তুনবাড়ি চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
তুনবাড়ি চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^
সত্যিই কি প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট শ্রমিক সুরক্ষার জন্য? ন্যূনতম মজুরীর দাবিতে যখন দিনের পর দিন চা শ্রমিকদের অবস্থান, বিক্ষোভ, গেট মিটিং বা স্ট্রাইক বা লকআউটের ঘটনা দেখি বা শুনি তখন ঠিক আই প্রশ্নটাই মাথাচাড়া দেয়। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে শ্রমিক সংগঠনগুলোর। চা শিল্পে প্রত্যেক বছর মজুরী এবং বোনাসের প্রশ্নে শ্রমিক মালিক বিরোধ নিত্য ঘটনা। মালিকেরা ন্যায্য মজুরী নিয়ে অযথা ঢিলামি করে বলে অভিযোগ
শ্রমিকদের। সরকারের ভূমিকাও শ্রমিক স্বার্থের পরিপন্থী বলে তারা অভিযোগ করে। শ্রমিকদের দাবি ন্যূনতম মজুরী, অন্যদিকে মালিকদের বক্তব্য চা শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে যতটা, ততটা বাজার দর পাওয়া যাচ্ছে না। শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হলে প্রতি বছর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিক মহলে। দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়, সময়ে সময়ে ত্রিপাক্ষিক। তারপর জোড়াতালি দিয়ে একটা মুখরক্ষার চুক্তি হয় এবং শ্রমিকদের তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। প্রশ্ন জাগে মজুরী এবং বোনাসের প্রশ্নে শ্রমিক মালিক বিরোধ কি কমবে না? একথা ঠিক যে কঠিন সময়ের মুখোমুখি উত্তরের চা শিল্প। ইন্ডিয়ান টি এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী জেনারেল অরিজিত রাহার কাছ থেকে জেনেছিলাম উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া সহ নানা ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি হলেও গত কয়েকবছর ধরে বাড়ছে না চায়ের দাম। ফলে চরম দূর্দশার মধ্য দিয়ে চলছে চা শিল্প। চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। ন্যায্য বেতনের দাবিতে আন্দোলনের মাঠে রয়েছে ফ্যাক্টরির বাবু ক্লার্ক সহ অফিস স্টাফেরা। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভুখা মিছিল এর ডাক দিয়েছিল কোন কোন শ্রমিক সংগঠন। এমন পরিস্থিতিতে মজুরি এবং বেতন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের একটা মহল সক্রিয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চা শিল্পপতিরা চলছেন বলে দাবি শিল্পপতিদের।
পরিস্থিতি ঘোরালো হয়েছিল ২০২০ সাল থেকে যখন লকডাউন হয়েছিল করোনাকালীন পরিস্থিতিতে। এক ভয়ঙ্কর সময়কাল এসে উপনীত হয়েছিল চা বাগিচা শিল্পে। ঠিক সেই সময়ে লকডাউন শুরুর সময়কালে আমি ছিলাম মালবাজারে। এসেছিলাম তুনবাড়ি চা বাগানে। দেখেছিলাম এবং বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম বাগিচা বৃত্তান্ত। ক্যালটাস্ক মোড় থেকে রিশি রোড হয়ে রওনা দিলাম তুনবাড়ি টি কোম্পাণী পরিচালিত তুনবাড়ি চা বাগান। রিশি রোড থেকে লাভা রোড ধরে অল্প গিয়ে তুনবাড়ি মোড়। তুনবাড়ি চা বাগান ডুয়ার্সের সমস্যাদীর্ণ চা বাগানগুলির মধ্যে একটি। মালিক আসে আর যায় কিন্তু তুনবাড়ির সমস্যা যেন আর শেষ হতে চায় না। অজস্র শিশু, শিরীষ, শিমূলগাছের ছায়ায় ঝলমলে প্রকৃতি, পেছনে নীলাভ পাহাড় অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা নিয়ে দন্ডায়মান। চা বাগান, পাহাড় এবং