তোর্সার ঘরবাড়ি-২১
তোর্সার ঘর বাড়ি//একবিংশতি পর্ব
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
--------------------------------------------------
নদী জল কানায় কানায়/কোথা তারে ধরি/ পুরান সব মানসি হারায়/ ধইরা রাইখতে নারি//
শুধু কি মানুষ! প্রিয় গাছ থাকে না, প্রিয় পথ থাকে না, ধুলো ঘেঁটে সোনা খোঁজে ওরা তাতেই পেট চলে কারো। ওই দশা এখন প্রজ্ঞা সান্যালের। বাড়ি ফেরেনি আজ বেশ কয়েকমাস। আসলে অনন্ত টান যে এ মাটির। এখানেই প্রিয় মুখ খোঁজে থমকে দাঁড়ায় পথের বাঁকে। এই তো সেদিন গবেষক তপন রায় বসুনিয়ার সঙ্গে হেঁটে আমতলা পেরিয়ে যেতেই হন হন করে পাশ কাটিয়ে সান্ধ্য ভ্রমণে হাঁটছে দুজন মানুষ। কি চেনা ওদের মুখ! কয়েক মুহূর্ত শুধু... একটু ছুটেই কাছাকাছি প্রজ্ঞা।.... কিরে, চিনতে পারিস? তুই তো অবনী, আমি চিনেছি ঠিক।.... আরে! মিনি না? তুই তো কলেজে এসেছিস, অনেক বছর পর, খবর পেয়েছি।...আরে, চিনতে তো পারনি। আমিই চিনেছি...অবনী, বুড়ো হয়ে গেছিস একেবারে।- হ্যাঁ।একখানা টাক পড়ে আরো।স্কুল সামলে, শুধু ঐ স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে স্কুল ফেরৎ এই পুরো বাঁধ রাস্তা হেঁটে ঘর্মাক্ত হয়ে বাড়ি ফেরা। এই তো রুটিন।তবে তুই কিন্তু বদলাসনি তেমন।.... হুঁ চেহারায় তো? ভিতরের আমিটা বহু অন্যরকম এখন। প্রিয় নদীর কাছে রোজকার মত আজ ও চলেছি তপন ভাইকে নিয়ে।ও বহু কথা খবর আমাকে জানায়।নদীপথ, গতিমুখ বদলানোর খবর, কোথায় বাঁধ হল... নতুন নতুন সব...
...আচ্ছা আবার দেখা হবে। চলে আসবি স্কুলে একদিন। বাঁধ রাস্তা কি ঝকঝকে দেখেছিস?- হুঁ তারই উৎস সন্ধানে চলেছি।
-চলুন ম্যাডাম। অন্ধকার হয়ে গেলে ঐ ফাঁসীর ঘাট বিসর্জনের ঘাটের দিকে যেতে অসুবিধে হতে পারে।তবে যতদূর জানি সেখানেও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলজ্বল করে। তবে মানুষজন কেমন তা তো জানেন ই।...এইযে দেখুন না, সেদিন ই ঐ নীলচে সাদা ডুম আলো দিয়ে সাগরদীঘির পাড় সাজিয়েছে প্রশাসন মানে পি ডব্লুডি। দেখুন একটাও আস্ত আছে কিনা,- সত্যিই মনখারাপ হয়ে যায়।তবে দুদিন যে ঝড়, মানুষকে কি আর দোষ দেবে, প্রকৃতি বিরূপ।...তবে ছেলেপুলে গুলো পথ চলতে এমন সব ভাষা নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে, কলোক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ যেন, নিজেরই কানে আঙুল দিতে ইচ্ছে করে। পিউরিটান নই আমি, কিন্তু আভিজাত্য হারিয়ে শহরকেন্দ্রিক ছদ্ম আভিজাত্য আমদানী করছে এরা।
- সত্যি ম্যাডাম, আশ্চর্য হই তবু মেনে নিই। প্রজন্ম বদলের ব্যাপার।
