রাঙামাটি চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
রাঙামাটি চা বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^
আমি ইতিহাসের ছাত্র বলে ইতিহাস আমার আগ্রহের বিষয়। সেইজন্যই ডুয়ার্সের ইতিহাস নিয়ে কোন না কোন অজানা বা জানা তথ্য একটু অন্য মোড়কে তুলে আনার জন্যই ডুয়ার্সের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াই। আর হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স নামক জনপদ ইতিহাসের নিরিখে নবীন মোটেও নয়। যেহেতু আমাদের প্রাক্তন শাসক ব্রিটিশদের হাতে তৈরি তাই সেই সময়ের ইতিহাসের গন্ধ ছড়িয়ে আছে এখানকার পথে-প্রান্তরে এবং অরণ্যে পাহাড়ে। শুধু তাই নয়, প্রাগজ্যোতিশপুর,
কিরাতভূমি, কোচ-কামতা, গৌড়-বরেন্দ্র, রংপুর বা জলপাইগুড়ি যে নামেই পরিচিত হোক না কেন, এই ভূখন্ডের আছে প্রাচীন ইতিহাস। এবারের বাগিচা সফর আমার ইতিহাসে মোড়া। আজকের তথ্যসূত্রের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই মুজনাই এর শৌভিক রায়ের একটি লেখাকে যেটা থেকে আমি জেনেছিলাম চাইবাসা ব্রিটিশ সমাধিস্থলের তথ্য এবং তারপরেই ছুটে যাওয়া রাঙামাটি চা বাগিচায়। লাটাগুড়ি হয়ে গরুমারা জাতীয় উদ্যানের বুক চিরে সকাল পৌনে এগারোটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম চালসার মোড়ে। ফোন করলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু বিক্রম ভার্মাকে। আগে থেকেই বলা ছিল রেডি থাকতে। ১০ মিনিটেই ভার্মা হাজির। ভার্মার বাইকে উঠলাম। মালবাজার শহর থেকে জাতীয় সড়ক ধরে মাত্র দুই কিলোমিটার এগোলে নিউ রেলওয়ে ওভারব্রিজ থেকে হাতের ডানদিকে বাঁক নিয়ে সোজা উপরে উঠে গেছে রাঙামাটি টি এস্টেটের রাস্তা। সমতল ছেড়ে ঢেউ খেলানো উঁচু-নিচু পথে ছুটে চলল মোটরবাইক। পথের দু’পাশে চা গাছের নরম সবুজ ভেলভেট ছড়িয়ে আছে আদিগন্ত। বাঁদিকে চাইলে দেখা যায় দূরের খোলা উপত্যকার পিছনে আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে হিমালয়ের বিভিন্ন রেঞ্জ। দেখলাম চা শ্রমিকরা পাতা তুলে রাখছে পিঠের নাইলনের জালের ব্যাগে। গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তায় সাইলি বাজার যাবার এই পথেই রাঙ্গামাটি চা বাগানের বিশাল চা কারখানার শেড। সেখানকার যান্ত্রিক শব্দ আর মন মাতানো টাটকা চা পাতার গন্ধে বুঁদ হয়ে ঢুকলাম ফ্যাক্টরিতে।
মালবাজার সাব ডিভিশনের রাঙ্গামাটি চা বাগানটির পরিচালক গোষ্ঠী অ্যামালগামেটেড প্ল্যান্টেশন প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পাণী। 'রাঙ্গা' অর্থ লাল এবং মাটি অর্থ 'ভূখন্ড'। ১৮৫০ সাল থেকে দার্জিলিঙে চা চাষ শুরু হয়। ডুয়ার্সে শুরু হয় ১৮৬২ থেকে। ১৮৬৬ সালে প্রথম আসাম থেকে চা বীজ নিয়ে এসে রাণীখোলা ডিভিশনে রোপন করা হয় সেই চা বীজ যেটা এই এস্টেটের সবচেয়ে পুরনো ডিভিশন। ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে রাঙ্গামাটি চা ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয়। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এই বাগান অর্থোডক্স টি এস্টেট হিসাবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চা প্রস্তূতকারক হিসাবে চা উৎপাদন করতে থাকে। ১৯৬৪-৬৫ সালে এটি সিটিসি চা উৎপাদনকারী সংস্থা হিসাবে কাজ করতে শুরু করে এবং চা নিলাম কেন্দ্রের অকশন মার্কেটে নিজের জায়গা তৈরি করে নেয়। এই এস্টেটের প্রথম ভারতীয় ম্যানেজার ছিলেন পি.কে.রায়। আগে থেকেই বড়সাহেবকে ফোন করে এসেছিলাম। অত্যন্ত খাতির করে নিয়ে বসালেন অফিসরুমে। পেশাতে মাস্টারমশাই শুনে এবং লেখালেখি নেশা এবং সেই নেশার টানে এতদূর ছুটে আসা শুনে খাতির যত্ন আরো বেড়ে গেল বুঝতে পারলাম। ওনার সহযোগিতাতে বাগানের বড়বাবুর কাছ থেকে পেলাম তথ্য যাতে একটা আদর্শ বাগানের প্রতিচ্ছবি পাওয়া গেল। জানলাম বাগানটি স্থাপিত হয়েছিলো ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি। বর্তমান কোম্পানীর পক্ষে পরিচালকমন্ডলী ১৯৮৬ সালে বাগানটি কিনে নেওয়ার পর হর্ষবর্ধন কেজরিওয়াল ১৯৯২ সালে বাগানটির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বাগানের পরিচালকমন্ডলীর মধ্যে প্রধান তিনজন। এঁরা হলেন অজয় কুমার ধনধনিয়া, বংশলোচন সিং এবং জয়বর্ধন কেজরিওয়াল। কোম্পাণীর বয়স ১৩৬ বছর। বাগিচাতে ছোট সাহেবের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে জানলাম আরো তথ্য। ফ্যাক্টরি রিনোভেশনের কাজ ২০০১ সালের পর থেকে শুরু হয় এবং ২০০৩ সালে রাঙ্গামাটি চা বাগান ২০৪৪৪৭৯ কেজি চা উৎপাদন করে।
একদা টাটার অধীনে থাকা চা বাগানটির মালিকানায় এখন অ্যামালগামেট। বাগানে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৯ জন। বাগানে প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ৩ টি। এস্টেটের মোট এরিয়া ১৪২৭.৭৭ হেক্টর তার মধ্যে চা উৎপাদিত অঞ্চল ৭৭৯.৬৩ একর, বছরে সিটিসি চা উৎপাদিত হয় গড়ে ১৬ লাখ কেজি। ৪.২২ হেক্টর জমিতে নার্সারি, বাঁশ এবং জ্বালানী গাছ ৪৩.৩৯ হেক্টর জমিতে, মিলিটারি সেনার ক্যাম্প এবং ওএনজিসির দখলে আছে ১০৭.৫১ হেক্টর জমি, পরিত্যক্ত জমি, ঘরবাড়ি, দোকান, শ্রমিক লাইন মিলে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমি। রাঙ্গামাটি চা বাগানে নিজস্ব চা পাতা উৎপাদনের গড় ৬০ লাখ কেজি। ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব মোট বাৎসরিক উৎপাদিত ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা ১২—১৩ লাখ কেজি। প্লাকিং শুরু হয় মার্চ মাস থেকে এবং শেষ হয় ডিসেম্বর মাসে। চা চাষের সর্বোচ্চ সময়ে প্রায় ৭০০ অস্থায়ী শ্রমিক লাগানো হয়।বাগিচার সাব স্টাফের সংখ্যা ৭১ জন। করণিক ১০ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ১২ জন। স্থায়ী শ্রমিক ১৯৯১ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ২১১ জন। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক ৫৬৬ জন। কম্পিউটার অপারেটর ১ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ২২৫৫ জন। মোট শ্রমিক আবাস ১৩১৬ টি। এলাম বাগিচার হাসপাতালে। এস্টেটে সাম্প্রতিককালে ৫০ বেডের হাসপাতাল চালু করা হয়েছে এবং এই টি এস্টেট ধারাবাহিকভাবে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরিসেবা দেয় সরকারি নিয়ম এবং নির্দেশিকা মেনে। রাঙ্গামাটি চা বাগিচার হাসপাতালে ডাক্তার আবাসিক হিসাবে বাগিচায় তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা তখন ছিল ২ জন। নার্সের সহযোগী মিডওয়াইভস ছিল ৪ জন, কম্পাউন্ডার বা স্বাস্থ্য সহযোগী ছিল ৩ জন। মেল ওয়ার্ডের বেড সংখ্যা ১৪, ফিমেল ওয়ার্ডের বেড সংখ্যা ১৩, আইসোলেশন ওয়ার্ড ৪, মেটারনিটি ওয়ার্ড ৫ টি, অপারেশন থিয়েটার আছে, অ্যাম্বুলেন্স আছে।
যদিও রাঙ্গামাটি চা বাগান নিজেরা কোন স্কুল পরিচালনা করে না, তথাপি এখানে রয়েছে ৪ টি প্রাইমারি স্কুল, একটি জুনিয়ার হাইস্কুল এবং সরকারি পরিচালনাতে দুটি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র। এস্টেটের শ্রমিক কর্মচারীদের আলাদা কাউন্সিল রয়েছে, আছে মহিলা মন্ডল এবং স্টুডেন্টস ক্লাব এবং শ্রমিকেরা সম্প্রদায়গতভাবে কমিউনিটি সেন্টারের মাধ্যমে নিজেদের সাংস্কৃতিক চর্চা করে থাকে। মেয়েদের স্বনির্ভর করে তুলবার জন্য এস্টেটে আছে আর্টস এবং ক্র্যাফটস সেন্টার। অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে সেখানে প্রায় ৮০ জন যুবতী এবং কিশোরী স্বনিযুক্তি প্রকল্পের শিক্ষা গ্রহণ করে। শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার প্রচেষ্টাতে তাদেরকে প্যাকেটজাত গুণগত মানের রেশন সরবরাহ করা হয়। রানীখোলা এবং চাইবাসা ডিভিশনে পুরোপুরিভাবে ইলেকট্রিফিকেশনের কাজ হয়ে গেছে। এসএফ এবং এনএসএফ ডিভিশনে কাজ চলছে। বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার আছে। যেহেতু রাঙ্গামাটি চা বাগান খরা অধ্যুষিত অঞ্চলে অবস্থিত তাই পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে বিভিন্ন ডিভিশনে এস্টেটের পক্ষ থেকে অনেকগুলি পুকুর খনন করা হয়েছে। শ্রমিকদের বসতিগুলি থেকে গোবর এবং অন্যান্য বর্জ্য সংগ্রহ করে আবর্জনাগুলিকে পরিশুদ্ধিকরণের মাধ্যমে গারবেজ ম্যানেজমেন্টের জন্য নিয়মিত শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং মিটিং সংগঠিত হয়। পরিবেশ সুরক্ষার স্বার্থে অরগানিক সার বেশি পরিমানে ব্যাবহার করা হয় এবং নিয়মিত মৃত্তিকা পরীক্ষা করা হয় এই বাগানে। তাই লেবার লাইনগুলিতে পাকা ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যাবস্থা হিসাবে একটা বাস আছে । বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব আছে। খেলার মাঠ আছে। এই টি এস্টেটে স্বাস্থ্যসুরক্ষার দিকে সর্বদাই দৃষ্টি দেওয়া হয়। এস্টেটের পাশেই প্রত্যেকটা ডিভিশনে আছে ৪ টি স্যাটেলাইট ক্রেশ। ১২ জন ক্রেশ সহায়িকা বাচ্চাদের দেখভাল করে। ক্রেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা এবং শৌচালয় আছে।
