পইলা সাঞ্ঝির কথা/২১
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ২১
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
আইন্না
রেডিওটা বরাবর উঠোনের এক পাশে রেখে কান্তেশ্বর সকালের চা-টা খায়। বসমতী বাচ্চাগুলোকে খাইয়ে রান্নার জোগাড়ে ব্যস্ত। এমন সময় বিষাদু এসে হাঁক দেয়,
"কোনেক চাহা খোয়াও বারে।"
বসমতী হাত থেকে কাটারিটা নামিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি উঠে এসে একটা পিঁড়ি পেতে দেয়। বলে,
"বইসো। চড়াছোং। নগতে হবে এলায়।"
কান্তেশ্বর কাপটা মাটিতে নামিয়ে রেখে বসমতীর উদ্দেশ্যে বলে,
"তে মোর কাপটাও নিগাও ওদি। ভাল করি আর এককাপ খাং মুইও।"
তারপর বিষাদুর দিকে তাকিয়ে বলে,
"কোটে থাকি আসিলু তে দা?"
বিষাদু একটা নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর থেমে টেনে টেনে বলে,
"গেলুং কোনেক কাম-কাজের বাদে, তে নাই। কাহোরে আজি কামলা নানাগে। বসিয়ায় আছোং রে, ভাইয়া রে। কালি পূজাখান বিরাইলে বলে ভাটাখানার গাড়ি আসিবে। এই সন থাকি মুইও ভাটাখানা যাইম। হিত্তি কাজে পাওয়া যায় না।"
বিমর্ষভাবে কথা কটা বলে বিষাদু মাথা নাড়ে। কান্তেশ্বর বলে,
"আজি মোরে কোনেক কাম কর। মুইও বাড়িত আছোং। দোনোঝনে ধরি।"
খুশিতে মুখটা উজ্জ্বল হয় বিষাদুর।
"কি কাম। করালে না করং রে ভাইয়া। মোর তালে আজিকার দিনটা চলে। সোগায় না তাঙ্কুবাড়ি, আলুবাড়ি বানের ধইচ্চে। তে আজি বোলে নানাগে। একঝোন কালি থাকি কামোত যাবার কইল।"
চা খেয়েই দুজনে উঠে পড়ে। কান্তেশ্বর বেড়াতে গূঁজে রাখা দা টা হাতে নেয়। বলে,
"চল বাঁশ কাটি।"
বিষাদু হা হা করে ওঠে।
"আজি দ্যাও বার। বাঁশ কাটা না যায় ঝোন?"
"আগেরে কাটি থোওয়া আছে। আজি খালি ডুম করির নাইগবে। তারপর ফালটা করি মাঠেয়া চ্যাকর দিমু। শাক বাড়িখানোত। ওদি চাইট্টা বিলাতী আলুও ফেলাবে বলে। তে যে মুরগি! শাগের বিচিলা খায়া নিবে। আর ছাগল-ছেলি তো আছে সোগারে।"
বসমতী পেছন থেকে চেঁচায়,
"খোরাকী না আটখোরাকী, মোক কনেক কয়া যাওখেনে।"
বসমতীর কথা শুনে দুজনেই থমকাল। তারপর বিষাদু বলে,
"মুই তো আটখোরাকীয়ে করং। মোক আদাস্যার চাউলে দ্যান বারে। বাড়িতে চাইট্টা জ্বালেয়া খামো সোগায়।"
যখন লাগে তখন আবার সহজে কামলা পাওয়া যায় না। এখনও জমি তৈরির কাজ শুরু হয়নি সেভাবে, কান্তেশ্বর বিষাদুকে পেয়ে চেকারের বেড়াটাই আগে বানিয়ে নেবে ভাবল। এসব কাজে বিষাদুর হাত ভালো।
আর কিছুদিনের মধ্যেই কামলার আকাল হবে। লোকে তামাক বুনবে, আলু বুনবে, বেগুন, কপি। কাজের তাড়া লেগে যাবে। কান্তেশ্বর তামাকের ঝামেলা করতে পারে না। অত সময় কোথায়? তাও লোক দিয়ে বাড়ির লাগোয়া জমিতে শাক-সব্জি কিছু না করলে চলে না। সেসব দেখাশুনা অবশ্য বসমতীই করে।
বাঁশ কেটে দুজনে মুখোমুখি বসে টুকরো করে কাটা বাঁশ ফাটিয়ে চেঁছে মসৃণ করতে করতে গল্পে মশগুল হয়। মাঝে বসমতী আর একবার চা আর চিঁড়ে খেতে দিয়ে যায়। তবে এবারে বেশি পরিমাণে লাল চা, চিঁড়ে ভিজিয়ে খাওয়ার জন্য। পান-সুপারীও দিয়ে যায় এখানেই। বিষাদু বলে,
"ছোট দেওয়ানি বলে এইবার গোটায় আগখানোত তাঙ্কু গাড়িবে। চাইর-পাঁচখান হাল নাগাইসে। ছাওয়ালাক হাজিরা নিসে জমির থুকুরা বেচির।"
"আর বচ্ছর তাঙ্কুর দাম ভাল গেইসে রে। ছোট দেওয়ানি পাটাতো মেলা টাকা বেচাইল, আরো আছে বলে, থুসে, পরে দাম উটিলে বেচাবে।"
কান্তেশ্বর উত্তর দেয়। বিষাদু গামছাটায় মুখ মুছতে মুছতে বলে,
"উমরা কি আর এইলা মানষির মতোন! পাটা একেনা কইল্লেক তে সেলা ওটেখেনায় আকালখান পড়ে। না বেচালে চলেছেকে না। তাঙ্কু চাইট্টা করিবে তে ভাল করি শুকাইতে না শুকাইতেই বেচের ধরিবে। কী দাম পাবে! ফড়েয়াগিলা আছে কে না ওই জইন্যে বসি!"
