তোর্সার ঘরবাড়ি-২৪
তোর্সার ঘর বাড়ি//চতুর্বিংশ পর্ব
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
----------------------------------------------
'নয়া চরের নয়া কাহন বসত নাওয়ের ছই/ সাঁকোর কাছে চরের দাওয়া মাসান আছেন ঐ'
এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া, দূরে বা কাছে বন্ধুর বাড়ি কিংবা বাড়ি থেকে দীঘির পাড়, ভবানীগঞ্জ বাজার যেতে হলে মিনিদের প্রচুর নিষেধাজ্ঞা ছিল তখন। ঐ কিশোর কাল আর তা পেরোনোর কালে। এখনকার মতো বিপুল স্বাধীন একা মনের মতো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো, কেউ কিছু বলার নেই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকার মানুষ নেই, 'অমুকের সঙ্গে কথা বললি কেন'! 'অতদূরের রাস্তায় গেলি কেন...'সে সব জবাব দিহির দায় নেই বলেই কেমন শূন্যতা। মার হাতের সে আধো ঘুমে বিছিয়ে দেওয়া চাদরের অনুভব আজো আছে মিনির, এ মাঝ বয়সেও। সুমির সঙ্গে সাতকাহন পুরোনো গল্প কিছুক্ষণ তোর্সার ধারে আর খানিকক্ষণ সাগরদীঘির পাড়ে বসে। কোন চেনা মুখ নেই এতদিন হয়ে গেলেও। সবাই অজানা অচেনা চোখে তাকায়। ওরাও এদিক ওদিক আর সন্ধে রাতে সাগরদীঘির জলে আলোর কাঁপন আর জলে থির থির নাচ দেখতে দেখতে পাড়ে দাঁড়ানো আর ভেসে যাওয়া রাজহাঁসেদের জলে ভেজা পালক শুকিয়ে নেওয়া বিকেলের সাঁতার আর পানকৌড়ির মত ডুব সব দেখেছে আর গলার কাছে কতগুলো কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠেছে। দুজনে হেঁটেছে মাঝ শহর বরাবর, সেকালের তৃপ্তি হোটেলের কদর কমেছে। জায়গা করে নিয়েছে 'যুবরাজ', 'ইলোরা'। ঝাঁ চকচকে। শুধু কি চাকরি! বিপুল ব্যবসার আড়তখানা এখন রাজশহর। বদলে গেছে টিমটিমে আলো, তার বদলে বছর বছর বদলে যাওয়া রকমারি এলিডি। দুজন দেখছিল মুগ্ধ হয়ে। হঠাৎ ই সুমি চেঁচিয়ে ওঠে, ঐযে দেখ,'গোপাল কেবিন'- হ্যাঁরে, এখন আমি ওদের ই কাছে রাতের রুটির খরিদ্দার।- চল ভেতরে যাই। দুটো মিল বলি।- আরে: তোকে যে বললাম রয়্যাল প্যালেসে আজকের ডিনার।- ঠিক আছে একটুতো দেখে আসি। এ দোকানে কত স্মৃতি। মা এখান থেকে অফিস ফেরত কতদিন খাবার প্যাকেট নিয়ে যেতেন।...তা নিয়ে যৌথ বাড়ির অন্যান্যরা কম বলেনি। মা কি রান্নায় ভয় পেত!তা তো না। ঠাম্মার জন্য আলাদা সব করতেই হত। নতুন করে উনুনের ধোঁওয়া ঢেকে দিত উঠোনের খোলা আকাশ আর বারান্দা।...সে সব সুন্দর টেষ্টের খাবার দাবার তখন সদ্য শুরু হয়েছে। মা আনত বাড়ির ছোটদের জন্য। পুনুও সে সব ভালবাসত যে!
