স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/পর্ব : ২২
রণজিৎ কুমার মিত্র
~~~~~~~~~~~~~~
বর্তমান
পর্বটি যখন আপনাদের কাছে পৌঁছোবে, তখন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ বছর
পূর্ণ, এই পর্বের শুরুতেই বহুশ্রুত রবীন্দ্রবাণী সমবেতভাবে
বিশ্ববিদ্যালয় বন্দনায় গীত হোক :
"বিশ্ব বিদ্যা তীর্থ প্রাঙ্গন করো মহোজ্জল আজও হে ...
এসো কর্মী এসো জ্ঞানী এস জন কল্যাণ ধ্যানী ...
এস হে ধী শক্তি সম্পদ মুক্ত বন্ধ সমাজ হে।"
উত্তরবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারকর্মীর পেশাজীবনে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের
গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপনা সূত্রে এই দুটি বিভাগকে ঘিরে
ছিল আমার স্বপ্নাভিযান। দুটি পর্যায়ে যোগাযোগ হয়েছে বহু মানুষ
অধ্যাপক-অধ্যাপিকা গবেষক আর ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে। অবসর নেবার পরেও এই
দুটি বিভাগের প্রতি আমার আকর্ষণ এতটুকুও কমেনি। সময়ের সাথে সাথে দুটি
বিভাগের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পুরনো অনেক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেছে, নতুনের
অনিবার্যতায়। সেইসব ভালো কি মন্দ হয়েছে তার কোন বিশ্বাসযোগ্য বা
যুক্তিগ্রাহ্য মূল্যায়নের চেষ্টা আমি করছি না, লেখায়-রেখায় 'স্মৃতি
দিয়ে ঘেরা'তে যতটুকু এসে যাচ্ছে তা আমার একান্তই নিজস্ব ও নিরপেক্ষ নিবেদন
মাত্র।
১৯৯০-১৯৯১ বর্ষে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে
লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স বিভাগের সূচনা হয় গ্রন্থাগারিক অজয়
রঞ্জন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে। এই বিভাগের সাথে আমার সংযোগ শুরু হয় কয়েক
বছর পর, দীর্ঘ কুড়ি বছরের বেশি এই বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে
পড়িয়েছি। আমার এই বিভাগে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করবার অনেক আগেই
অজয়বাবু প্রয়াত হয়েছেন, তার শূন্যতা পূর্ণ হয়নি, নতুন এই বিভাগটি সব
সময় তার অভাব বোধ করেছে, শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর কথা স্মরণ করেছে। অজয়
চক্রবর্তীর স্মৃতিতে বি লিব এস সি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপকের
মেডেলটি বিশ্ববিদ্যালয় অজয়বাবুর নামাঙ্কিত করেছে। উত্তরবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিভাগের সাথে নেতাজি সুভাষ
মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিভাগেও অতিথি অধ্যাপক
হয়ে কাজ করেছি বহুকাল। অধ্যাপনা, পরীক্ষক, গবেষণা নির্দেশকের দায়িত্ব
পালন করেছি।এই বিশ্ববিদ্যালয় সাথে এখনো আমার যোগাযোগ রয়েছে। উত্তরবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে অবসর নেবার সাথে সাথেই কাজের সম্পর্কগুলি ছিন্ন হয়ে
গেছে, এখন শুধু আমার স্মৃতিতে বিভাগটি শুধু আনাগোনা করে। তবে আনন্দ হয়
বহু ছাত্রছাত্রীরা এখনো যোগাযোগ রাখেন। এই বিভাগের সফল ছাত্র-ছাত্রীদের
তালিকা সুবৃহৎ, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে স্কুলে, সহকারি
ও বেসরকারি গ্রন্থাগারে আমাদের এই বিভাগটির ছাত্রছাত্রীরা গ্রন্থাগার
