আমি এক যাযাবর-২৪/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
২৪তম পর্ব
শৌভিক কুন্ডা
যাচ্ছি লুংসেল। আমি প্রথমে উচ্চারণ
করেছিলাম লাংসেল। বিক্রম পারাজুলি, বিশিষ্টা হোমস্টের মালিক, সংশোধন করে দিলেন ফোনে ফোনে। ওদলাবাড়ি থেকে সোজা মানাবাড়ি, তুরিবাড়ির রাস্তা। পাথরঝোরা বাগান পর্যন্ত পথের দুধারে উত্তরবঙ্গের সবুজ গালিচা। রাস্তাও ভালো । গজলডোবার পথে মিলনপল্লী এলাকা দিয়ে যেমন, তুরিবাড়িতেও তেমনি বেশ কিছু রিসর্ট তৈরি হচ্ছে, হয়েছে। পাথরঝোরা ছাড়ালে রাস্তা একটু একটু করে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। হঠাৎই যদি বা কখনো কোনো বস্তি, তা না হলে গোটা রাস্তায় শুধু আমরাই।
ওপরের দিকে রাস্তা অনেক জায়গাতেই ভাঙাচোরা, বাঁকও অনেক। মধুপর্ণা তো রাগেভয়ে বলেই ফেলল, "আর তোমার সাথে পাহাড়ে আসছি না আমি!" গত তিন/চার দশক ধরে মাঝেমাঝেই একথা শুনতে শুনতে আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। জানি, জায়গায় পৌঁছনোর পর অল্প বিশ্রামের দরকার কেবল, তারপরই এ রাগ উড়ে চলে যাবে। বরং রাস্তার পাশেই মনযোগ রাখি। নোয়ম ফরেস্ট হাতছানি দেয় ওপরে নীচে। এযাত্রায় হবে না, কিন্তু এ পাহাড়ি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ট্রেকিং রুট আছে জানি। গ্রামের মানুষেরাই গাইড হয়ে নিয়ে যাবে।
মাঞ্জিং ছাড়ানোর খানিক পর একটু বিপাকে পড়েছিলাম। আসার পথে যাকে যেখানে জিজ্ঞেস করেছি, সকলেরই জুবান, রাস্তা একটাই মাত্র! অথচ এবার যে মোড়ে পৌঁছেছি, সেখান থেকে তিনটে রাস্তা তিনদিকে। ভাগ্যিস তেমাথাতেই ছোট্ট একটা দোকান পেয়ে গেলাম। সেখানে জিজ্ঞেস করে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বিশিষ্টা হোমস্টের দরজায়। রিয়া আর যোগেশ কয়েকবার ফোন করেছে রাস্তায়। তৈরিই ছিলো আমাদের অভ্যর্থনায়। তবে ঢোকার মুখেই উজ্জ্বল বোগেনভিলিয়ার ঝাড়ও যে স্বাগত জানাবে, জানা ছিলো না। গেট থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে, ডানদিকে দেওয়াল আর বাঁ হাতে রঙিন বাঁশের বেড়াকে সাক্ষী রেখে।
যোগেশ ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগল হোমস্টে টি, রিয়া ঢুকে গেল কিচেনে। মোট ছ' খানা ঘর। দোতলার দুপাশে দুটো টুকরো ছাদ, ঘরলাগোয়া, দুটোতেই বারবিকিউএর ব্যবস্থা। গেটের দিকের ঘরটাতে আবার ফায়ারপ্লেসের ব্যবস্থাও দেখলাম। পাহাড়ের বেশির ভাগ হোমস্টের মতোই প্রতিটি ঘর ছিমছাম, ঝকঝকে।
রিয়ার গানের গলা মিষ্টি, সুরেলা। রান্নাঘরে কাজ করতে করতেন গুনগুন করছিলো, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই শুনতে পাচ্ছিলাম। যেমনটা বলেছি আগে, মধুপর্ণার ভয়, রাগ হাওয়া ইতিমধ্যেই! বরং রিয়াকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়ে আরও গানের অনুরোধ জানালো। মিঠে তরুণী লজ্জায় লাল, কিন্তু গাইতে লাগলো। নেপালি, হিন্দি। গান গাইতে গাইতেই টেবিল সাজানো চললো তার। যোগেশও সাহায্য করতে তৈরি। ধোঁয়া ওঠা থুকপা মুখে দিতেই বুঝলাম, রিয়ার গানের গলা যেমন, রান্নার হাতটিও ততটাই জব্বর!
লুংসেল জায়গাটি সম্পর্কে আমার প্রথম বক্তব্য এর নিষ্কলুষ পরিবেশ, আবহাওয়া। মাথার ওপর নীল, আর চারপাশের সবুজ এতটাই জীবন্ত, যেন এইমাত্র রঙ বোলানো শেষ হয়েছে। আর বাতাস। একটা গভীর শ্বাস টানার পর মনে হয় বুকের ভেতরে যা কিছু আবর্জনা ছিল, মুক্তি পেয়ে গেলো তারা। পটচিত্রের রাস্তাগুলো ধরে চরম অলস মানুষেরও হেঁটে যেতে ইচ্ছে করবে উঁচু নীচু ঠিকানায়।
বিশিষ্টা হোমস্টের লাগোয়া একটি খেলার মাঠ। স্বাস্থ্য সচেতন ভ্রমণার্থীরা এ মাঠে কয়েক চক্কর দিয়ে সকাল-সন্ধ্যের ওয়াক বা জগিং সেরে নিতে পারেন। গ্রামের বাচ্চাদের সাথে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলাতেও মেতে উঠতে বাধা থাকবে না কোনো!
মাঠেরই এক ধারে ভিউ পয়েন্ট। ছোট্ট বসার জায়গা, ছাউনি দেয়া। আবার দুটো তিনটে কংক্রিটের স্ল্যাবও আছে অলস সময়ে দিগন্তে চোখ মেলে রাখার জন্য। পরিষ্কার ভোরে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে হোমস্টে থেকে চলে আসবে কফির মাগ।
তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে আমার, ফেরার পথের একটি জায়গা, হয়তো ভ্রমণের আকর্ষণ বাড়াতেই যার নাম দেওয়া হয়েছে সাইলেন্ট ভ্যালি। কারণ যা-ই হোক, নামকরণটি সার্থক। এখানকার ভিউ পয়েন্টে বসে থাকতে থাকতে মনে হবে যেন বাতাসে একলা পাতার ভেসে নামাটুকুও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। আর আশ্চর্যজনক হলেও, আগে পিছে রাস্তা বেশ খারাপ হলেও এই স্ট্রেচটুকু মাখনমসৃণ! যেন সামান্য ঝাঁকুনিও সাইলেন্ট ভ্যালি নামটাকে আক্রমণ করে বসবে!
ঝান্ডি-ফাগু-অম্বিয়ক হয়ে গরুবাথান ছুঁয়ে ফেরার পথে সন্ধ্যে। তখন রাস্তার ধারে সুপারি বাগানের মাথায় চাঁদ। মনে পড়ল, লুংসেলের মাঠটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মধুপর্ণা বলেছিল, "পূর্ণিমার রাতে যদি এখানটায় বসে থাকা যায়!"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