শালসিঁড়ি ২৪/ বিমল দেবনাথ
শালসিঁড়ি ২৪
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
ময়ূখের কোন কিছু আজকাল ভালো লাগে না। সকালে দোলা মাসির কাছে ঘরদোর রেখে মা চলে যায় নার্সিং হোম। যাওয়ার সময় বলে যায়…
- ময়ূখ সাবধানে থাকবি বাবা।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাকে হাত দেখায়। আকাশে চিল দেখে। দূরে বড় রাস্তার পাশে রেইনট্রি গাছে চিল সহ আরো কিছু পাখি উড়ে এসে বসে- কাক শালিক হবে হয়তো। ময়ূখ ভাবে ঐ গাছের নাম কেন রেইন ট্রি! ঐ গাছ থেকে কি চোখের জলের মতো জল পড়ে। ঐ গাছ কি কাঁদে। কেউ কাঁদলে যে চোখের জল পড়ে। কই ঐ গাছ থেকে জল পড়ে না তো! ময়ূখ নিজের চোখ মোছে। ময়ূখের চোখে জল নেই- রেইনট্রি গাছের মতো। ময়ূখ জানে না কেন সব কান্নার জল থাকে না। ময়ূখ বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজের মতো করে ভাবে বাবা’র কথা মা’র কথা। দোলা মাসি ডাকে ব্রেক-ফাস্ট করার জন্য। ময়ূখ ফোন করে অংশুকে।
- হ্যালো …
- বল ময়ূখ, কেমন আছ? মা কোথায়? অপরূপা ফোন ধরে।
- ভাল আছি কাকিমা। মা নার্সিং হোমে গ্যাছেন।
- বল কিছু বলবে?
- কোন কিছু ভালো লাগছে না কাকিমা। অংশুকে পাঠাবে।
- ঠিক আছে। চিন্তা করবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। দুই বন্ধু সময় করে পড়ে নেবে। সামনে পরীক্ষা। আমরা সবাই আছি, তোমার বাবার কথা নিয়ে বেশি ভাববে না।
- ঠিক আছে কাকিমা।
অপরূপা কল কাট করে বসে পড়ে সোফার উপর। কলেজ অপরূপা মাধুরী বিকাশ… ফেসবুক আদরের কুকুরের মতো, কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। “ইওর মেমরি” নোটিফিকেশনে ভেসে আসে কলেজের পিছনের বট গাছের তলায় বসে থাকা মাধুরী বিকাশ অপরূপার একটা ছবি। বিকাশ কী সব কাণ্ড করে। কবে যে পুরোনো দিনের ওর ক্লিক-৩ ক্যামেরার তোলা ছবি দিয়ে দিয়েছে… তখনো অপূর্ব ফ্রেমে আসেনি। অনেক দিন পর অপূর্ব মাধুরীর জীবনে আসে, বট গাছে উড়ে এসে জুড়ে বসে পড়া গোলাপি গলার পায়রার মতো। বটগাছে কত পাখি আসত লাল ফল খেতে। মাঝে মধ্যে কিছু পাখি আসত না অনেক দিন ধরে, পরে আবার ফিরে আসত ঝাঁকে ঝাঁকে। বিকাশ প্রায়ই বলে, বনে ভেলোয়া ফলের মতো কত ফল পাওয়া যায় যা খেলে পশু পাখি মানুষ নিজের পথ ভুলে যায়- মরে যায়। অপরূপা ভাবে- বিকাশের কথা যেন ভুল হয়। অপূর্ব ফিরে আসুক গোলাপি বুকের পায়রার মতো আবার বট গাছে…
- অংশু…
- আসছি মা।
- ময়ূখ ফোন করেছিল। তোমাকে যেতে বলেছে। আমার মনে হয় তুমি গেলে ওর ভালো লাগবে। যাবে?