অরণ্যের পথে ফুরফুরে দক্ষিণা হাওয়ায় খুশির মেজাজে হেঁটে চলা যায় সামনে। তবে ক্ষেত্রসমীক্ষায় রবিবার চা বাগানে এসেছিলাম বলে বাগিচা প্রায় ফাঁকা। রবিবার চা বাগান বন্ধ থাকলে শুনশান চা বাগিচার পথ। মালবাজার সাব ডিভিশনের তুনবাড়ি চা বাগানটির পরিচালক গোষ্ঠী তুনবাড়ি টি কোম্পাণী লিমিটেড। ডাইরেক্টর নারায়ণ সিং, সহদেব সিং মেহেরওয়াল। ২০২১ সাল থেকে মুশকান মিত্তাল, শিবম মিত্তাল বোর্ড অফ ডিরেক্টর হিসাবে বাগানটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পাণী হিসাবে পরিচালনা করে আসছেন। বাগানটি ২০০৭ সালে এই কোম্পাণীর হাতে আসে। বাগানটি ডিবিআইটিএ সংগঠনের সদস্য। তবে ক্ষেত্রসমীক্ষার সঙ্গে সাম্প্রতিক তথ্য না মেলার সম্ভাবনা বেশি। কারণ সমীক্ষা করা হয়েছে অনেকদিন আগে। সাম্প্রতিক সফরে তুনবাড়ি গেলেও রবিবার বলে কাউকে পাইনি। তবে ঘটনাচক্রে মালবাজারে পেয়ে গিয়েছিলাম ট্রেড ইউনিয়ন লিডার মণিকুমার দার্ণালকে। ডুয়ার্সে ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্ট এবং চা এবং বাবু শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির লড়াইয়ের ঘাত প্রতিঘাত নিয়ে অনেক তথ্য পেলাম যা তুলে ধরছি তুনবাড়ির বাগান সমীক্ষাতে। তবে তার আগে বাগানের পরিকাঠামো সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা জরুরী।
তুনবাড়ি বাগানটির আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদীক্ষেত্র, সেচ এবং ড্রেনের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ১৫৯.৪৩ হেক্টর। এক্সটেন্ডেড জমির পরিমাণ ১৫৩.৪৩ হেক্টর। সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে প্রতি হেক্টর জমি পিছু ১৮০০ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। বাগানে নিজস্ব চা পাতা উৎপাদনের গড় ১০—১২ লাখ কেজি। ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব মোট বাৎসরিক উৎপাদিত ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা ২-৩ লাখ কেজি। বাগানটি এমজিএনআরইজিএস এর সুবিধা পায়। বাগিচায় ব্যাক্তিগত ইলেক্ট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ৩৪ টি। সেমি পাকা বাড়ি ২২, অন্য বাড়ি ১১০। মোট শ্রমিক আবাস ১৬৬ টি। মোট শ্রমিক ৩৩৫ জন। বাগানে শতকরা ৪৯ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। বাগিচায় শৌচাগারের সংখ্যা ৫০ টি। তুনবাড়ি চা বাগানে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৩ জন। সাব স্টাফের সংখ্যা ১০ জন। করণিক ৫ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ১১৯। স্থায়ী শ্রমিক ২৮৮ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৪২ জন ধরে মোট কর্মরত শ্রমিক ৩৩৫ জন। শাসকদলের ট্রেড ইউনিয়ন ছাড়া কোন নেতাকে বা অন্য ট্রেড ইউনিয়নের কাউকেই চোখে পড়ল না কথা বলার জন্য। বাগিচা অফিসে গিয়ে উদ্দেশ্য জানাতে প্রথমে তথ্য দেওয়া নিয়ে গড়িমসি করছিলো অফিস স্টাফেরা এবং ম্যানেজারের অনুপস্থিতিতে সহকারী ম্যানেজার। পরে পরিস্থিতি আয়ত্তে আসে। তুনবাড়ি চা বাগিচায় হাসপাতাল নেই, ডিসপেনসরি আছে। প্রশিক্ষিত নার্স, ডাক্তার কোনো কিছুই নেই। মিড ওয়াইভসও নেই। কম্পাউন্ডার আছেন একজন। ১ টি আউটার ডিভিশন ডিসপেনসারি আছে। বাগিচার হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স আছে। ক্রেশের সংখ্যা একটি। ক্রেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা নেই। শৌচালয় অপরিচ্ছন্ন, দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার ক্রেশের শিশুদের কাছে স্বপ্ন। শিশুদের পোশাক সরবরাহ করা হয় না। ক্রেশে মোট অ্যাটেন্ডেন্ট ৩ জন। পর্যাপ্ত পাণীয় জল ক্রেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করা হয় না। এককথায় নেই রাজ্যের বাসিন্দা তুনবাড়ি চা বাগিচার শ্রমিক কর্মচারীরা।
