বাগানিয়া জার্নাল-২৪
বাগানিয়া জার্নাল – তৃতীয় ভাগ
পর্ব।। আট।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
চিনা
চা-কারগররা যখন এল তখন চা-তৈরির মরসুম শেষ। আবার শুরু হবে মার্চে। তা ও কিছু চা যদি বানানো যায় সেই উদ্দেশ্যে ব্রুস সেই দুজন চিনা কারিগরকে নিয়ে আসামের চা-জঙ্গলগুলো দেখাতে বার হলেন। সেসব চা-গাছ দেখে চিনারা যেমন বিস্মিত হল তেমন আনন্দিতও। তারা জানালো এই চা-গাছগুলো একদম তাদের দেশের মতই শুধু একটু বেশী বয়সী।চিনারা সেই গাছের মূলত কচি পাতা, সঙ্গে কিছু মাঝারি ও বড় পাতা দিয়ে প্রথম পরীক্ষামূলক চা বানালো ডিসেম্বর ১৮৩৬ সালে।
চিনাদের কাছে দেখে ও শিখে ১৮৩৭ সালের অক্টোবর মাসে ব্রুস টি কমিটির কাছে ছোট বই-এর আকারে (pamphlet) তাদের কালো-চা বানাবার পদ্ধতি লিখে পাঠালেন।
বইটার প্রথম ভাগে তিনি ১৫টা ছবি দিয়ে চিনাদের কালো-চা বানানোর সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ ভাবে সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় ভাগে চিনা-কারিগরদের সঙ্গে চিনদেশের চা নিয়ে এক নাতি দীর্ঘ কথোপকথন। শেষ ভাগে তিনি আসামে আরও নতুন নতুন যে চা-এলাকা আবিষ্কার করেছেন তার বর্ণনা এবং সঙ্গে উচ্চ-আসামের একটি চা-মানচিত্র।
এরপর কিছুদিন পর, ১৮৩৭ সালের ডিসেম্বরে, মাটক দেশের চা-পাতা থেকে তৈরি কালো-চায়ের প্রথম নমুনা চারটে কাঁচের বোতলে ভরে, খড়কুটো দিয়ে চার দিক থেকে মুড়ে, কাঠের বাক্সে পাঠানো হল কলকাতায়। পথে দুটো বোতল ভেঙে চা ছড়িয়ে পড়ল খড়কুটোর ওপর।তাতে চায়ের সুগন্ধ খুব একটা নষ্ট হল না। টি কমিটির হাত হয়ে সে চা পৌঁছল সরকারের কাছে।
সরকারও জানিয়ে দিল প্রথম পরীক্ষামূলক চা, যদিও পরিমাণে অল্প, তবুও তা খুবই সন্তোষজনক এবং গুণগত মানে বিক্রয়যোগ্য। সরকার আরও পরীক্ষার জন্য আরও কিছু চায়ের পেটি পাঠাবার ব্যবস্থাও করতে বলল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
অবশেষে জানুয়ারী ১৯৩৮-এ আসাম থেকে সতেরো পেটি কালো-চা এসে পৌঁছল কলকাতায়। সেগুলো পাঠানো হবে ইংল্যান্ডে। জাহাজে। দেখা গেল দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার পক্ষে পেটির প্যাকিং ঠিক নেই। ভালো করে প্যাকিং না হওয়ায় আসাম থেকে নৌকো করে কলকাতা আনার পথে বেশ কিছু চা আর্দ্রতায় অনেকটাই মিইয়ে গ্যাছে। সে সময়ে চিন থেকে দুজন সবুজ-চা কারিগর, দুজন চা-বাক্স কারিগর আর একজন পেটি-কারিগর কলকাতায় উপস্থিত। তারা আসামের প্যাকিং খুলে ভালো করে আবার প্যাক করে দিল সব চা। তাতে বারো পেটি দাঁড়ালো। পিকো গ্রেডের ছয় পেটি আর সুচঙ গ্রেডের ছয় পেটি। প্রতিটি পেটিতে ১৯ সের বা ৩৮ পাউন্ড করে চা।
বাকি পাঁচ পেটির মত চা বাতিল করতে হল –নষ্ট হয়ে যাবার জন্য।
মে মাস নাগাদ সে চা রওনা দিল ইংল্যান্ডে। আর ওই চিনা-কারিগরদের পাঠিয়ে দেওয়া হল আসামে।
১৮৩৯ সালের দশই জানুয়ারি ইংল্যান্ডের নিলামকেন্দ্রে আসামের কালো চা প্রথম নিলামে উঠল। জনৈক ক্যাপ্টেন পিডিং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভিতর সবচেয়ে বেশি দাম দিয়ে একাই সব চা কিনে নিয়ে ইতিহাসে নাম তুলে নিলেন।
সেই চা যে গুণগত ভাবে খুউব উঁচুদরের ছিল তা নয়। তবে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্ত অঞ্চলে বৃটিশদের তৈরি প্রথম চা বলে একটা উত্তেজনা - আবেগ ও কৌতুহল- কাজ করেছিল।তাই গুণগত মানের থেকেও অনেক বেশি দাম উঠেছিল আবেগের উত্তেজনায়।
