বাগানিয়া জার্নাল-২৩
বাগানিয়া জার্নাল – তৃতীয় ভাগ
পর্ব।। সাত।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
স্থির লক্ষ্য, প্রবল ইচ্ছাশক্তি, অদম্য উৎসাহ আর পর্যাপ্ত শারীরিক সামর্থ্য থাকলে প্রথাগত জ্ঞানের বাইরে থেকেও যে নিজের স্বপ্ন পূরণ করা যায় তা দেখিয়ে দিলেন চার্লস ব্রুস। তার বিজ্ঞানের জ্ঞান ছিল না।না ছিল উদ্ভিদবিজ্ঞান বা উদ্যানবিজ্ঞান সম্পর্কে কোন ধারণা। পরের ঘটনাবলী থেকে বোঝা যায় তিনি ভাল ব্যবসায়ীও ছিলেন না। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা ও উদ্যম তার সমস্ত অভাব মিটিয়ে তাকে শিখিয়ে দিল কী করে একটা জঙ্গলকে শাসন করে তার গোপন ঐশ্বর্যকে তুলে আনতে হয়। প্রয়োজন আর লক্ষ্যই তাকে জুগিয়ে দিল ব্যবহারিক জ্ঞান; আর তিনি হয়ে উঠলেন ভারতীয় চা-শিল্পের সত্যিকারের প্রতিষ্ঠা-পুরুষ। স্বভাবে তাই তাকে একজন অভিযাত্রী(explorer) বলাই বোধহয় সবচেয়ে সঠিক।
#
ব্রুসকে নার্সারী ও চা-চাষের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে ‘সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ টি কালচার’ হিসেবে নিয়োগ করা হয় ১৪ই এপ্রিল ১৮৩৬ সালে। গানবোটের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে ব্রুস পুরোপুরি চায়ে মনোনিবেশ করলেন।তিনি সরকারি চিনা-চায়ের নার্সারীর পাশাপাশি নিজের বাড়িতেও দেশী চা-গাছের চারা দিয়ে একটা নার্সারী বানিয়ে নিলেন।
এর মাস চারেক পরে, আগষ্ট ১৮৩৬-এ, চার্লসের মৃত দাদার ছেলে ক্যাপ্টেন আর. ব্রুস (যার জন্মই হয়েছিল আসামে ) কাকার সহকারি হিসেবে যোগ দেন। ক্যাপ্টেন ব্রুস ছিলেন আসামের শেষ রাজা পুরন্দর সিং-এর সেনাবাহিনীর (militia) প্রধান। সেখান থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি চলে এলেন চা-য়ে।
#
‘সুপারিন্টেন্ডন্ট অফ টি কালচার’ হবার পর চার্লস নতুন চা-এলাকা খোঁজার কাজ আরও বাড়িয়ে দিলেন। দেখলেন যে মাটক দেশে তো প্রায় সমস্তটাই চা-এলাকা; তা বাদে সিংফোদের দেশে আরও নতুন এলাকা এবং নাগা পর্বতেও জংলি চায়ের প্রাচুর্য। স্থানীয় লোকজনদের সাহায্য নিয়ে তাকে একের পর এক চা-এলাকা খুঁজে বার করতে হয়েছিল। এরজন্য নানা রকম কৌশলও নিতে হয়েছিল তাকে। যেমন লোকমুখে একটা নতুন চা-এলাকার কথা শুনে সে এলাকার গামকে (Gaum-সর্দার) এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে গাম অস্বীকার করে বলে যে সেখানে নতুন কোন চা-জঙ্গল নেই। চার্লস তাকে একটু আফিম দিয়ে বেশ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে তাকে আরও একবার খোঁজখবর নিতে বলেন। কী আশ্চর্য, পরদিন সকালেই গাম চার্লসকে তার বাড়ির কাছেই একটা বেশ বড় চা-জঙ্গল দেখিয়ে দিল।
আর একবার এক নিংগ্রুদের গ্রামে যান। নিংগ্রু সিংফোদের আর এক গোত্র। সেখানকার গাম খুব ভদ্র ও সহৃদয়। কিন্তু সেও কোন নতুন চা-জঙ্গলের কথা অস্বীকার করে।চার্লস তাকেও একটু আফিম উপহার দেন। তারপর তার সঙ্গোপাঙ্গোদের মধ্যে পায়ের ওপর পা তুলে গ্যাঁট হয়ে বসে গামকে ‘দাদা দাদা’ বলে ডেকে তাদের সঙ্গে বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে গল্পগাছা করতে থাকেন। গাম তার দোনলা বন্দুক নিয়ে হাতাতে হাতাতে বলে কমিশনারকে বলে তার জন্যও এরকম একটা বন্দুকের ব্যবস্থা করে দিতে; বলে যে চার্লস তো মাটক দেশের দুই গোঁহাইকে (মাটক দেশের সর্দার) ইতিমধ্যেই এরকম বন্দুক উপহার দিয়েছে।চার্লস বলেন যে সে তো তারা সরকারকে অনেক সাহায্য করেছে সে জন্য। এবং গামও যদি সেরকম সাহায্য করে তবে তিনিও সরকারের কাছে তার জন্য একটা বন্দুকের সুপারিশ করবেন। এইসব কৌশলে তিনি গামের কাছ থেকে বুড়ি-ডিহাং-এর আরও নীচে প্রচুর চা-জঙ্গলের খবর পান।
