বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং-২১/রূপন সরকার
বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং
পর্ব ২১
ড. রূপন সরকার
প্রাথমিকভাবে দার্জিলিং শহরের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পড়ার সুযোগ ইউরোপীয় তথা কিছু সংখ্যক ধনী ভারতীয় নাগরিকদের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ ভারতীয় পরিবারের সন্তানেরা এর থেকে বঞ্চিত ছিল। তবে ভারতীয়দের মধ্যেও যারা সুযোগ পেত, তাদের সাথে বিমাতৃসুলভ আচরণ করা হতো। শহরের শিক্ষাক্ষেত্রের কিছু ছবি উঠে আসে উনবিংশ শতকের ষষ্ট দশকে প্রদত্ত কোচবিহার কমিশনাররের রিপোর্টে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী দার্জিলিং পৌরসভার সীমার মধ্যে একটি ইংলিশ স্কুল এবং চারটি ভার্নাকুলার স্কুল সহ মোট পাঁচটি সরকারি স্কুল ছিল। ১৮৬৫-৬৬ সালে ইংলিশ স্কুলের ছাত্রসংখ্যা ছিল ৫৯ জন। ইংরেজি ছাড়াও এই স্কুলে বাংলা ও উর্দু পড়ানো হতো। ভার্নাকুলার গভর্নমেন্ট স্কুলগুলির দুটি ছিল চাঁদমারি ও দুটি জোড়বাংলোতে। চারটি স্কুলের মাধ্যমই ছিল হিন্দি। স্কুলগুলির ছাত্রসংখ্যা বেশি ছিল না। ১৮৬৬-৬৭ সালে স্কুলগুলির কোনটিতে ১৪ জন, কোনটিতে ১৫ জন, কোনটিতে ১৭ ছাত্র ছিল। সবচেয়ে বেশি ছাত্র ছিল চাঁদমারির একটি স্কুলে, ২৩ জন। ছাত্রদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যাই বেশি ছিল। হাতেগোনা কয়েকজন মুসলমান ছাত্র স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করতো। অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলের সংখ্যাও বেশি ছিল না। ১৮৮৮-৮৯ সালে মিডিল ইংলিশ স্কুল, আপার ও লোয়ার প্রাইমারি, হায়ার ক্লাস ইংলিশ স্কুল, মিশন স্কুল নিয়ে মোট স্কুলের সংখ্যা ছিল ১১টি। এই স্কুলগুলির মধ্যে মিডিল ইংলিশ স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৬০ সালে। ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত স্পেশাল ইনস্টিটিশন অফ ভুটিয়া স্কুলটি ১৮৯২ সালে মিডিল ইংলিশ স্কুলটির সাথে সংযুক্ত হয়ে দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাই স্কুল নামে আত্মপ্রকাশ ঘটায়। দার্জিলিং পৌরসভা তাদের বহুমুখী কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এমনকি প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে রাজশাহী ডিভিশনের অন্যান্য পৌরসভার থেকে দার্জিলিং পৌরসভা অনেক বেশি এগিয়ে ছিল। সমস্ত দুর্বলতা স্বত্ত্বেও পার্বত্য শহর দার্জিলিং ধীরে ধীরে ইউরোপীয় শিক্ষা ব্যবস্থার পীঠস্থানে উন্নীত হয়। দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র শিক্ষা লাভের আশায় এই শৈল শহরে পারি দিতে থাকে। স্বল্পবিস্তর সীমাবদ্ধতা নিয়ে সব মিলিয়ে দার্জিলিং শহর আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র পরিণত হয়। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ভারতবর্ষের সব প্রান্তের ছেলেমেয়েরা দার্জিলিং শিক্ষা লাভের জন্য আসতে থাকে। এমনকি পার্শ্ববর্তী নেপাল, ভুটান এবং সিকিম থেকেও বিদ্যার্থীরা এই শহরে আসে শিক্ষা লাভের জন্য। শিক্ষাকে কেন্দ্র করেই শৈল শহর দার্জিলিংয়ের নগরায়ণ নতুম মাত্রা লাভ করে।
শিক্ষার মতো খেলাধুলোকেও ভারতীয়দের ইংরেজিকরণের (Anglicization) মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসকেরা। ইউরোপীয় খেলাধুলোর মাধ্যমে পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ও সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে বলিষ্ঠ শরীর গড়ে তোলাই ছিল সাহেবদের মূল লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই ইউরোপীয় খেলাধুলো যেমন ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদিকে বিদ্যালয় শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দার্জিলিং শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে আবাসিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে ইউরোপীয় খেলাধুলোকে জনপ্রিয় করে তোলা হয়। ইউরোপীয় খেলাধুলোর মাধ্যমেই পাশ্চাত্য নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই সরকারি ও মিশনারি স্কুল, কলেজে, বিভিন্ন ইউরোপীয় খেলাধুলো সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে দার্জিলিং সেন্ট পলস্ স্কুলের কথাই তুলে ধরা যেতে পারে। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৬৪ সালে প্রাথমিক ও জুনিয়র হাই বিদ্যালয় হিসেবে। নিয়মানুবর্তিতার জন্য স্কুলটি প্রসিদ্ধ। এই স্কুলের প্রতিটি বাচ্চা একটি করে নির্দিষ্ট খেলাধুলো প্রতিদিন ১ ঘন্টা করে, সপ্তাহে মোট পাঁচ ঘন্টা খেলবে একজন প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অধীনে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
