চা-ডুবুরি/পর্ব : ২৫
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^
" নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার.... "
'' আমি তখন খুব ছোট, বয়স ছয় সাত হবে..একদিন খুব ভোরে, তখনও আলো ফোটেনি ভাল করে, আমাদের কোয়ার্টার থেকে বেশ কিছুটা দূরে লেবার-লাইন ... লাইনের গা ঘেঁষে ছিল একটি চাপাকল ... সেই কলতলা থেকে কিছু মানুষের অস্পষ্ট গলার আওয়াজ...থালা বাসন পড়ে গেলে যেমন শব্দ হয়... তেমনি ঝনঝন শব্দ শুনতে পাই। শুনেই ঘুম ভেঙে যায় আমার। কৌতূহলবশতঃ জানালায় এসে দাঁড়াই... এবং সেখানে দাঁড়িয়েই দূরে দেখতে পাই কিছু মহিলাকে। কুপির আলো জ্বালিয়ে তারা ব্যস্ত হাতে সকালবেলার কাজ সারছে। অন্ধকারে ওদের দেখে কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে। আগে এ দৃশ্য দেখিনি কখনও তাই কেমন যেন ভয় ভয় করে। কেমন যেন অশরীরী ছায়ার মতো মনে হয় ওদের।"
সত্যপ্রিয় যেন সেদিনের সেই জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা শৈশবকে দেখতে পাচ্ছিলেন।। পরিত্যক্ত খনির অন্ধকার থেকে রত্ন খুঁজে পাওয়ার আনন্দ ভোরের আলোর মতো ফুটে উঠছিল তাঁর চোখে মুখে।
--" তাকিয়ে থাকতে থাকতে আলো ফুটত। দেখতাম ওরা একে একে ফিরে যাচ্ছে ঘরে। ততক্ষণে ঘরে ফিরে কেউ কেউ উনুন ধরিয়ে ফেলেছে। উনুনের কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়া ওদের ঘরের খড়ের চালের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসে আকাশে মিশে যাচ্ছে। সামান্য দৃশ্য। অথচ ওটাই আমাকে মুগ্ধ করত। কিছুক্ষণ বাদেই ওরা দেখতাম দলবেঁধে পিঠে ডোকো নিয়ে বেরিয়ে পড়ত কাজে। সারাদিন ওদের আর দেখতে পেতাম না। বিকেলে ঘরে ফিরে আবার ওরা মাথায় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি...যাকে ওরা বলে 'ডেকচি' আর হাতে সসপ্যান জাতীয় কিছু নিয়ে চলে আসতো কলতলায়। জল নিয়ে সন্ধে নামার আগে ওরা ধীর পায়ে ঘরে ফিরত। দেখে মনে হত খুব ক্লান্ত । ওরা ঘরে ফিরলেই আবার ধোঁয়া বের হতে দেখতাম চালের ফাঁক দিয়ে।
সেদিনের পর থেকে প্রায়ই ভোরে উঠে ওদের দেখতাম। ওদের মধ্যে সুরিয়ার ঘরটা ছিল খুব কাছে। ওর পরিবারের জীবনযাত্রা খুব গভীর ভাবে লক্ষ্য করতাম। কেন করতাম জানি না। তবে দুঃখ দুর্দশার ভেতরেও সবকিছু খুব সহজভাবে মেনে নিয়ে ওরা যে আনন্দে দিন যাপন করত সেই ছবি আমাকে খুব টানত। এই গল্পগুলো সুবর্ণকে আমি করেছি।" ---ধীরে ধীরে একটানা অনেকক্ষণ বলে সত্যপ্রিয় একটু থামেন।
-" খুব সুন্দর একটি ছবি। তবে যে সময়কার কথা বলছেন সে তো স্বাধীনতার আগেকার সম্ভবত। সেই সময় থেকে আপনি চা-শ্রমিক বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের দেখে আসছেন। আপনার চোখে দেখা সেই মেয়েটি, সুরিয়া... সে এবং আজকের নারী শ্রমিকদের মধ্যে কি তফাত আপনি লক্ষ্য করেছেন। মানে বলতে চাইছি স্বাধীনতার হীরক জয়ন্তীর দিকে চলেছি আমরা... এতগুলো বছরেও এদের আর্থ সামাজিক অবস্থার সত্যি কি কোনও পরিবর্তন এসেছে বলে আপনি মনে করেন?" প্রশ্ন করে মোবাইলটা সত্যপ্রিয়র মুখের কাছে এগিয়ে দেয় শ্রাবস্তী।
-" দেখো, আপাতদৃষ্টিতে পরিবর্তন যে হয়নি তা বলব না। যেটুকু হয়েছে তা কালের ধর্মে। কিন্তু সত্যিকার পরিবর্তন বলতে শুধু চা বাগান কেন সে অর্থে সংগঠিত বা অসংগঠিত কোন ক্ষেত্রেই নারী শ্রমিকদের বিশেষ কোনও উন্নতি হয়েছে কি? তোমরা ভাল বলতে পারবে। তবে স্বাভাবিক নিয়মে যতটা হাজিরা বেড়েছে সেটা যদি আর্থিক উন্নতির মাপকাঠি ধরা হয় সেটাও কিন্তু ন্যূনতম মজুরির চেয়ে যথেষ্ট কম। যে বিষয়টির আজও কোনও ফয়সালা হলো না। কী সুবর্ণ, ঠিক বলছি তো?" ঈষৎ জড়ানো গলায় সত্যবাবু প্রশ্নটা ভাসিয়ে দেন সুবর্ণর দিকে ।
