চা-ডুবুরি : পর্ব-২৩
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^
যখন তুমি বাঁধছিলে তার, সে যে বিষম ব্যথা
----------------------------------------------------------
মাঝরাতে একটা ধাতব শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সত্যপ্রিয়র। চোখ বন্ধ অবস্থায় তিলার্ধ ঘুমের রেশটুকু নিয়ে কান দুটো কেবলমাত্র সজাগ হয়ে ওঠে। আচমকা ঘুম ভাঙায় স্নায়ুগুলো অবশ হয়ে পড়ে। অসাড় দেহটায় তখন পাশ ফেরার শক্তিটুকুও থাকে না। শরীরটাকে মনে হয় একটা পোকা খাওয়া,অতিকায়, জীর্ণ কাঠের গুঁড়ির মতো । স্রোতস্বিনী সময় যাকে ছেড়ে চলে গেছে বহুকাল আগে এক জনহীন পরিত্যক্ত নদীখাতে। নিস্তব্ধ ঘরে ঘড়ির কাঁটায় অন্তহীন সময়ের স্রোত শুধু বয়ে যেতে থাকে হিম জলপ্রবাহের মতো। মাঝেমধ্যেই এমনটা হয়। একবার ঘুম ভেঙে গেলে ঘুম আসতে চায় না আর সহজে। অতীত তখন নিঃশব্দে মাকড়সার মতো ঢুকে স্মৃতিজাল বুনতে শুরু করে দেয় ছেঁড়াঘুমে। আধোতন্দ্রার ভেতর।
লোহার গায়ে জোরে আঘাত করলে যেমনটা হয়, শব্দটা তেমনই শোনালো। চোরটোর নয়তো! নাঃ, বহুদিন হলো ছিঁচকে চোরের উপদ্রব আর শোনা যায় না চা বাগান অঞ্চলে। একসময় যেটা হামেশাই হতো। চুরি ছ্যাঁচড়ামির চাইতে মানুষ এখন সম্মানের সাথে কাজ করে পয়সা রোজগার করতে বেশি আগ্রহী। কানখাড়া করে দ্বিতীয় বার শব্দটা শোনার চেষ্টা করে সত্যপ্রিয়। বেড়াল- টেড়াল হতে পারে। ইঁদুর ধরতে তো মাঝেসাঝেই বেড়াল সিলিংয়ে উঠে পড়ে। ছুটোছুটির শব্দও পাওয়া যায়। নামতে গিয়ে বেড়ালটাই কি পুরনো অ্যান্টেনার তারে গিয়ে পড়েছে বেকায়দায়! লোহার খুঁটিতে টানাতার ঘষা খেলেই অমন শব্দ হয়। কিংবা হয়ত কোনও রাতচরা পাখি টিনের চালে বসানো ডিশ-অ্যান্টেনায় ধাক্কা খেলো। ওটা বসানোর পরেও তো অনেকদিন হয়ে গেছে পুরনোদিনের অ্যান্টেনাটা আজও খোলা হয়নি । ধুঁধুঁলের ফলসমেত লতা জড়িয়ে ধরা জং পড়া অ্যান্টেনাটা এখন আর কোন তরঙ্গ টেনে আনে না মহাশূন্য থেকে। টেনে আনে কেবল ব্যথাময় কিছু টুকরো স্মৃতির ছবি। যে ছবিতে উজ্জ্বল হয়ে মিশে থাকে মহাশূন্যে হারিয়ে যাওয়া অভ্র নামের এক রুপোলি ঝিলিক।
সেবার বিশ্বকাপ ফুটবলের ঠিক আগে সাদাকালো টিভিটা বাজ পড়ে নষ্ট হয়ে গেছিল। ছুটিতে বাড়ি এসে বাবুর সেকি মন খারাপ।খেলা দেখা যাবে না। তাও কি হয়! তড়িঘড়ি ছুটেছিল টিভি আনতে। রঙিন টেলিভিশন সেটটার সাথে চব্বিশ স্টিকের ঐ পেল্লায় অ্যান্টেনাটাও নিয়ে এসেছিল ছেলেটা। এনে বেশ আত্মবিশ্বাসের সুরে বলেছিল,
