আমি এক যাযাবর-২২/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
পর্ব ২২
শৌভিক কুন্ডা
খুনিয়া মোড় ছাড়িয়ে লেভেল ক্রসিং। আসামমুখী লাইন চলে গেছে ঘন অরণ্যের বুক চিরে। ভুতুড়ে বাড়ির মতো পড়ে থাকা ভাঙাচোরা কেবিন রুমটির সংস্কার হয়েছে দেখে ভালো লাগলো। এ অঞ্চলে হাতির চলাচল খুব বেশি। দিনের বেলাতেও প্রায়ই দেখা মেলে। একবার এমনকি গজরাজের তাড়া খেয়েও কোনমতে বেঁচে ফিরেছিলাম এ চত্বর থেকে! চাপড়ামারির প্রবেশদ্বারকে বাঁ হাতে রেখে আরও কিছুটা উজিয়ে সিপচু। মন খারাপ হয়ে যায়। দশক তিনেক আগে এই শান্ত, নিরীহ জনপদটি আন্দোলন নামের হুজুগে রক্তে ভেসেছিল, আগুনে পুড়েছিল। ভিন্ন রাজ্যের দাবীতে।
সিপচু ছাড়িয়ে, খুমানি বিট পেরিয়ে পৌঁছনো কুমাই তে-মাথায়। এখান থেকে ডানহাতি রাস্তা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কিছুদূর অব্দি অনেকেরই চেনা। যাঁরা এর আগে ঝালং-বিন্দু ঘুরে এসেছেন। নিজেদের অজান্তেই প্রায় কখন যেন সমতল ছাড়িয়ে পাহাড়ি পথে উঠতে শুরু করি। দুপাশে ছড়াতে থাকে রাবার আর সিঙ্কোনা প্ল্যানটেশন। ঝালংমুখী মূল রাস্তা ছেড়ে এবার গৈরিবাসের দিকের বাঁ হাতি পথ। আরও ছ-সাত কিলোমিটার গড়িয়ে চাকা থামে অভীষ্ট লক্ষ্যে। দলগাঁওয়ের মেচিলিংমা হোমস্টে। দলগাঁও নামটিতে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে, তাই বলে রাখি, এ দলগাঁওয়ের সাথে বীরপাড়ার সম্পর্ক নেই। এটি নিতান্ত ছোট্ট একটি পাহাড়ি জনপদ। তো, বেড়াতেই যখন আসা, স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠে, কি আছে এখানে? উত্তর : কিচ্ছু না। সুতরাং অবাক প্রশ্ন, "তবে?" এবারও যদি অমনই নির্বিকার উত্তর আসে "সে জন্যই তো", স্বাভাবিক ভাবেই তৈরি হতে থাকে ধাঁধার খেলা। অতএব 'নেই'এর ফিরিস্তিটা পরিষ্কার করা যাক আগে। মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রায় নেই-ই। শহুরে স্বাচ্ছন্দ্য, দুটো তিনটি দোকান ছাড়া, নেই। সেগুলোতেও হুট বলতেই সব কিছু মিলবে না। পছন্দের সিগারেট ব্র্যান্ডও না। ফাস্টফুড সেন্টার নেই, গাড়ির ধোঁয়া নেই, মানুষের চোখে অপরিচয়ের সঙ্কোচ নেই, সন্দেহ নেই। আছে সমতল থেকে মাত্র দেড় হাজার ফুট ওপরে আরামদায়ক আবহাওয়া, শান্তির নির্জনতা, রংবাহারি ফুলে ফুলে সাজানো হাতে গোণা কয়েকটি বাড়ি, ভেষজ উদ্যান আর স্থানীয় মানুষের অকৃত্রিম হাসিমুখ। বিশেষ করে অরুণা আর সংগ্রাম সোতাংএর। মেচিলিংমায় আপনাদের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন এঁরাই।
সকালসন্ধ্যে অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তাজা, নিষ্কলুষ বাতাসের সাহচর্য পাওয়া যাবে, অ্যাডভেঞ্চারাস মন হলে গ্রামের শেষ প্রান্তের জঙ্গলপথে ঘুরে আসা যাবে। যে দোকানগুলোর কথা আগে বলেছি, তাদের উল্টো মুখে কাণাগলি, বাঁহাতের যে কোনো বাড়ির দরজায় নক করলে হাসিমুখের অভ্যর্থনা পাওয়া যাবে। ভুটানি তরলের সঙ্গতে হাসিগল্পের আড্ডা পাওয়া যাবে!