-" হ্যাঁ, চা- শিল্পে এখনও মিনিমাম ওয়েজ নিয়ে কোনও ফয়সালা হল না।" সুবর্ণ সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়।
-" আজও একজন চা-শ্রমিক দৈনিক যা মজুরি পান তা বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে যথেষ্ট কম। আর বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের কথা যদি বলি তো উনিশশো ছিয়াত্তরের আগে পর্যন্ত কিন্তু একজন পুরুষের চাইতে একজন নারী শ্রমিক কম বেতন পেতেন। পরবর্তীতে মজুরির সমতা হলেও সামাজিক সমতা আর পাঁচটা ভারতীয় নারীদের মতোই আজও সেই জায়গাতেই রয়ে গেল। বরং বেশ কিছুটা পিছিয়েই থেকে গেল বলা যায়। " সত্যপ্রিয় আরো কিছুটা তথ্য যোগ করেন।
-" হ্যাঁ, এই কাজের জন্য চা বাগানে আসার আগে বিভিন্ন সূত্রে এবং কিছুটা আমার মায়ের কাছে যতটা জেনেছিলাম এখানে এসে মনে হলো মহিলা শ্রমিকদের অবস্থা বাস্তবে আরও খারাপ। মানে ব্রিটিশ যুগে যে ধরনের এক্সপ্লয়টেশন চলত, এখন তার রূপটাই পাল্টেছে। বেসিক অবস্থাটা খুব একটা বদলায়নি।"
শ্রাবস্তীর কথার উত্তরে কিছু বলেন না সত্যপ্রিয়। সুবর্ণর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কি যেন ভাবেন। তারপর বেশ কুন্ঠার সঙ্গে কাঁপাকাঁপা গলায় বলেন,
" আমার ভীষণ খারাপ লাগছে সুবর্ণ। তুমি ওকে নিয়ে এলে। একটু যে চায়ের বন্দোবস্ত করব... "
-" আপনি আবার সেই কথা বলে আমাকে লজ্জায় ফেলছেন। ওঁকে সব বলেছি আপনার কথা। আপনাকে দেখতে, আপনার কাছে মূল্যবান কিছু কথা শুনতেই ওঁর এখানে আসা। আপনি এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাববেন না। " সুবর্ণ বলে।
" বৌমা এ সময়ে অফিসে থাকে। যে মেয়েটি কাজ করে সে-ও আজ আসেনি... একটা সময় ছিল যখন এ বাড়িতে কেউ এলে কাবেরী তাকে না খাইয়ে ছাড়ত না। তাই এখন কেউ এসে খালি মুখে ফিরে গেলে বড় কষ্ট হয়। " কথাগুলো বলার সময় দৃষ্টিক্ষীণতা প্রাণপণে অতিক্রম করে মুখের অভিব্যক্তিটা যেন খোঁজার চেষ্টা করছিলেন সত্যপ্রিয়।
" এভাবে বললে কিন্তু খুব কষ্ট হবে আমারও। আপনাকে দেখে আমার জেঠুমণির কথা মনে পড়ছে। অবিকল আপনার মত। চোখে ভাল দেখেন না। একা থাকেন ফ্ল্যাটে। একজন সর্বক্ষণের আয়া আছেন। তিন ছেলের একজন পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। বাকি দু'জন বাইরে। জেঠুমণি অ্যাট দ্য এজ অফ নাইন্টি-টু এখনও যথেষ্ট ফিট। সকালে হালকা ফ্রি-হ্যান্ড করেন এ বয়সেও। বাড়িতে গেলে কিছু খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ঠিক আপনার মত। না খেলে অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে থাকেন। "
শ্রাবস্তীর শেষের কথাগুলো শুনে মৃদু প্রসন্নতা ফুটে ওঠে সত্যপ্রিয়র মুখ। -"আর কী জানতে চাও বলো।" জিজ্ঞেস করেন সত্যপ্রিয়।
-" কদিন ফিল্ড সার্ভে করে যা বুঝলাম, এই নারী শ্রমিকরাই চা বাগানের মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু এরা কোনও বাড়তি সুযোগ সুবিধা পায় না। বরং বরাবর ঘরে-বাইরে সর্বত্র এরাই চাপ সহ্য করে এসেছে বেশি। একসময় শিক্ষার আলো ততটা প্রবেশ করেনি চা বাগানে । কিন্তু পড়াশোনা শিখে বর্তমান প্রজন্ম যারা চা বাগানের কাজে আসছে তারাও কি সেই আগের মতই চাপ নিচ্ছে? মানে আমার প্রশ্ন হল শিক্ষা কোথাও কি এদের নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলেনি এতটুকুও।" শ্রাবস্তী প্রশ্ন রাখে।
