স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/পর্ব : ২১
রণজিৎ কুমার মিত্র
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি
বিরাট
সম্ভাবনাময় শিক্ষায়তনে শুধুমাত্র পেশার সূত্রে ₹ই যুক্ত ছিলাম না।
ছাত্র-গবেষক-আধিকারিক-অধ্যাপক হবার সৌভাগ্য সূত্রে বহু কৃতী মানুষদের
সান্নিধ্যে
এসেছিলাম। সেই সব মানবিক সূত্রে কত স্মৃতিতে যে জড়িয়ে আছি।
সুখের-দুঃখের,অভিমানের-ক্রোধের সব রং আজ ফিকে হয়ে ক্রমশ ঝাপসা অস্পষ্ট
হয়ে যাচ্ছে তবুও সেই সব স্মৃতি এখনো আমার কাছে অবিমিশ্র আনন্দেরই, আনন্দ
বেদনা যার কাছ থেকেই যেমনই পাই না কেন 'সবারে আমি নমি'। কাব্য করে বলতে
গেলে আমাদের সব সুখের স্মৃতি, আসলে কোনও না কোনও দুঃখকেই বহন করে। অপরের
মুখ ম্লান করে দেওয়ার তীব্র সাধ পন্ডিতসমাজে একটু বেশি দেখেছি। আনন্দ
পরিহাসের মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়েছে।
সেই
সময় লাইব্রেরিতে দুটো শিফট চলত, সকাল সাড়ে দশটা থেকে রাত আটটা। শীতকালে
রাত ৭.৩০ পর্যন্ত। সবাইকে রোটেশনাল ভাবে ডিউটি করতে হত। মুখ্যত সার্কুলেশন
আর পিরিয়ডিক্যাল সেকশন খোলা থাকত, এসব অবশ্যই প্রাক-বৈদ্যুতিন পর্বের।
লাইব্রেরি সরগম থাকত পাঠকদের আনাগোনায়। বইয়ের জন্য তীব্র আকুল-ব্যাকুল
পাঠক ছিল। শনিবার হত হাফ ছুটি, দুপুর দেড়টায় ইউনিভার্সিটির ক্লাস বন্ধ
হয়ে যেত। শুধু লাইব্রেরি খোলা থাকত সাড়ে পাঁচটা অবধি। আমি নিত্যযাত্রী
ছিলাম, জলপাইগুড়ি থেকে বাসে যাতায়াত করেই সম্পূর্ণ কর্মজীবন কাটিয়েছি।
লাইব্রেরির সেকেন্ড শিফট আমার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। এই কারণে আমার জন্য
ব্যবস্থা ছিল প্রতি শনিবারের সেকেন্ড শিফট। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা,
বছরের-পর-বছর করতে হত শনিবারের ওই ডিউটি, অনুপস্থিত হওয়া চলবে না। কোনো
ছুটি নেওয়ার আবেদন-নিবেদন গ্রাহ্য হত না। মাঝে মাঝে খুব রাগ হত, শনিবার
বিকেলটা আমার মতো নিত্যযাত্রীদর কাছে ছিল খুব স্পেশাল। রবিবারের ছুটির
মেজাজ শনিবারের ওই হাফ ছুটির পর থেকেই সকলের শুরু হয়ে যেত, কিন্তু আমার
জন্য ছিল অন্যরকম। রবিবারের জন্য থাকত সপ্তাহ শেষের প্রচুর জমানো কাজ।
শনিবার দিন আমাকে একা একা দলছুট হয়ে অন্য বাসে জলপাইগুড়ি থেকে ভেঙে ভেঙে
ইউনিভার্সিটি যাতায়াত করতে হত। শনিবারে আমার ভিন্ন সময়ে অফিস, তাই
জলপাইগুড়ি থেকে আসা ইউনিভার্সিটির যাতায়াতের বাস আমি পেতাম না। শনিবার
আমার ভিন্ন সময়ে অফিস। জলপাইগুড়ি থেকে বাসে হাওড়া পেট্রোল পাম্প
পর্যন্ত, তারপর এয়ারভিউ-এর উল্টো দিকের বাস স্টপেজ থেকে অফিস। লোকাল বাসে