দলগাঁও গ্রামটি ডাইরেক্টরেট অফ সিঙ্কোনা প্ল্যানটেশন প্রোজেক্টের অধীন। গ্রামের লোকের গর্বিত উচ্চারণ, এই প্ল্যানটেশনের সাথে জড়িয়ে আছে পুরনো ইতিহাস। পৃথিবীকে ম্যালেরিয়ার হাত থেকে বাঁচাতে যখন লার্জস্কেল কুইনিন উৎপাদন শুরু, তখন থেকেই পত্তন এই প্ল্যান্টেশন প্রোজেক্টের। আরও জানা গেল, প্রাচীন ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে এখনো এখানে আধুনিক প্রযুক্তির প্রবেশ নিষেধ! কায়িক পদ্ধতিই কায়েম রয়েছে উৎপাদনে।
আমরা পৌঁছেছিলাম বিকেল নাগাদ। সুগন্ধি লিকার চায়ে চুমুক। তাজা হয়ে উঠে রওনা হলাম দলগাঁও ভিউ পয়েন্ট ওয়াচ-টাওয়ারের দিকে। সঙ্গী সদানম্র সংগ্রাম। হাঁটতে হাঁটতে ই চেনাতে থাকে ইপিকাক চাষ কোথায় হচ্ছে, কোনটা কফি ফুল। বড়ো এলাচের দানা গাছ থেকে ছিঁড়ে এনে দেয় কখনো। ওর মুখ থেকেই জানতে পারি তিন বছর অন্তর অন্তর পালটে যায় প্ল্যানটেশন জমি। জানতে পারি, বার্ড ওয়াচারদের স্বর্গভূমি এই দলগাঁও। নানা জাতের বুনো মোরগ থেকে শুরু করে কালিজ, হর্ণবিল, বী-ইটার, মিনিভেটের দেখা পাওয়া যায় এখানে। কথা বলতে বলতেই চট করে ঝুঁকে কি একটা ছিঁড়ে নেয় সংগ্রাম। হাতে নিয়ে দেখি কাশফুলের লিলিপুট সংস্করণ! সংগ্রাম বলে, "শিরু!" দীপান্বিতার সময়ে সলতের বদলে এই শিরুই ব্যবহার করে ওরা প্রদীপ জ্বালাতে।
এইভাবে গল্পে গল্পে চলে আসি ভিউপয়েন্টের কাছে। ভারী সুন্দর সাজানো জায়গাটি। ছোট্ট শালজঙ্গল পেরিয়ে প্যাগোডা রীতির গেট। উল্টো মুখে জিটিএ-র ট্যুরিস্ট কটেজ। নানারঙের ফুলে ঝলমল চত্বরের একপাশে ওয়াচ টাওয়ার। ওপরে উঠে বসি। সংগ্রাম চেনাতে থাকে দিগন্তের ক্যানভাস। ঐ যে দূরে রূপোলী ফিতে দেখা যাচ্ছে, ওটাই জলঢাকা নদী, ঐ ঘরবাড়িগুলো ঝালংয়ের, তারপর ঐ যে বিন্দু, জলঢাকার ওপারে যে পাহাড় আঁকা আছে, সেটাই ভুটান!
ওয়াচ টাওয়ারে বসে বসেই কেটে যায় অনেকটা সময়। মগ্ন শিল্পীর আঁকা ছবির মতো ফুটে থাকে দিগন্তের চালচিত্র। সূর্যাস্তের সময়ে ঝালং-বিন্দু ছুঁয়ে অবসানের লালিমা ছড়িয়ে যায় ভুটান উপত্যকার খেলাঘরের মতো মানুষ বসতের ওপর।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