তোর্সার ঘর বাড়ি// ত্রয়োবিংশ পর্ব
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
---------------------------------------------
হাওর অরে তোর্সা হাওর নৌকা চিন কি!/ হাল ধইর্যা সামাল সামাল কইন্যা বাইন্ধ্ বা কি...."
সকালে খুব তাড়া ছিল মিনির। নারী দিবস পালন হচ্ছে দুই কলেজ মিলে। বিশিষ্ট বক্তা থাকছেন অধীরা মিত্র, পরিবেশ বিদ, মহিলাদের এগিয়ে যাওয়ার কথা, উদারতার কথা যিনি বার বার বলেছেন। গতকাল থেকে সেজে উঠেছে কলেজ, আশপাশ, ক্লাসঘর, সেমিনার রুম। চোখ ফেরানো যায়না। পাশের কো এড কলেজ সেই মহারাজের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি। সেখানকার অধ্যাপক ড:সঞ্চয়ন ভারতী আর সম্রাজ্ঞী দাম দুজনেই আসবেন কথা দিয়েছেন। আর মুখ্য সঞ্চালক যথা নিয়মে প্রজ্ঞা।...সে চায়নি সঞ্চালকের ভূমিকা, এ মাটির যন্ত্রণা, ঠাঁই নাড়ার কষ্ট তো আছেই। সে সব নিয়ে রাজশহরের মাটিতে তার হয়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে কত কিই যে বলার অথচ সময় চলে যায়। পিছন ফেরেনা। ওর বকুলতলীর ফ্ল্যাট একেবারে বড় দেবী মায়ের মন্দিরের পাশেই। যেখানে ছোটবেলায় পুজোর ঐ একদিন ছাড়া যাওয়া যেতনা। বড় দূর যে! ঐ বাঁধ সংলগ্ন এপাড় ওপাড়ে যে ভালবাসাবাসি, অন্তরটান সে কি করে আজকের পরিবর্তিত সময়ে দিন রাতের মতো ফিরিয়ে দেবে! প্রতি সন্ধে রাতে সাগরদীঘির পাড় জানায় কত মুখের কথা, কত মানুষের গল্প। কত আচরণ বদলে গেছে, পাড় জুড়ে খাওয়ার দোকান, তেমনি ভীড়। সে কোয়ালিটি আইসক্রিম হোক আর ঝাল ঝাল মোগলাই তরকারি, ফুচকা চাট অথবা সি এফ সির দাঁড় করানো গাড়িই হোক। বিরাম নেই। আর দিনের আলোয় কলেজ যাওয়ার সময় সেই যুদ্ধের সাজিয়ে রাখা কামানের সামনে যেমন পান বিস্কুটের দোকান তেমনিই ডাব, কলা, কমলা আপেল কিছুই বাদ যায়না। মিনি এখান থেকেই প্রয়োজন মেটায়। বোঝে মুখগুলো দেখে,ক্রেতারা বেশিরভাগ বহির্প্রদেশ, অন্য শহর থেকে এসে থাকছে। খাওয়ার হোটেলগুলোয় উপচে পড়া ভীড়। সেইসঙ্গে জামা কাপড়ের দোকান, দশকর্মায় লোক গিস গিস করছে। ভয়ে মাস্ক আটকে নেয় মিনি এখনো। একটাই অসুবিধে মনে হয়, রাত হলে, এইযে কোন অনুষ্ঠান ভবনের ভারী অভাব হয়েছে। রবীন্দ্রভবন সেই গত আট ন বছর ধরে রেনভেশন চলছেতো চলছেই। আর উৎসব মঞ্চ! কে হাত দেবে? পুড়ে যায় ভাড়া নিতে গেলে।