চা-ডুবুরী-২৪/সুকান্ত নাহা
চা-ডুবুরি /পর্ব : ২৪
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^
'একদিন চা-বাগানগুলো বলবে - আমাদের কোনো শোক নেই'
- অমিত কুমার দে
"-হাঁ, ম্যাডাম-জি...দুখ-তকলিফ তো বহুতই ছিল সেই সময়। মালিক অচানক বাগান বন্ধ কৈরে চৈলে গেল...তো ভি প্রায় সাঁয়তালিশ-আটচালিশ সাল আগের ঘটনা....আমার বাবা হরকাবাহাদুর তামাং...অফিস চৌকিদার...একদিন উল্টাবেলায় (বিকেল) অফিস ছাইড়ে দৌড়াইতে দৌড়াইতে ঘর লাওটে আসলেন... পুরা শরীর পসিনা-পসিনা....পাগলার মতো হাত-পায় ছড়ায় এইভাবে বৈসে পড়লেন আঙনার মধ্যে....'' বলেই দিলু ওরফে দিলকুমার তামাং পুরো ঘটনাটা দৃশ্যায়িত করতে গিয়ে হাত দুটো পিছনে ঠেকিয়ে আক্ষরিক অর্থেই পা ছড়িয়ে বসে পড়লেন উঠোনের মাটিতে। দূরে দাঁড়িয়ে ধনমায়া, দিলকুমারের স্ত্রী, সে সব দেখছিল। স্বামীর স্মৃতিচারণা স্পর্শ করছিল তাকে। সেই দুঃসহ দিনের সাক্ষী যে সে নিজেও । স্বামীর শরীরী অভিব্যক্তিতে ফুটে ওঠা স্বর্গত শ্বশুর মশায়ের সেদিনের সেই হাহাকার ক্লিষ্ট বেদনার প্রতিচ্ছবি ধনমায়াকেও যেন ব্যথাতুর করে তুলছিল।
"...আঙনায় বৈসেই হাল্লা করে বাবা মাকে ডাকতেসিলো, 'কতা হো দিলু-কো-আমা...খবর পায়ো...হামরো সর্বনাশ ভৈ গয়ো...সর্বনাশ...মালিক লে বাগান লক-আউট গরি দিয়ে ...মনিজার হেরু পনি বাগান ছোড়ে-র ভাগেয়ো... হাই ভগোয়ান...আবো কে গরনু...কে খানু...কতা জানু...' মানে মালিকটা বাগান বন্ধ কৈরে দিসে, সাহেবগুলান সব বাগান ছাইড়ে পালাই গেসে...এখন কি খাব, কি করব, কুথায় যাব...'' অভিনয় করে ঘটনার বর্ণনা দিতে দিতে দিলকুমার যেন ঢুকে পড়ছিলেন হরকাবাহাদুরের সেদিনের সেই বিপন্নতার ভেতর।
" এই লাইনের সব মানুষগুলা ঐদিন এই আঙনাতে আইসে ভীড় করসিলো। বাবার কাছে শুনতেসিলো অফিসে কি কি ঘটনা হৈসে ...পুলিশ আসলো, লাফরা হলো, কিভাবে মনিজার ঘেরাও হৈলো... ব্যস, আগলা দিন থিকে রাশন-পানি-তলব সব বন্ধ্।"
-"আপনি তখন কত বড়? " মেয়েটি প্রশ্ন করে।
-এই কুছ আঠারো বিশ বচ্ছর হবে .. ফ্যাক্টরিতে বিঘা-লেবর ছিলাম।"
-" বিঘা-লেবর কী? " মেয়েটি জানতে চায়।
" বিঘা মানে লোকাল ল্যাংগুয়েজে টেম্পোরারি । অর্থাৎ অস্থায়ী কর্মী আর কি। " পাশ থেকে ছেলেটি উত্তর দেয়।
-" আপনিও তখন কাজ করতেন ? "মেয়েটি দিলকুমারকে প্রশ্ন করে।
-হাঁ, করতম তো! এক বচ্ছর আগে বিয়া করসি... কাজ না করলে বউকে খাওয়াব কি? ঘরে সানু(ছোট) দুইটা ভাই, বহিন। লিখাপড়ি করে। বাবা সাব-স্টাফ চৌকিদার...ফির ভি তলব তো বহুত কম ছিল। আমি কাজ না করলে তো মুসিবত। মা ঘরে গাই-বকরি পালতো । বাবুদের ঘরে-ঘরে দুধ পৌঁছাইতে যাইতম। এই বাবুদের ঘরেও তো দুধ পৌঁছাইতম...কী বাবু, মনে আছে...? তখুন তো আপনি এতটুক ছিলেন," বলে হাতের ইঙ্গিতে ছেলেটিকে দেখিয়ে দিলকুমার হাসে।
-" থাকবে না আবার? সব মনে আছে। " ছেলেটা চটপট উত্তর দেয়।
দিলকুমারের ঘরের উঠোনে বসে গরুর দুধে তৈরি মালাই-চা খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। মেয়েটি মন দিয়ে ধনমায়ার কাছে শুনছিল সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা। কিভাবে মাসের পর মাস জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শাশুড়ি-বউ মিলে জঙ্গল থেকে কাঠ এনে সেই কাঠ বেচে পেট চলত। কিভাবে গরুর দুধ, খাসি, মুরগি বিক্রি করে দিন গুজরান করেছিল তারা। দিলকুমার সে সময় প্রতি সপ্তাহে ধারে মাল উঠিয়ে লোম ছাড়ানো, 'গলা-নামানো', আস্ত শুয়োর সাইকেলের তেকোনা রডে ঝুলিয়ে নিয়ে যেত মৌয়াবাড়ি হাটে। বিক্রি হলে মালের মালিককে টাকা চুকিয়ে বাকিটা ঘরে আসত। ফাকসা(শুয়োরের মাংস)-র সাথে লুকিয়ে চুরিয়ে রক্সি( ধেনো মদ)ও বেচতো দিলু। দেওর ননদদের পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেছিল। দেওর নাগরাকাটায় গ্যারেজের কাজে ঢুকল আর ননদ শুরু করল পাশের বাগানে ম্যানেজারের 'কোঠি'তে কাজে যেতে।