১ নম্বর গেট আসা কি যে দুর্ভোগের দিন ছিল! প্রতি মাসের শেষ শনিবার আবার
পোকামাকড়ের হাত থেকে বই বাঁচানোর জন্য যে এজেন্সি লাইব্রেরিতে কীটনাশক
ছড়াতেন তাদের তদারকি করা। বছরের-পর-বছর এই একই রুটিনে হাঁপিয়ে উঠতাম,
কিন্তু শনিবারের ইউনিভার্সিটি ছুটির পর লাইব্রেরি কাজকর্ম চালু রাখার
ডিউটিতে যে আনন্দ ছিল সেই আনন্দটুকুর জন্যই শনিবারের ডিউটি সহনীয় হত।
অন্য
আনন্দ বলতে শনিবারের ডিউটিতে থাকাকালীন সময়ে প্রচুর ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে
যোগাযোগ হত, শনিবারে অধ্যাপকরা লাইব্রেরি একটু কমই আসতেন।
গ্রন্থাগারের
ব্যবহারকারী হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের বইয়ের জন্য চাহিদা, বিশেষ কোনো
বিষয়ের প্রতি গভীর আকর্ষণ, আমাকে খুব মুগ্ধ করত। দোতালায় সার্কুলেশন
কাউন্টার অর্থাৎ বই ইস্যু ও রিটার্নের কাউন্টার ছিল, দোতলার রিডিং রুমের
শেষপ্রান্তে। তেতলার স্টেক রুম যেখানে অধ্যাপক ও গবেষকরা ছাড়া অন্যদের,
অর্থাৎ স্নাতকোত্তর ছাত্র-ছাত্রীদের প্রবেশাধিকার ছিল না। দোতলায় ক্যাটালগ
দেখে ছাত্রছাত্রীরা বই রিকুইজিশনের স্লিপ কাউন্টারে জমা দিত। সার্কুলেশন
কাউন্টারের পাশেই ছিল শুধু বই ওঠানামা করানোর ছোট লিফট, ওই লিফটে
ছাত্র-ছাত্রীদের রিকুইজিশন স্লিপ পাঠিয়ে দেওয়া হত।দরকার মতো রিকুইজিশন
মিলিয়ে বই পাঠিয়ে দিতেন। বই না পাওয়া গেলে রিকুইজিশন স্লিপএ নট ফাউন্ড
সিল মেরে নিচে পাঠিয়ে দিতেন। যারা বই পেতেন তারা উল্লসিত হতেন, আর যাদের
রিকুইজিশন স্লিপ নট ফাউন্ড ছাপ নিয়ে ফেরত আসত, তারা হতাশ হয়ে আমাদের উপর
কিঞ্চিৎ রাগ প্রদর্শন করতেন। তাদের বোঝানো হত, স্বল্প সংখ্যক বই হয়তো
ইস্যুতে আছে। রাগ প্রশমিত হত না, তখন তাদের বলা হত ওই নির্দিষ্ট বইটির জন্য
ডিমান্ড জমা দিতে। লেটার বক্সএর মতন দেখতে একটি কাঠের লেটার বক্স থাকত
যেখানে ছাত্রছাত্রীরা যেসব বই পাচ্ছেন না তাদের চাহিদার বইগুলি ডিমান্ড
স্লিপ-এ লিখে সেই বাক্সে ফেলে দিতে বলা হত। সেগুলি জমা করে নির্দিষ্ট
বইটির বুক কার্ডে লাগিয়ে রাখা হত, পরে নির্ধারিত দিনে সেই বইটি যিনি
নিয়েছেন, তিনি বইটি ফেরত দিতে এলে বা রিনিউ করতে এলে বইটি আটকে দেওয়া হত।
বইটির প্রাপক হবেন তিনি, যিনি এই বইটির জন্য চাহিদাপত্র জমা দিয়েছেন।
অনেকেই ফাইন দিয়েও বই আটকে রাখতেন। নিজেদের বন্ধুদের বৃত্তের মধ্যে বইটিকে
রেখে দিতেন। এই সব অভিযোগের মীমাংসা করতে হত। কেন তাদের রিকুইজিশন নট
ফাউন্ড হয়েছে, তার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা সব সময় দিতে হত। ওই পড়ুয়াদের