- হ্যাঁ মা, যাই। ময়ূখ একদম ভেঙ্গে পড়েছে। পড়াশুনা করতে পারছে না।
- কিছু বই নিয়ে যেও।
- ঠিক আছে-মা।
অংশু বেরিয়ে পড়ে সাইকেল নিয়ে। অপরূপা দুয়ারে দাঁড়িয়ে মঙ্গল কামনায় ঠাকুরের নাম স্মরণ করে। অপরূপার বিশ্বাস ঠাকুর শুধু আসনে বা মন্দিরে বসে থাকে না। ঠাকুর থাকে মনে- হৃদয়ে। অপরূপার হাত দিয়ে কপাল ছোঁয় বুক ছোঁয়… চেনা জানা কারো বিপদের সময় বুকের ভিতর যেন কেমন করে- ভয় জমে ওঠে গিলা ফলের মতো। মনে পড়ে, শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার মতো কত কথা…
- অপরূপা, এক্ষুনি হেড অফিসে যাবার জন্য রেডি হতে হবে- বিকাশ বলে।
- সেকি, তুমি যে বললে আজ অফিসে অনেক ঝামেলা।
- পাঁচ ট্রাক অবৈধ কাঠ ধরা আছে, ঝামেলা তো থাকবে। আইনি নোটিশ দেওয়া আছে –দেখা যাক কী হয়।
বিকাশ তাড়াতাড়ি ব্রেক-ফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ে। হিরামতি বলে-
জান বৌদি, এখানে আসবার সময় দেখলাম পার্টি অফিসে অনেক লোকজন। কালকে যে ট্রাকগুলো ধরা হয়েছে সেই নিয়ে কী যেন বলছিলো।
-দাঁড়া, অংশু কেঁদে উঠল মনে হয়। অপরূপা বলে।
অপরূপা অংশুকে কোলে তুলে নেয়। মাস ছয়েকের অংশুর যেন কান্না থামে না। কান্না শুনে পাশের কোয়ার্টারের যোগেনেদার বৌ সরলা বৌদি ছুটে আসে। সরলা বৌদি হাত বাড়িয়ে কোলে নেয় অংশুকে। তাতে যেন অংশুর কান্না আরো বেড়ে যায়। সরলা বৌদি হাল ছেড়ে দিয়ে অংশুকে দিয়ে দেয় অপরূপার কোলে। বলে-
বৌদি, আমার মনে হয় বাবু সোনার হাওয়া লেগেছে। আমাদের বনে এই কম্পাউন্ডে ছোট বাচ্চাগুলোর প্রায় এরকমের হাওয়া লাগে। তোমাকে বলে ছিলাম, ব্রিটিশ আমলে এই জায়গাটায় কবর ছিল। লোকমুখে শোনা যায় কারণে অকারণে অনেক মানুষকে এই কম্পাউন্ডের জায়গাটাতে পোঁতা হয়েছে। “জঙ্গল কেটে জমি বানাও” আদেশ অমান্য করলেই মরণ। অকাল মরণের অতৃপ্ত আত্মাগুলো মনে হয় এখনো ঘুরে বেড়ায় এই কম্পাউন্ডে। তোমাকে কত করে বললাম, ছেলেটা হল, যাও শহরে বাপের বাড়ি গিয়ে থাক; তুমি সেটা করলে না। শহর ছেড়ে বনে চলে এলে। এখানে ডাক্তার বলতে তো সেই আশিস ডাক্তার। বাচ্চা থেকে বুড়ো, হাসি থেকে ফাঁসি সবার এক গতি। যাই লামা বুড়োকে ডেকে নিয়ে আসি। ঝাড়ফুঁক করে দিলে যদি ছেলেটার কান্না থামে…