- আচ্ছা, তোর ভাই পুনুর খবর কি?- সে'ত সময়ের গল্প। কেউ কি সম্পর্কে বাঁধা থাকে আজকাল! রক্তের সম্পর্ক এখন বুকের নীচে রক্তদাগ। তোকে তো বলেছি ওরা ভয় পেয়েছে মিনি দিদি আবার যদি এসে গেড়ে বসে পড়ে রাজশহরে! তাই আর খবর রাখেনা। আমিও খানিকটা আলগা হয়ে গেছি।...বুঝি, তুই সেদিন সেমিনারেও বলেছিলি 'ছাড়তে নেই।'...সেই তো অধিকারের টানাটানি। ওসব চাইনা আর। তোর্সার পাড়ের জন্য কষ্টটুকু তীব্র, ওটা থাকবে চিরদিন।...চল চল ঢুকি কেবিনে। চোখের জল কি দেখে নিল সুমি! রক্তনদীর কথা শুনে নিল কেউ। দুবছর গড়িয়ে তিনের দিকে। শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় হলরে!...-হুঁ আমিও কাল ফিরব। বলতে বলতেই কখন ওর মোবাইল ক্যামেরায় গোপাল কেবিনের পুরনো সাদাকালো মদনমোহনের বাঁশি হাতে ছবি ঝলকে উঠেছে। সঙ্গে ধর্ম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিবৃত্ত ও একে একে ছবির দেয়াল। কোরানশরিফের পৃষ্ঠা, গুরু গোবিন্দ সিং এর বানী... সব মিলে মিশে গিয়ে গোপাল কেবিন আর মালিকের টেবিলকে ওদের চোখে কি ভীষণ গ্রহনীয় করে তুলেছে। ওরা দুটো রুটি সবজি আর সামনের দোকানের দুটো চা আনিয়ে নেয়। মালিকের সঙ্গে পুরোনো দিনের গল্প করে। মিনি জানে এখানে মা বা বাবার নাম বললে অনায়াসে এই পরিচিত মুখের ভদ্রলোক চিনে নেবেন। যেটা আগেও কোন কোন জায়গায় হয়েছে। আজ মিনির ইচ্ছেই করছেনা। নিজেরা কোচবিহারের পুরোনো গল্পে ডুবে যায়। তাকিয়ে দেখে গোপাল কেবিনের ভিতর দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। ওখানেই আবাস। যারা দূর থেকে সওদা করতে আসে, অনেকেই এখানে দু একদিন থেকে কাজ সারে।খাওয়া দাওয়া করে।
আজ আর সুমি ইচ্ছে করেই সার্কিট হাউস ফেরেনা।...'চল্ দুজনে একসাথে থাকব আজ।' মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মিনির। আবার হাঁটতে হাঁটতে দুই বন্ধু সাগর দীঘির পাড়ের কাচারী মোড় ছেড়ে সোজা হেঁটে দেবী বাড়ির বড় দেবীর মন্দিরের সামনে সবুজ আর কিছুটা বাঁধানো চত্বরে বিশ্রাম নেয়। ফাঁকা ঠাকুর দালানে কাঠামোয় প্রণাম করে। এখানেই ময়না কাঠে কয়েকমাস পর মাটি পড়বে। গড়ে উঠবেন বড় দেবী। ইতিহাসের গন্ধ মেখে আর অতীতের বৃষ্টিতে ভিজে ওরা দুজনে সারা রাত নিভু নিভু আলোয় শৈশব থেকে কৈশোরের কথায় মেঘেদের ঘরবাড়ি খুঁজে নেয়।
* * *