-" হ্যাঁ, আগের চেয়ে শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে। আগে এত স্কুল ছিল না ডুয়ার্স অঞ্চলে। চা বাগানে একটা করে প্রাইমারি স্কুল ছিল যেখানে শ্রমিকদের ছেলেমেয়েরা তেমন আসত না বললেই চলে। পরবর্তীতে শিক্ষার প্রসার ঘটল...এখন যেমন অঙ্গনওয়াড়ি, শিশুশিক্ষা কেন্দ্র আরও কি কি হয়েছে। এ অঞ্চলে কলেজও হয়েছে বেশ কয়েকটি। তাতে চা শ্রমিকদের ঘরের ছেলে মেয়েরা যাচ্ছেও পড়াশোনা করতে। কিন্ত স্নাতক হয়েও অন্যকাজ না পেয়ে যারা বাধ্য হয়ে বাগানের কাজে ঢুকছে তারা শুধু কাগজ পত্রে সাক্ষরটুকুই করতে পারছে। সুরিয়াদের সাথে তাদের পার্থক্য মনে হয় এটুকুই। আদতে এরাও কালক্রমে ঢুকে পড়ছে সেই পুরনো চা-শ্রমিকের জীবনের ছাঁচেই।"
-" কেন, আমি তো দেখলাম এখনকার মেয়েদের বেশ স্মার্ট? যুক্তিতে বুদ্ধিতে আমাদের ঘরের মেয়েদের চেয়ে কম যায় না।" শ্রাবস্তী বলে।
-" ঐ যে বললাম, যা কিছু প্রগতি তা সময়ের চাহিদায়। কিছুটা আধুনিক জীবন যাত্রার প্রভাব। বিশেষ করে মোবাইল আর ইন্টারনেটের যুগে এরা যথেষ্ট খবরাখবর রাখে। আধুনিক ফ্যাশান, স্টাইল এসব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। টিভি দেখে চলনে বলনে আধুনিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতেই কি ওদের মুক্তি! নারী শক্তির প্রকৃত মুক্তি যে আজও ঘটেনি। সেই কবে রবীন্দ্রনাথ ঘরে বাইরে উপন্যাসে লিখেছিলেন, 'দেশের মেয়েরা যখন জাগবে তখন তারা পুরুষের চেয়ে ঢের বেশি স্পষ্ট করে বলবে 'আমরা চাই'-সেই চাওয়ার কাছে কোনও সম্ভব অসম্ভব, ভালো মন্দ টিঁকতে পারবে না।' এই যে 'আমরা চাই' একথা কি এরা আজও জোরগলায় বলে উঠতে পেরেছে, লেখাপড়া শিখেও?"
-" কেন, অনেক ক্ষেত্রেই তো দেখছি চা শ্রমিকদের ঘরের মেয়েরা বেশ এগিয়ে গেছে। সরকারি চাকরি, নার্সিং, পুলিশে চাকরিতে, স্কুলে , বিভিন্ন পদে তো এদেরও দেখা যাচ্ছে। সচেতনতাও বেড়েছে কিছুটা হলেও'' শ্রাবস্তী যেন প্রতিযুক্তি দেখায়।
-" সেই সংখ্যাটা খুবই কম। তাছাড়া বিচ্ছিন্ন এই চিত্রের সাথে চা শিল্পের নারীশ্রমিকদের সার্বিক উন্নয়নের সম্পর্ক কোথায়। যতদিন না ট্রেড ইউনিয়নের শীর্ষ নেতৃত্বে মহিলারা বেশি সংখ্যায় এগিয়ে আসছে, ততদিন অন্ততঃ তাদের মনের কথা সঠিক ভাবে উপস্থাপিত হবে না। পুরষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে এখনও মহিলারা ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বে আসতে পারছে না। আসতে দেওয়া হচ্ছে না। বিচ্ছিন্ন দু চারটে উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই। অথচ প্রয়োজনে বাগান কর্তৃপক্ষের সাথে দাবি আদায়ের লড়াই করার সময় সুযোগ বুঝে মহিলাদের এগিয়ে দিয়ে কার্যসিদ্ধি করা হচ্ছে। " সত্যপ্রিয় যুক্তি দিয়ে ছবিটা তুলে ধরেন ধীরেসুস্থে।
-"হ্যাঁ, আমিও দেখেছি, মহিলারা যারা একটু গুছিয়ে কথা বলতে পারেন, তারা দেখেছি খুব সুন্দর ভাবে ম্যানেজমেন্টের কাছে তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরতে পারেন। মাথা গরম না করেই। আর এরা চট করে জোট বাঁধতেও জানেন। কোনও প্ররোচনায় পা দেন না চট্ করে। কাজের জায়গায় ভুলত্রুটিও কম করেন। যে কারণে ম্যানেজমেন্ট এদের দোষত্রুটি না পাওয়ায় বেকায়দায় ফেলতেও পারে না। কাজের ক্ষেত্রে এরা যখন তুলনামূলক ভাবে বেশি ডেডিকেটেড তাই কোথাও যেন কর্তৃপক্ষের একটা সহানুভূতি বা ভরসাও থাকে মহিলাদের ওপর। তাই চা-বাগানের মূল চালিকাশক্তি যখন মহিলারাই তাই এদের হাতে আন্দোলনের রাশটুকু দিয়ে পুরুষরা পাশে দাঁড়ালে মনে হয় আরো বেশি ফলপ্রসূ হবে।" সুবর্ণ ওর নিজের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে।