লামা বুড়োর ভালো নাম তেজবীর লামা। বনের এই কম্পাউন্ডে কাজ করতে করতে সরকারী কাজে স্থায়ী হয়েছে। স্থায়ী কাজ হয়েছে বছর দুই হবে। এই দীর্ঘ সাতাশ বছরে বনে মন দিয়ে কাজ করার সাথে সাথে প্রসার ঘটিয়েছে নিজের কিছু বিশেষ গুণের। লামাজির ঝাড়ফুঁক এবং তাবিজ কবজ নাকি খুব কাজ করে। আশিস ডাক্তার ফেল করলেও, লামাজির ঝাড়ফুঁক নাকি ফেল করে না। লামাজি একদিন সকালে কোয়ার্টারে এসে বলে…
- মাঈজি এগারো টাকা দিন।
- কেন! অপরূপা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
- স্যারের জন্য একটা তাবিজ করে দিব। স্যারের তো অনেক শত্রু। কোমরে বেঁধে দিবেন। স্যারের কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবেনা- যত দিন এই তাবিজ স্যারের কোমরে বাঁধা থাকবে।
সাদা বকের মত মাথা ঝুঁকে লামাজি দাঁড়িয়ে থাকে অপরূপার সামনে। মুখ তুলে দেখে না মাঈজীকে। অপরূপার অবস্থা ডালিমের মতো। ফুল ও ফল এক সাথে ঝুলে আছে গাছে। অপরূপা বিজ্ঞান আর বিশ্বাসকে এক সাথে বুকে ধরে নিয়ে এগারো টাকা দিয়ে দেয় লামাজিকে। ভাবে- ভালোবাসা কী এমনই হয়, হারানোর আশঙ্কায় হাতের কাছে যা পায় তাকেই জিয়ন-কাঠি মনে হয়। লামাজি করজোড়ে এগারো টাকা নিয়ে বিড় বিড় করে কী বলে তিনবার ফুঁক দিয়ে টাকা নিয়ে চলে যায়। কত দিন পরে গত পরশু শনিবার সকালে এসে লামাজি তাবিজটি দিয়ে বলে –
- মাঈজি আজ দিন খুব ভালো, স্যারকে তাবিজটা স্নানের পরে কোমরে বেঁধে দেবেন।
- অপরূপা ভাবে- কোমরে তাবিজ বাঁধা হলো আর তার পরদিনই পাঁচ পাঁচটা কাঠের লগ ভর্তি ট্রাক ধরে নিয়ে এল বিকাশরা। তারপর পুরো রবিবারটি ফোনের পর ফোন এসে মাটি করে দিল! অপরূপা বুঝতে পারে এই সব ফোন সব লোকাল ফোন। কারণ বাইরের ফোন এত ঘন ঘন আসবে কী ভাবে। তখন তো দূরে ফোন করার জন্য ট্রাঙ্ক বুক করে বসে থাকতে হতো ঘন্টার পর ঘন্টা। ফোনের যাওয়া আসা দেখে অপরূপা বুঝতে পারে, স্থানীয় কারো কারো সাথে বাক্ বিতন্ডা হচ্ছে- বিকাশের। অপরূপা কোন কিছু জানতে চেয়ে ভার বাড়াতে চায় না বিকাশের। বরং ব্যস্ত থাকে ছেলের সাথে খেলতে। আজ সকালে বেরিয়ে গেল সদরে জরুরি খবরে পেয়ে। তারপরে ছেলেটা কান্না শুরু করে। কান্না আর থামতেই চাইছে না। সরলা বউদি এখনো লামাজিকে নিয়ে আসল না। অপরূপা বারান্দা থেকে দেখে সরলা বৌদি ছুটে ফিরে আসছে। এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে-
- বৌদি অফিসে তালা লাগিয়ে দিয়েছে অনেকগুলো লোক। কিছু লোক মাইক লাগাচ্ছে অফিসের চার দিকে। অফিসের ভিতরে লামা বুড়ো সহ সবাই আটকে রয়েছে। অফিসে খুব গন্ডগোল হচ্ছে। এখন কী হবে বৌদি।