প্রজ্ঞার কলেজের দিন প্রায় ফুরোলো। ওকে ছ'মাস পর ই অন্যত্র চলে যেতে হবে। ফুরিয়েতো যায়না কিছুই। আরো পাঁচবছর...কত যে কাজ বাকি।...রোহিনী পরিষ্কার বলে দিয়েছে শুভায়ু আর ও দুজনে রেজিষ্ট্রী অফিসে গিয়ে স্রেফ স ই সাবুদ করবে। উকিলকে বলে নোটিশ ও করেছে। আর মার হাতের ভাল ভাল রান্না খাবে। এটুকুই। মনে মনে শুধু একটাই ইচ্ছে মিনির, যে চা বাগানগুলো ভালোবেসেছে ছাত্রীদের ভালো করে চিনতে গিয়ে, ওদের স্কুল ইউনিয়ন একাডেমী, বা উরশুলপুর হিন্দী হাই খ্রিষ্টান স্কুলে গেছে, ওদের বনবস্তী এলাকায় খাওয়ার এক আয়োজন করবে। রোহিনীর বাবা এতদিনে অন্তত একখানা বিষয়ে সহমত। তার তোড়জোর করতে হবে। এর আগেও অনেকবার মিনি দলবল সহ বেরিয়ে গেছে, ওর 'রু' ওর সঙ্গে ছিল ,কিন্তু এ মানুষের একবারে রাজি হয়ে যাওয়া! আর বিয়ের জাঁকজমক বাদ দিয়ে শুধু এটুকু আয়োজন.... সব মিনির মনের মত আলো আলো হয়ে উঠছে, শুধু একটু মায়াই থেকে যাবে মাটির মায়া। পুনুকে কার্ডখানা পৌঁছতে সেই রবার গাছটার কাছে দাঁড়াতেই হবে। সামনে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সে তোর্সার বাঁধানো রাস্তাখানা। রাস্তা ছেড়ে উপর দিকে সিমেন্টের এবড়ো খেবড়ো সিঁড়ি আর বদলে যাওয়া পাড়া। বদলে যাওয়াই তো ধর্ম। যেমন নদী ইতিহাস ঠিক তেমন ই নারী ইতিহাস। ওর 'রু'ও তো আর ওর একার নয় এখন। কলেজ থেকে ফেরার পথে প্রায় ই মদনমোহন বাড়ির সামনের পথ ধরে। বৈরাগি দীঘির জলে সন্ধের মায়া, রাস্তার অন্যধারে পান্থ পাদপ সার সার এখন ও দাঁড়িয়ে। এ রাস্তার সঙ্গে যে শিশুকালের যোগ। আষাঢ়ের রথের চাকার দাগ। এ্যায়সান মোটা দড়িটার কথা ভাবতে ভাবতেই আবার দেখা 'নবযুগ' পত্রিকার সম্পাদক মনোতোষ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। এ সময় উনি প্রায় দিন ই হাঁটতে বের হন। আজ অনেকক্ষণ কথা হল যেতে যেতে।
-আচ্ছা মনোতোষদা, এ বাঁধ রাস্তার পরিবর্তন তো এর আগে দেখিনি, এসেছি তো বারকয়েক, মা বাবা বেঁচে থাকতে প্রতিবছর। খেয়াল তো করিনি।
-সেটা বলতে পার ২০১৪-১৫, খুব বেশিদিন না। নতুন সরকার। এদিকে শহরের রাস্তা তো দেখেছ কি হারে লোকসংখ্যা, সেই সঙ্গে বাইরের মানুষের ভীড়, স্থায়ী বাস নিয়ে নেওয়া, ব্যবসা সবকিছু। আর জান ই তো সীমান্ত শহর মাঝে কাঁটা তার, চ্যাংরাবান্ধা বরাবর।- হ্যাঁ দেখেছি। ছিটমহল তিনবিঘাতেও গেছি মেখলিগঞ্জ হয়ে।
- প্রাণের ভিতর কেমন করে না! এতটুকু শুধু কাঁটাতারের গল্প, এধারের মাটি ও ধারের বাগান পাশাপাশি সবুজে মোড়া। সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে আছে অবিরাম, বিভিন্ন মানুষের যাতায়াত, ভুটান বর্ডার, জয়গাঁর মানুষ, আসামের মানুষ। কোচবিহারে মূল রাস্তায় পর পর বেশ কটা দুর্ঘটনার খবর ছিল সে সময় খেয়াল করেছ বোধহয়। তখন আমার নবযুগেই প্রথম আমি এ নিয়ে এক খবর করি। সঙ্গে রেলগেটের কিছু দূরে ঘুঘুমারী স্কুলের রাস্তা আর হরিণচওড়ার রাস্তার ছবিও ব্যবহার করি, আমাকে সাপোর্ট করে লেখেন বলেন প্রসেনজিৎ দা, মানে প্রসেনজিৎ বর্মন?
