সোনগাছি চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
সোনগাছি চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^
মালবাজার মহকুমার চা বাগিচা সফর প্রায় শেষের দিকে। মিশন হিলে রাজকীয়ভাবে একরাত্রি আদর আপ্যায়নে অতিবাহিত করার পর আজ ফিরব জলপাইগুড়ি। তবে সকালে বেড়িয়ে আগে যাব সাকাম বনভূমি। তারপর সোনগাছি এবং সংলগ্ন নাখাটি ডিভিশন সার্ভে শেষ করে সন্ধ্যাতে জলপাইগুড়ি। ফলে আজকে হাতে সময় খুবই কম। ফাগু মিশন হিল রোড ধরে লোয়ার ফাগু চা বাগান হয়ে এগিয়ে চলেছি সাকাম বনভূমির দিকে। মিশন হিল টি এস্টেটের গোলাই ছাড়ালাম। কিছু পরেই গরুবাথান খাসমহল শুরু। তারপরেই সাকামের
ভার্জিন বনভূমি। পথ জনশূন্য। বনপথ এদিক ওদিক কত দিকে প্রসারিত। এবড়োখেবড়ো পথ এসে মেশে পিচ রোডে। নদী, চা বাগান এবং জঙ্গল পার হয়ে মসৃণ পিচ রোড সাকাম হয়ে সামনের দিকে প্রসারিত। দেখা যাচ্ছে সাকাম। গাড়ি ঘুরে গেল বাঁয়ে সাকামের দিকে। আমরা পৌঁছে গেলাম সাকাম বিটে। পাহাড়ের মাথায় সমতল, সুপারি গাছ, বুনোঘাসের জঙ্গল, খেলার মাঠ। স্থানীয় নেপালি বউ মেয়েরা কাজকর্মে ব্যস্ত। সাকাম ফরেস্ট বিটের লোকজনদের কোয়ার্টার। সামনে মৌচুকি, লাভা, নেওড়া জাতীয় উদ্যান। চমৎকার ভিউ পয়েন্ট। আমরাই একমাত্র পর্যটক। নিচে লোহার সাঁকো, ঘরবাড়ি, নদী। দূরে এঙ্গো, চিলৌনি, মেটেলি পাহাড়। সাকামে একসময় কিছুই ছিল না। চোখে পড়তো বনভূমির ভার্জিন বিউটি। পত্রপুষ্পে সবুজ অরণ্যে মোরা নীরব-নিস্তব্ধ ধ্যানমৌন সাকাম পাহাড়ে পৌঁছে মনে হলো পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীন পথ। সাকাম যেন রূপকথা, স্বপ্নলোকের দেশ। দুই পাশে শুধু শালবন, হাতিদের করিডোর। পথ ক্রমশ চড়াই। বাঁদিকে সাকাম বিট। পাহাড় ডিঙিয়ে দূর্গম পথের শেষ রোচেলার নেওড়া জাতীয় উদ্যানের বিস্ময়কর জায়গায় যেখানে ভালুক, চিতা, এবং দূর্লভ প্রজাতির পশুপাখির নিশ্চিন্ত বিচরণ। ডিজেল এবং পেট্রোল এর ধোঁয়া এখনও পৌঁছায় নি।
বর্ষায় সাকামের সৌন্দর্য পাগল করে তোলে। অসাধারণ আরণ্যক সৌন্দর্য ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। মনে হবে রং তুলি নিয়ে বিশাল ক্যানভাস জুড়ে আত্মভোলা এক শিল্পী তন্ময় হয়ে ছবি আঁকছেন। পাখিদের শুধু কনসার্ট নয়, রীতিমতো সম্মেলন শুরু হয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাহাড়ি ময়না, টিয়া, ধনেশ, বসন্তবৌরি, খঞ্জন, দোয়েল, আরও কত রকমের পাখি। যাদের চিহ্নিত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পাখিপ্রেমিকদের অনুরোধ সাকামের জঙ্গলে এসে একবার আমাদের চিনিয়ে দিন পাখির বংশগত চালচিত্র। পাখিদের বংশগত চালচিত্র নিয়ে প্রচুর গবেষণা করা যাবে। উন্মুক্ত তৃণভূমিতে ময়ূর-ময়ূরী ঘুরছে, বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে জংলি মোরগ রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে। শুনলাম, কদিন আগে এখানে ৫০-৬০ টি হাতি বনদপ্তরের ট্রাকটিকে ঘিরে