমজিএনআরইজিএস এর সুবিধা পায় না। বাগানটি ইউবিআই এর কাছ থেকে আর্থিক সুযোগ সুবিধা এবং সাহায্য পায়। বাগানটির লীজ হোল্ডার দার্জিলিং ডুয়ার্স প্ল্যান্টেশন লিমিটেড। লীজের ভ্যালিডিটির সময়সীমা ২৪.০৩.২০২৮। মোট শ্রমিক আবাস ৮৮৫টি। বাগিচায় ব্যাক্তিগত ইলেক্ট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ৪৪৪ টি। ক্লাস্টার মিটারযুক্ত বাড়ির সংখ্যা ১৯২ টি। বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাসের সংখ্যা ২৪৯ টি। মোট শ্রমিক ১৪৫৯ জন। বাগানে শতকরা ৬১ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে।
জুরান্তী চা বাগিচায় সমৃদ্ধ হাসপাতাল আছে। ডিসপেনসারিও আছে। ডাক্তার আছে। প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা ১ জন। মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৮ টি, ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৬ টি। আইসোলেশন ওয়ার্ড ৫ টি, মেটারনিটি ওয়ার্ড নেই। তবে মেটারনিটি ওয়ার্ড আগে ছিল। বর্তমানে চা বাগানের মেটারনিটির কেসগুলিকে সব গ্রামীণ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। বাগিচার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার নেই। অ্যাম্বুলেন্স আছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। সবচেয়ে কাছের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইনডং এ চিকিৎসার জন্য গড়ে বছরে ৩০০ জন শ্রমিককে রেফার করা হয়। বাগিচায় পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ হওয়ার দাবি উঠলেও শ্রমিকদের অভিযোগ কেবলমাত্র জ্বর, মাথাব্যাথা, পেট খারাপ এর ওষুধই দেওয়া হয়। বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার আছেন। ক্রেশের সংখ্যা ২ টি। ক্ৰেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা আছে। শৌচালয় নেই। দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার ক্রেশের শিশুদের দেওয়া হয় না। শিশুদের পোশাক সরবরাহ করা হয় না নিয়মিত। পর্যাপ্ত পানীয় জল ক্ৰেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করা হয়। দেখলাম বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে বেশ কিছুটা দূরে। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয়ও বেশ কিছুটা দূরে। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা হিসাবে একটা বাস আছে। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব আছে। খেলার মাঠ আছে। পরিচয় হল বাগানের অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং ক্যাশিয়ারের সঙ্গে। সুখদুঃখের আলাপচারিতার মাঝে জানলাম জুরান্তী টি গার্ডেনে বিগত অর্থবর্ষে গড়ে ৮০ লাখ টাকা প্রভিডেন্ড ফান্ড খাতে জমা পড়েছে। কোন পি এফ বকেয়া নেই। বিগত চার বছরে গ্র্যাচুইটি বাবদ বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ৫৩ লাখ টাকা। বছরে গড়ে ৫০ জন শ্রমিক গ্র্যাচুইটি পেয়ে থাকে। শ্রমিকদের মজুরি, রেশন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়। বাগানে শ্রমিকদের কোন পাওনাগন্ডা বাকি নেই।
নির্জনতা পাখির ডাকে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। দূরে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঘন বনানীর সীমারেখা। সামনে নিচে চা বাগানের ঢেউ খেলানো সবুজ কার্পেট। এবড়োখেবড়ো রাস্তা থেকে কয়েকহাত দূরে চা বাগান কোয়ার্টারে গেলাম। বাবুদের কোয়ার্টার যেমন হয়, সুন্দর নাম-না-জানা সাজানো বাগান, দোলন চাঁপা, বেলফুল, ফল আর কিছু ফুলের সমারোহ। আছে শাকসবজির বাগান, কোয়ার্টারের পেছনে প্রচুর কলাগাছ এবং ভুট্টাক্ষেত। মাঝেমাঝে হাতি এসে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যায়। চা-বাগানে আর সেই দিন নেই। ছেলেপুলেরা এখন আর বাগানের কাজ করতে নারাজ। সাহেবরা চলে যাবার পর চা বাগান মালিকের হাতবদল হয়েছে আর মুমূর্ষ রোগীর মত ধুঁকছে। সবচেয়ে অসুবিধা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা। ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে যেতে যেতে চা পাতার গন্ধ এসে নাকে লাগে। চা বাগানের পথ পাখ-পাখালির ডাকে মুখরিত। যেদিকেই তাকাই সবুজ সমুদ্র ঢেউয়ের মতন দূর দিগন্তে ছড়িয়ে রয়েছে। বিকেল একটু পড়তে না পড়তেই ঠান্ডা পড়ল জাঁকিয়ে আর তার সঙ্গে শনশনে হাওয়া। হাওয়া আর শীতের দাপটে বাইরে বসা গেল না দীর্ঘক্ষণ। সবাই ঢুকে পড়ল ঘরে। আমার মনে হচ্ছিল এই বসবার ঘরে একসময় গ্লাস হাতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ মালিকেরা আর চারিদিকে গাউন পড়া মেম সাহেবেরা পিয়ানোতে টুংটাং সুর তুলত। নেটিভরা তাদেরকে তৈলমর্দন করতে ব্যস্ত থাকতো। আজ তারা কোথায়? বাইরে বেরিয়ে দেখি উপরে ঝকঝক করছে তারা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছায়াপথ। দূরে কুলি বস্তির থেকে ভেসে আসছে ধামসা মাদলের শব্দ। রাত একটু বাড়লে নিস্তব্ধ হয়ে যায় চরাচর। এই নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় বসে মনে হচ্ছিল বুঝি বা সময় পিছিয়ে গেছে। কয়েক শতক অথবা কয়েক সহস্র। কিন্তু ঠান্ডায় বেশিক্ষণ বসা যাবে না। তাই ঘরে ঢুকে পড়ি। ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজে। এরই মধ্যে ডিনার তৈরী। ঘড়িতে যখন রাত্রি দশটা তখন সেটা শহরের সান্ধ্য আড্ডায় চা খাওয়ার সময় আর এখানে সকলে ঘুমে অচেতন। অতএব রাত্রি দশটাতেই বিছানায় যেতে হল।
সকালে উঠে হেঁটে এলাম খানিকটা। চারিদিকে সোনা রোদে ঝলমল করছে। যেন পরিসমাপ্তি নেই এই সবুজ সমুদ্রের ঢেউ এর। শিমূল, শিরিস, সিট্রোনেলা গাছ। ছায়াপথে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের সঙ্গে গল্প করতে করতে যাই। জুরান্তী চা বাগিচার একদিকে এঙ্গো, অন্যদিকে নাগেশ্বরী। চা বাগানগুলো আজ ধুঁকছে। চা বাগানের শ্রমিকরা আজও একই অবস্থায়। শুধু সাংগঠনিক দক্ষতার অভাবে আমরা চা বাগানগুলো ধ্বংস করে ফেলেছি। তাই বোধহয় আজ চূড়ান্ত অবক্ষয়। আজও ডুয়ার্সের নানা অঞ্চলে জলের ভয়াবহ সমস্যা। বিদ্যুৎ একবার গেলে তার দেখা মেলা ভার। এগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে। প্রকৃত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়নি। সদিচ্ছা ছাড়া বেশি দূর এগোনো দুষ্কর হবে। আমাদের চা বাগানগুলো ভিন রাজ্যের পর্যটকদের এবং বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। বেলা ১১ টা নাগাদ বের হলাম ফ্যাক্টরি দর্শন করতে। বাংলোর পূর্বদিকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে পাহাড়। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ঝুম চাষ হচ্ছে। রাশি রাশি প্রজাপতি উড়ছে থেকে থেকে। একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। শিমূল, শিরিস এবং সিট্রোনেলার গাছ। ছায়াপথে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের সঙ্গে গল্প করতে করতে ম্যানেজারবাবুর কুঠির পাশ দিয়ে হেঁটে যাই। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে কয়েকটা মদেশিয়া রমণী শুকনো রুটি আর ছোলা মটর খাচ্ছে। জোয়ান মরদেরা কেউ কেউ হাঁড়িয়া খাচ্ছে। ওদের ছবি তুলতে গেলে দারুণ খুশীতে ঢলে পড়ে এ ওর গায়ে। বড্ড সাধাসিধা জীবন ওদের। বাইরে থেকে আমরা কতটুকুই বা জানি। যেতে যেতে দেখতে পেলাম পাতা নিয়ে যাওয়া ট্রাকের পেছনে বাগানের বাবু এবং তাদের ছেলেমেয়েরাও অনেকে হাট বাজার সেরে ফিরছে। কেউ যাচ্ছে মেটেলিতে টুকিটাকি জিনিসপত্র আনতে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছে যাই ফ্যাক্টরিতে।