বলতে বলতে সারা কম্পাউন্ড-এ মাইকের শব্দের সাথে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অপরূপা দেখতে পায় সামনের কোয়ার্টারগুলোর দরজা সবাই বন্ধ করে দিচ্ছে। বনের ছোট ছোট আবাসস্থলগুলোতে এমনিতেই লোক সংখ্যা কম। তারপর অনেক কর্মচারী না থাকার জন্য অনেক কোয়ার্টার ফাঁকা পড়ে আছে। যে কয়জন কর্মচারী আছেন তারা অফিসের ভিতর আটক হয়ে আছে। মাইকে ভেসে আসে অশ্লীল গালি-গালাজ এবং বিকাশকে মারার হুমকি। ভেসে আসে – বিকাশকে কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হুঙ্কার। অপরূপার চেনা কম্পাউন্ডকে কেমন যেন অচেনা লাগে। ভয় যেন ঘিরে ফেলে পুরো কম্পাউন্ড, কালো ধোঁয়ার মতো। কতগুলো লোক অফিসের দিক থেকে ছুটে আসে কোয়ার্টারে দিকে- হাতে লাঠি আর তরবারি। সরলা বারান্দার দরজার আগলে দাঁড়ায়। লোকগুলো দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। হামলাকারিদের তীব্র চিৎকারে বন্ধ হয়ে যায় শিশু অংশুর কান্না। অপরূপার মনে হয়- আতঙ্কে শিশু অংশু যেন জমে বরফ হয়ে যায়। সরলা তীব্র স্বরে বলে- তোমরা এখানে কেন এসেছ। স্যার ঘরে নেই। সকালেই সদরে গেছে। আতঙ্কে অপরূপা অংশুকে চেপে ধরে বুকে। গলিয়ে দিতে চায় বরফের মতো সমস্ত ভয় বুকের উষ্ণতা দিয়ে … মোবাইল ফোন বেজে উঠে।
- মা, আমি পৌঁছে গেলাম।
- ঠিক আছে। সাবধানে থাকবে।
অংশু সাইকেল নিচতলায় স্ট্যান্ড করে উপরে উঠে যায়। ময়ূখ গোমড়া মুখে শুকনো শিউলি ফুলের মতো হেসে বলে-
- আয়, ভিতরে আয়।
দুই বন্ধু ড্রয়িং রুমে বসে শিমুল তুলোর মতো হালকা গল্পসল্প করে। সব গল্পের মাঝে শিমুলের বীজের মতো আটকে থাকে অপূর্বর কথা। দোলা মাসি ওদের প্রিয় চিকেন চাউমিন এনে দেয়। পছন্দের খাদ্য খেতে খেতে কখন যে রসে সিক্ত হয়ে যায় মন, সব সময় বোঝা যায়না। রসবোধ নদীর মতো নেমে আসে কথার ঝুড়ি নিয়ে। অংশু বলে -
- ময়ূখ, বাবা একটা ভুতের পল্প বলেছিল- শুনবি।
- ভুতের গল্প? বল।
- তখনো বাবা একা। আমরা কেউ ছিলাম না। বাবা একটা বনবাংলোতে রাতে হল্ট করছে। একা। ডিনারের সময় বাংলোর স্টাফ জানায়, বাবা যে ঘরটিতে থাকবে সেই ঘরে নাকি এক ব্রিটিশ মেম ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিল।
- কী বলিস!
- হ্যাঁরে। মাঝে মাঝে নাকি ভুত মেম গভীর রাতে ঘুরতে বের হয়। বাবা তো এসব কিছু বিশ্বাস করে না। তাই গট গট করে শুতে চলে যায়।
- তারপর!