"- এবারে সিগন্যালটা আরেকটু ভাল পাওয়া যাবে, বাবা। তমাল নিজেও ওর বাড়িতে লাগিয়েছে। বলল, 'নিয়া যা। পারলে দু'মাথায় দুটা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ঢাকনা লাগায়ে নিস। আমি এভাবে কইরে ফাটাফাটি সিগন্যাল পাইতেসি। '' দিনভর মালির সাথে লেগেছিল অ্যান্টেনা ফিট করতে।
তমাল, অভ্রর বন্ধু, ওয়ার্ল্ড-কাপের আগে ব্যাংক লোন নিয়ে কাঠের নড়বড়ে রেডিও-টিভির দোকানটার ভোল পাল্টে ফেলেছিল। সাতপাঁচ বুঝিয়ে অভ্রকে ইন্সটলমেন্টে কালার টিভিটার সাথে অ্যান্টেনাটাও গছিয়ে দিয়েছিল একরকম জোর করে। ওর বিক্রি দিয়ে কথা। কিন্তু এভাবে করলে আদতেই যে সিগন্যালের খুব একটা তারতম্য হয় না তা বোঝা গেল অচিরেই। অভ্র তবু দেড়-ইঞ্চির লোহার পাইপটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রাণান্ত লড়ে যেত সিগন্যাল ঠিক করতে।
সেসময় ডুয়ার্স অঞ্চলে কেবল-টিভির চল হয়নি। চা-বাগানের মানুষ ঐ অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়েই একবার বাংলাদেশ টি. ভি আর একবার কার্শিয়াং রিলে কেন্দ্র থেকে প্রচারিত দূরদর্শনের ঝিরঝিরে অনুষ্ঠান দেখে মনে ভরাতো। কোনও কারণে ওয়েভলিংকের শক্তিবৃদ্ধি ঘটলে হঠাৎ করে ছবি কাঁচের মতো ঝকঝকে হয়ে উঠত। তখন সকলের সেকি আনন্দ ! এরপর এলো মুচমুচে বিনোদনের কালো কেবল-তার। তখনও অভ্রর মাতামাতি ছিল দেখার মত। পিকচার কোয়ালিটি খারাপ হলেই কেবল-অফিস এর লোকদের ফোন করে পাগল করত। বিশেষ করে খেলা দেখার সময় ট্রান্সমিশন ডিস্টার্ব হলে তো কথাই নেই। চেঁচামেচি শুরু করে দিত। তারপর একদিন বাড়ির চালে বসল ডিস অ্যান্টেনার ছাতা। হাজারো চ্যানেলের 'সাড়ে বত্রিশ ভাজা'র ভরপুর আয়োজন। আর এখন, পুরো ব্যাপারটাই যেন থমকে গেছে। নাতনি, বৌমা দুজনের হাতেই দুটো মোবাইল। বাড়িতে কারোরই টিভি খোলায় বিশেষ আগ্রহ নেই । স্মার্ট ফোনের ছোট্ট পর্দার দিকে তাকিয়ে দুজন দুদিকে নিশ্চুপ। কোনও খবর, কোনও বিনোদনই যেন সম্পূর্ণভাবে ওদের আর স্পর্শ করে না।
টিভিটা যখন কিনেছিল সেসময় অভ্র রাজস্থানে চাকরি করত। একটি মার্বেল কম্পানিতে। গ্র্যাজুয়েশনের পর নিজেই যুগিয়েছিল চাকরিটা। আয় মন্দ ছিল না। কিন্তু বছর দুয়েক যেতে না যেতেই রিটায়ারমেন্টের আগে সত্যপ্রিয় তাকে ডেকে নেয় । বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে ভাবমূর্তি ভাল থাকায় ছেলেকে অফিসে জুনিয়র-ক্লার্কের পদে ঢোকাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। এরপর নিজেকেও অবশ্য বসে থাকতে হয়নি বাড়িতে বেশিদিন। শিলিগুড়ির কাছে একটি চা বাগান থেকে পরিচিত এক ম্যানেজার ফোন করে সত্বর দেখা করতে বলেন। দেখা করতে যেতেই বললেন,