এইভাবে চার্লস প্রায় একশ কুড়িটার মত চা-জঙ্গল খুঁজে বার করেছিলেন একের পর এক।
টি কমিটি ব্রুসের এইসব কাজে উচ্ছ্বসিত হয়ে সরকারের কাছে আবার তার প্রচুর প্রশংসা করে। সঙ্গে ব্রুসকে কয়েকটা সস্তার দোনলা বন্দুক আর পিস্তল কেনার অনুমতির জন্যও সুপারিশ করে যাতে ব্রুস তার ইচ্ছেমত সেগুলো দেশী সর্দারদের উপহার দিতে পারে।
চার্লস ব্রুস শুধু যে নতুন নতুন চা-অঞ্চল খুঁজে বেড়িয়ে ছিলেন তা নয়।
তিনি চা-সংক্রান্ত সব ঘটনা খুব মন দিয়ে ‘নিরীক্ষা’ করেছিলেন, তা নিয়ে নিজে হাতে পরীক্ষা করে তার ফলাফল নথিভুক্ত করেছিলেন। এরমধ্যে এমন কিছু ঘটনা আছে যা ব্রুসের পরীক্ষার হাত ধরে আজকের দিনেও চা-বাগানগুলোতে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মেনে চলা হয়।এবার সেই গল্প।
একদিন একটা চা-অঞ্চল দেখে ফেরার পথে চার্লস আরও একটা নতুন চা-অঞ্চলের খবর পেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন জঙ্গল খুব বেশী ঘন হয়ে গিয়েছিল বলে স্থানীয়রা সেই সব চা-গাছগুলোকে গোড়া থেকে কেটে ফেলেছে। তারপর সেই জমিতেই আগুন লাগিয়ে কাটা ডালপালাগুলো পুড়িয়ে সেখানে ধান চাষ করেছে। এখন ধান কেটে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। ব্রুস আশ্চর্য হয়ে দেখলেন সেইসব কেটে ফেলা চা-গাছের শিকড় এবং গোড়া থেকে নতুন করে গোছা গোছা, ঘন, অসংখ্য চায়ের ডাল বেরিয়েছে – যেগুলো এখন লম্বায় প্রায় ইঞ্চি ছয়েক। কিছু কিছু চা গাছকে গোড়ার বদলে এক ফুট বা দুই থেকে চার ফুট ওপর থেকে কাটা হয়েছিল। এদের প্রত্যেকটা থেকেই, যেখানে কাটা হয়েছিল তার এক বা দু ইঞ্চি নীচে থেকে, প্রচুর অঙ্কুর (shoot) গজিয়েছে। আগে যেখানে একটা চা গাছ ছিল সেখানে তখন ডজনখানেক চায়ের ডাল মাথা তুলে সুন্দর ঝোপড়া হয়েছে। এর আগে একটা কান্ডের ওপর মাত্র কয়েকটা ডাল থাকতো।এখন প্রতিটি গোড়া-কাটা গাছই ঝোপড়া। না-কাটলে গাছগুলো বছরে যত পাতা দিতে এখন তার বারোগুণ পাতা দিচ্ছে। কাটার পর যে অঙ্কুরগুলো বার হয়, সূর্যের আলো পাওয়ার জন্য তাদের পাতাগুলোতে একটু হলদেটে ভাব থাকে। কিন্তু কিছুদিন পরেই তা চলে যায় এবং জঙ্গলের ছায়ায় থাকা গাছগুলোর মতই সবুজ হয়ে যায়।
এই কেটে ফেলা এবং আগুন লাগানোর কান্ড দেখে ব্রুস কাছের আর একটা চা-জঙ্গলেও ঠিক সেরকমই কাজ করলেন এবং সেখানেও যে রকম আশা করেছিলেন তেমনটাই ঘটল।
এভাবেই ব্রুস একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চললেন। কখনও ছায়ার মধ্যে চা-গাছের ডাল ছেঁটে, কখনও ছাঁটা ডাল মাটিতে ফেলে তার ওপর মাটি দিয়ে, কখনও ডালগুলোকে মাটিতে পুঁতে...কখনও বড় ছায়া-গাছগুলো না কেটে শুধু লতাপাতা ও মাঝারি মাপের গাছগুলো কেটে জঙ্গলের ভিতরে কিছুটা রোদ আসার ব্যবস্থা করে। এবং তার এই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে জন্ম হল আজকেও মেনে চলা ‘গাছ-ছাঁটা’ (Pruning), ‘ছায়া গাছ’ (Shed Tree), ‘কলমকারি‘(Grafting) ইত্যাদি পদ্ধতি ।
ওদিকে ততদিনে চিন থেকে গর্ডনের পাঠানো কালো-চা বানানোর দুজন চিনা কারিগররা এসে গ্যাছে কলকাতায়। সেখান থেকে তারা ব্রুসের কাছে এসে পৌঁছল ১৮৩৬-এর পয়লা অক্টোবর।সঙ্গে চিনা দোভাষী।
-----------------------------------------------------------
ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া...
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