রেখেছিল। বুড়িখোলা জঙ্গল যেন শেষ হয় না। ভুট্টাবাড়ি, গরুবাথান, বুড়িখোলা হয়ে হাতিরা দলবেঁধে সফর করে। গাড়ির স্পিড একটু কমে যায়। নিসর্গের সংগীত শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল ফিরবো না কংক্রিটের জঙ্গলে। জঙ্গলের মধ্যেখানে তিরতিরে ঝোড়ার কাছে গাড়ি দাঁড়ালো। ভালো করে একটু চারপাশটা দেখি। উদাসী হাওয়ায় মন ভরে যায়। বনপথের দুদিকে রাশি রাশি বন্য টগর, কোথাও ভাট ফুলের সমারোহ। শিমূল গাছে লাল ফুল যেন শত শত লাল রঙের পাখি। রুদ্রাক্ষ, আমলকি গাছ। নব কিশলয়, সুবাসিত শালমঞ্জরি, ঝিঁঝির শব্দের তীব্র একটানা সুর। বনতল যেন শুকনো পাতায় ছাওয়া মোজাইক। সাকামে এবং ভুট্টাবাড়ির জঙ্গলে হাতি যখন তখন চলে আসে। হাতির চেয়ে বড় ভয় ভাল্লুক এবং লেপার্ড।
নব কিশলয়, সুবাসিত শালমঞ্জরি ঘেরা সাকাম। টিলার ওপরে কয়েকটা ঘরবাড়ি। এখন সাকামে বেশ কয়েকটা দোকান হয়েছে। সপ্তাহে একদিন নাকি হাটও বসে। শীতে চড়ুইভাতির মেলা বসে যায় সাকামে। চায়ের দোকানে ঢুকে চা-বিস্কুট খেয়ে সামনে পাহাড়ি চোরাই পথে হেঁটে বেড়াই। প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার তহবিল থেকে পিচঢালা পথ নির্মাণ হচ্ছে। একটু ঘুরপাক, তারপর সটান সাকামের নিচে নেওড়া নদীর কোলে। এখানকার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দেখার মতো। সাকাম ছুঁয়ে চলে আসি নেওড়া নদীর কাছে। ভয়ংকর শব্দে জলধারা তীব্র স্রোতে অসংখ্য পাথরের উপর দিয়ে সমতলে ছুটছে। চারিদিকে সুউচ্চ পাহাড়। পুঞ্জপুঞ্জ মেঘ ভাসছে। পেছনে সবুজ পাহাড়টা যেন হেলান দিয়েছে নীল আকাশের কোলে। জলাধারে কলকল শব্দ। ঝাঁকে ঝাঁকে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি এবং ফড়িঙের মেলা। লাইন দিয়ে আদা কোয়াসের বস্তা মাথায় করে গাঁয়ের লোকজন আসছে চোরবাটো পথ ধরে। শীতে কমলালেবু নিয়ে পাহাড়িরা টুকরি বোঝাই করে সোমবারি এবং মেটেলির হাটে চলে যায়। শীতের দুটি মাস পিকনিকপ্রেমীরা শহর থেকে গাড়ি বোঝাই করে আসে। স্থানীয় দোকানগুলিতে তখন বেচাকেনা হয়। আগামীদিনে এই পথ মসৃণ হয়ে যুক্ত হবে মেটেলির চৌপথি পর্যন্ত। আপাতত মেটেলি থেকে সাফারি, জোঙ্ঘা, কমান্ডার যাত্রী বোঝাই করে সাকামের কাছাকাছি একটু ওপরে আসে। স্থানীয় গ্রাম এবং বস্তির লোকজন হেঁটে, পিঠে মালের বস্তা চাপিয়ে ওঠানামা করে গাড়ি যতদূর পর্যন্ত আসে ততদূর পর্যন্ত। এখান থেকে হেঁটে এঙ্গো চা বাগান হয়ে মেটেলি এবং সামসিং যাওয়া যায়। স্থানীয় লোকেরা সেভাবেই যাতায়াত করে। বনপথে হাতির বড় ভয়। ইদানিং বুনো শুয়োরের উপদ্রব বেড়েছে।