''আপনি আজই জয়েন করুন আমাদের ফ্যাক্টরিতে। অ্যাজ -অ্যা ফ্যাক্টরি-ম্যানেজার।''
বাবু থেকে সরাসরি সাহেব। অফারটা অপ্রত্যাশিত হলেও সাথে সাথে জয়েন করা সম্ভব হল না। একদিন সময় চেয়ে নিয়ে বাড়ি এসে সকলকে জানিয়ে ফের যেতে হয়েছিল সত্যপ্রিয়কে। সেখানে বাংলো, সার্ভেন্ট, মালি, চৌকিদার,ভাল মাইনে। এককথায় পুরোদস্তুর সাহেবি সুযোগ-সুবিধে। কয়েক বছর সেখানে ভালমন্দ মিশিয়ে এককথায় ভালই কাটছিল। কাজের মানুষ সত্যপ্রিয় কাজ ছাড়া থাকতে পারে না। সেদিক থেকে মনের খোরাকের সাথে সাথে কিছু আয়ও হচ্ছিল। আর ঠিক এই সময়েই কাবেরীর অসুখটা ধরা পড়ে। ফিরে আসতে হয় ছুটি নিয়ে তৎক্ষণাৎ।
একটা শব্দ মনে করিয়ে দেয় কত যন্ত্রণার কথা। চাকরি পাওয়ার বছর খানেকের ভেতর ঘটা করে ছোট ছেলের বিয়ে দিয়েছিল সত্যপ্রিয়। কয়েক বছর যেতে না যেতেই একদিন ফাঁকি দিয়ে অভ্র চলে গেল, স্ত্রী আর একমাত্র মেয়েকে রেখে। মাত্র কয়েকঘন্টার বুকে ব্যথা। ব্যস সব শেষ। চিকিৎসার সুযোগ না দিয়েই বুড়ো বাপকে ফেলে জোয়ান ছেলেটা স্বার্থপরের মত পাড়ি দিল একলা। ঐ মহাশূন্যের ওপারে। দিনটা ভুলে যেতে চায় সত্যপ্রিয় আপ্রাণ। তবু এমন ঘুমভাঙা দুঃসহ প্রহরে ফিরে আসা স্মৃতি বড় যন্ত্রণা দেয়।
সত্যপ্রিয়র মনে পড়ে আরো একটি রাতের কথা। সেদিনও ঘুম আসছিল না কিছুতেই। বিছানা ছেড়ে কাঁচের জানালার পর্দা সরিয়ে জোৎস্না ধোওয়া রাতের সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হচ্ছিল সত্যপ্রিয়। ফুলবাগানে ফুলে ঢাকা সাদাগোলাপের ঝাড়ে একটুকরো স্বর্গ নেমেছে যেন। সাদা-বেগুনি ফ্রান্সিসিয়ার ঝোপ থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি গন্ধ। সত্যপ্রিয়র তখন বারবার মনে পড়ছিল দুটি লাইন , 'পারিজাতের কেশর নিয়ে, ধরায় শশী ছড়ায় কি এ, ইন্দ্রপুরীর কোন রমণী বাসরপ্রদীপ জ্বালো...ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো...।' এমন রোমান্টিক মুহুর্তে কাবেরী পাশে নেই। ছেলে কোলে কদিনের জন্য বাপের বাড়ি গেছে। কাবেরীর মুখটা মনে করে কল্পনায় তার সঙ্গসুখ উপভোগ করছিল সত্যপ্রিয়। মোহাবিষ্ট চেতনায় ডুবে যেতে ঘোর কাটে একটি যন্ত্রণা কাতর শব্দে । মুহুর্তে আশংকাজড়ানো একটা অস্বস্তি মনটাকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। পাশের ঘরে কুমুদরঞ্জন জোরে কঁকিয়ে উঠলেন যেন । অবস্থার কি তাহলে আরো অবনতি হলো! একটু আগে দেখতে গিয়ে মনে হয়েছিল বুকের শ্লেষ্মাজনিত ঘড়ঘড়ে শব্দটা যেন কিছুটা বেড়েছে। বিকেলে ভালজ্যেঠিমা দেখতে এসে একপ্রস্থ চোখের জল ফেলে খেনের- মাসিকে বলে গেছিলেন, " আজ আবার পুণ্ণিমের জো আচে গো মাসি...