-হুঁ। ওইতো তুমি যেখানে বাসা নিয়েছ তার পাশেই তো ওনার পুরোনো আমলের বাড়ি।- হাঁ, ভারী আশ্চর্য হ ই, শহরের প্রায় সব বাড়িঘর বদলে গেলেও ওনার বাড়িটা সেই আগের মত। ওনার ঘর জুড়ে কত ব ই। আমি গিয়েছি দু- তিনবার। আসলে পুরোনো মানুষদের কাছে এত জমানো কথার ভিতর ভেসে যাই।
- দেখ, কেমন চলে গেলেন।
-হ্যাঁ খুব কষ্ট হয়েছিল, পরে মনে হয়েছে বয়স হয়েছিল ঠিক ই, ভোগাননি কাউকে।সজ্ঞানে চলে গেলেন, এইতো চার পাঁচমাস হয়ে গেছে।
- হ্যাঁ উনিই আমাকে সমর্থন করে নতুন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। সেসময় চেয়ারম্যান বীরেন কুন্ডু। উনিওতো প্রয়াত। মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ও এ ব্যাপারে সদর্থক মত দিয়েছিলেন সে সময়।
- আসলে একদিকে পুন্ডিবাড়ি অন্যদিকে খাগরাবাড়ি হয়ে নিউকোচবিহারের দিকে যেতে মানুষকে শহরের ভিতর ঢুকতে হচ্ছেনা। বিরাট সুবিধেও।
হুঁম আমিও বেশ ক'বার নিউকোচবিহার যেতে বাঁধের জাতীয় সড়কই ব্যবহার করেছি। মনে মনে কোথায় এক সূক্ষ্ম ভাল লাগাও তৈরি হয়েছে।
- আর এখন তো দেখি তোমার প্রাইভেট কার ও ঘুঘুমারির দিকে যেতে বাঁধ রাস্তাই নিচ্ছে।
- হ্যাঁ মনোতোষদা, ঐ বাঁধ আর তোর্সা কত যে প্রিয়, এই টুকু সান্নিধ্যে গিয়ে বাতাস লুটেপুটে নিই আর তৃষিতের মত ডানদিকে চরের বাড়ি আর তোর্সার জল যেমন দেখি, সঙ্গে নিজের বাড়ির রাস্তাটুকু উপর থেকে খুঁজি। কখনো দেখি, কখনো হুস করে পেরিয়ে যায়।
মনোতোষদা চুপ করে যান।...সত্যি মিনি, তোমার বাবা অভিজিত দা যতদিন ছিলেন এক অন্য রকম প্রাণের ছোঁয়া পেতাম তোমাদের পাড়ায়।...
ততক্ষণে আমতলা মোড়। মিনি প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়। ...নিউটাউন-দিনহাটা রোডের এই বিকল্প রাস্তা এ কিন্তু অভিনব পরিকল্পনা। ভারতে অন্যান্য রাজ্যে, শহর ভিত্তিক নদী ভিত্তিক এমন কাজ হয়েছে, এখানে এই তো প্রথম, আপনাদের উদ্যোগের কথা একদিন নিশ্চয় ই বলবে ইতিহাস। -আর এ সড়কে মারণ য়ন্ত্র লরি, ট্রাক ঢুকতে পারছেনা - খেয়াল করেছি দাদা, ঐ কারণেই নিশ্চিন্তে ঢুকছি, বেরোচ্ছি...চিরন্তন হয়ে থাকছে তোর্সার জলের দূরের সৌন্দর্য, বাঁশের সাঁকো আর শাশ্বত মাসানের কথা ...এই তো পাওয়া।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