তারপর থেমে বলে,
"তুই তাঙ্কু না গাড়িস?"
কান্তেশ্বর বিরক্তভাব দেখিয়ে বলে,
"তাঙ্কুত না টাকা আছে! তে এইলা ঝামেলা কায় করিবে? গাড়িলে তো হবে না, গোড়াসীর বুড়া পাত ভাঙেক রে, জল দেক - মেলা ঝামেলা। তাঙ্কু গাড়িতে যেমন ঝামেলা, কাটিতেও ঝামেলা। দিন-আতি বসি ছেঁচকুনি বানের নাগে।"
"হুটা না হয়। ঝামেলাখানের জইন্যেই কাহো কাহো তাঙ্কু না গাড়ে।"
কান্তেশ্বর পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বলে,
"উমুরা যে এলাইতে হাল নাগাইসে, হেঁউতি গাড়ে নাই?"
"গাড়িসে না!" বিষাদু উত্তর দেয়।
"বাড়ির আগখানোত এইবার পাটা করে নাই। পাটা সব দোলাত। হেঁউতি আগুরি করি আগুরি কাটিল। ওদি কাটি ওদি হাল নাগে দিসে। মেলা কামলা কাজ করেছে। দোলার ধান তো এলাং পাকে নাই।" তাঙ্কুর পুলি ফেলাইসে একপাখে। উত্তরের ডাঙাখানোত। উমার মেলা জমি। চাইরোপাখে বুদ্ধি খাটে।"
কান্তেশ্বর মাথা নাড়ে।
"হয় রে দা। হামার এখিনা জমিত কুদি কি কোরিমু এইলা নিয়ায় মোর গিত্থানির সতে নাগি যায় কোনেক।"
বিষাদু হাসে।
"কেনে আরো নাগে, উমারটাও থাউক, তোরটাও নোউক। বুদ্ধি ভরসা না দোনোঝনে করিবেন। তোমার এলা বুড়া-বুড়ি নাই। আর কায় কতা কবে!"
"অ্যায় যে, উয়াক বিলাতী আলুও করির নাগে, হুদি অসুন পিঁয়াজী, নাপা, শোলুপ, চন্দনি, ধুনিয়া-বাবরি তামাল্লায় নাগে। পালনও ফেলাবে একপাশে। থে মনে কর গোটায় জমিখানে না নাগেছে!"
"কেনে, আরো না জমি আছে ওদি, তুই ওদি কর কি করিবু!"
বিষাদুর কথায় কান্তেশ্বর বলে,
"ধান না কাটা হলে জমিলা তো এলা বন আছে না। পুলি ফেলেরে জাগা নাই। আগুরি গাড়ির পালে হাটোত দাম পাওয়া গেল হয়। তে উয়ায় এখেরে ফেলেরে নাদে।"
কথার মধ্যেই বিষাদুর বৌ এসে দাঁড়ায়। হাতে কতকগুলো শাক-পাতা। ওকে দেখে কান্তেশ্বর বলে,
"দেখির আসিলু? মানষিটা হারাইল।"
বৌদিও কম যায় না। আপাত নিস্পৃহভাব দেখিয়ে বলে,
"হারাউক। হারালে ভাল। কার কি হয় তাতে!"
