বাগানিয়া জার্নাল-২২
বাগানিয়া জার্নাল – তৃতীয় ভাগ
পর্ব।। ছয়।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
[জার্নালের তৃতীয় ভাগ মূলত প্রায় দুশ বছর পিছনের ইতিহাস। তথ্যের জন্য তাই নির্ভর করতে হচ্ছে নানারকম বইপত্রের ওপর। লেখা শুরু করার সময় সেসব বইপত্রের বেশীরভাগই ছিল Secondary Source। এখন কিছু Primary Source হাতে আসছে। তাতে দেখা যাচ্ছে যে প্রাথমিক তথ্যে যা ছিল ‘রাম’ তা ক্রমশই পালটে পালটে পরবর্তীতে কখনও হয়েছে রমা, কখনও রামা, কখনওবা রোমা। উদাহরণ দেওয়া যাক।
কিছু কিছু Secondary Source বলছে ড. ওয়ালিচ আসাম চা-বীজের পক্ষে এবং ড. গ্রিফিথ চিনা চা-বীজের পক্ষে; আবার চা-চাষের ক্ষেত্রে ড. ওয়ালিচ অব-হিমালয়ে এবং ড. গ্রিফিথ আসামের পক্ষে। কিছু Secondary Source আবার এর একদম বিপরীত কথা বলছে।
কিন্তু Primary Source থেকে বোঝা যাচ্ছে পক্ষে-বিপক্ষে সরাসরি এত আড়াআড়ি ভাগ ছিল না – এরমধ্যে প্রচুর ধাপ ও মোচড় আছে যেসব তথ্যকে Secondary Source-গুলো হিসেবে নেয়নি।
তথ্যের জন্য পঞ্চম পর্ব পর্যন্ত নির্ভর করা হয়েছে Secondary Source-এর ওপর। এখন থেকে Primary Source হিসেবে সরাসরি নেওয়া হচ্ছে সে সময়ের সরকার, টি-কমিটি এবং সংশ্লিষ্ট মানুষজনের সরকারি-নথিভুক্ত (recorded) চিঠি-পত্র, রিপোর্ট ইত্যাদি।
সুতরাং পঞ্চম পর্ব পর্যন্ত যা বলা হয়েছে আগামী পর্বগুলোতে তার মধ্যে কিছু অসঙ্গতি দেখা যেতে পারে। আশাকরি পাঠকেরা বিষয়টির জটিলতা উপলব্ধি করবেন।]
#
বিজ্ঞানী সমীক্ষক দলটি কিছুদিন একসঙ্গে ঘোরার পর ভাগাভাগি হয়ে যায়। ড. গ্রিফিথ চলে যান মিশমি পর্বত অঞ্চলে সেখানকার উদ্ভিদ নিয়ে সমীক্ষা করার জন্য। বাকী দুজন সিংফো অধ্যুষিত বিসা-র দিকে। পরে ড. ম্যাকক্লিল্যান্ড, যিনি মূলত ভূতাত্ত্বিক, জোড়হাট থেকে আবার আলাদা হয়ে চলে যান মিকির পর্বতের দিকে – সে অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষার জন্য।ড. ওয়ালিচ তার চায়ের সমীক্ষা শেষ করে ফিরে আসেন কলকাতায়।ড. গ্রিফিথ মিশমি হিলের সমীক্ষা শেষ করে ফেরার পথে আবার আসেন আসামে ।
কলকাতায় ফিরে ড.ওয়ালিচ চার্লস ব্রুস সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি লেখেন - আসামে চা-চাষের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন একজন সত্যিকারের উপযুক্ত মানুষকে দায়িত্ব দেওয়া। আমি বিশ্বাস করি যে এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা, উৎসাহ এবং শারীরিক দক্ষতার দিক থেকে চার্লস ব্রুস-এর মতন যোগ্যতম দ্বিতীয় মানুষ খুঁজে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। এবং আমি অত্যন্ত জোরের সঙ্গে টি কমিটিকে সুপারিশ করছি যেন ব্রুসকে আসামের চা-জঙ্গলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। চার্লস