মিনি আর তপন হেঁটে উঠে পড়ে ভেনাসস্কয়ার ধরে সোজা বাঁধ রাস্তায়। চর এলাকার বিপুল জনবসতি ভীষণ টানে মিনিকে। যতবার আসে নতুন নতুন ভাবে কি যেন খোঁজে সে। প্রতিদিনের ডায়রীর পৃষ্ঠা ভরে যায়। রোহিনীকে পড়ে শোনায়। ফোনের অন্যদিকে 'রু' তখন আরো কিছু দেখবে বলে ছটফট করে। তবে মনের ভিতর এক শূন্যতা তার আছেই। কত ছোটবেলায় দাদু দিম্মা দুজনেই নেই হয়ে গেল। সে রাজনগরে আসতে চাইতনা আর। যে শহর ছিল তার প্রাণের, এখন সে আকাশ মাটি তার চেয়ে অনেকদূরের। মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া অনন্ত বিস্তার যোজন ব্যবধান। মিনিও সেভাবে ওর ইচ্ছে না হলে আর ডাকেনা। পড়াশুনোর কাজ, বাবাকে সে দেখে, না বাবাই তাকে দেখে রাখে সে খবরে মিনি মাথা ঘামায়না। সে খবরদারী কেউ মেনে নেয়না। দূরে থাকার যে অসম্মতি সেটাই এখন বাদ দিয়ে চলায় অভ্যস্থ। সুতরাং মিনি মিনির মতোই। সে সব ভাবলে এ রাজপথ এ নদী পুরোনো বাড়ির ইটের খিলানের কথা খুঁজবে কে! তপনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো শোনে। এই তো খুব বেশিদিন না, ২০১৪ সাল। বাঁধ রাস্তা পাকা করতে হবে, এ যেন কয়েকজন মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত। বিদ্যুতের মত এ প্রস্তাব উঠে এসেছিল ভুক্তভোগী মানুষের তরফেই। তোর্সাকে বাঁধনে বাধা তো সোজা কথা নয়। ১৯৫৪ সালের বন্যার পর ও মানুষ দেখেছিল নতুন উপনগরী গড়ে তোলা খুব সহজ নয়। বিরাট কর্মযজ্ঞ। বিরাট ব্যয়ভার।
পশ্চিমবঙ্গের সেইসময় মুখ্যমন্ত্রী ডা: বিধান চন্দ্র রায়, শরণ নিলেন সেইসময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর। উনি কিন্তু সে ডাক উপেক্ষা করেননি। কোচবিহারে চলে এসেছিলেন ঝটিকা সফরে। তোর্সার ভাঙন চাক্ষুষ করেছিলেন। সরেজমিনে খুঁটিয়ে দেখেই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সহযোগিতা ও সাহায্যের সব রকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজপ্রাসাদে দ্বিপ্রাহরিক অতিথি সেবা নিয়ে দিল্লীর পথে চলে যান। সে প্রতিশ্রুতি যে রক্ষা করেছেন প্রধানমন্ত্রী সে উদাহরণ তো মিনিদের ছোটবেলা ঘিরে ছিল। তোর্সার জলধারা সেই উদ্দালকের মতই মাটি পাথর বালি সহ ধরে রেখে কোচবিহারকে বেষ্টন করে দাঁড়িয়ে থাকা তোর্সার বাঁধেই পরিচয়।ঐ সময়ই কোচবিহার শহরের পূর্বদিকে একেবারে প্রান্তে গড়ে ওঠে নিউ পাটাকুড়া। মিনি মিলু রতু সোনা ওরা অবাক হয়ে কতগুলো বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকত খেলার সময়। ঐ দত্ত বাড়ি, গোপ্পী বাড়ি, সাহা বাড়ি, ব্রহ্ম বাড়ির বেশ খানিকটা যেন ঘরের অর্ধেক সিমেন্টের দেয়াল থেকেই শুরু হয়ে গেছে তোর্সার বাঁধ। কতবার সোনা মিলু ওদের বাড়ির খিড়কি দরজা দিয়ে বাঁধের উপর উঠে গেছে ।আর অল্প বুদ্ধি আর আবেগে ভেবেছে মিনি পুনু,আহা! তোর্সা এইরকম আমাদের দরজা থেকেই শুরু হল না কেন!...
