আমি এক যাযাবর-২৫/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
পর্ব ২৫
শৌভিক কুন্ডা
একটি পাখি
আমায় ডাকি
তার কাননে
লুকিয়ে পড়ছে মনে মনে
তার বদলে অনেক হলুদ সবুজ পাখি আসছে চলে
কিন্তু আমার পছন্দ তো সেই পাখিটিই, এবং, আমার পছন্দ যে সেই পাখিটিই.... (একটু ভুল হলেও হতে পারে, স্মৃতি এখন কাঁধের থেকে মাঝেমধ্যে হাত সরিয়ে নেয়)
ক্লিশে হলেও, এই যে মাঝে মাঝেই উঠিয়ে ঝোলা চলল ভোলা, তার কারণ ঐ অচিন এবং একটি পাখির ডাক। এখন পৃথিবী মুঠোবন্দী, জাদুআয়নায় পাখিটির তত্ত্ব তালাস বের করে নিতে সময়-শ্রম কিছুই লাগে না। অতএব মাজুয়া।
সহজ এবং সবচেয়ে কম সময়ের রাস্তা শিলিগুড়ি থেকে মিরিক, সুখিয়াপোখরি, মানেভঞ্জন হয়ে। সোজা নিজের বা ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হয়। পকেটের কথা ভাবলে, শেয়ার গাড়িতে মিরিক, একইভাবে সুখিয়াপোখরি, তারপর মানেভঞ্জন, শিলিগুড়ি থেকে তিনবার শেয়ার গাড়ি পাল্টে। শুনেছি মিরিক থেকেও মানেভঞ্জনের দু একটা গাড়ি পাওয়া যায়, সুখিয়াপোখরির জন্য তুলনায় বেশি। সে ক্ষেত্রে এক বা দুবার গাড়ি পাল্টাতে হচ্ছে। তবে, মানেভঞ্জন থেকে পাঁচ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে, নতুবা গাড়ি রিজার্ভ করতেই হবে। কারণ, মাজুয়া থেকে সকালে একটাই শেয়ার গাড়ি দার্জিলিং যাওয়ার পথে মানেভঞ্জন-সুখিয়া ছুঁয়ে যায়, বিকেলে সেটিই একই পথে ফিরে আসে। সময় একটা দেওয়া থাকে ঠিকই, কিন্তু একমেবাদ্বিতীয়ম যে হেতু, তিনি চলেন নিজের মর্জিমাফিক।
নেটে ছবি দেখেই মাজুয়ার প্রেমে। গতমাসেই দু দুবার তল্পি কাঁধে নিয়েছিলাম। তাই আরো কিছুদিন পরে সাড়া দেবো তার হাতছানিতে, এরকমটাই ভাবা ছিলো। কিন্তু ঐ যে বলে, "man proposes, God disposes!" উৎপল দা জানালো জলপাইগুড়ি আসছে। আগের থেকেই কথা হয়ে ছিল, এবার এলে বেরিয়ে পড়ব দুজনে। অতএব।
১১ তারিখ, জুন, ২০২২ শিলিগুড়ি ইচ্ছেবাড়িতে অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, ব্যক্তি পরিসরে 'কাকু', প্রয়াত ভবানী সরকারের "স্মরণলেখ" প্রকাশ অনুষ্ঠান ছিলো। তাঁর একমাত্র সন্তান, আকৈশোর বন্ধু শুভর ডাকে বিকেল থেকে সন্ধ্যেয় সেখানে। তারপর শেখরদার ব্যবস্থাপনায় সস্তায় অতি পুষ্টিকর সরকারি অতিথিশালায় রাত কাটিয়ে সক্কাল সক্কাল তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডের সামনে।
জানলাম মিরিক যাওয়ার শেয়ার গাড়ি জাংশানের সামনে পাওয়া যাবে। গেলও। তবে কেবল সামনে বোর্ড লেখা গাড়ি। তার ছাড়ার সময় সম্পর্কে খোঁজ খবর দেবার বা আমাদেরটা নেবার মতো আগ্রহী কোনো জনমনিষ্যি পেলাম না। ধর তক্তা মার পেরেক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম রিজার্ভ গাড়িই নেবো, কারণ, হিসেব বলছে "দূর অস্ত্ মাজুয়া!" তাছাড়াও উৎপল'দার সংযোজন, "বেশ দেখতে দেখতে খেলিয়ে যাওয়া যাবে"। তাই হ'ল, তবে ড্রাইভার দাদার চোখের পুরু কাচ আমাকে একটু হলেও ভাবিয়েছিলো! দার্জিলিং মোড়, খাপরাইল, শিমুলবাড়ি হয়ে গাড়িধুরা। প্রয়োজনীয় বাদবাকি সরঞ্জাম সাথেই ছিলো, কেবল রাস্তার জন্য জলের বোতল কেনা ওখান থেকে। এরপর উৎপল'দার উসখুস, "এসি'টা একটু চালালে হতো না কি রে?" দুধিয়া ছাড়াতে না ছাড়াতে উত্তর পৌঁছে গেল জানালা বেয়ে! আর ফুগুরি পৌঁছাতে পৌঁছাতে মেঘ কুয়াশার মাখামাখি! বৃষ্টি নামে নি তখনও।
ড্রাইভার দাদা বললেন, "মিরিককে বাইপাস করি?" আমাদের তখন গা এলিয়ে চালকের ইচ্ছায় কর্ম। এমনিতেও মিরিকের ঘিঞ্জিপনা আমার নিতান্তই না-পসন্দ্। অতএব শহরকে পাশ কাটিয়ে পশুপতির রাস্তায়। মাঝে গোপালধারা, গোলপাহাড়। উৎপল'দার চা চেপেছে। কিন্তু ঐ বাহারি টি-"বার" এবং গোল পাহাড়ের সামনে মকরস্নানের চেয়েও অনেক বেশি গ্যাঁজগেজি। আমার জানাই ছিলো, তাই ড্রাইভার দাদাকে এগিয়ে যেতে বললাম। আর বাগানসীমা পার করেই বাঁ হাতে পেয়ে গেলাম ছোট্ট চায়ের "দোকান"। কোজি কর্ণার বলতে যা বোঝায়। মালকিন একের পর এক ব্ল্যাক, হোয়াইট ইত্যাদি চায়ের গুণকীর্তন শুরু করলেন। আমার দরকার কফি। ব্ল্যাক, চিনি ছাড়া। তা-ও জুটলো। উৎপল'দা চা-খোর। সুগন্ধি ফার্স্ট ফ্লাশ। দুধ-চিনি। সঙ্গে মোমো। ফেরার পথে চায়ের প্যাকেট কেনার বাসনা নিয়ে রওনা হলাম। পশুপতি চেক গেটের কিলোমিটার খানেক আগে থেকে দাঁড় করানো গাড়ির সারি রাস্তাকে সরু করেছে। আমরা কোনমতে ফাঁকফোকর গলে এগোলাম। সীমানা ভিউ পয়েন্টে পিকনিক সীজন। নামি নি, ক্যামেরা গলানোরও তো জায়গা চাই!