কান্তেশ্বর বলে,
"হারাউকখেনে। সেলা তো খুউব এখেরে কান্দি বেরাবু।"
বৌদির কাঁদার কোনো লক্ষ্মণ দেখা গেল না। উল্টে হেসে বলে,
"হারাউকখেনে। দুইদিনে আপনে বাড়ি আসিতে দিশা না পাবে।"
আত্মবিশ্বাস দেখে কান্তেশ্বর হেসে ফেলে। বিষাদু গোমড়া মূখ করেই বলে,
"শাক হিলা আরো কার না? ভাত চড়ালে চড়াও। কনেক বনুয়া কচুর ডাইল আন্দেন।"
"কার না আরো শাক! দুই বাড়ি বেরেয়া জোড়ালুং! কনেক আইন্না আন্দিম। কালি তো হাটে করেন নাই। কি আন্দোং! আর বনুয়া কচু না ওঠালে কোটে পান! মুই যে বাঁশের মুড়া তুলোছোং সইত্যেন ঘরের না, কত্থন কচু ওঠাং। আজি আইন্না দিয়ায় খাও।"
কথাগুলো বলেই বিষাদুর বৌ আর দাঁড়ায় না। হন হন করে বাড়ির দিকে চলে যায়। কান্তেশটবর আবার আগের কথায় ফিরে যায়। একটু থেমে বলে,
"মুই তো কালি না নোইম। তুই কিন্তু আসিবু। হালখান দিয়া জমিত কয়টা পাক কোনেক ঘুরি দিয়া বাঁশে মাঠাইস। বাড়ির অগলে-বগলে এদি কোনেক শাক-পিতার না গাড়িলে না হয় বলে!"
"কুনখান জমিত?
বিষাদুর কথার উত্তরে কান্তেশ্বর বলে,
"ওই তো ডাইনপাখের খান। পুলি ফেলাইম আপাতক। তোর ভিরা-টিরা আছে তে ক। কিনি ন্যাং।"
"হ, আগোতে কলু হয়! বেচে ফেলাসুং।"
কান্তেশ্বর বলে,
"কইম কইম করি ফমে থাকে না। নিসুং বুধেশ্বরের একটা ভিরা আর মন্তেশ্বরেরটা। হবে। হামারটা আছে।"
তারপর গলায় জোর দিয়ে বলে,
"এ দা, তুই কিন্তুক মোরেঠে কাম করিবু। বাড়ির বগলের ধানলা পাকিতে মতোন কাটি ফেলাইম। এদি হাল থাকি ধরি সার উবা হাতে পুলি বানা সবে তুই করিবু। আরো মানষি নিম। কিন্তুক তুই এখেনা নিজের মতোন দেখাশুনা করিবু।"
দায়িত্ব পেয়ে বিষাদু খুশি হয়। বলে,
"নে নে হবে। মোর বাঙ্কুয়াখান যে মইদ্যতে ডুম হইসে রে, আর বানায় হয় নাই।"
কান্তেশ্বর বলে,
"হুটা চিন্তা না করিস। মোরখান আছে। আর বুদবারিয়া হাটোত দুইটা নয়া খাচারি আনোছোং, দ্যাখকেনে।"
আর কিছুদিন যেতে না যেতেই বাড়ির আশেপাশে, মাঠে শুরু হবে নতুন চাষ। তারই প্রস্তুতি সবার ভেতর। বসমতী বিকেলবেলা ঠাকুরঘরের একপাশে রাখা ভাঁড়ারে ঢুকে এ হাঁড়ি ও হাঁড়ি হাতড়ে ছোট ছোট দেশি আলুর বিছনগুলো বের করে দেখে। বাঁশের পাটাতন দিয়ে বানানো মাচাটাই হল ভাঁড়ার। একপাশে ধান রাখার ডোল বা ডুলি। লাউয়ের বস বা খোলেও কিছু আলু। বেড়ায় টোপলা বেঁধে রাখা নানান শাক সব্জির বীজ। উপরে বাঁশের উপর ঝুলছে ছোট ছোট দেশি পেঁয়াজের থোকা, রসুনের থোকা। বছর বছর বসমতীর শাক-সব্জির বীজের নিজস্ব একটা সংগ্রহ থাকেই। যা বিছন উঠবে এখান থেকেই আবার অনেকে চেয়ে নেবে। শাক-সব্জি নিজ হাতে ফলানোর আনন্দই আলাদা।
.................................................................
আইন্না - দু-তিন রকম শাক অল্প তেলে সাঁতলে রান্না করা
তাঙ্কু - তামাক
ছেঁচকুনি - বাঁশ থেকে পাতলা করে তোলা আঁশ। তামাক পাতার ছোট ছোট আঁটি বাঁধতে লাগে
বন আছে - বন্ধ আছে
ভিরা - বাড়ির পাশে গর্ত করে সারা বছর গোবর জমা করা হয়, ওটাকেই ভিরা বলে।
.................................................................
ছবি : ময়ূখ রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