যা দেখচি তাতে জো কাটবে বলে তো মনে হচ্ছে নে । সতুকে বোলো বৌমাকে খবর দিক। রাতে আমরা জেগেই থাকব। তেমন বুজলে আমাদের একটু জানাতে ভুলো নি কো।"
সন্ধে নাগাদ ডাক্তার মিত্র দেখে বলে গেছিলেন, -''অবস্থা ভাল ঠেকছে না বুঝলে। কাফ-কনজেশনটা ক্রমশ বাড়ছে। ওষুধ দিয়ে গেলাম। তেমন হলে ডেকো। রাতে এমনিতেই তো আজ জাগতেই হবে। স্টেথো ছেড়ে আজ আবার লাঠি ধরার দিন ...। "
সে সময় কাজলিডাঙায় চোর ডাকাতের উপদ্রব বেড়েছিল বেশ। বাবুদের কোয়ার্টারে হামেশাই নিশিকুটুম্বের আবির্ভাব ঘটছিল। পাকঘরের দরজার কড়া কেটে , কখনও জানালা ভেঙে থালা বাসন চুরি যাচ্ছিল প্রায়রাতেই। কিছু না পেলে মিটসেফের খাবার সাবড়ে ঘরময় বাহ্যি ত্যাগ করে রেখে যাচ্ছিল কুচুটে কুটুম্বের দল। বাড়ি ফাঁকা থাকলে ঘরের জিনিসপত্রও লোপাট হয়ে যাচ্ছিল বেমালুম । শেষে কাঁইয়ার দোকানে যেদিন ডাকাত পড়ল, হুঁশ হলো সকলের। বীরপাড়া থানার দারোগা এসে পরামর্শ দিলেন,
'আপনারা রাত জেগে পাহারার ব্যাবস্থা করুন। আমরা মাঝে মধ্যে এসে পেট্রলিং করে যাব। '
গড়ে উঠলো কাজলিডাঙার নাইট গার্ড পার্টি। শিফটিং ডিউটি না থাকলে সত্যপ্রিয়কেও রাতে পাহারা দিতে হয়েছে। তখনও তিতির, অভ্র, মিতুল এদের জন্ম হয়নি। শুভ্র সবে বছরখানেকের হবে। বাচ্চা নিয়ে কাবেরী প্রথম প্রথম ভয় পেতো। খেনের-মাসি অভয় দিয়ে বলত, '' চিন্তা না করিস বউ। মুই আছং তোর সাথত। "
রাত পাহারার সদস্যরা বাসা লাইনের এমাথা থেকে ও মাথা লাঠি ঠকঠক করে হাঁটত আর 'জা-গ-তে রা-হো-ও-ও' বলে চিৎকার করে সজাগ করে দিত সকলকে। ডাক্তার মিত্রর ডিউটি থাকলে কেউ চেঁচাত না। উনার নির্দেশ মতো ট্রলি-রেলের পরিত্যক্ত লোহার ট্র্যাক দিয়ে তৈরি লাইট পোস্টের গায়ে এভাবেই পাথর ঠুকে শব্দ করে জানান দিত যে তারা পাহারায় আছেন। ধাতব সেই শব্দতরঙ্গ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ত বাসালাইনের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত।