ড্রাইভার'দার সাথে কথা হয়েছিলো সুখিয়াপোখরি অব্দি যাওয়ার। পথে কথায় কথায় সেটা আরেকটু এগিয়ে মানেভঞ্জন পর্যন্ত করা গেছিল। 'সীমানা' ছাড়িয়ে সুখিয়ামুখি চলতে চলতে হঠাৎ তিনি নিজেই বললেন, "জোড়পুখুরি দেখছেন?" আমার দেখা, উৎপল'দার নয়। সারথি যখন নিজেই কাজী, টগবগ করে ওঠা গেল। অতএব, চালাও পানসি জোড়পুখুরি! আহা, না এলে বড্ডো পাওনাদার থেকে যেতাম। তখনও রোদ বিছিয়ে আছে, কুয়াশা দূর থেকে উঁকি দিচ্ছে, পুখুরির জলে রাজহাঁসেদের অলস চলা, পাইন-ধুপির পাহারায়। তবে, পাহাড়ের প্রাচীন প্রবাদ, আরও গোটা দুই Wর মতো Weatherও যে এখানে চূড়ান্ত Unpredictable, টের পেলাম একটু সময় পরেই! ডাকাতের মতো কুয়াশা মেঘ হানা দিলো। সাড়ে সাত হাজার ফুট উচ্চতার রোদ ঝলমলে চত্বর, পুখুরি, পাইনের আউটলাইন এক মুহূর্তে আবছা হয়ে এলো তাদের তান্ডবে, সঙ্গে ঝমঝম বৃষ্টি! কনকনে ঠান্ডা।
শিলিগুড়ির সরকারি অতিথি নিবাস থেকে ১২ই জুন সকালে যখন বের হই, আকাশ জানান দিচ্ছিল সারাদিনই বেশ গরম থাকবে। কিন্তু সে জানকারি তো সমতলের জন্য! আমার গায়ে "চলো হারিয়ে যাই" লেখা টি-শার্টই কেবল। এ ক্যাপশন বেশ প্রশংসা পেয়েছে, টি-শার্টটিও, চলার পথেই পোস্ট করা একটা ছবিতে। কিন্তু এখন, এই যে জোড়পুখুরির লেক, লেকের জল থেকে উঠে আসা বিশাল নাগমুর্তি, অল্প দূরের বাংলো সবই যখন মুছে যাচ্ছে বৃষ্টির জলধোয়ায়, ঐ হাফ হাতা সম্বল তো ঝড়ের মুখে কাগজকুচি! এদিকে ড্রাইভার দাদার "প্রেসার আসছে", তিনি দরজা খোলা রেখেছেন গাড়ির, মুক্ত হতে গেছেন, সঙ্গে চাবি নিয়ে। উৎপল'দা দূরদর্শী। অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জ্যাকেট আগেই বের করে নিয়েছিলো, আমাকেও বলেছিল, আমি যথারীতি তখন ডোন্ট কেয়ার! এখন তো গাড়িতে বসেও হু হু কাঁপছি। চাবি ড্রাইভারদার কাছে, ডিকি খোলা যাচ্ছে না, যার ভেতরে আমার ব্যাগ, যে ব্যাগের ভেতর জ্যাকেট। চাবি নেই, হাফ খোলা পাওয়ারউইন্ডো বন্ধ করা যাচ্ছে না, জলের ছাঁটে ভিজে যাচ্ছে গাড়ির অন্দর মহল! বৃষ্টি ধরে এলে চালক ফিরলেন, 'প্রেসার' নামিয়ে। আবার গড়ালো গাড়ি। পিছে পড়ে রইলো জোড়পুখুরির পুকুর, হাঁটার জন্য বাঁধিয়ে রাখা চত্বর, জলে খেলা করতে থাকা রাজহাঁসের দল, দূরবৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া পাইন ধুপির সারি, স্যালামান্ডার ট্যাংক।
খিদে পেয়েছে বেশ। সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট, সাড়ে দশটা নাগাদ এক কাপ কফি। জোড়পুখুরি থেকে মানেভঞ্জন সাড়ে আট কিলোমিটার মতো।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