-" আচ্ছা কাকাবাবু, আপনি যে ছোটবেলায় দেখা সুরিয়াদের কথা বললেন, তাদের চেয়ে বর্তমান প্রজন্মের নারী শ্রমিকদের অবস্থার কি কোনও অগ্রগতিই হয়নি, আপনার কী মনে হয়? " শ্রাবস্তী প্রশ্ন করে।
সত্যপ্রিয় কিছু ভেবে নিয়ে স্মিত হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে বলেন, " দেখো, বর্তমান প্রজন্মের মেয়েরা বেশ সচেতন একথা ঠিক। তারা সবসময় পড়ে পড়ে মার খায় না, প্রতিবাদ করে এটাও সত্যি। অগ্রগতি বলতে পোষাক পরিচ্ছদ, কথাবার্তা, আচার ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে এটাও ঠিক। কিন্তু তাতে কি হল। এখনও চা শ্রমিকদের পরিবারে বিশেষ করে আদিবাসী শ্রমিকদের ঘরে পুরুষরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর্থিক দিকটা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যদিও সাংসারিক খরচ খরচা মেয়েরাই বেশি চালায়। তারা বাজে খরচা করে কম। কিন্তু ঘরে রান্নার কাঠ নেই, কাঠ জোগাড় করা, ঘরের ফুটো চাল দিয়ে জল পড়ছে তা সারাই করার জন্য অফিসে গিয়ে কথা বলা,ঘরে বাচ্চা কাচ্চা অসুস্থ তাদের দেখাশোনা করা,এমনকি সাপ্তাহিক হাট পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রে নারীরাই করে । ব্যতিক্রম আছে অবশ্যই। কিন্তু চিত্রটা প্রায় একই। তবে পুরুষরা অধিকাংশই নেশা করে পড়ে থাকে, সংসারের খোঁজ খবর রাখে না-- এই যে চিত্রটা এটা কিন্তু ইদানীং কিছুটা হলেও বদলাচ্ছে। আগে নেশা করে যত্রতত্র শ্রমিকদের পড়ে থাকতে দেখা যেত। এখন আর তেমন যায় না। তবুও আদিবাসী শ্রমিকদের ঘরে মহিলারাই যাবতীয় কাজ করে। পুরুষরা কিছুটা অলস প্রকৃতির। এখনও মহিলারা অন্ধকার থাকতে উঠে ঘরের সব কাজ সেরে নিজের এবং মরদের জন্য দুপুরের খাবার টিফিন বক্সে সাজিয়ে দিয়ে, বাচ্চাদের খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দৌড়তে দৌড়তে কাজে যায়। দেরি হলে হয় ম্যানেজারের গালাগাল শুনতে হবে, নয়ত সর্দার কাজ দেবে না। কোলে বাচ্চা থাকলে তো কথাই নেই। কোলে বাচ্চা বেঁধে কাজে যেতে হয়। যদিও সুরিয়াদের সময় ক্রেশের ব্যবস্থা ছিল না। এখন আছে। " কেটে কেটে প্রতিটি শব্দ বেশ দৃঢ়ভাবে পরিবেশন করেন সত্যপ্রিয়।
-" হ্যাঁ, একটা ভাল কথা মনে পড়ল। নীলপাহাড়ি এবং আরো দু একটা বাগানে দেখলাম মোবাইল ক্রেশ। ক্রেশ গুলোর পরিকাঠামো কেমন, একটু বলবেন। " শ্রাবস্তীর কথা শেষ হতেই সুবর্ণ প্রশ্নটা কেড়ে নেয়,
" আমি বলি। কাকাবাবু অনেকক্ষণ বললেন। দেখুন চা বাগানে ক্রেশ রাখাটা বাধ্যতামূলক। কিছু বাগানে ক্রেশের পরিকাঠামো ভাল। আমাদের নীলপাহাড়িতেই যেমন মোবাইল ক্রেশ ছাড়াও সেন্ট্রালি একটা ক্রেশ ঘর আছে। ক্রেশ অ্যাটেন্ডেন্ট আছে দুজন। বাগান কর্তৃপক্ষ রোজ দুধ বিস্কুটের যোগান দিয়ে থাকে। কোনও কোনও বাগানে বিশেষ দিনে কর্তৃপক্ষ খেলনা, পোষাক এসবও দেয়। আবার এমন বাগানও আছে যেখানে কাজের জায়গায় বাঁশ প্লাস্টিক শিট খাটিয়ে অস্থায়ী ক্রেশ বানানো হয়। যেখানে কুকুর ঘোরাফেরা করে। বৃষ্টি হলে জল পড়ে। এসবও দেখা যায়", সুবর্ণ কথা শেষ করতেই শ্রাবস্তী প্রশ্ন করে,
"- মায়েরা অসুস্থ হলে বা গর্ভবতী মায়েদের মাতৃত্বকালীন সুযোগ সুবিধা...? "