কেবল হরকাবাহাদুরই কেমন যেন হয়ে গেছিল। সকালে গরু নিয়ে বেরিয়ে সেগুলো ছেড়ে কোথা থেকে কোথায় যে চলে যেত তার ঠিকঠিকানা থাকত না। ঢাঁড়-ময়দানে, চৌপাল(চৌমাথা) কিংবা চোরবাটো( ঝোপ জঙ্গলের ভেতর পায়ে চলা সরু রাস্তা)য় যেখানেই বাগান খোলার ব্যাপারে আলোচনা শুনতো কিংবা জটলা দেখতো, সেখানেই হাতের লাঠিটা বগলে চেপে দাঁড়িয়ে পড়ত। হাতের তেলোয় "সূর্তি" ( খৈনি) ঘষে মুখে ফেলে জমিয়ে বসত উবু হয়ে লোকের গালগল্প শুনতো। রাতপোয়াতেই-ভোর- হওয়ার ছেঁদোগল্প শুনে পুলকিত হতো। পুলকে পরিপূর্ণ পেয়ালা যখন পিরিচে চলকানো চায়ের মতো উপচে পড়তো হরকার ছোপধরা ক্ষয়াটে দাঁতগুলো তখন চূড়ান্ত বিকশিত হতো। আশা ঝলকাতো কোঁচকানো মুখের বাদামি চামড়ায়, বিন্দু বিন্দু ঘামের গায়ে । ঠা-ঠা রোদ্দুরে অজানা আঘাটায় গরু ছেড়ে এসে বেখাপ্পা প্রহরে সানুমায়াকে এক-পক্কর-জল-মেশানো কোমল "আশাবরী" শোনাতে এসে "রাগাশ্রয়ী" ত্রিতাল হজম করে চুপসে যেত। চুপচাপ গিয়ে বসে পড়ত তখন উঠোনের কোণে। বাতাবি গাছের ছায়ায়, কাটা জারুলের শুকনো গুঁড়ির ওপর। আসলে সানুমায়ারও যে কিছুই করার ছিল না। স্বামীর এহেন ছিটেল আচরণে বাঁধ ভাঙছিল ধৈর্যের। বিরক্তি উজিয়ে হতাশা জন্ম নিচ্ছিল ক্রমশ।
বছর ঘুরতেই পেটে বাচ্চা এসেছিল ধনমায়ার। ভর-পোয়াতি অবস্থায় গোয়াল ঘরে কাজ করতে করতে একদিন হঠাৎ অসহ্য ব্যথা ওঠে। বাড়িতে কেউ ছিল না সে সময়। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে কাউকে যে ডাকবে সেই শক্তিটুকুও ছিল না। খানিক বাদে ওখানেই বাচ্চা প্রসব করেছিল । প্রসবের পর নিজে হাতে বাঁশের 'চোঁচ' দিয়ে নাড়ি কেটেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ধনমায়া। জঙ্গল থেকে দাউরা(কাঠ) নিয়ে ফিরে বুয়ারি(বৌমা) কে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পাশের বাড়ির বউ-ঝি দের ডেকে প্রসূতিকে ঘরে তুলেছিলেন সানুমায়া। ধনমায়ার শাশুড়ি। বাঁচার আশা প্রায় ছিলই না। সানুমায়া তখন বুয়ারিকে নীলপাহাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের এক আত্মীয় "ঘরের-লোক" পরিচয় দিয়ে হাসপাতালের নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করায়। জীবন বাঁচে ধনমায়ার।
সে সময় কাজ খুঁজতে এখনকার মত হিল্লি,দিল্লি, কেরালা, সিকিম চলে যাওয়া যেত না। কাজ হারালে কাজ পাওয়াও ছিল দুস্কর। তাছাড়া মানুষ তখন বাগানের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বেশিদূর যেতেও ভয় পেতো। সেসময় এত গাড়ি ঘোড়াও চলত না ডুয়ার্সে। মালবাজার তক গেলেই মানুষ ভাবতো কতদূর চলে এসেছে। বাগানের গাড়ি আর দু'একটা বাস ছাড়া অন্য কোনও সাধনও ছিল না বাইরে যাওয়ার। বাস ধরতে হলে বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে দু কিলোমিটার পেরিয়ে যেতে হতো নীলপাহাড়ি বাস স্টপেজে। সারাদিনে দুটো মাত্র বাস। ধরতে না পারলে বাড়ি ফিরে আসা। না হলে ভরসা সাইকেল অথবা দুটো পা। ধনমায়ার মুখে গল্পগুলো শুনতে শুনতে মেয়েটি যেন একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছিল অতীত চা-জীবনের লবনাক্ত জলে।