লকডাউন যখন শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের মার্চ মাসে তখন চায়ের ছিল ভরা মরসুম। চা কে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যসামগ্রীর তালিকাভুক্ত করে পাতা তোলার ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু রাজ্য সরকার সেই ছাড় এখানকার চা-বাগানে বাড়তি সতর্কতাজনিত কারণে চালু করেনি। তাই কেরল, তামিলনাড়ু এবং অসমে চা পাতা তোলার কাজ চলতে থাকলেও এই রাজ্যে তা হয়নি। কেন্দ্র চা বাগিচায় একসঙ্গে ৫০ শতাংশ শ্রমিককে কাজে যাওয়ার অনুমতি দিলেও রাজ্য প্রথমে দিয়েছিল মাত্র ১৫ শতাংশ শুধুমাত্র কীটনাশক ছড়াতে, পাতা তুলতে নয়। পরবর্তীকালে অবশ্য শ্রমিক সংখ্যা ২৫ শতাংশ হিসাবে অনুমতি দেওয়া হয়। চা শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত মালিকপক্ষের সংগঠনগুলোর দাবি ছিল অন্যান্য রাজ্যের মত এই রাজ্যেও ৫০ শতাংশ শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোর। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নি স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কারণেই এবং সামগ্রীকভাবে এই সিদ্ধান্ত উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে সঠিক ছিল। এই সময়কালে কেন্দ্রীয় সরকার জানায় ২০ এপ্রিল থেকে চা শিল্প সংক্রান্ত এবং পরিপূরক অনুসারী শিল্পক্ষেত্রে একাধিক ছাড় দেওয়া হবে। আশাবাদী হল ডুয়ার্সের চা শিল্প যে এর জেরে হয়তো চা শিল্পের ওপর ঘনীভূত সংকটের অনেকটাই লাঘব হতে পারে। কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রীর প্রতি উত্তরবঙ্গের মানুষের আশা ভরসা থেকেই আবেদন উঠলো উত্তরবঙ্গ থেকে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। তার একাংশ খরচ হোক মালিক তথা শ্রমিক-কর্মচারীদের বাঁচাতে। অন্তত এই ভয়ঙ্কর দূর্দিনে। পাহাড়েই হোক, বা তরাই অথবা ডুয়ার্সে প্রশ্ন উঠে গেল এবার কি তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিসর্জন দিতে হবে প্রথম ফ্লাশের চা কে? কারণ লকডাউন পরিস্থিতিতে দেখা গেল সামগ্রীকভাবে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স, তরাই এবং দার্জিলিংয়ের চা বাগিচা শিল্প এবং শ্রমিকদের বাঁচাতে হলে বিশাল বড় মাপের আর্থিক প্যাকেজ চাই।
২০২০ সাল থেকে বাজার খারাপ থাকায় উত্তরবঙ্গের চা শিল্পে ধাক্কা লাগার অভিযোগ আগেই তুলেছেন বাগান মালিকেরা। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছিলেন চা বাগান মালিকদের একটি অংশ। চা বাগানের ব্রিটিশ আমলের পুরনো গাছ তুলে নতুন বাগান তৈরির জন্য কিছু কেন্দ্রীয় অনুদান পান বাগান মালিকরা। তা ২০১৫ সাল থেকে বকেয়া রয়েছে বলে দাবি তাঁদের। বাগান মালিকদের অভিযোগ ছিল দার্জিলিং, তরাই, ডুয়ার্স মিলিয়ে একাধিক বাগানে উৎপাদনের তুলনায় রফতানি কমছে। টিপার সভাপতি মহেন্দ্র বনসলের সেই সময়ে অভিযোগ ছিল “অসম মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশের অংশীদার। অথচ, বাগানের জন্য কেন্দ্রীয় বরাদ্দের প্রায় ৮০ শতাংশ সেখানে যাচ্ছে। অথচ উত্তরবঙ্গে একের পর এক চা বাগান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেখানে কেন্দ্রীয় অনুদান বাকি ২৫০ কোটি টাকা”। ২০১৮-২০১৯ সালে ডুয়ার্সের চা ১১৫ টাকা এবং তরাইয়ের চা ১১২ টাকা প্রতি কেজি হিসাবে বিক্রি হয়েছিল। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে ডুয়ার্সের সিটিসি প্রতি কেজি নিলাম হয়েছে গড়ে ১৭২.২৩ টাকায় এবং তরাইয়ের সিটিসি বিক্রি হয়েছে ১৪৫ টাকা প্রতি কেজি। ডুয়ার্সের বটলিফ ১১৩ টাকা এবং তরাইয়ের বটলিফ বিক্রি হয়েছে ১১৩.৫০ টাকা প্রতি কেজি। অর্থাৎ গত আর্থিক বছরের থেকে সেই বছর বাজার দর ছিল বেশি এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে চা শিল্পপতি তথা সিআইআইয়ের নর্থবেঙ্গল জোনের চেয়ারম্যান আনন্দকুমার আগরওয়ালের বক্তব্য কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাঁর বক্তব্য ছিল নিলামের দর দিয়ে সমস্ত কিছু যাচাই করা ঠিক হবে না। উৎপাদন খরচ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। লকডাউন পরিস্থিতিতে পরিস্থিতি ভয়াবহ। ফলে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলছে চা শিল্প। কার্যত একই দাবি করে নর্থবেঙ্গল টি প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রবীর শীল বলেন, “গুণগতমান বজায় রাখার ক্ষেত্রেই খরচ বেড়ে গিয়েছে। বাজার নষ্ট হয়েছে অন্য দেশগুলি চা বাজার ধরে নেওয়াতেও”। শ্রমিক সংগঠনগুলি অবশ্য আন্দোলনের রাস্তা থেকে সরতে নারাজ।
প্রশ্ন জাগে প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট কি সত্যিই শ্রমিক সুরক্ষার জন্য? বাস্তবে চা শিল্পে আছে রাজনীতির সাপলুডো। তরাই ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (টিপা) এর অন্তর্ভুক্ত বাগান মালিকদের দাবি ছিল কেন্দ্রের বঞ্চনা, টি বোর্ডের উদাসীনতায় বন্ধ বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি পাঠানো হয়েছে, বিজেপির সাংসদদের কাছে এই নিয়ে একাধিকবার অভিযোগ জানানো হয়েছে। এরপরেও কোনও ফল হয়নি। মালিক সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ কনসালটেটিভ কমিটি অফ প্ল্যান্টেশন অ্যাসোসিয়েশন করোনাজনিত পরিস্থিতিকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে স্পেশাল প্যাকেজ চেয়েছিল। তারা জানিয়েছিল করোনাজনিত পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন না ঘটলে চরম সমস্যায় পড়তে হবে শিল্পপতি থেকে শ্রমিকদের। ২০২০ সালের বোনাসের সময় অসমের চা মালিকরা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন পূজো বোনাসের পরিমাণ কমছে। কেউ কেউ আবার একধাপ এগিয়ে বোনাস আইনের সর্বনিম্ন যে ৮.৩৩ শতাংশ হারের কথা বলা হয়েছে তার বেশি দেওয়া সম্ভব নয় বলেও ঘোষণা করেছিলেন। উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রেও চা মালিকদের সংগঠনগুলি পূজো বোনাস নিয়ে বৈঠকের আগে সেই বিপন্নতারই ধুয়ো তুলে গতবারের হারে সেবার বোনাস দেওয়া সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছিলেন। বোনাস ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে ব্যাঙডুবিতে ইন্ডিয়ান টি এসোসিয়েশনের তরাই শাখার অফিসে বৈঠকে বসেছিল চা মালিকদের শীর্ষ সংগঠন। সেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার পর দেখা যায় বহু বাগান আর্থিক ক্ষতিতে চলছে। উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, অথচ তৈরি চায়ের দাম সেই একই জায়গায় স্থির। অসমের পরিস্থিতি থেকে উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি আলাদা কিছু ছিল না। তাই অন্যান্য বছরের মতো বোনাস দেওয়ার ক্ষমতা বাগানগুলির ছিল না। চা মালিকদের সংগঠন টি অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার রাম অবতার শর্মা বলেন, চা শিল্প যে গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
বড় চা বাগানগুলির পাশাপাশি ক্ষুদ্র বাগানগুলিও জানায় তাদের শ্রমিকদের গতবারের মতো বোনাস দেওয়া সম্ভব হবে না। জলপাইগুড়ি জেলা ক্ষুদ্র চা চাষী সমিতির সভাপতি বিজয়গোপাল চক্রবর্তীর কথায়, টি বোর্ড প্রতি মাসে কাঁচা পাতার ন্যূনতম বেঞ্চমার্ক দাম ঘোষণা করে দেওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে কিন্তু তা মেলে না। যেখানে টি বোর্ড নির্ধারিত দাম পাওয়া উচিত সেখানে মিলছে ১০ টাকা থেকে ১২ টাকা। ফলে ক্ষতি হচ্ছে প্রচুর। শ্রমিক সংগঠনগুলো মালিকদের এসব কথাকে বাৎসরিক কান্নাকাটি হিসাবেই দেখে। জয়েন্ট ফোরামের অন্যতম আহ্বায়ক অলক চক্রবর্তীর মত ছিল লকডাউন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে চা রপ্তানি বন্ধ থাকায় চাহিদা কিছুটা হলেও মার খেয়েছে এতে সন্দেহ নেই। তবে এমন পরিস্থিতি সাময়িক। তাছাড়া জয়েন্ট ফোরাম প্রশ্ন তোলে বোনাস হবে ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরের পারফরমেন্সের ভিত্তিতে। সেবার চায়ের বাজার যথেষ্ট তেজী ছিল। ফোরামের আরেক আহ্বায়ক মনিকুমার দার্নাল সহাস্যে জানিয়েছিলেন প্রতিবার ঠিক বোনাস বৈঠকের আগেই মালিকদের চোখে চা শিল্পের পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। এই রহস্য সমস্ত শ্রমিকদের জানা। খোলামনে আলোচনা করেই বোনাস চুক্তির রফা হবে। বিজেপি প্রভাবিত চা শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় টি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দাবি ছিল ২০১৭ সালে বোনাসের হার ছিল ১৯.৭৫ শতাংশ। ১৮ সালে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছিল। ২০১৯ সালে চা শ্রমিকরা পেয়েছিল ১৯.৫০ শতাংশ হারে। তার আগে টানা ছয় বছর কুড়ি শতাংশ হারে বোনাস পেয়েছিলেন উত্তরের চা শ্রমিকরা। তাই তিনি কুড়ি শতাংশ হারে বোনাসের দাবি জানিয়েছিলেন। এছাড়াও যে সমস্ত শ্রমিক ক্ষুদ্র চা শিল্পে কাজ করে তাদেরকেও যেন বোনাস দেওয়া হয় সেই দাবির কথাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তুনবাড়ি চা বাগিচা সফর করে মালবাজারে ফিরে এই লেখাটা লিখতে যাওয়ার আগে তাই ভাবছিলাম উৎপাদনে তেমন হেরফের ঘটেনি। পরিবর্তন হয়নি তেমন দামের ক্ষেত্রেও। কিন্তু বর্তমানে চা শিল্পে দূর্দশা চলছে বলে দাবি করা হচ্ছে চা শিল্পপতিদের তরফে এবং এই যুক্তি খাড়া করে তারা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির বিপক্ষে। কিন্তু চা শিল্পের দূর্দশার দাবির বাস্তবতা আছে কি? বাজার যখন ঠিক রয়েছে তখন কেন মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আপত্তি তোলা হচ্ছে এই প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। পাশাপাশি চা শিল্পপতিদের