তপন হাঁটতে হাঁটতেই বলেন, জানেন, সে সময় প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু কোচবিহারে যাতায়াতে দুটি এ্যভ্রো বিমান ব্যবহার করেছিলেন সে দুটোর নাম ছিল পুষ্পক। -আহা! কি অদ্ভুত, মিনির চোখের সামনে দেবতার পুষ্পক রথ যেন। যা শুধু কল্প চোখেই মালার মত অদ্ভুত ধোঁয়া ধোঁয়া অস্পষ্ট। যেমন 'অভাগীর স্বর্গে' কাঙালীর মা অভাগীর স্বর্গের ধোঁয়ার সিঁড়ির রথ। মনে মনে সেই বহুদিনের প্রিয় বাঁধ আর নদীর গন্ধ নেয় বুক ভরে। ভিতরে বসে থাকা এ 'বাঁধ উপত্যকা' ছবি হয়ে থাকে।
সন্ধে হয় হয়। তপন বসুনিয়া গুন গুন করে ভাওয়াইয়ার সুর ধরে। ওর পরিবারেই তো গান লেগে আছে, পত্রিকাও চালায়। লোকসংস্কৃতি বিষয়।
প্রজ্ঞা সান্যালের আচ্ছাদনে মিনি ঘুরেছে অনেক। দেখেছে কত। উত্তর ছেড়ে দক্ষিণের লোক আঙ্গিকের মোড়কে সাহিত্য নিয়েও কাজ করেছে, কতরকম মানুষ বন্ধু হয়েছে। তেমনি একজন মানুষ পুরঞ্জয় ঘোষ। উনি উত্তরবঙ্গকে যেমন তাঁর ক্ষেত্রসমীক্ষা মূলক কাজে তুলে এনেছেন, তেমনি দক্ষিণবঙ্গের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের গ্রাম চষে ফেলেছেন। চব্বিশ পরগণা থেকে মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, সেখানকার নদী, আবার গৌড়বঙ্গ মালদাও তাঁর গবেষণা থেকে বাদ যায়নি। দক্ষিণদিনাজপুর, পশ্চিম কোনদিক ই তাঁর দৃষ্টির বাইরে নয়। অথচ এ প্রান্তের গবেষক যত সবাই কেমন ক্ষেত্রসমীক্ষা ছাড়াই বেশিরভাগ উত্তরকে নিয়ে কাজ করে যায়। কোন নদীর কাছে না পৌঁছে তার গর্জনে কান না পেতেই নদী কথার বাষ্প গন্ধ বানিয়ে তোলা কথায় পূর্ন করে।দক্ষিণ বঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকার লোকসংস্কৃতি তো দূরের কুসুম এদের কাছে।..আলোচনা চলে এ প্রান্ত ও প্রান্তের। সন্ধে ঘনিয়ে রাত এলেও হেঁটে যায়। বাঁধের উপর বাঁধানো রাস্তা জুড়ে ছোট ছোট দোকান, নদীয়ালি মাছ, শাক সবই আছে। তপন বলেন, আসুন ম্যাডাম, চা খাই। চা চা করছিল বটে মন। তবে নদীর কাছে দাঁড়ালে সব ভুলে যায়, বিশেষ করে ছোটবেলার আঁকড়ে থাকা নদী কথা, চর কাহিনীর বারমাস্যা যেখানে দোল খায়। দূর পশারির হাটের দিকে বিন্দু বিন্দু আলো। নদীও স্তব্ধ অন্ধকার। বাঁশের সাঁকো জুড়ে এখনো বাইকের আনাগোনা। দোকানী চা বানানোর ফাঁকেই বলে...