দীর্ঘ একবছর প্রায় বন্ধ ছিল ডুয়ার্সের স্বপ্নপুর চা-বাগান। কেউ কোনও পদক্ষেপ নিল না বাগান খোলবার ব্যপারে। বাগান বন্ধ হতেই বাসালাইনে কেটে দেওয়া হল জলের সাপ্লাই। বিদ্যুৎ ছিন্ন হলো। বাবুরা পড়লেন বিপাকে। পেটে টান পড়তেই রোজগারের খোঁজে তারা বাগান ছাড়লেন সপরিবারে।
'' বাবুরা বাগান না ছাড়লে কিন্তু বাগান খুইলে যেত। কিন্তু তাদেরও কসুর নাই। তলব-তংখা নাই, উপর থিকে কিছু বদমাশ লোক ভয় দেখাইতে লাগল। চুরি শুরু হৈলো। অফিস, বাসা, কোঠি সব তোড়ফাড় কৈরে বেইচে দিতে শুরু করল চোর বদমাশের দল। থানা পুলিশ কিছু করলো না। নেতা মন্ত্রী আসলো। ময়দানে মিটিং হৈলো। কিন্তু মালিক আসলো না। সাহেবরাও ফিরল না। আখিরে হারু দে আইসে বাগান খুলল। ' দিলকুমার বলে যেতে থাকেন।
- হারু দে কে? ' মেয়েটি জানতে চায়।
-" ঐ লোকটা ছিল ছিল লেবার ইউনিয়নের লিডর। আরেকটা চোট্টা। মানুষদেরকে বুঝাইলো কাঁচা পাতা বেইচে ও বাগান চলাবে। ফ্যাক্টরি, অফিস, কোঠি সব তো উতনা দিনে হাওয়া। হারু দে আইসে কাঁচা পাতা বেচতে লাগলো। কত মুনাফা হৈতো কেউ জানত না। লেবারদের হাজিরা কমতি দিত। কয়েকবছ্রের ভিত্রে পাতি বেইচে লাল হৈয়ে গেল হারু দে। লেবাররা যখুন বুঝলো লোকটা একনম্বর চোর, ওকে তাড়াইল। কিছুদিন আবার বন্ধ থাকল বাগান। ফির সরকার বাগানটা নিল পরে চালু হৈল বাগান।"
ছেলেটি যদিও স্বপ্নপুরের পুরনো ইতিহাস,ঘটনা, ঘটনার ঘাত- প্রতিঘাত, চড়াই-উতড়াই সবই প্রায় জানে। তবু বহুদিন বাদে দিলকুমার দাজুর মুখে শুনতে ভালই লাগছিল তার।
-" আপনার বাবা কেমন আছে বাবু? আমাদের মাস্টার জি? " দিলকুমার প্রসঙ্গ পালটে জানতে চায় ছেলেটির কাছে।
" ভাল নেই খুব একটা। বয়স হয়েছে। নানা রকম সমস্যা। "
-" এই স্কুলটায় মাস্টার জি পড়াইতেন।" স্বগতোক্তির মত কথাটা বলে আঙুল তুলে মেয়েটিকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাকা ইমারতের পেছনে একটা কাঠের ভগ্নাবশেষ দেখায় দিলকুমার।
মেয়েটি সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছেলেটির দিকে ফিরে বলে," "এই স্কুলে আপনিও পড়তেন? "
-" হ্যাঁ, এটাই ছিল আমার প্রথম স্কুল । "
স্মৃতি বিজড়িত স্কুল ঘরের অবশিষ্ট চিহ্ন গুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে ছেলেটার। মনে পড়ে যায় বাবার হাত ধরে প্রথম স্কুলে আসার দিন। সুর করে বাবা নামতা পড়াচ্ছেন। ব্ল্যাকবোর্ডে অংক কষছেন। সহজ পাঠের ছন্দময় পংক্তিগুলো যেন এখনও ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে অন্ধকার করিডরে কাঠের জীর্ণ খুঁটিগুলোর ফাঁকে। পলেস্তারা খসা দেয়ালের ঝুলকালি মাখা নোনাধরা ইঁটের সারি যেন তাকে চিনতে পেরেছে। ম্লান হেসে কাছে ডাকছে ওরা। প্রার্থনা সংগীতে গলা মেলানো শিশুদের এলোমেলো সুর যেন ভেসে আসছে কানে। মন্ত্রধ্বনির মত যেন টেনে নিচ্ছে অতীত ধ্বংসস্তূপের ভেতর অন্ধকার ক্লাসরুমের দিকে।
- "ঐ স্কুলঘরের ওপর কাঠের দোতলার মেঝেতে কাঁচা চা-পাতা শুকোনো হত, জানেন। যেজন্য ঐ ঘরটার নামই হয়ে গেছিল 'কাচ্চি-গুদাম"। অর্থাৎ কাঁচা পাতার গুদাম। সেই পাতা রোপওয়ে করে পাঠানো হত পাহাড়ের অনেক নিচে। ফ্যাক্টরিতে। রোপওয়ে যদিও আমি দেখিনি। শুনেছিলাম। আর নিচতলায় ছিল আমাদের স্কুল। " ঘোরের মধ্যে কথাগুলো উঠে আসতে থাকে ছেলেটার গলায়।