-" অসুস্থ হলে সিক-লিভ বছরে ১৪ দিন। সেক্ষেত্রে হাজিরার প্রায় তিন চতুর্থাংশ বেতন পাবে। মাতৃত্বকালীন ছুটি ১৮০ দিন। প্রসবের আগে ৯০ দিন পরে ৯০ দিন। সেক্ষেত্রে পুরো বেতন মেলে।" সুবর্ণ পরিসংখ্যান দেয়।
-" মহিলাদের স্বাস্থ্য যা দেখলাম তা ভাল বলা যায় না মোটেই। বাগানে চিকিৎসা ব্যবস্থাও তো দেখলাম বলতে গেলে কিছুই নেই। "
-" চা শ্রমিকরা অপুষ্টি জনিত রোগ বিশেষত টিবি, চর্মরোগ, লো-প্রেশার এসবের ভোগে বেশি। এছাড়া ম্যালেরিয়া,ডায়েরিয়া এসব তো আছেই। বেশিরভাগ বাগানে জ্বর, সর্দিকাশি, পেট খারাপ এসবের চিকিৎসা ছাড়া কিছুই হয় না। গুরুতর কিছু হলে বাইরের হাসপাতালে পাঠাতে হয়। এ চিত্র তো চিরকালীন। " সুবর্ণ বলে।
-" আচ্ছা, একটা সময় তো চা বাগানে শিশু ও কিশোর শ্রমিক কাজ করত শুনেছি। এখন সেটা বন্ধ হয়েছে। তবে আগে কারখানায় মেয়েদের নেওয়া হতো না, এখন তো শুনলাম মেয়েরাও কাজ করছে। কারখানার বিপজ্জনক মেশিন পত্রের মাঝখানে মেয়েরা যে কাজ করছে তাতে তো বিপদ আপদও ঘটতে পারে।" শ্রাবস্তী সুবর্ণ কেই প্রশ্নটা করে।
-" দেখুন এখন চা বাগানে পুরুষ শ্রমিক পাওয়াটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে মহিলাদের কারখানার কাজে নেওয়া হচ্ছে। তবে তাদের কম বিপজ্জনক কাজেই দেওয়া হয়। "সুবর্ণ বলে।
-" কিন্তু পুরুষরা যাচ্ছে কোথায়? "
-" চা বাগানের মজুরি কম। বাইরের ভীনরাজ্যে মজুরি তিনগুণ বা তারও বেশি। সেখানে শ্রমিকদের চাহিদাও বেশি। তাই চা বাগান গুলো বিশেষ করে সিক-গার্ডেন গুলো থেকে দলে দলে পুরুষ এবং মহিলারাও চলে যাচ্ছে অন্য রাজ্যে। খুব তাড়াতাড়ি যদি ন্যূনতম মজুরি না বাড়ে তবে আগামী দিনে চা বাগানে শ্রমিক পাওয়াই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।"
-" আচ্ছা এই যে শ্রমিকরা চা বাগান ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে, এটা কেন? আগে তো কখনও এমনটা হতো না? " শ্রাবস্তী জিজ্ঞেস করে।
এতক্ষণ চুপ করে দুজনের কথা শুনছিলেন সত্যপ্রিয়। প্রশ্ন শুনে গলাটা খাঁকরে নিয়ে বলেন," আগে চা-বাগানের চৌহদ্দি ছেড়ে যাওয়ার কোন সুযোগও যেমন ছিল না,প্রয়োজনও পড়েনি। মানুষের চাহিদা ছিল কম। মজুরি যেমনটাই হোক সুযোগ সুবিধা গুলো সময় মত মিলত। শ্রমিক কর্মচারীরা রেশন, তলব, বোনাস সময়মত পেত । অবসর গ্রহণের পর পি. এফ গ্র্যাচুইটি নিয়ে ভাবতে হতো না। বছরে একবার শীতকালে খড়, বাঁশ দিয়ে ঘর ছাওয়া হতো। মেরামতি হতো। বর্ষার ছাতা, শীতের কম্বল একবছর অন্তর মিলতো। চপ্পল দেওয়া হত। দেওয়া হতো জ্বালানি র কাঠ। মনোরঞ্জনের জন্য বাগানের মাঠে পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখানো,ম্যাজিক শো দেখানোর বন্দোবস্তও করত কর্তৃপক্ষ।অসুখ করলে বাগানের ডাক্তারের ওষুধেই রোগ সারত। অভাব অভিযোগ কি ছিল না। যথেষ্ট ছিল। তবু মানুষ মোটের ওপর আনন্দেই ছিল। অনন্ত নিরাপত্তা টুকু ছিল বলা যায়।" বলে সত্যপ্রিয় কিছুক্ষণ চুপ করে যান। হয়তো মনে মনে সেসব সোনালী দিনের স্মৃতিতে ডুবে যান।
-" আচ্ছা আরেকটি প্রশ্ন করি, যেটা মেয়েদের কাজের ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে। সেটা হল মেয়েদের ঋতুকালীন সমস্যা চলাকালীন পরিছন্নতা রক্ষার বিষয়ে সচেতন করা কিংবা কাজের জায়গায় এদের টয়লেটের ব্যবস্থা করা। বাগান কর্তৃপক্ষ কি এ ব্যাপারে সত্যি কোনও নজর দেয়। অথবা এর জন্য কোনও সরকারি নজরদারি বা সচেতনতা গড়ে তোলার কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কি?" শ্রাবস্তীর প্রশ্ন শুনে সত্যপ্রিয় কিছুটা ভেবে নিয়ে বলেন,