এলাম নেওড়া নদীর পাশে। বর্ষায় নদীর চেহারা পাল্টে যায়। পাহাড়ি নদী তার ধর্ম অনুযায়ী গাছের গুঁড়ি এবং বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই নদীর স্রোতোধারা ধরে টেনে নিয়ে আসে। ভয়ংকর উত্তাল তরঙ্গায়িত নেওড়া বয়ে চলেছে। ওপারে সবুজ অরণ্য। মাথার ওপর নীল আকাশ, নির্জন নদ, সব মিলিয়ে চমৎকার কোলাজ। নেওড়া নদীর কোল ঘেঁষে জুরান্তি চা বাগিচার কাছে আশ্চর্য সুন্দর এক পিকনিক স্পট আছে। অনাবিল স্নিগ্ধতা। নুড়ি পাথর ভেঙে নেওরা নদীর একেবারে কাছ বরাবর চলে এসেছি। নেওরা নদীর স্বচ্ছ জলে নামলাম। পা ডুবালাম জলে। এক প্রশান্তি ছড়িয়ে গেল শরীরে এবং মনে। ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকি। পায়ের নিচে নুড়িপাথর সুড়সুড়ি দিচ্ছে। মেটেলি থেকে জুরান্তির পথটি ভারি সুন্দর। চালসা থেকে জুরান্তী পর্যন্ত জিপ, জোঙ্গা, কম্যান্ডার যেভাবেই যাতায়াত করা যাক না কেন, জিপের ভেতর ঠেসে ঠেসে জনা কুড়ি যাত্রী বসিয়ে কিভাবে যে ড্রাইভার চালিয়ে নিয়ে যায় তা বিস্ময়ের ব্যাপারে। বিশেষত হাটের দিন। লোকজন এতেই অভ্যস্ত। আসলে মেটেলিতে বেশিরভাগই চা শ্রমিক। জিপগুলোও অনেক চা শ্রমিকদের। নিজেরাই ছুটির দিনে চালায়। কিছু কিছু ড্রাইভারের এটাই মূল পেশা। এবড়োখেবড়ো রাস্তা থেকে কয়েক হাত দূরে চা বাগান কোয়ার্টারে গেলাম। বাবুদের কোয়ার্টার যেমন হয়। ফল আর কিছু নাম না জানা ফুল, তাছাড়াও বেলফুল, দোলনচাঁপা, এবং আরো কিছু ফুলের সমারোহ। আছে শাকসবজির বাগান। কোয়ার্টারের পেছনে প্রচুর কলাগাছ এবং ভুট্টাখেত। মাঝেমাঝে হাতি এসে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যায়। চা বাগানে আর সেই দিনকাল নেই। ছেলেপুলেরা এখন আর বাগানের কাজ করতে নারাজ। সাহেবরা চলে যাবার পর চা বাগান মালিকের হাতবদল হয়েছে আর মুমূর্ষু রোগীর মত ধুঁকছে। সবচেয়ে অসুবিধা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা।
বড্ডো একঘেয়ে জীবন চা বাগানে। দুই চারদিন ভালো লাগে নিরিবিলি এবং নির্জনতার জন্য। কিন্তু তারপর সেই বৈচিত্রহীন দিনযাপন। হঠাৎ কেউ এলে বড়ই মুশকিল। ছুটতে হয় মেটেলি অথবা চালসা বাজারে। যারা শান্তিপ্রিয় তাদের হয়তো চা বাগানের চাকরি ভালো লাগতে পারে। ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে যেতে যেতে চায়ের গন্ধ নাকে লাগে। চা বাগানের পথ চারিদিকে পাখপাখালির ডাকে মুখরিত। যেদিকেই তাকাই সবুজ সমুদ্র ঢেউয়ের মতন দূর দিগন্তে ছড়িয়ে রয়েছে। যেন পরিসমাপ্তি নেই এই সবুজ সমুদ্র ঢেউ এর। যে সমস্ত টুরিস্টরা এই সমস্ত বাংলোতে আসেন তাদের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে। যদিও গালভরা নাম টি ট্যুরিজম, তবুও ডুয়ার্সের অন্য অন্য ট্যুরিজমের সঙ্গে তফাৎ আছে। সরকার বহুদিন ধরেই টি ট্যুরিজম করতে চাইছে। কিন্তু তার নির্দিষ্ট রূপরেখা কি হবে তার কোন প্ল্যান নেই। ওদলাবাড়ি থেকে শুরু করে নিউল্যান্ডস পর্যন্ত এই যে এতগুলো চা বাগান তার প্রত্যেকটার অবস্থান অনবদ্য। পাহাড় এবং চা বাগান মিলে প্রত্যেকটা চা বাগান অনিন্দ্যসুন্দর। এগুলোকে এক ছাতার তলায় আনা যায় কিনা একটু চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। একটু অর্থবান টুরিস্ট এর সেরা ডেস্টিনেশন হতে পারে চা বাগানের বাংলোগুলি। জমি সংক্রান্ত জটিলতা একটা বড় সমস্যা হলেও সেটাকে কাটানো বড় সমস্যা নয়। জুরান্তী, ফাগু, ফাসখাওয়া অথবা সামাবিয়ংকে ঘিরে ইকো পর্যটন এর বিকাশ ঘটতে পারে। একটি দুটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ সফল হতে পারে। কিন্তু একটি আলাদা সার্কিট হিসাবে জনপ্রিয়তা পেতে গেলে আলাদা উদ্যম প্রয়োজন। এটা যে সম্ভব তার প্রমাণ গ্লেনবার্ণ এবং তাকদা। অনেকগুলো বাগান সার্ভে করে বেছে নিলে একটি বা একাধিক বড় রিসর্ট পাল্টে দিতে পারে চা বাগানের বিধ্বস্ত চেহারা। চালসা, ডামডিং, মেটেলি বা মালবাজার যেখানেই হোক না কেন, তিস্তা এবং নেওরার বুকে রাত্রির ছায়া নামে। ডুবে যাওয়া মিলনের ম্যাজিক লণ্ঠন জ্বলে ওঠে ডুয়ার্স ভুবনে। সে আর এক রূপ। অবাক করা এই রূপ চিরস্থায়ী হয়ে থাকে অনুভবে। ধীরে ধীরে ঘরে ফিরে আসি বেলা শেষে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