ঘরটা প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। পাশেই পাকা সরকারি স্কুল বিল্ডিং উঠেছে বছরখানেক হলো। অনেক বদলে গেছে স্বপ্নপুর এতগুলো বছরে। সরকারের কাছ থেকে হাতবদল হয়েছে নতুন মালিকের হাতে। একটু একটু করে শ্রী ফিরেছে বাগানের। সরকারী মালিকানাতেই নতুন কারখানাটা গড়ে উঠেছিল। নতুন অফিস, বাংলো, কোয়ার্টার যা কিছু হয়েছে সব লোয়ার-স্বপ্নপুরে। আপার-স্বপ্নপুর আজও পড়ে আছে একদা কোলাহলপূর্ণ জনপদের স্মৃতিময় ধ্বংসপাষাণ বুকে চেপে। একান্তে জঙ্গলাকীর্ণ নির্জনতার মাঝখানে।
- "আপনারা কোনদিকে থাকতেন?" মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।
- চলুন, যাব ওদিকে। আপনার যা কিছু জানতে চাওয়ার হয়ে গেছে? " ছেলেটি জিজ্ঞেস করে।
- " আজ যতটুকু শুনলাম ঐ ধনমায়া দিদির মুখে তা অনেকটাই আমার কাজে লাগবে। বাকি যা কিছু তা জমা পড়ে থাকবে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। "
চলে আসার সময় দিলকুমারের পরিবার রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছিল ওদের দুজনকে। হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে দিলকুমার তামাং বলেছিলেন ' ফেরি ভেটনু হুন্ছ। বুঝতে পারলেন তো মেডাম-জি, কী বললাম? "বলে একগাল হেসে দিলকুমার বলেন, " আবার দেখা হোবে।"
হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে ওরা হাঁটতে হাঁটতে এগোয় । লোয়ার স্বপ্নপুরের দিকে নেমে যাওয়া পাথুরে রাস্তাটা ডানহাতে রেখে ওরা এগিয়ে যায় আরো আগে। কিছুটা গিয়ে ডানহাতে ঘুরে কাঁচা রাস্তাটা ধরে খানিকটা এগোতেই দূরে অনেকটা জায়গা জুড়ে চা গাছ বিহীন জঙ্গলে ঢাকা ফাঁকা জায়গাটা চোখে পড়ে। যেখানে বয়সের ভারে ন্যূব্জ একটি জটাধারী প্রাচীন বট সাক্ষ্য দিচ্ছে অতীত জনপদের। বুনো কাঁটাঝোপ, পুটুস, ঘেঁটু,আকন্দ, ফুলঝাড়ূ, কেয়াগাছ এবং আরও অনেক জংলি আগাছার ভীড়ে মাথাতুলে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ এক কাঠগোলাপ গাছ শূন্য ডালপালা মেলে প্রাণপণে চিৎকার করে যেন বলছে ' এখানে মানুষ ছিল একদিন, ছিল জীবনের কলরব। সবাই ছেড়ে চলে গেছে এই অভিশপ্ত প্রান্তর। স্মৃতিভারে আমিই শুধু পড়ে আছি ফুলবাগানের ধূসর স্মৃতি বুকে আঁকড়ে। ঠিক তার পাশেই দৈন্য, দুঃখ, বিষাদকাতরতা ছাড়িয়ে ব্যতিক্রমী একটিমাত্র দৃঢ়চেতা গাছ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশানের মতো । উঠে গেছে সোজা অনন্ত আকাশের দিকে। সেদিকে আঙুল তুলে ছেলেটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে,
''- ও-ই যে ঐ দূরে যে তালগাছটা দেখছেন, ওটা আমার মায়ের হাতে লাগানো। গাছটার ঠিক পাশেই ছিল আমাদের রান্নাঘর। গতবছর যখন এসেছিলাম এই রাস্তাটার ওপর দু'চারটে কচি তাল পড়েছিল । কুড়িয়ে নিতে গিয়েই অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে,জানেন...' বলে ছেলেটি আবিষ্ট চোখে মেয়েটির দিকে তাকায়। "
-' কী রকম... ? ' হাঁটতে হাঁটতে দূর্নিবদ্ধ দৃষ্টিটা ফিরিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞাসু হয়।
"-তেমন কিছু নয়...খুব তুচ্ছ সমাপতন হয়ত। কিন্তু ওটাই আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। তাল কুড়োব বলে যেই না নিচু হয়েছি, খুব কাছে...এই যে...ঠিক এই ঝোপটায় অদ্ভুত মিষ্টিসুরে শিস দিয়ে উঠেছিল একটা কমলাবউ ।'