" দেখো খুব অপ্রিয় একটি সত্যি কথা যদি বলি কোনও কালেই চা বাগান কর্তৃপক্ষ সরকারি নির্দেশ খুব একটা মেনে চলে নি। চা বাগান এখনও টি-এস্টেট ,অর্থাৎ জমিদারি। এখানে সমান্তরাল একটি শাসনব্যবস্থা চলে এসেছে এতকাল। নিয়মকানুন সঠিক ভাবে মেনে হাতে গোনা কিছু বাগান কাজ করে। যদিও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হবার পর বিভিন্ন সরকারি সুযোগ সুবিধা বাগানের মানুষ পাচ্ছে। তবু সরকারি আইন, নির্দেশ ভায়োলেট করা বা দায় সারা গোছের পালনের প্রবনতা রয়েছে বাগান কর্তৃপক্ষের।আর নজরদারির ব্যাপারে বিশেষ কিছু না বলাই ভাল। সারা দেশ জুড়ে সব ক্ষেত্রেই তো কন্ট্রোলিং ব্যাপারটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। সরকারি ইন্সপেকশন বা নজরদারি যেটা বললে সেসব ম্যানেজ করাটা তো কঠিন ব্যাপার নয়।"
-"তারমানে আপনি বলছেন যেসব বললাম সেগুলো কিছুই পালন করা হয় না।" শ্রাবস্তী উদগ্রীব হয় জানতে।
-" ফিল্ডে যেসব মহিলারা কাজ করেন তারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে প্রকৃতির কোলেই যান। আর যেহেতু এখন কারখানায় মহিলারা নিযুক্ত হচ্ছেন তাদের জন্য আলাদা টয়লেট খুব কম বাগানেই আছে বলে মনে হয় আমার। থাকলেও সেই দায়সারা গোছের। আর ঋতুকালীন সমস্যার ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তোলা হয় না বললেই চলে। একসময় বাগানে বাগানে মাদারস-ক্লাব গড়ে তোলা হয়েছিল। তারা এসব করত... "
-" মাদারস-ক্লাব কী? " শ্রাবস্তী জানতে চায়।
-" মাদারস-ক্লাব হল ..." সত্যপ্রিয়কে কিছুটা বিশ্রাম দিতে, আলোচনায় ঢুকে পড়ে সুবর্ণ, "বাগানের কিছু মহিলাদের নিয়ে গড়ে তোলা একটি সংগঠন। যার শীর্ষে থাকবে ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার, এরা। এই ক্লাব মা এবং সন্তানের স্বাস্থ্যসচেতনতা গড়ে তোলা, মদ্যপান বিরোধী অভিযান, নারীদের ওপর অত্যাচারের বিরোধিতা করা এসব করত। এখন সরকারি অঙনওয়াড়ি, আশাকর্মী এরা চলে আসার পর মাদারস-ক্লাব উঠে গেছে। "
-"তার মানে বাগান কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব আরো কমে গেল , তাই তো? " শ্রাবস্তী কোট করে।
-" সে তো বটেই। যাও বা ছিটেফোঁটা রয়েছে, আগামীতে নব্বই শতাংশ চা বাগান কর্তৃপক্ষ আর সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করবে না। তারা শুধু বেতন আর আবাসন, এ দুটোই দেবে। তাও আবাসন মেরামতির দায়ও সেভাবে নেবে না তারা... " সুবর্ণ বলে যেতে থাকে। সত্যপ্রিয় তাকে বাধা দিয়ে বলেন,
-" তবে বেশ কিছু বছর আগে কিন্তু বানারহাটের কাছে একটি বাগান কর্তৃপক্ষ ও একটি এন জি ওর যৌথ উদ্যোগে বাগানের মহিলাদের মধ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলি করে তার উপযোগিতা সম্পর্কে প্রচার করা হয়। সেখানে বিশ্বসুন্দরী একজন এসেছিলেন... কী যেন নাম মনে নেই... তার সাথে আরো একঝাঁক মডেল। এরা এসে প্রচার করে যায়। এটুকু জানি। "
শ্রাবস্তীও কয়েকমুহুর্ত কথোপকথনে ছেদ টেনে প্রশ্ন করে,
"আচ্ছা আবার আমি আগের প্রশ্নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরেকটি প্রশ্ন করি। সেটা হলো লেবার মাইগ্রেশন এটা কবে থেকে শুরু হল উত্তরবঙ্গের চা বাগান অঞ্চলে? "