- বাবা নাকি গভীর ঘুমে। হঠাৎ মনে হয় ঘরের কাঠের পাটাতনের উপর কেউ হাঁটছে। হাঁটার সাথে সাথে পায়ের নূপুর বাজছে- ছম ছম। ঝম ঝম…
- আমাদের স্কুলের ক্লাস নাইনের শ্যামলী যখন পারফর্ম করতে স্কুলের অডিটোরিয়ামের স্টেজে ওঠে তখন যেমন নূপুর বাজতো- সেই রকম! ময়ূখ হাসে।
- তুই ইয়ার্কি করছিস।
- না না বল। তারপর।
- বাবা বিছানা থেকে নেমে উপরতলা পুরোটা খুঁজে দেখে। কোন কিছু না পেয়ে নিচ তলায় যায়। সেখানেও কোন কিছু মেলে না। বাবা আবার গিয়ে শুয়ে পড়ে। আবার কিছুক্ষণ পরে সেই নূপুরের শব্দ ভেসে আসে ঘরের ভিতর। বাবা তখন চোখ খুলে শুয়ে থাকে মেম ভুত দেখার জন্যে। বাবার সারা রাত ঘুম হয় না এবং মেম ভুত দেখাও হয় না।
- বাব্বা, কাকুর খুব সাহস তো!
- কি হলো চাউমিনটা শেষ কর- দোলা মাসি প্লেট নিতে এসে দেখে অংশুদের খাওয়া শেষ হয়নি। দোলা মাসির কথা শুনে আবার খেতে শুরু করে ওরা।
- বল তারপর কী হলো? ময়ূখ জিজ্ঞাসা করে।
- সকালে ব্রেক-ফাস্টের পর বাবা স্টাফের সাথে বন বাংলোর নিচের পাটাতনের তলায় ঢোকে। পাটাতনের তলায় ঢুকেই স্টাফটি পালাতে গিয়ে পাটাতনের তলার কাঠের বিমের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাথায় আঘাত পায়। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলে- স্যার, ভুতের পায়ের ছাপ।
- কি বলিস ভুতের পায়ের ছাপ ছিল, কাঠের পাটাতনের তলায়।
- শোন না। বাবা সব দেখে শুনে বেরিয়ে আসে। স্টাফকে বলে- এই ভুত কিন্তু যে সেই ভুত নয়। মেম ভুত! খুব সাবধানে থাকবে।
- খুব ভয়ানক ঘটনা তো!
- আমিও তাই ভাবছিলাম। তারপর বাবা সব খুলে বলে।
- কী?
দোলা মাসি এসে খাবারের প্লেট নিয়ে যায়। ময়ূখকে অনেক দিন পর হাসি খুশি দেখে দোলামাসির খুব ভাল লাগে। গাল স্নেহ লাবণ্যে লাল হয়ে উঠে লাল জবার মতো। মনে মনে ভাবে- বৌদি এই ময়ূখকে দেখলে কত খুশি হতো। অংশু বলে –
- বাবা তো বুঝে গেছে- ওটা কিসের পায়ের ছাপ। বাবা বলেন বনে শুধু পায়ের ছাপ দেখতে নেই। পায়ের ছাপের ট্রেইল দেখতে হয়। তাই ঐ পায়ের ছাপ মানুষের মতো হলেও ভুতের নয়।
- তাহলে ওটা কিসের পায়ের ছাপ ছিল?