-' কী ব-উ? 'মেয়েটির দু'চোখে কৌতুক। ঝকঝকে দাঁতের ভীড়ে ক্ষুদে গজদাঁত দুটো নিঃশব্দে মুক্তো ঝরায়।
" কমলা-বউ...সুন্দর একটা পাখি! বুক আর গলার কাছটা কমলা-বাদামি। পিঠের দিকটা নীলচে ধূসর। আগে কখনও ঐ পাখি দেখিনি। পরে নেট সার্চ করে জানলাম পাখিটার নাম অরেঞ্জ হেডেড থ্রাশ। বাংলায় কমলাবউ। খানিকটা দোয়েল পাখির মত দেখতে। চমৎকার শিস দেয়। চোখ খোলা রাখুন...দেখতে পেলেও পেতে পারেন। এ সময়টাই ওদের ব্রিডিং সিজন। "
-''তাই বুঝি...! কী করে জানলেন...?" চোখের তারায় আলো ছড়িয়ে মেয়েটি গভীর দৃষ্টিতে তাকায়।
-" পাখিটা বলে যায় নি অবশ্যই... " ছেলেটি কৌতুক ফেরায় ," তবে সবই তো 'ব্যাদে' থাকে... পাতা ওল্টালেই হলো।"
-" মানে!" এবারে একটু অবাক হয় মেয়েটি।
- "আরে বাবা, নেট। গুগলের কথা বলছি। ওটাই তো এখন আমাদের বেদ, বাইবেল,কোরাণ,ত্রিপিটক।"
-" ওহ্, তাই বলুন।" রসিকতা উপভোগ করে মেয়েটি মোবাইল বের করে ক্যামেরা অন করে।
-" কী সুন্দর জায়গাটা... এখানেই আপনারা থাকতেন!" বলতে বলতে মোবাইল ক্যামেরা তাক করে মেয়েটি এগোয়।
-" হ্যাঁ, এখানেই...এখন দেখতেই পাচ্ছেন,শ্মশানে পরিণত। কয়েক বছর আগেও এক- আধটা কোয়ার্টারের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ত। এখন আর পড়ে না। ভেঙে মাটিতে মিশে গেছে। কিংবা ঝোপজঙ্গল ঢাকা পড়ে আছে। চলুন ওদিকটায় যাই। পাহাড়ের ঢাল শুরু হয়েছে যেখানে। ওখানে দাঁড়ালে দূরে নদীটা দেখতে পাবেন। নদীর ওপারে ফরেস্ট। ফরেস্টের পেছনে একটু বাদেই সূর্য অস্ত যাবে। তবে নভেম্বর টু ডিসেম্বর মিডলে ...তখন সানসেট...এককথায় দূর্দান্ত। "
- "তারপর কী হল...বললেন না তো! আপনার সেই কমলাবউ কী করলো ...?" সামনের দৃশ্যটা জুম করতে করতে মেয়েটি বলে।
- ও হ্যাঁ, তো সেই পাখিটা ক্রমাগত শিস দিতে দিতে এ ঝোপ থেকে ওই ঝোপে, ওই ঝোপ থেকে দূরে আরো দূরে এগিয়ে যাচ্ছিল আর ফিরে ফিরে দেখছিল আমাকে। যেন ইশারায় টেনে নিচ্ছিল ঐ তালগাছটার দিকে। ঝোপঝাড় পেরিয়ে যখন কাছে গেলাম, দেখি কয়েকটা কচি তাল পড়ে আছে গাছটার নিচে। পৌঁছে দিয়েই পাখিটা উধাও। আর দেখতে পেলাম না । সেসময় কী মনে হচ্ছিল জানেন, শুনলে হাসবেন.. '
- "কেন...হাসব কেন ?" মেয়েটি পুটুস ফুলে বসা হলুদ প্রজাপতিটার দিকে ক্যামেরা ফোকাস করে। ক্লিক করা হয়ে যেতেই ঘনচোখে ঘাড়বেঁকিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে "হাসব না, নিশ্চিন্তে বলুন' বলেই ধীর পলক ফেলে স্মিত হাসে।
-" না, শুনে হয়ত আমাকে একটু এক্সট্রা-ইমোশনাল ভাবতে পারেন...তবে কেন যেন সেদিন ঐ পাখিটাকে দেখে মনে হয়েছিল পাখিটা আমার মা। মা যেন কাছে ডেকে নিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল গাছটায় ফল ধরেছে....' বলতে বলতে ছেলেটি চুপ করে যায়। মন উড়াল দেয় হেমন্তের এক সোনায় মোড়া রোদমেদুর বিকেলের কাছে।
সদ্য স্কুলে যেতে শেখা ছেলেটি স্কুল থেকে ফিরে রান্না ঘরে পিঁড়ি পেতে বসেছে। হাঁ করিয়ে ভাতের গ্রাস তুলে দিচ্ছেন মা। জানালার জাল গলে পড়ন্ত বিকেলের আদুরে বল্লমের মতো তির্যক রোদ এসে খেলা করছে ছেলেটির মুখে। জানালায় ঝুঁকে থাকা শিশু তালগাছ বাতাসে ঝুঁকে পড়ে তাকে দেখছে আর বারবার ঢাল হয়ে আড়াল করছে শিশুটির মুখ। আপনমনে রোদছায়ার লুকোচুরি দেখতে দেখতে ছেলেটি প্রশ্ন করে মাকে, "মা, এটা কী গাছ ?