দেখলাম একটা মন্দির। জানলাম সেটা পঞ্চকন্যার মন্দির। পরিচয় হল ফ্যাক্টরির স্টাফ তথা এলাকার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত অর্জুন ছেত্রীর সঙ্গে। জানলাম স্থানীয় এই পঞ্চকন্যা দেবী মন্দির কমিটির তত্ত্বাবধানে মালবাজার ব্লকের রাঙামাটি চা বাগানের চাইবাসা ডিভিশন সহ বিভিন্ন জায়গায় সম্পূর্ণ রীতি রেওয়াজ মেনে অনুষ্ঠিত হয় তিজ উৎসব। অর্জুনের কাছ থেকে জানলাম নেপালী সম্প্রদায়ের মহিলারা কঠোর ব্রত পালনের মাধ্যমে এই উৎসবে শামিল হন। তিজ উৎসবে বিবাহিত মহিলারা উপবাস থেকে স্বামীদের দীর্ঘায়ু এবং মঙ্গল কামনা করেন। মহিলারা ভক্তিগীতি এবং নৃত্য পরিবেশন করেন, চলে সারাদিন ভগবানের পাঠকথা। এই তিজ উৎসব দেখতে দুরদুরান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন রাঙ্গামাটি চা বাগানে। অর্জুনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে সবুজ চা বাগানের বুক চিরে আমরা চললাম প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র চাইবাসার পথে। সবুজ গালিচা বিছানো বাগিচার বুক চিরে উঁচু-নিচু ঢেউয়ের মত পথ ধরে যে রাস্তা পেরিয়ে গেছে তার ধারে ধারে এই চা বাগানের একের পর এক ডিভিশন। কবিতার মত তাদের নাম স্প্রিংফিল্ড, সুন্দরী লাইন, চাইবাসা ইত্যাদি। কয়েকটা বাঁক নিয়ে কিছুদূরে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম কয়েকটা চা-বাগানের কোয়ার্টার। সামনে ফুল আর সবজির বাগান। হাতের ডানদিকে একটা সাইন বোর্ডে ইংরেজীতে লেখা আছে চাইবাসা। বুঝলাম পৌঁছে গেছি। পথের পাশেই মাচার উপর একটা ছোট্ট মুদির দোকানে এক আদিবাসী বালক বসে। দোকানের ছেলেটির কাছে পুরানা ‘কাবরিস্তান কা রাস্তা' জিজ্ঞেস করতেই ডান হাত তুলে দেখিয়ে বললো 'উস তরফ যাইয়ে'। ডানদিকে একটা খেলার মাঠ। প্রাইমারি স্কুল। চা-বাগানের ফ্যাক্টরি, স্টাফ কোয়ার্টার, আবাসন পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম চাইবাসা ডিভিশনে যার পূর্বপ্রান্তে জনবসতির অদূরে গাঢ় সবুজের মাঝে প্রাচীর ঘেরা প্রায় পাঁচ বিঘা জমিতে রয়েছে এমন এক সমাধিস্থল যেটি শ্বেতপাথরে মোড়া এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।
চাইবাসা ব্রিটিশ সিমেট্রি। চা বাগান প্রতিষ্ঠার সেই শুরুর দিনগুলির এমন কিছু নিদর্শন আজও রয়েছে যা স্থানিক ইতিহাসকে যেমন অন্যভাবে চিনতে সাহায্য করে, তেমনি জানা যায় ডুয়ার্সের সেই সময়ের অবস্থাটিও। রাঙামাটি চা বাগানের চাইবাসা বা ডিভিশনের পুরনো সমাধিস্থলটি এরকমই একটি উদাহরণ। সমগ্র ডুয়ার্সে এত পুরনো সমাধিস্থল খুব সম্ভবত আর নেই। দুর্ভাগ্য, সমাধিস্থলটি সংরক্ষণের কোনও প্রচেষ্টাই নেই। ফলে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে এটি। রাতে তো বটেই, দিনের বেলাতেও মাঝে মাঝে বসে নেশার আসর। চা বাগানের কর্মী দিলবাহাদুর থাপা কয়েকবছর আগে সঙ্গী সহ সমাধিস্থলের দেখাশোনা করলেও সমাধিস্থল আজ প্রহরীবিহীন। পাঁচ বিঘা জমির উপর এই সমাধিক্ষেত্রের সীমানাপ্রাচীর বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে পড়েছে যত্নের অভাবে। প্রবেশপথটি অভিনব। কাঁধ সমান উঁচু দেয়ালের উপর দিয়ে বসানো সিঁড়ি ডিঙিয়ে প্রবেশ করতে হয়। তারপরেই রয়েছে সুদৃশ্য গথিক এবং ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের মিশেলে তৈরি একটি খিলান দেওয়া গেট। তার ছাদে মস জাতীয় উদ্ভিদ গজিয়ে ছেয়ে ফেলেছে পুরোটা। মেঝেতে মার্বেলের ফলকে কিছু একটা লেখা ছিল কিন্তু সেটা এখন আর পড়া