গাড়ি লাট্টুর মতো পাক খেয়ে নামছে। ডুয়ার্সের অসাধারণ অনন্যসুন্দর সৌন্দর্যখনি সাকামের পাহাড়ি অরণ্য ঘিরে পর্যটন পরিকল্পনা হোক। বাঁদিকে প্লাস্টিকে ঘেরা ঝুপড়ি চা দোকান। একটু চা এর সন্ধানে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হল। এখানকার বড় সমস্যা সন্ধ্যে হলেই হাতি অথবা লেপার্ডের অত্যাচার। এরকম জায়গাতে যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই কে আসবে বেড়াতে? লোহার সাঁকো পেরিয়ে ওপারে আরও দুচারটে দোকান হয়েছে। নেওড়া জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কুলিমজুর, বাবুদের ওপর ভরসা। বসন্তে নেওড়াতে শুধু ছোট-বড় অসংখ্য পাথরের চাঁই। জল সামান্যই। উদোম ন্যাংটো বালকেরা জলাধারে মনের সুখে সাঁতার কাটছে। ছেলেগুলোর একটুও ভয়ডর নেই নাকি রে বাবা। আমরা চুপচাপ সিমেন্টের বাঁধানো চাতালে বসে প্রজাপতি পর্যবেক্ষণ, পাহাড় অরণ্যের চিত্রমালায় নিমগ্ন হলাম। অরণ্য পথে ঢুকে পড়ি। মালনদী চা বাগান হয়ে বুড়িখোলা বিট। চারপাশে হাতির অত্যাচার থেকে রেহাই পাবার জন্য ইলেকট্রিক ফেন্সিং। বনবস্তি, বনবিভাগের কোয়ার্টার পেরিয়ে ঘন অরণ্যপথ শেষ হলো ভুট্টাবাড়িতে গিয়ে। মালনদী, তুনবাড়ি, গুরজংঝোরা হয়ে অবশেষে মালবাজার-চালসা রোডে উঠে পৌঁছালাম সোনবাড়ি চা বাগান মোড়ে। পিচ রোড থেকে চা বাগানের ভিতরে ঢুকে পড়ি। বাবুদের কোয়ার্টার, শ্রমিক মহল্লা, দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তুলছে চা শ্রমিকরা। ছায়াগাছ, দুধারে শুধু সবুজ সোনার দেশ। বাঁদিকে গাছগাছালির আড়ালে ডুবে আছে ম্যানেজারের বাংলো। জমি থেকে আমরা বেশ উঁচুতে উঠে পড়েছি। দু’পাশের সবুজের ঝালর যেন ঝুলে পড়েছে। সোনগাছি থেকে নাখাটি ডিভিশন।
শুরু করেছিলাম এলেনবাড়ি দিয়ে। শেষ করব সোনগাছি এবং তার সংযুক্ত ডিভিশন নাখাটি দিয়ে। তাই এসেছি সোনগাছিতে। মালবাজার সাব ডিভিশনের সোনগাছি চা বাগানটিতে চালসা থেকে যাওয়া যায়। আইভিল চা বাগান ছুঁয়ে চালসার গোলাই পেরিয়ে মালবাজারের পথে খানিকটা গেলেই সোনগাছি চা বাগান। চালসা থেকে ৪ কিমি সোনগাছি চা বাগান মোড়। ডানদিকে আইভিল এবং বাঁদিকে সুনগাছি বা সোনগাছি দুটিই বড় বাগান। সোনগাছি চা বাগিচার নাখাটি ডিভিশনের সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। পরিচালক গোষ্ঠী সোনগাছি টি ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং এবং ডুয়ার্সে অবস্থিত চা কোম্পানিগুলির একটি গ্রুপ যারা ভারতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন ধরনের চা পণ্যের উৎপাদন, বিপণন এবং বিতরণে নিযুক্ত আছে। এই চা-কর পরিবার ১৯৫৫ সাল থেকে চা বাগান পরিচালনায় নিযুক্ত রয়েছে। পরিবারটি ১৯৫৫ সালে প্রথম চা বাগানটি কিনেছিল এবং তারপর থেকে কখনও পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চারটি চা বাগানে সোনগাছি টি ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড গ্রুপের মোট চা উৎপাদন এখন প্রায় ৪ মিলিয়ন কিলোগ্রামে দাঁড়িয়েছে। সোনগাছি টি ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড এর যাত্রাপথ শুরু হয়েছিল ১৯৭৬ খৃস্টাব্দের ৬ ই জানুয়ারী ঘনশ্যামদাস আগরওয়াল এর হাত ধরে। অন্যান্য বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের মধ্যে বালকিষাণ সারিয়া ১৯৮১ সালের ২৫ শে অক্টোবর, শিউ সারিয়া কুমার ১৯৯৫ সালের ৯ ই জানুয়ারী এবং পরবর্তীকালে সানওয়ারমল চানগোইওয়ালা বোর্ড অফ ডিরেক্টর হিসাবে যোগদান করেন।