কাছে কখনো তাদের ক্যাটালগ দেখে ওই একই বিষয়ে ভিন্ন বই নিতে বলা হত। মনে
থাকলে চটজলদি কিছু রেফারেন্স বইয়ের নাম বলে দিতাম। সেসময়ে একটা বিষয়
গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের কলেজ থেকে আসা
ছাত্র-ছাত্রীদের একটা বড় অংশ আধুনিক গ্রন্থাগারের ব্যবহার জানতেন না,
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই তাদের পরিচয় ঘটত আধুনিক গ্রন্থাগার ব্যবস্থার সাথে।
অনেকেই ক্যাটালগ ঠিকমতন দেখে রিকুইজিশন স্লিপ ফিলাপ করতে পারতেন না। দোষটা
অবশ্যই তাদের নয় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন কলেজে গ্রন্থাগার ব্যবস্থা অত্যন্ত
দুর্বল ছিল, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বহু গ্রন্থাগার ব্যবহারকারীর
ছাত্র-ছাত্রীদের খুব অসুবিধে হত। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করতাম যাতে তারা
সেইসব অসুবিধাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেন। সেই সময় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে
অনাবিল সম্পর্ক গড়ে উঠত। এই সম্পর্ক স্থাপনে সব থেকে বেশি সফল যিনি, তিনি
হলেন তনয়া গুপ্ত, তনয়াদির ব্যক্তিত্বর মধ্যে এমন কিছু ছিল, যার সহযোগে
ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তিনি খুব সহজ হতে পারতেন। অনেকেরই গ্রন্থাগার
পরিষেবা পাবার, আশা-ভরসার সহায়তাকারী ছিলেন তনয়াদি। পরবর্তীকালে
বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে সেই সময়কার বহু
ছাত্রছাত্রীকে
দেখেছি পরিণতমনস্ক, অধ্যাপক-গবেষক- প্রশাসক-শিক্ষাকর্মী হতে। উত্তরবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আজো অনেকে রয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক, প্রশাসক হয়ে। এখনো তাদের সেই ছাত্রাবস্থায় কথা স্মরণ করালে
প্রায় সবার মুখে সেই পুরনো আনন্দ-উচ্ছ্বাসের, ছাত্রকালীন সময়ের আবেগে
মুখগুলো জ্বলজ্বল করে ওঠে।
পিজি
কাউন্সিলের সেক্রেটারি সত্যেন দাস ছিলেন আমাদের একই বর্ষের ছাত্র, অবসর
নিয়েছেন। সদ্য অবসর নিলেন নিবন্ধকার ডক্টর দিলীপ কুমার সরকার। যারা এখনো
আছেন সেই সময়কার ছাত্ররা ডঃ সুব্রত সান্যাল, ডঃ দেবাশীষ দত্ত, ডক্টর
অরুণাভ ভদ্র, ডক্টর জয়দীপ বিশ্বাস, ডক্টর নূপুর দাস, ডক্টর বিশ্বজিৎ
চ্যাটার্জী। ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকে দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজের
অধ্যাপকদের মধ্যেও অনেকে আছেন। তবে তাদের সঙ্গে পরবর্তীকালে খুব একটা
যোগাযোগ ছিল না। এরা সকলেই উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন। বিশেষ করে