- ওটা ছিল সজারু’র পায়ের ছাপ। বাবা বলেন শুধু পায়ের ছাপ নয়, মানুষ যে যা করে; সব কিছুর ছাপ পড়ে পৃথিবীর উপরে। আমরা ভালো কিছু কাজ করলে ভালো কিছু হবে পৃথিবীর আর খারাপ কিছু কাজ করলে খারাপ হবে পৃথিবীর- মানুষের।
- তাই।
- হ্যাঁ। সজারু যখন কাঠের উপর হাঁটে তখন পায়ের ছাপ পড়ে না। কাঠের পাটাতনে হাঁটার সময় সজারুর কাঁটার একটার সাথে আর একটা কাঁটার ঘষা খাওয়ায় যে শব্দ তৈরি হয় সেটা নূপুরের শব্দের মত হয়। আবার কাঠের পাটাতনে মানুষ যখন হাঁটে তখন তার কম্পন পেয়ে সজারু দ্রুত পাটাতনের তলায় মাটির গর্তে ঢুকে যায়। কেউ খুঁজে পায়না সজারুকে। বন বাংলোতে রাতে শুধু ভূত হাঁটতে থাকে।
অংশু ময়ূখ হি হি করে হেসে উঠে। হাসি হল যষ্টিমধুর মতো। যত চিবোবে তত মিষ্টি। মুখ মন মিষ্টি হয়ে যায়। দোলা মাসির মন দুলে উঠে আনন্দে ও কষ্টে। ঘরের কাজ করতে করতে ভাবে মাধুরীর কথা…
- কেমন দেখলে, অপূর্বকে।
- কথা বলছে। তবে কোমোরের নিচের অংশে তেমন সাড়া নাই।
- ডাক্তার কী বললেন।
- এ্যাক্সিডেন্টের পর অপূর্বকে খুব খারাপ ভাবে নার্সিং হোমে আনা হয়েছে। প্রথমে বোঝা যায়নি যে স্পাইনাল কর্ডে মাল্টিপল ব্রেকেজ হয়েছে। অপারেশনে জ্ঞান ফিরলেও কত দিন লড়াই করে বেঁচে থাকতে পারবে তা এক্ষুনি বলা যাচ্ছে না।
- তুমি কি রাতে ক্যাবিনে থাকছ।
- না, সারা দিন থেকে রাতে ফিরে যাই।
- চলো ভিতরে যাই। একবার কথা বলি।
বিকাশ মাধুরী কেবিনে ঢোকে। বিকাশ একটা চেয়ারে বসে অপূর্বর হাত ধরে থাকে। অপূর্বর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। বিকাশ বুঝতে পারে স্পাইনাল কর্ডে মাল্টিপল ব্রেকেজ হলে কী হতে পারে। শালসিঁড়ি ভেঙ্গে গেলে হারিয়ে যেতে পারে প্রজাপতি, পাখি, ডুমুরের মতো কত বন্যপ্রাণ ও গাছ। শালসিঁড়ি আর মেরুদন্ড তো একই রকম। শালসিঁড়ির আর মেরুদন্ডের ক্ষতের বিলম্বিত শুশ্রূষা বিপদগ্রস্থ করে তোলে জীবন -মানব জাতির এবং মানুষের। লোভের আগুনে পুড়ে যায় মরে যায় সম্পর্কের উপাদান শালসিঁড়ির সহচরী এক একটি গাছ বন্য প্রাণীর মতো। শালসিঁড়ির ক্ষত আর মানুষের ক্ষত দেখে অন্তর্জলিতে কী লাভ হয় কেউ জানেনা। তবুও বাস্তব ভুলে অনুষ্ঠিত কত অন্তর্জলির। লোভী কুমিরের মতো জেগে- ঘুমিয়ে থাকে অনেকে, ভুলে যায় সবুজ বন আর সুস্থ জীবন অক্ষত থাকে অটুট খাদ্য শৃঙ্খল আর গভীর শৃঙ্খলা বোধের জন্য। বিকাশ ডাকে…
- অপূর্ব…
অপূর্ব মাথা তুলতে চাইলে মাথা এলিয়ে পড়ে যায় বিছানার উপর বাসি জারবেরা ফুলের মতো… বিকাশ ভাবে- এটাই কী নিয়তির নিয়ম, শুরুতে ও শেষে মানুষের মুখমন্ডল ফুটে ওঠে ফুলের মতন! মাধুরীর চোখের জল বট গাছের কষের মতো সাদা গাঢ়, ঝাপসা হয়ে উঠে দৃষ্টি। কেঁপে ওঠে বিকাশের ফোন… মাধুরীর মন…
নির্মল বাবু বলে-
- স্যার পুলিশ বেইটের তথ্য চাইছে, কী করব…
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