-" তালগাছ। "
" তাল কী? "
-" তাল একটি ফল। পাকলে রস হয়। সেই রস দিয়ে বড়া, ক্ষীর, পাটালি অনেক কিছু হয়। ''
-' ফল কবে হবে মা।? '
- হবে। সময় হলেই হবে। তবে যে তাল লাগায় সে তো আর খেতে পারে না। তার ছেলে কিংবা নাতিরা খায়। যেদিন ফল ধরবে সেদিন হয়ত আমি থাকব না। তুই থাকবি। তোরা এই গাছের ফল খাবি। "
-' ওয়াও...হোয়াট আ সিনিক বিউটি...আই অ্যাম জাস্ট গোয়িং ম্যাড অ্যামিড দিস হেভেনলি ল্যান্ডস্কেপ...'' মেয়েটির চিৎকারে স্বপ্নজাল ছিঁড়ে যায় ছেলেটির। ছবি তুলতে ভুলে গিয়ে মেয়েটি টি-শার্ট আঁটা ব্লু-ডেনিমের খাঁজে হাত রেখে চেয়ে আছে দূরে, দূরান্তে। যেখানে অরণ্যরেখার ওপারে একটু একটু করে ঢলে পড়ছে দিনান্তের সূর্য। সিঁদূরে আভায় বনানীর চালচিত্র লজ্জারাঙা হয়ে উঠেছে। আরেকটু বাদেই অরন্যের বুকজুড়ে আঁধার নামার আয়োজন শুরু হবে। নদীর জলঠোঁটে চিকচিক করে উঠেছে গোলাপি আলোর চুম্বন। অনেক নিচে ছোট ছোট বাড়িঘরগুলো চোখে পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে ছেলেটি বলে,
"জানেন ছোটবেলায় খুব বিপজ্জনক একটা খেলা খেলতাম। "
-" কী রকম..? " মেয়েটির চোখ তখনও দূরে নদীর জলের ওপর খেলা করা ক্যালাইডোস্কোপে আটকে আছে।
-" বাড়ির পেছনে ছিল এই পাহাড়ি ঢাল। স্থানীয় মানুষ যাকে বলত ঢারিঙ্গা বা ঢেরেঙ্গা। ঢারিঙ্গার মাথায় দাঁড়িয়ে পাথর গড়িয়ে ফেলতাম। গড়িয়ে গড়িয়ে সেই পাথর শব্দ করে ছুটে যেত নিচে ঐ রাস্তাটার দিকে। যদিও দুর্বল হাতে ছোঁড়া পাথরগুলো কোনোটাই রাস্তা ছুঁতে পারত না। মাঝপথেই আটকে যেত। তবু এই খেলার জন্য কম বকা খাইনি বাবার কাছে। ঐ রাস্তা দিয়েই ওপারে ভুটান থেকে কমলা বোঝাই গাড়ি যেত শহরে। বাগানের বড় দাদা, কাকুরা যারা তখন তরুণ- যুবক, দুষ্টুমি করে ঢাকা গাড়ির পেছনের ত্রেপল কেটে দিত। ব্যস আর কি, কমলা গড়িয়ে গড়িয়ে রাস্তায়...। ঐ যে দূর ছোট্ট পাহাড় দেখছেন ওটাই ভুটানরেঞ্জের সবচেয়ে ছোট পাহাড়। মাথার ওপরটা সমতল। একসময় মেলা বসত ওখানে। পৌষে। মেলা থেকে মাইকে ভেসে আসত গান। নাগরদোলা, রকমারি দোকান কত কি বসত। বাবার কাঁধে চেপে একবার ঐ নদীটা পেরিয়ে গেছিলাম মেলা দেখতে। "
এক নিঃশ্বাসে স্বপ্নতাড়িতের মত বলে যেতে যেতে ছেলেটা স্তব্ধ হয়। মনে মনে চুপ করে নেমে যায় পাহাড়ের ঢাল গড়িয়ে অনেক নিচে পড়ে থাকা পাথুরে রাস্তাটাকে ছুঁতে। এঁকেবেঁকে যে রাস্তাটা গিয়ে মিশে গেছে চা সবুজের মখমলি চাদরের ভেতর। যার ওপর ছায়াগাছগুলো মেলে দিয়েছে তাদের ক্লান্ত শরীর। বেলাশেষের আলোয় ডানা ভিজিয়ে দূর পাহাড়ের দিকে কোরাস গাইতে গাইতে ফিরে যাওয়া টিয়াগুলো যেন দিলকুমারের মতো বলে গেল, "যাই...আবার দেখা হবে !" ওরা ফিরে যেতেই ছায়াগাছ থেকে উড়াল দিল দুধসাদা বকের ঝাঁক। দিন -ফুরোনো-গল্পের শেষপাতাটা উল্টে দিয়ে ওরা ফিরে যাচ্ছে অরণ্যে। সেদিকে তাকিয়ে ফ্রিজ হয়ে গেছিল মেয়েটা।
-" কী হল, ছবি তুলবেন না? " ছেলেটি মনে করিয়ে দেয়, " তুলতে থাকুন। এরপর আলো কমে যাবে। ' সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মেয়েটা চটপট কিছু দৃশ্য মোবাইল বন্দী করে নেয়।
তোলা হয়ে গেলে চারপাশে আবিষ্ট চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে আলগোছে কোমরে ঝোলানো ওয়েস্ট-পাউচের জিপার টেনে সিগারেটের প্যাকেট বের করে ছেলেটির দিকে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-" চলে তো? "