ব্রুস অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাটক এবং গাব্রু অঞ্চলের চা-গাছ খুঁজে বার করেছেন। তার দীর্ঘদিন আসামে বসবাস, সেখানকার এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অনেক জনজাতির সামাজিক আচার-ব্যবহার, প্রথা, ভাষা, সংস্কার সম্পর্কে তার অন্তরঙ্গ পরিচিতি, আমাদের সবার চেয়ে উৎকৃষ্ট নৈতিক-চরিত্র, আর তার অসাধারণ শারীরিক শক্তি যা তাকে বর্ষাকালের ভয়ঙ্করতম জঙ্গল - যে সময়ে কারো পক্ষে সেই জঙ্গলের সঙ্গে যুঝতে যাওয়াটা মৃত্যুর মতো মারাত্মক - তার সঙ্গে লড়াই করার সামর্থ জোগায়। এই সমস্ত গুণগুলোকে একসঙ্গে বিচার করলে আমাদের চা-কাজের দায়িত্বের পক্ষে সে-ই যোগ্যতম ব্যক্তি।
ওয়ালিচ সাহেব আরও প্রচুর প্রশংসা করার পর লিখেছেন যে ব্রুসের ব্যক্তিগত সাহায্য ছাড়া তাদের পক্ষে এই বিপজ্জনক সীমান্ত-অঞ্চলে প্রায় কোন সমীক্ষা করাই সম্ভব ছিল না। ব্রুস ইতিমধ্যেই চা-নার্সারীর কাজটা সামলেছেন এবং এখানকার সব অঞ্চলের সারা বছরের আবহাওয়াতেই মানিয়ে নিয়েছেন। সুতরাং ব্রুস এ ব্যাপারে অন্য যে কোন লোকের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে - তা সেই লোক যতই গুণী-জ্ঞানী হোক না কেন; আর তাকে সম্ভবত পাঠানো হবে কলকাতা থেকে - সেক্ষেত্রে তিনি খুব তাড়াতাড়িই আসাম-জঙ্গলের মারাত্মক ক্ষতিকারক দিকটা টের পেয়ে যাবেন।
সে সময়ে উত্তর-পূর্ব সীমান্তে গভর্নর-জেনারেলের প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন এফ.জেনকিনস্ও চার্লসকে চা-নার্সারীর দায়িত্ব দেবার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ড. ওয়ালিচকে সমর্থন করে তিনি লেখেন ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, যে কোনো ভাবেই হোক তার (চার্লসের) সাহায্য আমাদের নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।আমি এ কথা বলছি না যে তাকে ছাড়া আমাদের (চায়ের) কাজ অন্য লোককে দিয়ে হবেই না – তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে সেক্ষেত্রে কাজটা ঢিলে ও বাধাপ্রাপ্ত হবে।‘
ড. ওয়ালিচ ও ক্যাপ্টেন জেনকিন্সের সুপারিশ মোতাবেক টি কমিটিও সরকারকে চা-নার্সারী ও দেশি চা নিয়ে পরীক্ষামূলক কাজকর্মের সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে চার্লসের নিয়োগের জন্য সরকারকে সুপারিশ করে। এবং ব্রুস ‘সুপারিনটেন্ডেন্ট অফ টি কালচার’ হিসেবে নিয়োজিত হন।