যায় না। ইউরোপিয়ানদের জন্য সংরক্ষিত ব্রিটিশ আমলের এই সমাধিস্থল ছিল পশ্চিম ডুয়ার্সের সবচেয়ে বড় এবং পুরনো ক্রিশ্চান সমাধিস্থল। কাজেই ডুয়ার্সের ইতিহাসের আলোচনায় চাইবাসা সমাধিস্থলের যে বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে সে কথা বলাইবাহুল্য। একসময় এখানে প্রায় ১০০ টি সমাধি থাকলেও বর্তমানে কুড়ি-পঁচিশটির বেশি চোখে পড়ে না। যেগুলি এখনও অটুট আছে তাদের অবস্থাও খুবই করুণ। কোন কোন সমাধির ফলক বা হেড স্টোনের ইটালিয়ান মার্বেলের উপর যে পিতলের হরফে মৃত ব্যক্তির নাম, জন্ম-মৃত্যুর তারিখ ইত্যাদি লেখা থাকতো সেগুলি আজ উধাও। এক সময়ে প্রচুর ঔষধিবৃক্ষ সমাধিস্থলের বিরাট সম্পদ ছিল। বর্তমানে যেগুলির কোনও অস্তিত্ব নেই। আসলে বদল তো সর্বত্র। তাই সবুজ চা বাগানের পাশে ভাঙা প্রাচীরে ঘেরা সমাধিস্থলটি দেখে মন সত্যিই খারাপ হয়।
উনবিংশ শতাব্দীতে স্থাপিত এই সমাধিস্থলে যারা ঘুমিয়ে আছেন তারা কেউই দেশের নাগরিক নন, প্রায় সকলেই ইংরেজ। ব্রিটিশরাজ যখন ডুয়ার্সে চা-বাগানের পত্তন করেন তখন যে সমস্ত ইংরেজ সাহেব এই জঙ্গলঘেরা পাহাড়ের পাদদেশে এসেছিলেন চা বাগানের মালিক হিসাবে বা ম্যানেজারের দায়িত্ব নিয়ে, মৃত্যুর পরে তাদের এখানেই কবরস্থ করা হয়েছিল। তাদের সমাধিস্থ করার জন্যই এই সমাধিস্থল নির্মাণ করা হয়। সেই সকল চা বাগানের মালিক অথবা ম্যানেজার অথবা তাদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অনেক হতভাগ্যের জীবনতারা খসে গিয়েছিল সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে ভারত নামক তৃতীয় বিশ্বের এক ব্রিটিশ উপনিবেশে। ডুয়ার্সের অতীত ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সমাধিস্থলটির সঠিক সংরক্ষণ না হলে ইতিহাসের একটি অনবদ্য অধ্যায় মুছে যাবে অচিরেই। বাংলার উত্তরাংশে হিমালয়ের কোলে হিংস্র জীবজন্তু অধ্যুষিত ডুয়ার্স নামক ক্ষুদ্র ভূখন্ডে ম্যালেরিয়া ইত্যাদি প্রাণঘাতী রোগের আতুরঘর ছিল এই ভূখন্ড। রাঙ্গামাটি, মেটেলি, সামসিং, বাগরাকোট অঞ্চলে যেসব ইংরেজ ম্যানেজার এবং তাদের নিকট আত্মীয়দের প্রাণবায়ু নির্গত হয়েছিল অকালে তারাই চিরনিদ্রায় শায়িত চাইবাসা সমাধিস্থলে। এখনো তার অসংখ্য চিহ্ন বহন করে চলেছে ভগ্নপ্রায় এই সমাধিস্থল। আজও সেই সমাধির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয় আত্মীয় বিয়োগের ব্যাথাতে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে সমাধিস্থলের বাতাস। রয়েছে বেশকিছু সমাধি, যেগুলির পরিচয় জানা যায় না। এদের বেশিভাগেরই মৃত্যু হয়েছিল অনেক কমবয়সে। কেউ ৪, কেউ ৩৩ বছর বয়সে, আবার কেউ চলে গিয়েছিলেন মাত্র ২৪ বছর বয়সে। সম্ভবত ডুয়ার্সের মারণব্যাধি কালাজ্বর অথবা ম্যালেরিয়াই তাদের অকাল মৃত্যুর কারণ। কেউ তার প্রেয়সীকে, কেউ বা তাদের একমাত্র পুত্রকে এই সমাধিস্থলে চিরশায়িত রেখে নিজের দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। তবে এরাও যে চা বাগানকে কেন্দ্র করে কোনও না কোনও সময় ডুয়ার্সে পা রেখেছিলেন সেকথা স্পষ্ট বোঝা যায়।