একটা শব্দর সূত্র ধরে ট্রলি লাইনের কথা মনে পড়তেই ভীড় করে আসে আরো কিছু কথা। এককালে ঐ ট্রলি লাইনের ওপরেই ছোটো ছোটো ওয়াগনগুলো চলতো। ফ্যাক্টরি কম্পাউন্ডের শেষপ্রান্তে ছিল কয়লা-ডিপো। সেখানে বাগানের মরিস, শেভ্রলে লরিগুলো দলগাঁও স্টেশন থেকে কয়লা বয়ে এনে পাহাড়ের মতো জমা করে রাখত। ডিপো থেকে হিটার রুম অবধি পাতা ছিল ট্রলি লাইন। পরবর্তীতে কাজলিডাঙায় ওয়াগন উঠে যাওয়ায় লোহার বড় বড় চৌকো বাক্সে কয়লা বোঝাই করে হাতে টানা ট্রলিতে চাপিয়ে নিয়ে এসে ফেলা হতো হিটার রুমে চা-শুকোনোর জন্য । স্টোকার বা 'তাও-ওয়ালা'রা সেই কয়লা বেলচা দিয়ে ঢেলে দিত কোলহিটারে। কালচিনি অঞ্চলের চুয়াপাড়া, মেচপাড়া এসব প্রত্যন্ত চা-বাগানে কয়লা যেত হ্যামিল্টনগঞ্জ স্টেশন থেকে । স্টেশন থেকে লাইন পাতা ছিল বাগান অবধি। রেলের ওয়াগন থেকে কয়লা ছোট ট্রলি ওয়াগনে ঢেলে ডিজেল ইঞ্জিনে টেনে আনা হত বাগান পর্যন্ত। রবিবার হাটের দিনে আবার বাবুরা সেই ট্রলি ওয়াগনে চেপেই হ্যামিল্টনগঞ্জের হাটে যেতেন। ট্রলি লাইন পাতা ছিল বাগানের বিভিন্ন সেকশন থেকে ফ্যাক্টরি পর্যন্তও। সেকশন থেকে পাতা বোঝাই ওয়াগনগুলো ডিজেল ইঞ্জিন টেনে আনত কারখানার ভেতর। এখনও সেই ট্রলি লাইন গুলোর ভগ্নাবশেষ সেসব বাগানে আছে কি নেই সত্যপ্রিয়র জানা নেই।
পরদিন দোলপূর্ণিমার সকালে চলে গেলেন কুমুদরঞ্জন। খবর পেয়ে বিশ্বপ্রিয় সাইকেল চালিয়ে চলে এসেছিল বীরপাড়া থেকে। পরেশ ট্রাঙ্ককলে খবর পাঠিয়েছিল কাবেরীকে। খবর পাওয়া মাত্রই কাবেরী ভাইকে নিয়ে বাসে ওঠে শামুকতলা থেকে। দোলের রঙ পিচকিরি নিয়ে বাসা লাইনের বাচ্চারা বেরিয়েছিল রঙ খেলতে। বিনয়ভূষণ সেসময় নাড়ি দেখে কুমুদরঞ্জনকে মৃত ঘোষণা করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন বাড়ি থেকে। গেটের মুখে বাচ্চাদের দেখে ডেকে বললেন,
' শোনো, তোমরা হয়ত জানো না, তোমাদের মাস্টার দাদু আজ সকালে মারা গেছেন। তোমরা আজকের দিনে যে রঙ খেলতে বেরিয়েছ সেটা কি ভাল হচ্ছে? '
বাচ্চারা কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে থাকে তাঁর দিকে। তারপর একে একে মনখারাপ করে ফিরে যায় বাড়িতে । সরুগাঁও চা- বাগানের মাসতুতো জামাইবাবু চলে এসেছিলেন তার কীর্তনের দলবল নিয়ে। কাজলিডাঙার বাবু-মাঈজিরা এক এক করে আসতে লাগলেন মাস্টার মশায়কে দেখতে। কুমুদের পুরনো ছাত্র, শ্রমিকদের কেউ কেউ শেষ দেখা দেখতে আসেন তাদের মাস্টারজীকে। ছবিলাল খবর পেয়ে সেই সাতসকালে এসে বসেছিল গেটের সামনে। বাঁশ কেটে কখন যেন ও মাচাটা বানিয়ে ফেলেছিল। বিশ্বপ্রিয় কাকে যেন বীরপাড়া পাঠিয়ে দশকর্মার জিনিসপত্র, কাপড় চোপড় সব জোগাড় করে এনেছিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সত্যপ্রিয় দেখে যাচ্ছিল তাকে ছাড়াই সবকিছু কেমন যেন যন্ত্রবৎ ঘটে চলেছে। তাকে কেউ বিরক্ত করছে না। সবাই যেন তাকে পিতৃশোক অনুভব করার অবসরটুকু দিয়ে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