সেকেন্ডের ভগ্নাংশে হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে ছেলেটা হাতে তুলে নেয় একটা। মেয়েটির নিরাভরণ আঙুলের চাপে জ্বলে ওঠা লাইটারের নীলচে আগুন সিগারেট চাপা ঠোঁট দুটো টেনে নেয়। নিষ্কলুষ প্রকৃতি কলুষিত হয় কটূগন্ধী ধোঁয়ায়।
-" একটু ঘুরে দাঁড়ান তো, একটা সেলফি তুলে রাখি ঐ গাছটার সাথে। " তালগাছ পেছনে রেখে সেলফি তোলেন মেয়েটা।
-" এত সুন্দর জায়গাটা কেমন অ্যাবান্ডান্ট পড়ে আছে, তাই না! চারদিকে অদ্ভুত একটা মেলানকলিক টিউন যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। মনটা যেন কেমন হু-হু করে ওঠে ! " - বাতাসে উড়ে যাওয়া ধোঁয়ায় মনকেমনের চিঠিটা হাওয়া ভাসিয়ে দিচ্ছিল মেয়েটা।
-" তাই বলছেন, আর যারা একদিন এই জায়গাটা ছেড়ে চলে গেছিল, তাদের কথা ভাবুন। তাদের মধ্যে আজও যাঁরা বেঁচে আছে, এই স্বপ্নপুরের কথা শুনলেই তাদের বুকের ভেতরটা এখনও এরকমই হু-হু করে ওঠে। বারো-ঘর -এক-উঠোনের মত এগারোজন বাবুর কোয়ার্টার আর একটি মুদি দোকানের মাঝে এই জায়গাটা একসময় জীবনের কলরবে গমগম করত। প্রতিটি পরিবার সুখেদুঃখে একে অপরকে জড়িয়ে বেঁচে ছিল। আনন্দেই ছিল। কিন্তু একদিন ভেঙে গেল সেই খুশির হাট।"
-ঐ বটগাছটা যদি কথা বলতে পারত তাহলে হয়ত সব বলে দিতে পারত। কিংবা ঐ তালগাছটা। " মেয়েটা যেন ভাবুক হয়ে ওঠে।
-" তাহলে নিশ্চয়ই ওদেরও একটা এক্সকূসিভ ইন্টারভিউ করতে পারতেন। আপনার থিসিস পেপারের কাজে লেগে যেতো। "
" একদম। গাছের মত অথেন্টিক ডেটা কেউ দিতে পারে ! বটগাছ তো অবশ্যই। "
-" ওদিকটায় যাবেন?" ছেলেটা জিজ্ঞেস করে। " ওদিকে ছিল স্বপ্নপুরের অফিস, হাসপাতাল, ইন্সপেকশন বাংলো। অফিস চত্বরে ছিল বড় বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ। ওগুলো অবশ্য এখনও আছে। ঐ দেখুন ফুল ধরতে শুরু করেছে। আর ছিল এই রাস্তার ধারে একটি তুঁতফলের গাছ। "
-" তুঁতফল কী? " মেয়েটা জানতে চায়।
-" একধরনের ছোট ছোট বুনো গন্ধ যুক্ত ফল। টকমিষ্টি স্বাদ। ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে দৌড়ে আসতাম সেই ফল খেতে। "
"-কজন বন্ধু ছিল আপনার ছোটবেলায়? "
" দু তিনজন তো ছিলই । "
- "আর বান্ধবী ? ছিল না? "
-" তাও ছিল। একজন। এগুলোও কি আপনার থিসিস পেপারের ম্যাটেরিয়াল হতে পারে বলছেন? "
-" না, তা নয়, আসলে ছোটবেলায় আমার কোনও বন্ধু ছিল না, জুজি ছাড়া। "
-" জুজি কে? "এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এই প্রশ্নটা করে ছেলেটি।
-" জুজি আমাদের বাংলোয় কাজ করতো। বাংলোতেই থাকত। আমাদের নিজের লোকের মত। জ্ঞান হয়ে ওর কোলেই নিজেকে পেয়েছি। আমার চেয়ে অনেক বড়। তবু একটু বড় হতেই ও-ই হয়ে উঠল আমার খেলার সাথি। আমার প্রাণের সখী। "
কথায় কথায় সন্ধে নামে। বুকের ভেতর সুগন্ধী কাপড়ে জড়িয়ে রাখা এক টুকরো স্বপ্নসুরভীর অংশভাগী কাউকে করতে পেরে ছেলেটার মনের ভেতর কোথাও যেন তৃপ্তি জাগে।
-" চলুন ফেরা যাক। এরপর অন্ধকার নামলে... "
-" কী আর হবে... দুজনে বসে থাকব সারারাত এই নির্জনে। বেশ রোমাঞ্চকর একটা অভিজ্ঞতা হবে। আপত্তি আছে আপনার...? " মেয়েটির দুচোখের তারায় চকিত আলোর ঝলকানি নজরে পড়ে না ছেলেটির।
-" আপত্তি নেই, আবার আছেও। " ছেলেটির স্বরে সংযত আভাস।
-" কেন? "