চাইবাসা সমাধিস্থলে সকলেই শুয়ে রয়েছেন হিমালয়ের পাদদেশে, দুটি পাতা একটি কুঁড়ির চা বাগানের সবুজ বিস্তারের মাঝে এই বিরাট সমাধিস্থলে। কেউ আবার প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে লিখেছেন মর্মস্পর্শী কবিতা। এদের কেউ স্বদেশ স্বজনকে ছেড়ে জীবিকা অর্জনের উদ্দেশ্যে, কেউ বা নতুন দেশ দেখার আগ্রহে, কেউ স্বামীর সাথে থাকতে সুদূর ব্রিটেন থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেছিলেন। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে এদের কেউ ফিরে যেতে পারেননি স্বভূমে। এটি এমন এক ঐতিহাসিক সমাধিস্থল রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে যেটির করুণ দশা। সীমানা প্রাচীরের গায়ে, প্রবেশদ্বারটির ছাদে, দেয়ালের গায়ে এবং সমাধিগুলির গা দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় ধুলোময়লা এবং শ্যাওলার মিশ্রণে পুরু আস্তরণ পড়ে গেছে। প্রিয়জনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্বেতপাথরে খোদাই করা কবিতা বা লেখার পাঠোদ্ধার করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। অথচ মালবাজারকে কেন্দ্র করে পর্যটনের বিকাশে বর্তমান সরকার যেভাবে উদ্যোগী হয়েছে তাতে ডুয়ার্স বেড়াতে আসা অসংখ্য পর্যটকের কাছে অন্যতম দ্রষ্টব্য হয়ে উঠতেই পারে ইংরেজ সাহেবদের এই সমাধিক্ষেত্র। শুধু তাই নয়, বিদেশি পর্যটকদের কাছে বেড়ানোর অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে এই স্থান। সবুজে ঘেরা চা-বাগানের এই শান্ত সমাহিত সমাধিভূমিতে শুধু পাখির কলতান আর পাহাড়িয়া বাতাসের শীতলতায় তাঁরা চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছেন।
দুই বন্ধু কিছুক্ষণ বসি ঘাসের উপর। উদাস মনে কেমন একটা বোঝাতে না পারার কষ্টে মন ভারাক্রান্ত হয়। একটু আগেও রোদ ছিল। এখন এক খন্ড পাতলা কালো মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে সূর্য। পশ্চিম দিকের দেওয়ালের উপর এসে বসেছে একটা ইসাবেলিন শ্রাইক পাখি। হেমন্তের হালকা বাতাসে পাতা ঝরাচ্ছে ইউক্যালিপটাস। খুব দ্রুত উপযুক্তভাবে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না নিলে ভগ্নপ্রায় এই ইতিহাস কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে একসময়। কিন্তু টি ট্যুরিজমের সাথে সাথে ইতিহাসভিত্তিক পর্যটনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের মধ্যে পরিচিতি লাভ করলে ডুয়ার্সের পর্যটন মানচিত্রে স্হায়ী জায়গা করে নেওয়ার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে চাইবাসার। দরকার শুধু চা বাগান কর্তৃপক্ষ আর পর্যটন দপ্তরের একটু সমন্বয় আর ভালো কাজ করার সদিচ্ছা। যদি এই ঐতিহাসিক স্থানটি সংস্কারের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যায় তবে সুন্দর একটি পর্যটনস্থল গড়ে উঠবে মালবাজারের বুকে। ফিরে আসার সময় মনশ্চক্ষে দেখছির উপরে পড়ছে মাটি আর সাথে গীর্জার পাদ্রীর প্রার্থনা। সেই প্রার্থনার প্রতিধ্বনি যেন আজও বুকে নিয়ে বেঁচে আছে চাইবাসা সমাধিস্থল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