বাকি থাকল পান্থ নিবাস সুকান্ত মঞ্চ।...সেটাও শহরের মাঝখানে তো নয়, দূরে। ল্যানস্ ডাউন হল, কিংবা স্টেট ট্রান্সপোর্ট মঞ্চের কথা মনে হলে হু হু করে বুকের ভিতর। কত নাটক, কতনা অনুষ্ঠানের দিনগুলো রাতগুলো...। সেদিন 'নটসূর্যের"" আহ্বানে নাটক দেখতে গিয়েছিল মিনি। একাই। এখানে কি তার চেনা নেই কেউ! না, সে ত পরদেশী। দুটো নাটক ছিল, প্রথম নাটক শেষ হতে হতেই চলে এলে ভাল হত। কিন্তু ঐ যে ভারী অভদ্রতা মনে হয় উঠে এলে। আর যারা অংশ নিয়েছেন, সকলের অনুষ্ঠান ছেড়ে মাঝপথে উঠে আসা অন্যায় আর সেটাই করল প্রজ্ঞা সান্যাল। স্বভাব বিরুদ্ধ। সুকান্ত মঞ্চ যে বড় দূর। ঘড়িতে সাড়ে সাত । এখনো মানুষজন আসছে। উদ্বোধনে পাশের স্কুলের সমবেত আলেখ্য বেশ লাগে। নাটক কুশলীরাও দক্ষ। আর ঐ দ্বিতীয় নাটকের মাঝখানেই প্রবল বৃষ্টি। বাইরের বৃষ্টি পতন এ মঞ্চের নিয়ন্ত্রণ দরজা ভেদ করেই শব্দ হয়ে কানে আসছিল। আসলে হলের মাথায় নিশ্চয় ই টিনের সাঁজোয়া। তবে নাটক শেষ হতেই ধরে গেছে বৃষ্টি।ঘড়িতে সাড়ে নটা। বৃষ্টিও নেই মনে হচ্ছে। প্রজ্ঞা চট করে দর্শকাসন থেকে উঠে দাঁড়ায়।...ঠিক যা ভেবেছিল তা নয়। বাইরে বৃষ্টি ভাল ই পড়ছে। চারদিকের অন্ধকারে মানুষজন কম। মনে মনে ভেবে নেয় সার্কিট হাউসের সামনে দিয়ে গেলে অনেকটা ঘুরতে হবে। বাঁ হাতের রাস্তা দিয়ে ঐ মরাপোড়া দিঘীর পাশ দিয়ে ফিরতে হবে। সেটাও বেশ লম্বা। টো টো গুলো যে যার মত ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটছে। প্রায় শুভম নার্সিং হোমের কাছাকাছি এসে একখানা টোটো দাঁড়ায়। কোনো ভাবনা করার সময় নেই, উঠে পড়ে। নাক মুখ বন্ধ করে অন্ধকার লম্বা রাস্তা পেরোয়। মদনমোহন বাড়ি পেরিয়ে সাগরদীঘির পাড় ছুঁতে কেমন নিশ্চিন্ততা। আসলে এ যেন তার নিজের হয়ে উঠেছে। দেবীবাড়ি তল্লাট ছুঁতেই সেদিন দুজনের টাকাই দিয়েছিল টোটোঅলাকে। কেমন অজানা ভয় তাড়া করেছিল অন্ধকারে। সকলের মুখেই'ঐ দিনকাল ভালোনা', অপরাধ জগতের মানুষের ভিড়' এসব এই একার চলায় গেড়ে বসতে চায় এ শহরে।...দুদ্দাড়িয়ে দোতলায় উঠে পড়ে নিশ্চিন্ত। সে দিনের পর দূরের দিকে অনুষ্ঠান অনুষ্ঠান মন হলেও আর এগোয় না। টোটোঅলা আর সঙ্গের ছেলেটির কতগুলো যেচে পড়ে কথা, ফোন নম্বর চাওয়া, সিটের নীচে ফাঁকা বোতলে নেশার গন্ধের নির্যাস ঐ ভয়ের কারণ।