বিজ্ঞানের অধ্যাপনায় ও গ্রন্থাগারিকতায় উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের
গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগের গৌরব বাড়িয়েই চলেছেন। অনেকের মুখের ছবি
অস্পষ্ট হয়ে আসছে তবুও সেই সময়কার সব ছেলেমেয়েরাই আজো রয়েছে হৃদয়
জুড়ে ।
শুরুতে
বিভাগটি ছিল সান্ধ্যকালীন। ক্লাস হত কলাবিভাগের ভবনে, বিকেল চারটে থেকে
রাত আটটা। অজয়বাবু প্রয়াত হবার পর বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব সামলেছেন
উপ গ্রন্থাগারিক দিলীপ চৌধুরী ও জ্যোতির্ময় রায়। কখনো কখনো সেই ভার
অর্পিত হয়েছে সহকারি গ্রন্থাগারিক ডক্টর ল্যাডলি রায়ের ওপর। মনোজ রায়,
বৃন্দাবন কর্মকার, মৃগাঙ্ক মন্ডল, হিমালয়ান স্টাডি সেন্টারের ডকুমেন্টেশন
অফিসার জ্যোতিরিন্দ্র মোহন মজুমদার, উপ গ্রন্থাগারিক সৌমিত্র সরকার
,সকলেই এই বিভাগের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।
১৯৯৫ থেকে
টানা কুড়ি বছরের বেশি পড়িয়েছি এই বিভাগে। গ্রন্থাগার ভবন থেকে অবসর নেয়ার
সময়কালীন পর্যন্ত কখনো ছেদ পড়েনি। ওই সান্ধ্যকালীন বিভাগ চলার সময়
থেকে স্থায়ী অধ্যাপক হলেন ডক্টর সপ্তর্শি ঘোষ। তিনি ছিলেন পূর্ণ সময়ের
একমাত্র স্থায়ী অধ্যাপক। তার আগে তিনি আমাদের গ্রন্থাগার বিভাগের সহকর্মী
ছিলেন। অনেক পরে দুজন স্থায়ী অধ্যাপক এই বিভাগটিতে যোগদান করেন একজন
অধ্যাপক তপন বারুই অপরজন অধ্যাপক ময়ুখ বিশ্বাস।
অধ্যাপক
সপ্তর্শি ঘোষ-এর অক্লান্ত পরিশ্রমে বিভাগ সম্প্রসারিত হয়, বি লিবএস সির
সাথে এমলিব এস সি চালু হল। সম্প্রতি পিএইচডি কোর্স চালু হয়েছে। এই সব
কিছুর সাথে রয়েছে সপ্তর্ষির পরিশ্রম ও নিষ্ঠা। আমি ও মনোজ রায়দা সহযোগী
হয়েছি। সেখানে অবশ্য আমাদের জন্য কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপিত ছিল।
গ্রন্থাগারের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্বও মিটিয়ে আমাদের গ্রন্থাগার ও তথ্য
বিজ্ঞান বিভাগের আসতে হত। বিভাগটির সম্প্রসারণের সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ে
সর্বক্ষণের চুক্তিভিত্তিক অধ্যাপক অধ্যাপিকা কয়েকজন যোগ দিয়েছিলেন,
অধ্যাপক জিয়াউর রহমান, অধ্যাপিকা নীলিমা পাল, অধ্যাপিকা সুস্মিতা
চক্রবর্তী, অধ্যাপিকা পুবালিকা ভট্টাচার্য প্রমুখ। স্বল্প সময়ের জন্য
অতিথি অধ্যাপক হয়ে এসেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভুবনেশ্বর
চক্রবর্তী, অধ্যাপক বিপ্লব চক্রবর্তী, যাদবপুর থেকে অধ্যাপক উদয়ন
ভট্টাচার্য, অধ্যাপিকা চৈতালি দত্ত, অধ্যাপক কৃষ্ণপদ মজুমদার প্রমুখ।
এদের মধ্যে সেই সময়ে একজন ছিলেন তৎকালীন উপাচার্য অরুনাভ বসু মজুমদারের
বিশেষ ঘনিষ্ঠ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই হানাদার উচ্চাভিলাষী অধ্যাপক এই
বিভাগটিকে প্রায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগের শাখা
বা প্রায় উপবিভাগ করে ফেলেছিলেন। দুর্যোগের একটা ভয়ঙ্কর পর্ব এই
বিভাগকেও পেরোতে হয়েছে।
মনে
পড়ে, আমারও কিছু দুর্ভোগের কথা। কখনো ওই গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগে, কখনো
গ্রন্থাগারে নিধিরাম সর্দারের মতো আমাকে শীর্ষ পদটির পাদুকা-সিংহাসন রক্ষা
করতে হয়েছে। ভারি মজার একটি শব্দবন্ধ ছিল 'লুক আফটার'!