লন্ডনের জেমস ফিনলে এন্ড কোম্পাণীর কাছ থেকে হাত বদল হয়ে প্রায় ৫১ বছরের এই ঐতিহ্যশালী সুনগাছি টি ইন্ডাস্ট্রিজ (পি) লিমিটেড কোম্পাণী চা উৎপাদনের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে। ডিবিআইটিএপরিচালিত সোনগাছি চা বাগিচাতে ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৭ জন। বাগানে প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়নে শাসক দলের প্রাধান্য হলেও জয়েন্ট ফোরাম এবং ডিটিডিপিএলইউ শক্তিশালী। সোনগাছি চা বাগানটির আয়তন বেশ বড়। বাগানের সহকারি ম্যানেজারের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানলাম ১৩০০ হেক্টর বাগিচার গ্রস এরিয়া এবং গ্র্যান্ট এরিয়া ১০৫২.১ হেক্টর। আপরুটেড এরিয়া ২৬.১৩ হেক্টর। ২৮.৮৪ হেক্টর জমি নতুন করে বপন করা হচ্ছিল ক্ষেত্রসমীক্ষার সময়ে। সেই সময়ে ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত প্ল্যান্টেশন অঞ্চল ছিল ৬৯৩.৪২ হেক্টর। প্রতি হেক্টর জমি পিছু ২৬১০ কেজি করে গুণগত মানের ভালো চা ফ্যাক্টরিতে আসে প্রসেসিং এর জন্য। সোনগাছি চা বাগানে নিজস্ব কাঁচা চা পাতা উৎপাদনের গড় ৭৫-৮০ লাখ কেজি। ফ্যাক্টরিতে মোট বাৎসরিক নিজস্ব উৎপাদিত তৈরি চা গড়ে ১৬-২০ লাখ কেজি। বাইরের বাগান থেকে সংগৃহীত কাঁচা চা পাতা বাৎসরিক ১০-২০ লাখ কেজি। তবে তা প্রতিবছর একইরকম থাকে না। ফ্যাক্টরিতে কেনা চা পাতায় উৎপাদিত চা প্রায় ৫ লাখ কেজি গড়ে। প্যাকেজড টি উৎপাদনের পরিমান ১২-১৫ লাখ কেজি। চা এর গ্রেড অনুযায়ী সোনগাছি চা বাগিচাতে মোট বাৎসরিক উৎপাদিত ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা ২০-২৫ লাখ কেজি। চা বাগানের লিজ হোল্ডার। সোনগাছি চা বাগিচার সাব স্টাফ ১১৯ জন। করণিকের সংখ্যা বড়বাবুকে ধরে ১৯ জন। ক্ল্যারিক্যাল বা টেকনিক্যাল স্টাফ ১৮ জন।
সোনগাছি চা বাগিচায় শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৪৪৫। মোট জনসংখ্যা ২৬৩০। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিযুক্ত শ্রমিক সংখ্যা ৭৭৬। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত কর্মী এবং স্টাফের সংখ্যা ৭৪। মোট শ্রমিক ৬৮৮ এবং শ্রমিক পরিবারগুলির উপর নির্ভরশীল অশ্রমিক ১৯৪২ জন। সাম্প্রতিককালে এই পরিসংখ্যান কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। সোনগাছি চা বাগিচা এমজিএনআরইজিএস এর সুবিধা পায় না। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের কাছে বাগানটি আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ। চা বাগিচার লীজ হোল্ডার সোনগাছি টি ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড। সোনগাছি চা বাগিচাতে পাকা বাড়ির সংখ্যা ১১৩০, সেমি পাকা ১৫, অন্যান্য পাকা বাড়ি ৭০, সরকারি অথবা সরকারি স্কিমে গড়ে ওঠা পাকা বাড়ি ১৭০ টা। মোট বাড়ি ১৩৮৫, মোট শ্রমিক ১৬৯৯। বাগিচাতে ৮২% পাকা বাড়ি নির্মিত হয়েছে। চা বাগিচাতে একটি হাসপাতাল আছে এবং ২ টি আউটার ডিসপেনসরি আছে। বাগিচাতে ডাক্তার আছে। বহুদিন আগে পরিচয় হয়েছিল ডঃ জে এস সারাঙ্গীর সঙ্গে। তিনি ছিলেন এমবিবিএস ডাক্তার। যেদিন ভিজিটে গেলাম সেদিন কারোর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নি। ট্রেন্ড নার্স ১ জন, কম্পাউন্ডার ১ জন, হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট ১ জন, মিড ওয়াইভস ২ জন। হাসপাতালে মেল ওয়ার্ড ১৬ টা, ফিমেল ওয়ার্ড ১৪ টা, আইসোলেশন ওয়ার্ড ২ টি, মেটারনিটি ওয়ার্ড ৩ টি, অপারেশন থিয়েটার আচ্ছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। অ্যাম্বুলেন্স আছে। বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার ছিলেন পিণাকী পাল। এখনও আছেন কিনা জানি না। বাগিচাতে স্থায়ী ক্রেশের সংখ্যা ১১ টি। ভ্রাম্যমান ক্রেশের সংখ্যা ৬ টি। ক্ৰেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা এবং শৌচালয় আছে। ক্রেশের শিশুদের দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হয় বলে দাবি। তবে ক্ৰেশে শিশুদের জন্য দুধের ব্যবস্থা করা হয়। শিশুদের পোশাক সরবরাহ করা হয়। পর্যাপ্ত পানীয় জল ক্ৰেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করা হলেও তা কতটা শুদ্ধ তা নিয়ে অবশ্যই সংশয় আছে। ক্রেশে মোট অ্যাটেন্ডেন্ট ৩৪ জন।
বাগিচার কাছাকাছি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় আছে। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা হিসাবে একটা বাস আছে। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব এবং খেলার মাঠ আছে। প্রভিডেন্ড ফান্ড খাতে নিয়মিত অর্থ জমা পড়ে। বোনাসের পরিমাণ ২০ শতাংশ। মালিকপক্ষ বোনাসের সময় ন্যায্য টাকা দিতে গড়িমসি করে না। বকেয়া পিএফ এর মোট অর্থ জানা যায়নি। তবে মোটামুটি আপডেট থাকে। শ্রমিকদের মজুরি, রেশন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়। গ্র্যাচুইটি নিয়েও কোন সমস্যা নেই সোনগাছি চা বাগিচাতে। আসলে চা বাগানের পরিস্থিতি খুবই সংকটজনক। বহু চা বাগান বছরের পর বছর বন্ধ। বাবু, শ্রমিকেরা অর্ধাহারে, অনাহারে কোনরকমে বেঁচে আছেন, আবার কোথাও বা শুধু মৃত্যুর মিছিল। সরকার মালিকদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে ব্যর্থ। শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বোবা হয়ে আছেন। শুধু অসার বক্তৃতা। তবে সোনগাছি চা বাগিচা দেখে ভালো লাগল। একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ বাগান। মনে পড়ল মেটেলি থেকে জিপে নাগেশ্বরী চা বাগানের ভেতর দিয়ে জুরান্তিতে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলাম অনেক দিন আগে। সেখান থেকে এঙ্গো, চিলৌনি। কি অপরূপ সুন্দর চা বাগানগুলি। চিলৌনি হয়ে জাতীয় উদ্যান মৌচুকির দিকে যাওয়া যায়। ঘন্টাখানেক নদী, জঙ্গল, পাহাড় পেরিয়ে চলে আসা যায় সাকাম।