* * *
অধীরা মিত্রের বক্তব্যে বেশ অনুপ্ররণা পেয়েছে ছাত্রীরা। জলপাইগুড়ি শহরের ডিষ্ট্রিক্ট মহিলা জজ ও অংশ নিয়েছিলেন। সঞ্চালনার ফাঁকে নারীর অধিকার প্রসঙ্গ উঠল। মিসেস বসু বললেন নারীদের নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা এক বড় ব্যাপার।...সেদিন অনুষ্ঠান শেষে বিকেলে ঘরে ফিরে ফোন করেছিল প্রজ্ঞা মিসেস বসুকে...কে সচেতন নয় ম্যাডাম? শিক্ষিত, সামান্য একটুখানি পারিবারিক সম্পর্ক মাটি চেতনা যার আছে কে সচেতন নয়? পারিপার্শ্বিকতা সে সচেতনতায় ঘৃণা করে। ভাবে এই মহিলার কিই নেই! তিন চারখানা বিভিন্ন শহরে বাড়ি, নিজস্ব গাড়ি অথচ দেখ নজর ঐ পড়ে থাকা মাটির! ঐ ভাইয়ের সঙ্গে দখলদারি!...'দখলদার' নাম পাওয়ার আগেই সমবন্টন হয়না কেন বন্ধু?...ঠিক। সুমিতা বসু প্রজ্ঞার স্কুলের বন্ধু। আরো কিছুক্ষণ দুই বন্ধু অধিকার প্রসঙ্গে পুরোনো স্কুলের কথা বলে।উঠোন অলা বাড়ির কথা হয়, ছবি হয়। ঠিক হয় পরদিন সকালে সেই পুরোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় হাজরাপাড়ার দিকে যাবে দুজনে বাঁধ রাস্তা ধরে।...আর সে কীর্তনের আখড়ার আটচালা আছে? যেখানে মাঝদুপুরে নির্জনতায় ধুলো উড়িয়ে দৌড়তাম'নৌকা বিলাস' দেখব বলে?
"...সব সখীরে পার করিতে লইব আনা আনা/তুমি নারী পার করিতে লইব কানের সোনা..." মনে আছে? কৃষ্ণ নাম। গা ভরা নীলচে রঙ আর চুমকিতে মুকুট আর গাঁদার মালায় কৃষ্ণকে কি ভালবাসতাম দুজনে! নিজেরাই তখন এক একজন রাধা, চন্দ্রাবলী।
-ঠিক বলেছিস।..কাল ঠিক এগারোটায়। আমার পর পর তিনটে অফ আছে।
- উরে: না। চল চুটিয়ে গল্প করব। ছবি টবিও। তারপর আমার বাংলোয়। জমিয়ে খাব মিনি।
- আরে! সেই পুরোনো নামটা নিলি...কেউ সে নামে ডাকেনা রে সুমি।
-ঐ দ্যাখ, দুজন দুজনকে ঐ ডাক নামেই একশোবার ডেকে নেব কাল। কতদিন পর দেখা বল তো!
-বেশ। এরপর আবার একসঙ্গে হব আমার শহরে।তোর কাজের ফাঁকে। আমার বাড়িতে 'রু' এর উৎসবে।...ওহো তুই তো তারপর এক্কেবারে আকাশে ওড়া দুধরাজ রে! কোথায় পালাবি যে...
-বেশ ঠিক করা যাবে, কোথায় যাব। তাহলে কাল...