বক্তব্য, গুণগতমান বজায় রাখতে গিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে অনেকটাই। তাই মন্দার বাজারে অতিরিক্ত ব্যয় কখনোই সম্ভব নয়। শিলিগুড়ি চা নিলাম কেন্দ্রের সেন্টারের থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে জেনেছিলাম ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে দাম কমেনি, বরং বেড়েছে এবং কয়েক মাসের মধ্যে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে ডুয়ার্সে চা উৎপাদন হয়েছিল ১৯৯ মিলিয়ন কেজি এবং এর মধ্যে নিলাম হয়েছিল ১৩৮ কেজি। গড়ে প্রতি কেজি সিটিসি বিক্রি হয়েছিল ১৫৩ টাকায়। তরাইতে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৩৭ মিলিয়ন কেজি এবং এর মধ্যে সিটিসি কেজি প্রতি ১৩৬ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। নিলাম হয়েছিল মোট ১৩৪ মিলিয়ন কেজি। বটলিফের ক্ষেত্রে ডুয়ার্সের চা ১১৫ টাকা এবং তরাইয়ের চা ১১২ টাকা প্রতি কেজি হিসাবে বিক্রি হয়েছিল। ২০২০ সালের আর্থিক বছরে ডুয়ার্সে সিটিসি প্রতি কেজি নিলাম হয়েছিল গড়ে ১৭২ টাকায় এবং তরাইতে সিটিসি বিক্রি হয়েছিল ১৪৫ টাকা প্রতি কেজিতে। অর্থাৎ ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরের থেকে ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে বাজার দর ছিল বেশি। কিন্তু তবুও পরিস্থিতি সুখকর নয় বলে দাবি ছিল চা বাগান মালিকদের। তাদের বক্তব্য, নিলামের দাম দিয়ে সমস্ত কিছু যাচাই করা ঠিক হবে না। উৎপাদন খরচ অনেকটাই বেড়ে গেছে। গুণগত মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে খরচ বেড়ে গেছে। স্থানীয় বাজার নষ্ট হয়েছে। অন্য দেশগুলো বাজার ধরে রাখার ক্ষেত্রে কিছু কিছু আপৎকালীন কৌশল গ্রহণ করে। এখানে সেই সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছে চা শিল্প।
একজন ভ্রামণিক, চা প্রেমিক, চা বাগিচা পর্যটক এবং সংবেদনশীল মানবপ্রেমিক হিসাবে ডুয়ার্সের চা শ্রমিকদের একাংশের কষ্ট চোখে দেখা যায় না। নিজে যেহেতু আমার বিদ্যালয়ে আদিবাসী ছাত্রদের পড়াই, ওদের জীবনবোধ তৈরি করি তাই বিষয়টা আমাকে হয়তো বেশি কষ্ট দেয়। তাই যেকোন বাগিচাতে সমীক্ষা করতে গেলে এক একটা সমস্যাকে চিহ্ণিত করে সমস্যা এবং সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করি। তাই পরিস্থিতির পরিবর্তনে আপতকালীন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সাহায্য অত্যন্ত প্রয়োজন। সিসিপি এর বক্তব্য যে হারে উৎপাদন বেড়েছে তার সঙ্গে সমতা রেখে সরবরাহ হচ্ছে না। এই ক্ষেত্রে রপ্তানির পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। একথা সমর্থনযোগ্য। বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাঁচা চা পাতার ন্যূনতম বেঞ্চমার্ক মূল্য বেঁধে দেওয়া, নিলামের ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে অধ্যাপক মহাদেবন এর সুপারিশগুলি কার্যকর করা জরুরী। ইন্ডিয়ান টি এসোসিয়েশনের চেয়ারপার্সন এন পাল চৌধুরীর যে প্রস্তাব ব্যাংকিং সাহায্যের ক্ষেত্রে অন্তত পাঁচ বছরের জন্য কার্যকরী মূলধন এর উপর ৩ শতাংশ সুদের ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত সেটাও বিবেচনা করা প্রয়োজন। চা শিল্পে সুদিন আসুক এই শুভ কামনা নিয়ে ফিরলাম তুনবাড়ি থেকে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