ওদিকে ড.গ্রিফিথ তার সফর থেকে ফিরে রিপোর্ট পেশ করেন। তাতে তিনি জানালেন যে আসামের চা গাছকে চিনা চা গাছের সঙ্গে পরাগ-মিলন ঘটিয়ে উন্নততর করে নিলে ভাল চা-গাছ পাওয়া যাবে। এজন্য যার তত্ত্বাবধানে এই কাজ হবে তার মাথায় গোটা পরিকল্পনাটা থাকতে হবে। এখন এই জাতীয় যে কোন কাজের দায়িত্ব যার ওপর থাকবে তার কিছু পরিমাণ হাতে-কলমে কাজ করার ব্যবহারিক জ্ঞান থাকতে হবে। এবং তার সঙ্গে যদি কিছুটা তাত্ত্বিক জ্ঞানও থাকে তাহলে সাফল্যের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাহলে এখন এ প্রশ্ন করা যেতেই পারে যে এখানকার বর্তমান সুপারিন্টেন্ডেন্ট মি. ব্রুস কী ভাবে এই দুটো যোগ্যতায় উৎরাচ্ছেন? প্রশ্নটা আক্রমণাত্মক মনে হতে পারে, বিশেষ করে তাদের কাছে যাদের আসাম অপরিচিত, কিন্তু উত্তরটা পরিষ্কার; প্রকৃতপক্ষে মি. ব্রুসের প্রতি সুবিচার করেই আমি বিশ্বাস করি যে এ দুটো গুণের কোনটারও অধিকারী বলে মি.ব্রুস নিজেও ভাণ করেন না। একজন প্রবল উৎসাহী, কঠোর পরিশ্রমী মানুষ হিসেবে মি.ব্রুস সবাইকে ছাপিয়ে গ্যাছেন; এবং তার এইসব গুণের সঙ্গে তিনি যোগ করেছেন উচ্চ-আসামের জনজাতির সঙ্গে তার চলনসই পরিচিতি, আসামের ভাষা, এমনকি নীচুতলার লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলার মতো কথ্যভাষার জ্ঞান এবং প্রচন্ড শারীরিক শক্তি।
তবে জাভার চা-সুপারিন্টেন্ডেন্টের সঙ্গে আসামের চা-সুপারিন্টেন্ডেন্টের তুলনা করলে বলার মতো কোন উত্তরই থাকে না। জাভার মি. ডিয়ার্ড (Diard) একজন প্রখ্যাত প্রকৃতিবিদ যিনি নিঃসন্দেহে সেখানকার চা-চাষের সাফল্যের পিছনে প্রচুর অবদান রেখেছেন। আর আমাদের এখানে পুরো কাজটা এমন একজন মানুষ দেখভাল করছেন যিনি বড় হয়েছেন নাবিক হিসেবে এবং আসামে তার দীর্ঘ বসবাসের পুরো সময়টাই কেটেছে তার নিজের ব্যবসার ধান্ধায় আর গানবোট পরিচালনায়।
ওপরে সুপারিন্টেন্ডেন্টের যে দুটো গুণ থাকার কথা বলা হল তা আমার কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং চা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে একমাত্র আবশ্যিক।তার অবশ্যই হর্টিকালচার এবং আর্বোরিকালচার সম্পর্কে হাতে-কলমের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাত্ত্বিক জ্ঞানও থাকতে হবে। সেরকম লোক যদি এখানে না পাওয়া যায় তবে ইংল্যান্ড থেকে আনানো যেতে পারে।আসামের অস্বাস্থ্যকর জলবায়ু নিয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে তার কোন ভিত্তি নেই, বিশেষকরে ইউরোপীয়দের জন্য; এসব ভীরু-দুর্বল লো্কেদের কথা যারা ধারালো ঘাস দেখলেই মনে করে মৃত্যুবাহী ছোরা।
সুতরাং তেমন একজনকে চা-পরীক্ষা নিরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হোক; ব্রুসকে তার অধীনে ছোটখাট কাজের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
ভাগ্যিস টি কমিটি কানে নেয়নি সে কথা। নইলে ভারতের চা-শিল্পের সূচনা যে আরও কত বছর পিছিয়ে যেত কে জানে...
---------------------------------------------------------
ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