-ঠিক। গুড নাইট।
* * *
তোর্সার চড়ে ঐ দূরে নৌকোটা যতটা টেনেছিল, ওরা দুজনে বহুকষ্টে চড়াই উৎরাই বড় বড় বোল্ডার আর মাটি পেরিয়ে যখন সে ঘাটের সামনে দাঁড়ালো ঐ দূরের কাশবনের মতোই কাছ থেকে দেখার স্বপ্নটা মরে গেল।
চারদিকে পুরোনো কাঠামো। পচা পোয়ালের গাঁটরি। গলা মাটি, জলের আশপাশে নোংরা জমে আছে, চারদিকে গন্ধ ও বটে। তাহলে চরুয়া মানুষের প্রাতকৃত্য এখনো এ এগিয়ে যাওয়া'অচ্ছে দিনে'ও চলছে! আসলে নোংরা বয়ে নিয়ে যাওয়া জল এখানে কোথায়? তোর্সার সে স্রোত এ ঘাটে নেই, এখানে চরের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে দূরের বাঁশের সাঁকো পেরোনো গ্রাম ওদের হাতছানি দেয়।...সুমি ওর সানগ্লাসটা ঠেলে দিয়েছে মাথায়।
-চল মিনি, আমাদের সেই উঠোন অলা, কুলগাছের কাঁটা ভরা স্কুলটা খুঁজে বের করি। ওরা দুজনে হাত ধরাধরি পাকা বাঁধানো বাঁধ রাস্তার জাতীয় সড়কে উঠে পড়ে।- বেড়ে তৈরী করেছেরে মিনি, সেই মাটির বাঁধ আর নেই,...দেখ, সেই খেজুর গাছটার মত আর এক গাছ।- ওটাই নয়তো?- না: তা হবেনা। মিনির লাজুক হাসিটা সুমির চোখ এড়ায় কি করে!- ও: বাবা, মাঝবয়সেও পুরোনো কথা উঠে আসে?
- আরে! ঐ নিয়েই তো বেঁচে থাকা। চল চল্ ঐযে কালীবাড়ি...শ্মশান কালী বাড়ি কি পাকাপোক্ত করেছে দেখ্।
- আরে চল খুঁজি স্কুল। এখানে ওখানে আড্ডা, বিকেল বিকেল বাড়ির রোয়াক। সে মেছো পাড়া চেনার উপায় নেই।
মিনি গলা তোলে...দিদি, এখানে একটা প্রাইমারি স্কুল, হাজরাপাড়া প্রাথমিক...এখনো চলে। দেখিয়ে দেবেন? বয়স্কা সাদা কাপড়ের বৃদ্ধা আঙুল তুলে যেদিকে দেখায় দুজনে হাঁটতে শুরু করে। খুঁজে পায়না সে স্মৃতির উঠোন। মনে মনে জানে, পরিবর্তন হয়েছে, তবে আছে যে মিনি জেনেছে খোঁজ নিয়ে। পথচারী আর একজন সাইকেল আরোহী টিন ঘেরা এক ছোট পরিসর আর গেট দেখিয়ে দেয়। খুব কষ্ট করে লালচে কালির হাজরাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় লেখাটা খুঁজে বের করে দুজনেই আবিষ্কারের আনন্দ পায়। আশপাশের মানুষ জন এদের পাগলপনা দেখে, ভাবে এ আবার এমন কি!...
সে যে এমন কি, তা জানে ঐ নদী ঘেরা পথ, জানে চারদিকের পুরোনো সবুজ আর বন্ধ গেটের ভিতরের ক্লাসঘর দু তিনটে। তার এখন সিমেন্টের পলেস্তারা, বাঁধানো মেঝে। কোথায় কাঠের প্লানকিং আর কোথায় ই বা সে পাকা কুলের গাছ অলা উঠোন...সব কংক্রিট। দুই মাঝবয়সিনী নির্ণিমেষে তাকিয়ে থাকে সে স্কুলের দিকে, মিড ডে মিলের মাসিক নোটিশের দেয়ালের দিকে... খুব ধীরে ওরা মোবাইলে ছবি তুলতে ভোলে না। এগিয়ে যায় নতুন বাজারের দিকে। সেই আটচালা, খুঁজে নিতে...যেখানে কানু বিনে গীত নেই, বাল্যলীলা, পূর্বরাগ, অভিসার থেকে মাথুরের দিকে যেতে যেতে কেঁদে ভাসাত চন্দন আঁকা কপালের মানুষেরা, কীর্তনীয়ারা, সঙ্গে ত্রিপলে বসে থাকা মাসি দিদারা...পিছনে দাঁড়িয়ে থাকত চুপ করে মিনি সুমি ঘনা রতু রঞ্জুর দল...ওদের চোখেই কি জল চিক চিক ....