এরপর, ওই ১৮৩৯ সালের শেষের দিকে, আরও পচানব্বই পেটি চা এসে পৌঁছল ইংল্যান্ডে। এবং ১৭ই মার্চ ১৮৪০ সালে তার মধ্যে পঁচাশি পেটি চা আগের মতই হৈ হৈ করে বিক্রি হয়ে গেল। বাকি দশ পেটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেরা বিভিন্ন মানুষের কাছে বিলি করেছিল।
বিভিন্ন টি ব্রোকাররা এবারের চা-কে আগের বারের থেকে অনেকটাই ভাল বলল। বিখ্যাত টি ব্রোকার মেসার্স টুইনিং এ্যান্ড কোম্পানি লিখল –‘ সব মিলিয়ে বলা যায় আসাম যে বাজারে বিক্রি করার মত খুব ভালো চা বানাতে পারবে - এবারের চা থেকে তা খুব ভালো ভাবেই আশা করা যায় । যদিও এখন মূলত গন্ধ ও লিকারের দিকে বেশি ধ্যান দিয়েই চা বানানো হয়েছে তবে এ কথা সন্দেহ করার কোন কারণই নেই যে আরও ভালো চা-সংস্কৃতি (Tea Culture) ও কারিগরি দিয়ে আসাম এমন চা বানাতে পারবে যা বাজারে চিনা চায়ের মতই উন্নত গুণমানের হবে।‘
কী গভীর দূরদৃষ্টি। ১৮৩৪ সালে লর্ড বেন্টিঙ্কস যেদিন ভারতে চা-চাষের জন্য সওয়াল করেছিলেন সেদিন বোঝা যায় নি যে মাত্র ছ বছরের মধ্যে পাশা উলটে যাবে। আসলে এই ১৮৩৯-৪০ সালেই চিনা চায়ের পৃথিবীব্যাপী একচেটিয়াত্ব শেষ হয়ে বৃটিশ চায়ের জয়যাত্রা শুরু হয়ে গেল।
ইংল্যান্ডের নিলামের পরের ঘটনা কলকাতার নিলাম কেন্দ্রে। ১৮৪১ সালের পাঁচই মার্চ উচ্চ-আসামের জয়পুর থেকে ৯৫ পেটি চা প্রথম পাঠানো হল কলকাতা নিলাম কেন্দ্রের জন্য - যার মধ্যে কালো ও সবুজ দুরকমই চা ছিল –কেননা ইতিমধ্যে সবুজ চা বানাবার চিনা কারিগর আসামে পৌঁছেছিল। এই চা-নিলাম উপলক্ষ্যে একটা হ্যান্ডবিল ছাপানো হয়েছিল। তাতে লেখা হল ‘Novel and Interesting Sale of Assam Teas- the First Importation for the Calcutta Market’. এবার নিলামের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ঘটনা ছিল ঐ ৯৫ পেটি চায়ের মধ্যে ৩৫ পেটি চা ‘সরকারি ব্যবস্থার সাহায্য নিয়ে’ সযত্নে বানিয়েছিল সিংফো সর্দার নিংগ্রুলা এবং ঘোষণা করা হয়েছিল যে সেই চা-বিক্রীর টাকা তার মঙ্গলের জন্যই নিয়োজিত হবে।
তাতে জর্জ ওয়াট লিখলেন – তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ড. ওয়ালিচ যখন আসামের দেশি চা-গাছকে সত্যিকারের চা-গাছ বলে মানতেই চাইছিলেন না তখন সিংফোরা সেই গাছের পাতা দিয়ে চা-বানাতে রীতিমত সিদ্ধহস্ত ছিল।
অবশ্য ওই ‘সরকারি ব্যবস্থার সাহায্য নিয়ে’ কথাটা এখানে নিংগ্রুলার ‘চা-বানানো’-র ঘটনাতে সত্যিকারের অবদান নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলে দেয়।কেননা সিংফোদের ‘ফালাপ’ তৈরির পদ্ধতি ও কালো-চা তৈরির পদ্ধতি আলাদা। তাই মনে করা হচ্ছে নিংগ্রুলার আদেশে তার প্রজারা হয়তো কাঁচা পাতা সরবরাহ করত সরকারি ফ্যাকটরিতে যেখানে চা বানানো হত। এবং সর্দারকে সেই চা বানানোর কৃতিত্ব ও আর্থিক লাভ দেবার পিছনে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাই মনে হয় বেশী ছিল যাতে তাকে খুশী রেখে সে অঞ্চলে শান্তিতে ব্যবসা করা যায় এবং তার অধীনস্ত জমিতে আরও চা-বাগান তৈরিতে তাকে উৎসাহিত করে তোলা যায়।
-----------------------------------------------------------
ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া...
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