অনুজপ্রতিম এই আধিকারিকেরা পদমর্যাদার অবস্থান থেকে সরে এসে তাদের
ছাত্রাবস্থার গ্রন্থাগারের রণজিৎদাকে বেশি আপন করে নিতেন। আধিকারিক
সমিতির কাজ করার সময় এরা যেভাবে আমাকে সহায়তা করতেন, সাহস উদ্দীপনা
যোগাতেন তা কখনো ভুলবার নয়। অনুজপ্রতিম কেউ পদাধিকারে অনেক উচ্চ স্থানের
অধিকারী, কখনোই মানবিক সম্পর্কের অন্তরায় হয়ে ওঠেনি। অনুজ প্রতিম
সহকর্মীরা গৌতম-শান্তনু অজয় -জয়দীপ-মানস -কমলাকান্ত - প্রায় সকলের কাছ
থেকেই অপরিসীম ভালোবাসা পেয়েছি। খুব মনে পড়ে মাহবুব আলমকে, বড় অসময়ে
ওকে আমরা হারিয়েছি। ওর সাথে অনেক কাজ করেছি বিশ্ববিদ্যালয় এবং
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও। ওর একটা বড় কাজের জগত ছিল। একটা সময় সহকর্মীদের
কাছ থেকে, স্বার্থান্বেষী এক চক্রের ষড়যন্ত্রে ওকেও অনেক যন্ত্রণা ভোগ
করতে হয়েছে ।
বিশ্ববিদ্যালয়
পেশার সূত্রে অবমাননা-যন্ত্রণার স্মৃতিও নেহাত কম নয়। আধিকারিক সমিতির
একজন বিশিষ্ট রুচিশীল রবীন্দ্র সংগীত গায়ক আধিকারিক, শম্ভু-নিশুম্ভ
মার্কা, উপাচার্যের তাবেদার আধিকারিকদের নিয়ে অনুজপ্রতিম সহকর্মীদের নায্য
প্রতিবাদ হেয় করে, সদম্ভে বলেছিলেন 'ব্লাডি জুনিয়র অফিসার'। শিহরিত
হয়েছিলাম এদের রুচি ও শিক্ষার কথা ভেবে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম ওয়াচ এন্ড
ওয়ার্ডের অফিসার-ইনচার্জ তুষার মৈত্রর হেনস্থায়। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে প্রায় এক রকম বিতাড়িত করা হয়েছিল। সহজ-সরল নিয়মনিষ্ঠ এই মানুষটির
অপরাধ তিনি উপাচার্যের অন্ধ অনুগামী ও স্তাবক হতে পারেননি। সেদিন যারা
তাকে উপাচার্যের বিরোধিতায় প্রায় অভিমন্যুর মতো যুদ্ধে নামিয়ে দিয়ে
নিজেরা সরে পড়েছিলেন,
নিজের নিজের পদ সুরক্ষিত
রাখতে, তারা কিন্তু কোন ক্ষমারই যোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি মন্থনে
শুধু অমৃত নয় ফেনায়িত গরল উঠতে দেখেছি বহুবার। সময় নীলকন্ঠ হয়ে সেসব
ধারণ করে আছে । সাফল্যের-সমৃদ্ধির শীর্ষে বসে সেইসব পদাধিকারীরা ভুলে
যেতে চেয়েছেন সবকিছু। এই সাফল্য কারো কারো একান্তই ব্যক্তিগত সাফল্য যা
কিছু হয়েছে সব ব্যক্তিস্বার্থে বা গোষ্ঠীর স্বার্থে, শিক্ষার স্বার্থে
কোনো কিছু হয়নি। রাজা রামমোহনপুরের ক্যাম্পাসে শিক্ষার স্বার্থকে গৌণ
করে দেবার খেলা কত যে দেখেছি সুদীর্ঘ পেশাজীবনে !
মেঘ
ও রোদ্দুরের এই খেলা থামে না, চরৈবেতির চলন বদলে গেছে। সে সব অন্য চলনের
এক ইতিহাস, অলক্ষ্যে তার খেলা চলে। 'স্মৃতি দিয়ে ঘেরা'তে এই খেলার
প্রতিভাধরদের রাখবো কোথায়?