-" যবে থেকে বড় চা-বাগানগুলো, যাদের সেট-গার্ডেন বলা হয় ছোটো ছোটো চা বাগান গুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়লো। ছোট চাষীরা সরকারি ছাড়পত্র পেয়ে ধান, আনারস এসব তুলে দিয়ে নেমে পড়লো অর্থকরী চা চাষে। জায়গায় জায়গায় ভুঁইফোড়ের মত গজিয়ে উঠলো বটলিফ ফ্যাক্টরি। যেসব কারখানায় শ্রমিকরা কেবল মজুরিটুকু ছাড়া কিছু পায় না। মালিকদের বাড়তি দায়দায়িত্ব নেই। ছোট চা বাগানের বাড়বাড়ন্ত হওয়ায় সেট গার্ডেন গুলোর মুনাফায় পড়লো টান। কিছু মালিক শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করতে শুরু করলো। শুরু হল অসন্তোষ। অসন্তোষ তীব্র হতেই আড়ম্ভ হলো লক-আউট। একটা সময় একের পর এক বাগান বন্ধ হতে শুরু হয়েছিল। এটা মোটামুটি দু হাজার দুই সালের পর। লক আউটের সংখ্যাটা বাড়তে থাকে। পেটের দায়ে মানুষ ঘর ছেড়ে চলে যেতে লাগলো প্রথমে আশপাশের শহরে, পরে দূরের রাজ্যে। প্রথমদিকে পুরুষরাই যেত। পরে মহিলারাও পাড়ি দিতে লাগলো বাইরে। এখন তো একটু লেখাপড়া জানা চৌকশ মেয়েরাও অনেকেই বাইরে চলে যাচ্ছে। ভাল রোজগার, ভাল থাকা খাওয়া, শহুরে জীবনের টানে। " সত্যপ্রিয় কথা শেষ হতেই শ্রাবস্তী আরো কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল। সুবর্ণ বাধা দিয়ে বলে,
" আমাদের মনে হয় এবারে ওঠা দরকার। এরপর ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। বাকি কিছু জানার থাকলে নাহয় আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। "
-" হ্যাঁ, আমার আরেকটু জানার ছিল সেটা হলো বিগত বেশ কিছু বছর যাবৎ চা বাগান থেকে এই যে যুবতি মেয়েরা পাচার হয়ে যাচ্ছে বাইরে, বলা যায় কখনো স্বেচ্ছায় আবার কখনও দালালের খপ্পরে পড়ে। ডুয়ার্স অঞ্চল থেকে এমন কতজন গেছে, তারা ফিরে এসেছে কিনা। কতজন ফেরেনি। তারপর নারীদের ওপর ঘটে যাওয়া ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স...ক্রাইমের পেছনে কোন্ কোন্ সোশিও ইকনোমিক ফ্যাক্টর কাজ করছে ,সেসবের যদি কিছু ইনফরমেশন...। " শ্রাবস্তী কে থামিয়ে সুবর্ণ বলে,
" সেসব তথ্য যে দিতে পারবে তাকে ডেকে নিচ্ছি, চলুন।"
-" তিনি কে? "
- " তিনি একজন সাংবাদিক। আমার পরিচিত। হালফিলের তথ্যগুলো ও ভালো দিতে পারবে। ওকে ফোন করে বলে দিচ্ছি। যাওয়ার পথে দেখা করে নেব। "
সত্যপ্রিয়কে প্রণাম করে দুজনে যখন উঠে আসছে,সত্যপ্রিয় শ্রাবস্তীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-" এত অল্প সময়ের জন্য এলে, আর কোনও কথাই হল না। তোমার সম্পর্কেও জানা হল না কিছুই। "
শ্রাবস্তী সংক্ষেপে নিজের সম্পর্কে বলে। সব শুনে সত্যপ্রিয় কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে একদৃষ্টে। দৃষ্টির অস্পষ্টতা শ্রাবস্তীকে হয়ত পুরোপুরি স্পর্শ করে না। তবু এক অচেনা ঘোর লেগে থাকে চাহনির ভেতর। ম্রিয়মান হাসি ভাঙে ঠোঁটের কোনে। সত্যপ্রিয় বলেন, "তোমার মতোই, হয়ত তোমার চাইতে কিছুটা বড়ই হবে... আমার একটি মেয়ে ছিল। আজ সে নেই। ভাল লাগল তোমার সাথে কথা বলে। আবার এসো।"
সামনের মাঠটা পেরিয়ে গাছতলায় দাঁড় করানো বাইকের সামনে এসে শ্রাবস্তী পেছন ফিরে দেখে। সত্যপ্রিয় তখনও দরজার পাল্লায় দুহাত ঠেকিয়ে শূন্যদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে। বহুদিন একসাথে কাটানোর পর প্রিয়জন চলে যাওয়ার সময় যে বেদনা লেগে থাকে চোখে মুখে সেই ব্যথিত অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন বাইরের দিকে।
" ভদ্রলোককে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল জানেন। মনে হচ্ছিল আমি যেন আমার জেঠুমণির সামনে বসে আছি। কী সুন্দর মার্জিত কথা বলেন। আচ্ছা ওঁর আর কে কে আছে?"