শ্রীনাথবাবু খবর পাঠিয়েছিলেন দাহকার্যের জন্য কাঠের জোগাড় করতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্র্যাকটরে করে শবদাহের কাঠ, পোড়া ডিজেল, পুরনো টায়ার সব এসে যায়। মালবাবু যোগেশ নিজেই সব যোগাড়যন্ত্র করেছিলেন। তুলসিতলায় বাঁশের মাচায় শোয়ানো হয়েছিল কুমুদরঞ্জনকে। জামাইবাবুর কীর্তনের দল খোল করতাল নিয়ে তৈরি। অপেক্ষা করা হচ্ছিল কেবল কাবেরীর জন্য। ও আসতেই অতীন, রমেন, পরেশরা সকলে মিলে শ্মশান যাত্রার তোড়জোড় শুরু করে। হরিধ্বনি দিয়ে উঠোন থেকে মরদেহ তোলা হতেই চারপাশে ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নার শব্দগুলো প্রকট হতে শুরু করে। সবকিছু ছাপিয়ে খেনের-মাসির বুকফাটা চিৎকার হঠাৎ করে বাতাসটা ভারী করে তুলেছিল,
'-হায় হায় রে,..হামাক ছাড়িয়া তোমোরা কুন্ঠে যান দাদাবাবু... তোমাক ছাড়িয়ার আমোরা এলায় কেনং করি থাকমো দাদারে এএএ...'
কুমুদরঞ্জনের শরীরটা ট্রাকে তোলা হলে শ্রীনাথবাবু এগিয়ে এসে বললেন, ' সতু তুমি সামনের সিটে গিয়ে বোসো। বিশ্ব উঠে পড়েছে। আমি একটু বাদে আসছি। '
এগোতে গিয়ে হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ে সত্যপ্রিয়র। মায়ের কাছে যেতে মনটা ছটফট করে ওঠে। ফিরে এসে মায়ের ঘরে ঢোকে সতু। সেই একভাবে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে মা। খেনের-মাসি বাইরে তখনও বিলাপ করে চলেছে। মায়ের পায়ের কাছে ছেলে কোলে কাবেরী দাঁড়ানো। সামনে এসে দাঁড়াতেই হয়ত সন্তানের গায়ের গন্ধ পান সুনয়নী। ধীরে ধীরে মুখ ফেরান । ততদিনে তিনি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। সতুকে দেখে তাঁর ঠোঁটটা শুধু কাঁপে । তারপর গভীর একটা দীর্ঘশ্বাসে বুক ঠেলে উঠে আসে। মেঘলা চোখের দু'কূল ছাপিয়ে উপচে পড়ে জল।
সত্যপ্রিয়র গলার কাছটা ভারি হয়ে আসে। চোখ ঝাপসা হতে থাকে। বাবার মৃত্যুর যতটা না আঘাত অনেকদিন বাদে এত কাছ থেকে মায়ের এই অসহায় জীবন্মৃত অবস্থা দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারে না সত্যপ্রিয়। এগিয়ে এসে মায়ের কোলে মাথা রেখে ভেঙে পড়ে অঝোর কান্নায়।