-" ঘাসে জোঁক, ঝোপঝাড়ে জন্তু জানোয়ার, সাপখোপ, রাত বাড়লে কনকনে হিমেল হাওয়া এসবে যদি আপনার আপত্তি না থাকে তো আমার কোনও অসুবিধে নেই। "
- " ভয় দেখাচ্ছেন! আটবছর চা বাগানের আশেপাশে জুজির কোলেপিঠে ঘুরে ঘুরে অনেক ভয় আমার কেটে গেছে ঐ বয়সেই। তারপর মানুষরূপী জন্তুও তো কম দেখিনি। ব্ল্যাক বেল্ট অবধি যেতে না পারলেও, দু'একটা জানোয়ার পেড়ে ফেলার অভিজ্ঞতাও আমার আছে। তাই আমাকে ওসব গল্পশুনিয়ে লাভ নেই। বরং আপনি ভয় পাচ্ছেন কিনা সেটাই বলুন। এই নির্জনে অপরিচিতা একজন যুবতী মেয়ের সাথে রাতকাটালে বউ কিছু বলবে কিনা...। " মেয়েটির গলায় শীতল কৌতূক।
-" সে প্রশ্ন যদি আমি করি...? " স্মিত বাঁকাচাঁদ ছেলেটির ঠোঁটে। দু' চোখের ঘন দৃষ্টি দুটো সরাসরি গেঁথে যায় মেয়েটির চোখের তারায়। যেখানে ঝুঁঝকো আঁধারের শরীর বেয়ে চুঁইয়ে নামছিল পাথুরে শীতলতা ।
-" হতাশ হবেন...তাই না করাই ভাল। চলুন এগোনো যাক। "
মেয়েটির কথা শেষ না হতেই শিরিষের ডালে একটা ডাহুক কর্কশ গলায় ডেকে ওঠে কোঁয়াক... কোঁয়াক শব্দ করে।
শব্দ থামতেই নির্জন বিকেল যেন নির্জনতর হয়ে ওঠে। স্তব্ধবাক দুজন পাশাপাশি হেঁটে এসে বাইকে ওঠে। বাইক ছোটে ধুলোমাখা কাঁকুরে রাস্তার লিক ধরে। লালচে ধুলো পিছু নেয়। বাতাসে লাট খেয়ে ছোটে কিছু এলোমেলো টুকরো সংলাপ।
-" আপনি যাবেন রিসোর্ট পর্যন্ত, নাকি আজও...? "
-" আমিই যাচ্ছি, চলুন। "
-" ভালই হল। যাচ্ছেন যখন তখন চা খেয়ে আসবেন। রিসোর্টের ভদ্রলোক মিক্সড ভেজ পকোড়ার সাথে চা-টা যা বানান না..ইয়াম্মি...জিভে লেগে থাকবে। "
-" আজ হবেনা। আপনাকে নামিয়ে দিয়েই ফিরে আসতে হবে। এ সপ্তাহে আজকেই শেষ নাইট শিফট। "
-" চা খেতে আর কতক্ষণ লাগবে। "
-" কাল রোববার। তৈরি থাকবেন। আপনাকে নিয়ে যাব একজনের কাছে। যাঁকে চা বাগানের জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বলেন কেউ কেউ। অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন তাঁর কাছে। ফেরার পথে নাহয় আপনার আতিথেয়তা গ্রহণ করা যাবে। "
স্বপ্নপুরের গা ঘেঁষে বয়ে চলা ঝোরাটার কাছে এসে বাইকের গতি শ্লথ হয় । কংক্রিটের ছোট্ট কালভার্টটা পেরোতেই ঝুপ করে নামে অন্ধকার । জ্বলে ওঠে হেডলাইট। আলো লাফিয়ে পেরোয় প্রতিবেশী নীলপাহাড়ীর সীমানা ঘেরা কাঁটাতার। বাইক অবশ্য ডানদিকে ঘুরে পাথুরে রাস্তাটা ছেড়ে পাকা সড়কে ওঠে। হেডলাইটের আলোয় ধূসর রঙের দুটি খরগোশ একে অপরের পিছু নিয়ে দ্রুত রাস্তা পেরোয়। চোখের পলকে এপাশ থেকে ঢুকে পড়ে ওপাশের চা-জঙ্গলে । গাড়ির গতি ফের তীব্রতর হয়। এলোমেলো বাতাসের ঝাপটা লাগে চোখমুখে। দু'পাশের সবুজ ছুঁয়ে ছুটে আসা হিমেল বসন্ত বাতাসে ভাঁটফুলের বুনো সুবাস, সিট্রোনেলা ঘাসের ঝিমধরানো ঘ্রাণ, খড়বন আর কচি সবুজ চায়ের শরীর ছেনে উঠে আসা লালচে ধুলোয় আদিম গন্ধের মিলিত ককটেল স্নায়ু আচ্ছন্ন করে তোলে নারীটির। ষড়যন্ত্রী হাওয়ায় বুকের ভেতরটা মোচড় খায়। মলাট খুলে অতীতের পৃষ্ঠাগুলো স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। পাখসাট আছড়ে পড়ে বন্ধ দরজার ওপর । অবচেতনে মস্তিষ্কের দৃঢ় গ্রন্থিগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হতেই অচেনা পারফিউমের মৃদু শরীরী গন্ধে জেগে ওঠা পুরুষটি অনুভব করে তার শক্ত দু'কাঁধে ডানা ছড়িয়েছে নরম পালকের উষ্ণ পেলব অনুভূতি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