সিটিসি চা - তে সোনগাছি দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ প্যাকেজিং কোম্পানি। এই বাগিচা নিজস্ব ব্র্যান্ডের অধীনে প্রায় ৪ মিলিয়ন কিলোগ্রাম চা সরাসরি বাজারজাত করছে। এদের চা উত্তরপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, বিহার, রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের মতো অনেক রাজ্যে বাজারজাত করা হয়। সোনগাছির দার্জিলিং টি এস্টেটে প্রিমিয়াম চা তৈরি করা হয় যার বেশিরভাগই সারা বিশ্বে রপ্তানি করা হয় এবং কিছু ভারতে বিতরণ করা হয়। সাদা, ওলং, সবুজ এবং ঐতিহ্যবাহী দার্জিলিং চা সহ বিভিন্ন ধরণের চা তৈরি করছে সোনগাছি। হ্যান্ড ক্রাফটেড চা, পার্ল টি, অলিম্পিক ফ্লেম, পিওনি রোসেট এবং সিলভার নিডলস এর মত কিছু বিরল চা তৈরি করে সোনগাছি। এস্টেটটিতে অত্যাধুনিক কারখানা এবং প্যাকেজিং ব্যাবস্থা উন্নতমানের। চা অঞ্চলটি সেচযোগ্য এবং একশো শতাংশ জমি সেচের আওতায় রয়েছে। মাটির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে নিয়মিত গোবর সার প্রয়োগ করা হয়। গৃহীত ব্যবসায়িক নীতি, প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যবসায়িক অখণ্ডতা, কর্মচারী এবং ভোক্তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, পরিবেশের প্রতি দায়িত্ব এবং তার কর্মীদের প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতা, চা বাগানগুলির পরিবার কল্যাণ, শিশুদের টিকাদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে সোনগাছি চা বাগান গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি করেছে। পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বাড়ানোর জন্য চা বাগানগুলি বিভিন্ন ধরণের পরিবেশ বান্ধব কর্মসূচী গ্রহণ করে।
এটা উল্লেখ্য যে চা শিল্পে বেশ কিছু সামাজিক, রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত সমস্যা কাজ করে। বাগানগুলি মূলত দেশের প্রত্যন্ত কোণ থেকে উপজাতিদের নিয়োগ করে যারা সামাজিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত অংশের অন্তর্গত। সামাজিক উন্নতির উপর সরকার যে জোর দেয় তা চা শিল্পের দ্বারা পূর্ণ হয় না। বাগানগুলি সমাজের প্রতিবন্ধী অংশগুলিকে ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য, আবাসন, মানসম্পন্ন চিকিৎসা সুবিধা, শিশুদের জন্য স্কুল এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা প্রদান করে। বেশিরভাগ বাগান প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এবং চা বাগান ব্যবস্থাপনা এত দূরবর্তী অঞ্চলে ক্ষুদ্র প্রশাসন প্রদান করে এবং রাজ্য প্রশাসনকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে। কোম্পানি এটা নিশ্চিত করে যে তার বাগানের কর্মীদের জন্য তাজা পানীয় জল, সুসজ্জিত হাসপাতাল, মাতৃত্বকালীন ক্লিনিক, ক্রেস, ভাল স্কুল এবং ভর্তুকিযুক্ত রেশনের দায়িত্ব চা বাগিচার।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