ঐ তো এখন তো ইলেকট্রিকি আলো হইছে। কত্ত রাইত পর্যন্ত ঐ গাড়ি যায় আর আইসে।' এদিক ওদিক ঘন কালো হয়ে জমির পর জমি কলা বাগানে ছায়া পড়ছে। আকাশে মেঘ আছে। তারাদের দেখা নেই। আবার মুখোমুখি হয় অবনীদের। সান্ধ্যকালীন হাঁটা শেষে ফেরার মুখে।....ওরে বাবা! তোরা এখনো এখানে? এ দোকানে আমিও তো চা পান করে থাকি।- তবে আয়। কলেজ বেলার মত...এই বিষ্টু আমারটায় চিনি দিবিনা। অবনীর কথাটা শেষ না হতেই তপন বলে, ম্যাডাম ও চিনি খান না।...সব চিনি ছাড়াই বানাও বিষ্টু।...অবনীর হাসির মধ্যে সেই সদ্য যুবক হয়ে ওঠার কালের ঝলক বেরিয়ে আসে। দুজনেই দুই পরিবারের কুশল আলাপ করে। মিনির ঐ বাড়ি নিয়ে বিশেষ কথা বলা আসেনা। সব কি মনের মত হয়! ' রু' ওর আদরের মেয়েটা একেবারে অন্যরকম।। ওর এখনো গবেষণার কাজ শেষ হতে তিন চার বছরের ধাক্কা।...একথা বলে দেখেছে, অনেকেই কেমন নিরুৎসাহ করেছে।...যেমন, চাকরীর বাজার এখন যা, রেজাল্ট ভাল ছিল কোন চাকরী নিয়ে নিলেই তো পারত...এসব কথার কোন উত্তর মিনির জানা নেই। ও তো'রু' কে নিজের মত বাড়তে দিয়েছে, যা কিছু জীবনের সিদ্ধান্ত সব ওর। এ নিয়ে ঠান্ডা লড়াই বাবাতে মেয়েতে। আর গড়ে ওঠার কালে কতটুকু সঙ্গ দিতে পেরেছে 'রু'কে! আর কতটুকুই বা জানে আজকালকার হাল হকিকত! কোথায় কতটুকু পা ফেলে নিজের সুবিধে, ভাল মন্দ বুঝে নিতে হয়, নিজেই জানলোনা কোনদিন! ঐ নদীর আপনমনে চলার মতই তো ওর বর্তমান। তাই গুছিয়ে নেওয়া হয়নি। মেয়ের চাকরি বিয়ে এসব নিয়ে আত্মীয়দের মাথা ব্যথা বেশি দেখেছে কখনো কখনো। আর বিষয়ী বাবার হিসেবী মেয়ে তো হলোনা রোহিনী, তাই বাবাও ওর কাছে ঠান্ডা মতন একটু দূরের নক্ষত্রের মত। ঐ যা কিছু ক্ষোভ মান অপমান ,কোন লেখা পড়ে ভাল লাগা মন্দ লাগা সব জায়গাটি মিনি। হাতে ধরা মোবাইল, আর কখনো মার জীবনে নিজেকে জড়িয়ে বোহেমিয়ান হওয়ার শখ।... অবনীর ছেলে মেয়ে, পুত্র পুত্রবধূর খবর নিতে, সদ্য কথা বলতে শেখা নাতির গল্প শুনতে ভাল লাগে প্রজ্ঞার। রাত বাড়ে। সাতটা পেরিয়ে আটটায়। তপন আব্বাসউদ্দিনের সেই চেনা সুরে মন ভরিয়ে তোলে। চা খেতে খেতে ওরা বিভোর হয়।
"তোরসা নদীর উতাল পাতাল কারবা চলে নাও/ নারীর মন মোর উতাল পাতাল কার বা চলে নাও/ সোনা বন্ধুর বাদেরে মোর কেমন করে গাওরে/ তোর্সা নদীর উতাল পাতাল কার বা চলে নাও...."
* * *
মন ভাসে। চায়ের গন্ধে আর বিজাতীয় বন্য গন্ধে...দূরে তোর্সার জল ঝিলমিল করে। তারা ফুটেছে বুঝি....
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