নানা রঙের গানগুলি-২১/শৌভিক কুন্ডা
নানা রঙের গানগুলি (২১)
শৌভিক কুন্ডা
---------------------------------
সরকারি মতে সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি। সে সময়ে আমার কাকুমনির মুখে 'নাগমতী' নামের একটি চলচ্চিত্রের বিষয়ে জানতে পারি। ১৯৮৩র রিলিজ সে ফিল্মটি আজও আমি দেখি নি। কেবল, গৌতম চট্টোপাধ্যায় নামটা আমার ওই প্রথম শোনা। নাগমতীর পরিচালক। "মহীনের ঘোড়াগুলি'র গান শুনেছি ক্যাসেটের যুগে। তার বেশ অনেক বছর পর একটা পুরনো সাদা-কালো ভিডিও দেখতে পাই। বাউলসুর। গাইছেন অগোছালো চুল দাড়ির একজন। গান গাইছেন বলা ভুল, দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মঞ্চ জুড়ে। লম্বা কর্ডে বাঁধা স্পীকারটি নিয়ে গাইতে গাইতে চলে যাচ্ছেন ফ্রন্ট স্টেজে। একটি চরণ গেয়ে শ্রোতাদের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন হাতের স্পীকার। তাতে ভেসে ঢুকে পড়ছে অনেক স্বরে,
" কখন তোমার আসবে
টেলিফোন।" গৌতম চট্টোপাধ্যায়। পরবর্তীতে বাংলা ব্যান্ড এ গানকে আমাদের পরের সময়ের এমনকি প্রজন্মের কাছেও পৌঁছে দিয়েছে। আরও অনেকেরই মতো আমার অন্যতম প্রিয় গান।
"কালা, যখন তখন
করো তয়াল
বুঝি না ছাই তোমার খেয়াল
তোমার আমার এই যে দেয়াল
ভাঙবে রে কখন
যখন তোমার আসবে
টেলিফোন...... "
এর অনেকটা সময় পর।তখনও জলপাইগুড়িতে মোবাইল ফোন আসে নি। বা, যদি এসেও থাকে, ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে নি। আমার ঘরেও না। ল্যান্ডলাইন ছিলো। সে সময় আমরা কাবুলিওয়ালা মসজিদের লাগোয়া একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতাম।
বেশ অনেকটা রাত। ঘুম ভেঙে গেছিলো ফোন আসার শব্দে। মধুপর্ণার বোধহয় আমারও আগে ভেঙেছিলো ঘুম। ও-ই রিসিভ করে সে কল্। আর আমি ঘুম ঘুম চোখে অবাক হচ্ছিলাম, মধুপর্ণা কোনো কথা বলছিলো না দেখে। শুরুতে একবার "হ্যালো" বলা ছাড়া! কিছুক্ষণ পর ও আমাকে ইশারা করাতে আমিও সরে গিয়ে রিসিভারে কান পাতলাম। ঘুম, উদ্ভট রিসিভিং এন্ড, সব মিলে খুব স্পষ্ট কোনো কথাকে বুঝে নিতে পারি নি। খুবই আস্তে, তবে একটা হালকা সুরের আভাস ছিলো। এবং পুরুষ কন্ঠ। এটুকু নিশ্চিত, এ সুর আমি আগে শুনি নি। শেষ হয়ে গেছিলো আমি কান পাতার একটু পরেই। অবাক আমি গভীর রাতের গান শুনে! মধুপর্ণার দিকে তাকিয়ে থেকেছিলাম চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে। আর, আরও অবাক হয়ে গেলাম বিবরণ শুনে। রিসিভড হওয়ার পর ও প্রান্ত থেকে কেউ কোনো কথা বলে নি। সামান্য নীরবতার পর গান শুরু হয়েছিলো। মধুপর্ণাও গানের কথাগুলো ঠিকমতো ধরতে পারে নি। কেবল, বলেছিলো আমাকে, খুব অদ্ভুৎ! সে রাতটা বাকিটুকু আমাদের জেগেই কেটেছিলো। অনেক হাতড়ে মধুপর্ণা বলতে পেরেছিলো, রাতজাগা, চিলেকোঠা শব্দদুটো! আর, বলেছিলো, "ঠিকমতো বুঝতে পারলাম না, কিন্তু লিরিকটা কেমন অন্যরকম। ভালোও লাগছিলো।" আর বলেছিলো, "খুব সম্ভবত ক্যাসেট।" বাকি রাতটুকু আমরা কাটিয়েছিলাম অজানা এই কলারের সম্ভাব্য পরিচিতির খোঁজে, নানা কল্পনায়।
গৌতম চট্টোপাধ্যায়, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, সুমন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা চক্রবর্তীদের হাত ধরে বাংলা গান তখন নূতন পথে বাঁক নিয়ে নিয়েছে। ব্যান্ডের গানও পুজো প্যান্ডেলে গমগম করে বাজছে। আগের মতো তেমন ভাবে গান আর শুনি না, তবু কানে এসেছিলো কিছু কিছু। তেমনি ভাবেই ঐ গমগম করা গানগুলোর দল থেকে ভেসে এসেছিলো আমার কাছে চন্দ্রবিন্দু'র এই গান:
আমার ভিনদেশি তারা
একা রাতেরই আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে...
মধুপর্ণাকে শোনালাম। গান শেষ হলে একটু চমক নিয়েই বললো, "এটাই তো, ঐ যে রাতের বেলায় ফোনে......."!
আজ আমি সেই নীরব থাকা টেলিফোন-জকিটির পরিচয় জানি! জানি বলতে, প্রমাণ দিতে পারবো না, তবে আমি নিশ্চিত। জলশহরে এসেছিলেন বাইরে থেকে, চাকরিসূত্রে। এখনও আর থাকেন না এখানে। ধন্যবাদ তাঁকে, পরের সময়কালে যে গানটি আমার অন্যতম প্রিয় হয়ে উঠবে, তার সাথে প্রথম, এবং গানটির মতোই অ-সাধারণ উপস্থাপনায়, পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