নানা রঙের গানগুলি-২৪/শৌভিক কুন্ডা
নানা রঙের গানগুলি( ২৪)
শৌভিক কুন্ডা
------------------------------
গত শতক। নয়ের দশকের প্রথম দিকে হবে। এ শহরে (জলপাইগুড়ি) চিত্তপট নাটকের দলের সদস্য আমি। আজও সে দলেরই সাথে আছি। যা হোক, সেই চিত্তপটে প্রস্তাব এলো একটা অন্যরকম অনুষ্ঠান করার। অনুষ্ঠানটি গানের। কিন্তু, "বহিরাগত শিল্পী সমন্বয়ে" না। সকলেই স্থানীয় শিল্পী। কেউ তখনও স্কুলে পড়ছে, কেউ উত্তরবঙ্গে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন গানের উঠোনে। প্রস্তুতি পর্ব চলেছিলো মাস পাঁচেক! শহরের গায়ক গায়িকাদের নিয়ে অনুষ্ঠান,তবু। কারণ, শুরুতেই যে বলেছি 'অন্যরকম'! হ্যাঁ, এই আয়োজনের একটা অন্য ধরনের নামও দেওয়া হয় : "ভালো লাগা গান"। কাদের ভালো লাগা? না, চিত্তপটের সদস্য সদস্যাদের নয়। সে সময়ে অন্তত পঞ্চাশ বছর বয়স হয়েছে, এমন মানুষদের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছিলাম আমরা। বিষয়টি বুঝিয়ে তাঁদের হাতে হাতে দিয়ে এসেছিলাম ছাপানো প্রশ্নমালা। আজ ঠিক মনে পড়ছে না, প্রশ্ন সংখ্যা কত ছিলো। তবে কয়েকটি প্রশ্ন বেশ মনে আছে, নাম-ঠিকানা, পরিচয় জানতে চাওয়া ছাড়াও : প্রিয় গায়ক/গায়িকার নাম, তাঁদের গাওয়া অন্যতম প্রিয় গান, কোনো গানের সাথে ব্যক্তিগত কোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে কি না, নয়ের দশকের গানের সাথে সেসব গানের পার্থক্য, ইত্যাদি।
এই উত্তরমালা সংগ্রহ করে আকর্ষণীয় ফর্মগুলো আলাদা করে, তাদের মধ্যে থেকে common উল্লেখ গুলোকে একসাথে করা, গায়ক/গায়িকা অনুসারে ভাগ করা, তারপর এ শহরে সেসব গান কে কোনটা গাইতে পারবে তা নিয়ে বৈঠক, এমনকি খেলোয়াড় বাছার স্পটার হিসেবে এ গলি সে পাড়া ঘুরে বেড়ানো, এ সব করতেই তো প্রায় আড়াই মাস কেটে গেল। সাথে চললো স্ক্রিপ্ট লেখা, এবং সে স্ক্রিপ্ট কাটাছেঁড়া, কয়েকবার। তারপর রিহার্সাল! উফ, কিছু দিন গেছিলো তখন!
মধুমিতাদির, মধুমিতা চট্টরাজ, তখন অবশ্য মুখার্জি, গোল আলোর বৃত্তে বসে খালি গলায় শুরুয়াৎ। প্রাথমিক সঞ্চালনায় মৌসুমি, তারপর থেকে সে দায়িত্ব শেষ অবধি টেনে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে মধুপর্ণা আর আমি।
পর্ণা গেয়েছিলো "গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু"। তীর্থঙ্কর, তখন নেহাৎই তরুণ তীর্থ, " দেহতরী দিলাম ছাড়ি ও গুরু"। ছোট্ট সুকন্যার গলায় "আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা"। মৌসুমি চৌধুরী তখনই রেডিওতে গান করে, " মনে ক'র আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে"! এ ছাড়াও সৌরজ্যোতি, সঙ্গীতা।ঘুরে ফিরে কত গান, কত গান! পর্ণার "ও তোতা পাখি রে" আক্ষরিক অর্থে জল এনে দিয়েছিলো শ্রোতাদের চোখে! "আকাশে হেলান দিয়ে" গানটি গাওয়ার পর এক প্রৌঢ়া স্টেজে উঠে এসেছিলেন কাঁদতে কাঁদতে। এ গানটি তিনিই শুনতে চেয়েছিলেন। মঞ্চে এসে আমার হাত থেকে মাইকটি নিয়ে জানালেন পাথরঝোরা বাগানে কাটানো তাঁর ছোট বেলার কথা। জানালেন কি ভাবে এই গানটির সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর প্রয়াতা দিদির স্মৃতি!
কারোকে কিছু জানতে না দিয়ে অন স্টেজ স্ক্রিপ্টের বাইরে চলে গেছিলাম একবারই। শেখরদা, ভাস্কর দা রীতিমতো ঘাবড়ে গেছিলো। গান গাইবে দীপংকর, দীপংকর রায়, এখন জলপাইগুড়ি রূপায়ণের পরিচালক, ভাই নামেই চেনে সবাই। আমি স্পীকার হাতে খুঁজে বেড়াচ্ছি, "দীপংকর! ভাই! কোথায় রে!" নাটকের মানুষ দীপংকর, স্ক্রিপ্ট ছাড়াচ্ছি বুঝেও ঠিক সময় মতো এন্ট্রি নিলে আমি ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, "কোথায় চলে গেছিলে,ভাই! আমরা যে তোমার পথ পানে চাহি...." দীপংকর সাথে সাথে শুরু করলো হিমাংশু দত্তের সেই বিখ্যাত সৃষ্টি,
"তোমার পথ পানে চাহি
আমার এ পাখি গান গায়..."
মাঝে মাঝে ভাবি, সে সব দিন যদি আবার ফিরে আসে!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