হেলমেটের স্ট্রাপটা বাঁধতে বাঁধতে সুবর্ণ বলে, " সকলেই ছিল। একে একে অনেক প্রিয়জনদের হারিয়েছেন। বড়ছেলে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে স্কুলের সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যায়। সেই আঘাতে দারুণ ভেঙে পড়েছিলেন একসময়। সে প্রায় সত্তরের দশকের ঘটনা। দু হাজার সালে স্ত্রী মারা যান ক্যান্সারে। এর বছর কয়েক বাদে ছোট ছেলে। হার্ট অ্যাটাক। এই বাগানেই চাকরি করতো। সেই চাকরিটাই ছেলের বৌ পেয়েছে, রিপ্লেসমেন্ট গ্রাউন্ডে। সবশেষে সম্প্রতি বড় মেয়ের চলে যাওয়ার আঘাতটা বড় মারাত্মক। শেষ বয়সে এসে। একমাত্র ছোটমেয়ে যিনি কলকাতায় থাকেন আর বড় জামাই....পাশেই থাকেন...এঁরা খোঁজখবর করেন। বাগানের মানুষও তো প্রায় ভুলেই গেছেন যে ভদ্রলোক আছেন কি নেই। অথচ একসময় দেখেছি, এই বাড়িটায় লোকজন লেগেই থাকত।"
বাইক ছুটতে থাকে হাইওয়ের দিকে। সূর্য ততক্ষণে অনেকটা নিচু হয়ে দিগন্ত রেখা ছুঁয়ে ফেলেছে। অনেকটা দূর গিয়ে ডায়না ব্রিজে উঠতেই শ্রাবস্তী প্রশ্ন করে সুবর্ণকে,
- " আপনি যাকে ফোন করলেন আমরা কি তার বাড়ি যাচ্ছি? "
-" না। ওকে বলেছি ধাবায় আসতে। আমরা ওখানে বসে চা খেতে খেতে বাকি আলোচনাটা সেরে নেব।" হেলমেটের উইন্ডশিল্ডটা উঠিয়ে সুবর্ণ উত্তর দেয়।
-" বা-রে। আজ তো আমার ওখানে আপনার চা খাওয়ার কথা। তার কী হবে! আজকেও কেটে পড়ার তাল করছেন তাই না! হবে না, আই ওন্ট অ্যালাও ইউ টু বি স্কেপড..." আদুরে আবদারে কথাটা বলতে বলতে শ্রাবস্তী সুবর্ণর পিঠে আলতো ঘুঁষি মারে।
-" সে অন্যদিন হবে নাহয়। আজ কাজটা তো সেরে নিন আগে। "
-" অন্যদিন আর কবে হবে? কাল তো চলেই যাচ্ছি। '
-" কাল যাবেন মানে! কাজ হয়ে গেছে আপনার?'' বাতাসের গায়ে সুবর্ণ বেশ জোরে কথাটা ভাসিয়ে দেয়।
-" অলমোস্ট ডান। পরশু কলকাতায় ফেরার টিকিট কাটা আছে। কাল শিলিগুড়ি গিয়ে বিজনদার বাড়িতে গিয়ে দেখা করব। উনি কিছু ডেটা কারও থেকে নিয়ে রাখবেন বলেছেন।"
-" তা হলে চা-টা বাকি থাকল। পরে কখনও নাহয়... "বসুবর্ণ নির্লিপ্ত সুরে বলে।
- "নো ওয়ে স্যার... আপনার শাস্তি হল আজকের ডিনারটা আপনি আমার সাথে করবেন। অ্যান্ড দ্যাট উইল বি আ গ্র্যান্ড ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। আমি ফোন করে ম্যানেজারকে বলে দিচ্ছি সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে। আপনি আমার জন্য এত করলেন,এটুকু অন্তত করতে দিন।" শ্রাবস্তীর গলায় আর্তি ঝরে পড়ে।
-" সে কি! আমার তো ঘরে সব রান্না করা আছে..."
-" থাক, কাল খেয়ে নেবেন নাহয় ওসব। আজ আপনাকে কিছুতেই ছাড়ব না। আর হ্যাঁ, বউয়ের পারমিশন যদি লাগে তো ফোন করে নিন... বলবেন, ভয় নেই রাতভর আটকে রাখব না আপনাকে। তাড়াতাড়িই ছেড়ে দেব..." বলতে বলতেই শ্রাবস্তী মোবাইলে রিসর্ট ম্যানেজারের নম্বরটা রিং করে কথা বলতে শুরু করে দেয়।
সুবর্ণর হঠাৎ মনে হয় সে কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছে। কথা বলতে বলতে স্পিডোমিটারের কাঁটা অনেকটাই নেমে গেছিল নিচে। নিজেকে সামলে লুকিং গ্লাসে রিয়র ভিউটা একবার দেখে নিয়ে অ্যাকসিলেটরে চাপ বাড়ায় সুবর্ণ।