গ্রন্থাগার
বিজ্ঞান বিভাগে যখনই যতটুকু সময় পেয়েছি উজাড় করে দিতে চেয়েছি
ছাত্র-ছাত্রীদের। আনন্দ পেয়েছি খুব, ছাত্র-ছাত্রীদের সাফল্য ও হাসি মুখ
দেখে। অনেকেই সফল গ্রন্থাগারিক, সফল অধ্যাপক হয়েছেন। কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পরীক্ষিত মন্ডল, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবীণ
কারকি, পঞ্চানন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনয় লামা সাফল্যের সঙ্গে অধ্যাপনা করছেন।
গ্রন্থাগারিক হিসেবেও বহু সফল ছাত্র-ছাত্রীরাও রয়েছেন বিভিন্ন কলেজ ও
সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগারে। অপর্ণা চাঁচল কলেজে, সূর্যসেন কলেজে
শান্তনু, টেকনো ইন্ডিয়ায় পিনাকী, সেন্ট জেভিয়ার্সএ শাশ্বতী, বর্ধমান
বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌমিতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজিব, এরা সকলেই
গ্রন্থাগারিক হিসেবেও যথেষ্ট সফল ও সুনামের অধিকারী। আমাদের নিজেদের
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে এই বিভাগের কয়েকজন প্রাক্তনী, শান্তনু
আছেন আইন মহাবিদ্যালয়ে, অজয় মিশ্র রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে, ডক্টর রত্না
নন্দী শিব মন্দির বি.এড কলেজে। সবথেকে আনন্দের বিষয় প্রফেসর ডক্টর
সপ্তর্ষি ঘোষ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের প্রাক্তনী ও
গ্রন্থ ভবনের প্রাক্তন গ্রন্থাগারকর্মী।
আমার
গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের শিক্ষাদান পর্ব শুরু হয়েছিল আরো অনেক আগে সেসব কথা
না বললে এই পেশা জীবন কথা বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় না। আর আটের দশকে যখন
শিলিগুড়ি মহকুমা জুড়ে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের তীব্রতা চলছে, তখন
উত্তরবঙ্গের একমাত্র গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের সার্টিফিকেট কোর্সের কেন্দ্র
কালিম্পং সেন্টারটি বন্ধ হয়ে গেল, সদ্য লাইব্রেরি বিল পাস হয়েছে,
গ্রন্থাগার কৃত্যক তৈরি হয়েছে, জেলায়-জেলায় সরকারি গ্রামীন গ্রন্থাগার,
শহর গ্রন্থাগারগুলিতে নতুন নতুন পদ তৈরি হয়েছে। হায়ার সেকেন্ডারি
স্কুলগুলিতে লাইব্রেরি খোলার তোড়জোড় শুরু হয়েছে, অথচ গ্রন্থাগার
বিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের সংখ্যা খুব কম সেই সময়ে কলকাতা কলকাতা
বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ উদ্যোগ নিয়েছিল শিলিগুড়িতে একটি সার্টিফিকেট
পর্যায়ের গ্রন্থাগার বিজ্ঞান শিক্ষণ কেন্দ্র খুলবার। অধ্যাপক প্রবীর রায়
চৌধুরীর উৎসাহে বিভাগ খোলা হল শিলিগুড়ির বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদের ভবনে,
শিলিগুড়ি কলেজে ক্লাস হত। কোরস কো-অর্ডিনেটর ছিলেন যাদবপুর
বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের পূজনীয় অধ্যাপক মঙ্গল প্রসাদ সিনহা। স্যার নিজে
এসে আমাদের ডেকে নিলেন এই সেন্টারটির কাজে, ঠিক করে দিলেন কে কোন বিষয়ে
পড়াবেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি, বিজয় ছেত্রী, মনোজ রায় ও
শ্যামল বসাক যোগ দিয়েছিলাম। শিলিগুড়ি বেতারকেন্দ্রে তখন গ্রন্থাগারিক
ছিলেন জয়শ্রী পাল চৌধুরী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের
পাল্লা ভারি ছিল সেই সময়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য গঠিত
হিমালায়ান স্টাডি সেন্টারের ডকুমেন্টেশন অফিসার হয়ে এসেছিলেন যাদবপুর
বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার-এর অশোক বসু, তাকে যাদবপুরের ছাত্র সময় থেকে
চিনতাম। বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদের একনিষ্ঠ কর্মী, কলকাতার সেন্টারে
দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন, অভিজ্ঞ অশোক বসুকে এই সেন্টারের পরিচালনার
দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। অশোকদা অবশ্য বেশিদিন থাকেননি । গ্রন্থাগারিক
বীরেন চন্দ্র এর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এই কেন্দ্রটিকে গড়ে তুলতে এই
