বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং-২২/রূপন সরকার
বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং
পর্ব-২২
ড. রূপন সরকার
শিক্ষার মতো খেলাধুলোকেও ভারতীয়দের ইংরেজিকরণের (Anglicization) মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসকেরা। ইউরোপীয় খেলাধুলোর মাধ্যমে পশ্চাত্য মূল্যবোধ ও সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে বলিষ্ঠ শরীর গড়ে তোলাই ছিল সাহেবদের মূল লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই ইউরোপীয় খেলাধুলো যেমন ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদিকে বিদ্যালয় শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দার্জিলিং শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে আবাসিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে ইউরোপীয় খেলাধুলোকে জনপ্রিয় করে তোলা হয়। ইউরোপীয় খেলাধুলোর মাধ্যমেই পাশ্চাত্য নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই সরকারি ও মিশনারি স্কুল, কলেজর, বিভিন্ন ইউরোপীয় খেলাধুলো সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে দার্জিলিং সেন্ট পলস্ স্কুলের কথাই তুলে ধরা যেতে পারে। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৬৪ সালে প্রাথমিক ও জুনিয়র হাই বিদ্যালয় হিসেবে। নিয়মানুবর্তিতার জন্য স্কুলটি প্রসিদ্ধ। এই স্কুলের প্রতিটি বাচ্চা একটি করে নির্দিষ্ট খেলাধুলো প্রতিদিন ১ ঘন্টা করে, সপ্তাহে মোট পাঁচ ঘন্টা খেলবে একজন প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অধীনে।
শুধুমাত্র স্কুল নয়, দার্জিলিং শহরে পাশ্চাত্য খেলাধুলোকে জনপ্রিয় করতে ইউরোপীয় প্রশাসক, চা-বাগান মালিক সহ অন্যান্যদের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অবসর সময়ে দার্জিলিং শহরে কাটাতে আসা ব্রিটিশ নাগরিকদের কাছে থাকতো অফুরন্ত সময়। সারাদিন শুয়ে, বসে কাটানো ছিলো কষ্টকর। এই সময় তারা খেলাধুলো করে সময় কাটাতেন। তারা প্রথমে ক্রিকেট, পোলো, লংটেনিস, ব্যাডমিন্টন, গল্ফ, হকি ইত্যাদি পাশ্চাত্য খেলা শুরু করেন। পরিবর্তীতে ফুটবল, ভলিবল খেলাও শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে শহরে তিনটি আউটডোর খেলার মাঠ ছিল। একটি ব্রিক হিল পার্কে, দ্বিতীয়টি, গভর্নমেন্ট হাউসের কাছে, এবং তৃতীয়টি লেবং-এর রেসকোর্সের মাঠ। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন সময়ে এই মাঠগুলিতে খেলাধুলো হতো। জিমখানা ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৯ সালে British Planters Association - এর হাত ধরে। গল্ফ, পোলো ইত্যাদি পাশ্চাত্য খেলাধুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ক্লাবটিতে। নানা রকম জনকল্যাণকর কাজের জন্য ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গোর্খা দুঃখ নিবারক সংঘ। জনকল্যাণকর কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম খেলাধুলো বিশেষকরে ১৯৫২ সাল থেকে একটি ভলিবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। মেয়েদের জন্য পেমা দোমা ট্রফি, দুলিচাঁদ আগরওয়াল ট্রফি এবং ছেলেদের জন্য এসডি লামা কাপ ছিল দার্জিলিং ছাত্র সমাজের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। ব্রিটিশদের পাশাপাশি বাঙালি জমিদার শ্রেণি তথা অভিজাতদের কাছেও অচিরেই দার্জিলিং হয়ে ওঠে ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন। গান্ধী-রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সি.আর. দাস বিবেকানন্দ তৎকালিন বঙ্গ সমাজের প্রতিনিধিরা প্রায় সবাই দার্জিলিং-এ সময় কাটিয়েছে। ব্রিটিশদের পাশাপাশি কোচবিহার রাজা থেকে বর্ধমানের রাজা সক্কলে মিলে দার্জিলিং শহরেকে Vibrant শহরে পরিণত করে। প্রতিষ্ঠিত হয় এক ইউরোপীয় - ভারতীয়' এক মিশ্র সংস্কৃতি। গড়ে ওঠে একের পর এক ক্লাব, টাউন হল, টেনিস কোর্ট ইত্যাদি। ইউরোপীয়দের হাত ধরে ক্লাব সংস্কৃতির সাথে সাথে চলে আসে থিয়েটার, বল ড্যান্স, কনসার্ট ইত্যাদি। দূর্গাপুজা সহ ছুটির মরসুমে ইউরোপীয়রা পরিবার সহ দার্জিলিং - এ সময় কাটাতে আসেন এবং নানা রকম বিনোদনমূলক কর্মকান্ডে যুক্ত হতেন। ইউরোপীয়দের মধ্যে ঘোড় দৌড়, জুয়া খেলা ছিল বেশ জনপ্রিয়। ভারতীয় পর্যটকরাও এই সমস্ত খেলা দেখতে পছন্দ করতেন। ইন্ডোর খেলার জন্য ক্লাবের মধ্যে কার্ড রুম, বিলিয়ার্ড রুম ইত্যাদি খেলার জায়গা আলাদা আলাদা থাকতো। প্রথমদিকে না হলেও পরের দিকে সাহেবরা ছাড়াও ভারতীয় রাজা-জমিদার এবং অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিরা এই সমস্ত ক্লাবের সদস্য হতে পারতেন। দার্জিলিং - এর লেবং রেসকোর্স ক্লাব ছিল তেমনই একটি ক্লাব, যা সাহেবদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৮৬৮ সালের পর যখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ করা শুরু হয় তখন কিছু চা বাগান মালিক মিলে দার্জিলিং প্ল্যান্টার্স ক্লাব প্রতিষ্ঠিত করে। ব্রিটিশরা বন্দুকবাজী ও মাছ ধরা পছন্দ করতেন এবং এ কারণেই তারা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন দার্জিলিং Shooting & Fishing Club. এছাড়া ১৯০৫ সালে দার্জিলিং গল্ফ ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। দার্জিলিং জিমখানা ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৯ সালে।
১৯৭০ সালে দার্জিলিং জেলা ক্রিড়া সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, পরিবর্তীতে এই সংস্থার নাম পাল্টে রাখা হয় 'গোর্খ পার্বত্য ক্রীড়া সংস্থা'। এই সংস্থার অধীনে নানা ধরনের প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলোর আয়োজন করা হয়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