মানুষটির অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শ্রদ্ধেয় বীরেনদা , বীরেন চন্দ
ছিলেন উত্তরবঙ্গ গ্রন্থাগার আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ। এই মানুষটি
গ্রন্থাগারিকের পেশাকে কতভাবে যে সম্মানিত ও সম্প্রসারিত করেছেন যা এক
দীর্ঘ ইতিহাস রচনা করেছে। শিলিগুড়ির গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, সাহিত্য
সংস্কৃতির জগতেও বীরেন চন্দ একটি বিশিষ্ট নাম, তাঁর সম্পাদিত উত্তরধবনি
পত্রিকাটি ৫০ বছরে উপনীত। বীরেনদার কাছে গ্রন্থাগারিকতার পেশায় ও তার
পত্রিকার সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায়, সেই কবে থেকে আশ্রয় ও প্রশ্রয়
পেয়েছি। নানা ঘটনা উত্থান-পতন-পরিবর্তনের মধ্যেও মানুষ বীরেন চন্দ একই
রকম আছেন আজো।
অশোক
বসু উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিদিন থাকেননি, কিন্তু তাঁর আন্তর্জাতিক
মানের হিমালয়ান স্টাডিজের গ্রন্থপঞ্জি রয়ে গেছে। তিনি উত্তরবঙ্গ থেকে
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনায় চলে
গিয়েছিলেন। বিভাগীয় প্রধান, বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ডীন
হয়েছিলেন। একেবারে কর্মজীবনের শেষ বেলায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে
গ্রন্থাগারিক হিসেবে যোগ দিলেন। তখন তিনি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রফেসর পদে ছিলেন।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বেলায় যোগ দিয়ে কোনো
অভিমান বা প্রতিজ্ঞা পূরণ করেছিলেন জানি না। অশোকদার স্ত্রী মঞ্জুরি বসু
প্রেসিডেন্সি কলেজের গ্রন্থাগারিক ছিলেন। উত্তরবঙ্গে বসেও আমাদের পেশার
জগতের কলকাতার ও পশ্চিমবঙ্গের এবং পশ্চিমবঙ্গের বাইরের বহু গ্রন্থাগারিকের
সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। পেশাগত সংগঠনগুলি এই যোগাযোগের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ
করত, আজো করে থাকে।
অশোকদার প্রসঙ্গের সাথে আরেকটি
কথা মনে পড়ল আমি কলেজ লাইব্রেরিয়ানের পদ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের
সর্বকনিষ্ঠ গ্রন্থাগার বৃত্তি কুশলী কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম, অনেক
আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে, অশোকদা এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। সাবধান করে
বলেছিলেন , "যত ভালো বৃত্তিকুশলী তুমি হও না কেন, ওই পরিষেবা দেবার জন্য
এবং নিজেকে পরিশুদ্ধ করবার জন্য যত আবেগ তোমার থাকুক না কেন সবই কিন্তু শেষ
অব্দি পদ প্রতিষ্ঠা ও প্রচারে আটকা পড়ে যায়। তোমার বিশুদ্ধ আবেগ
গ্রন্থাগারের জন্য তখন অবান্তর মনে হবে না তো! অনেকেই গ্রন্থাগারের এই
মায়াজালে আটকা পড়ে বিপদগ্রস্ত হয়েছেন। একবার ইসলামপুর কলেজ আরেকবার
শিলিগুড়ি কলেজ অফ কমার্স, কোনখানে মন বসাতে পারিনি, বিশ্ববিদ্যালয়
গ্রন্থাগার আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। চিত্রভানু সেন ও অজয় রঞ্জন
চক্রবর্তীর পরে যারা গ্রন্থাগারের শীর্ষপদে আহরণ করেছেন তারা যেভাবে যে
সিঁড়ি ধরে এগিয়েছেন আমি তা পারিনি। আমি দেখেছি ক্ষমতার অপব্যবহার করে কি
করে পেশা-পরিষেবা দানের দুর্বলতাকে ঢাকতে হয়, তথাকথিত সাফল্য ও
প্রতিষ্ঠিতদের পেছনের অন্ধকার দিকগুলো দেখেছি। জানি, এসব কথাগুলো ফলাও করে
বলা অর্থহীন অবাস্তব ও অবান্তর, তবে পেশাজীবনে আমি তৃপ্ত। যা পেয়েছি যা
দেখেছি তুলনা তার নেই ।
জীবন
সীমার একটা বিশেষ বৃত্তে এসে হয়তো নিজের সত্তার উন্মোচনের আগ্রহ জন্মায়,
নিজস্ব ব্যথা-তাপ-সংশয়-সংঘাতের গোপন আড়ালটি সরে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়
গ্রন্থাগারে ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগে প্রবেশ করে যেসব উপলব্ধি আমার
হয়েছে তা আমার একান্ত নিজস্ব ও ব্যক্তিগত, হয়তো স্মৃতিকথাতে তার বিশেষ
কোনো মূল্য নেই।তবে আমার নিজের মনে হয়েছে, ব্যক্তিটি কে নয় তার সময়টাকে
উপলব্ধির জন্য অন্তত সেই ব্যক্তি মনের বন্ধ জানালাটা খুলে দিতে হয়।