চা-ডুবুরী-২১/সুকান্ত নাহা
চা-ডুবুরি : পর্ব-২১
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^
যে সানাই মিশে আছে বনজোৎস্নায়
মেয়ে সোমত্থ আর ছেলে উপযুক্ত হলেই বাড়িতে ঘটকের আনাগোনা বাড়ে। সত্যপ্রিয়র ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। 'গুদামবাবু' পদে চাকরিটা পাকা হতেই 'মালবাবু' যোগেশ ঘটক আক্ষরিক অর্থেই ঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। স্বেচ্ছায়। এর পেছনে যেমন একটা কার্যকারণ সমীকরণ ছিল, তেমনি ছিল সত্যপ্রিয়র প্রতি তার প্রচ্ছন্ন স্নেহ। ভূতপূর্ব মালবাবু আচমকা মরে ভূত হতেই সেই পদে চাপে পড়ে বহাল হতে হয়েছিল যোগেশকে। প্রভিডেন্ট-ফান্ড ক্লার্কের পদটা শ্রমিকদের মুখে অপভ্রংশ হয়ে 'ফান-বাবু' হয়ে গেলেও যতটা না দুঃখ ছিল, রাতারাতি 'ফান-বাবু' থেকে 'মাল-বাবু' হতে হবে জানার দুঃখটা আরো তীব্র ছিল। একবগ্গা যোগেশ তাই বড়বাবুর হুকুম এড়িয়ে নানান বাহানা মারছিলেন। শেষে লালমুখো বড় সাহেব যেদিন চেম্বারে ডেকে জলদগম্ভীর গলায় আধা-জলদস্যুর মতো আচ্ছা করে কড়কে দিয়ে,
' ইউ...বাবু, ফ্রম টুমরো ইউ মাস্ট টেক চার্জ অফ স্টোরস, ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড...?' বলে তোপ দাগলেন, তখন সেই 'আন্ডারস্ট্যান্ড' শব্দটার দাপটে আন্ডারপ্যান্ট খুলে যাওয়ার দশা হয়েছিল যোগেশের।
আলটপকা বহাল হওয়ায় ন্যাজেগোবরে ঘটকবাবু না পারতেন চটজলদি 'অ্যাকাউন্টস' মেলাতে না পারতেন 'ইনভেন্টরি' তৈরি করতে। অগত্যা মেধাবী সত্যপ্রিয়র দ্বারস্থ হতে হত তাকে। গুদামে চা-তৈরির তদারকির শেষে সত্যপ্রিয় মালগুদামে এসে মালবাবুর হিসেবপত্র দেখে দিত। মালপত্রের স্টক-ইনভেন্টরির কাজে সাহায্য করে দিত। কৃতজ্ঞতা বশে ঘটকবাবু তাই এই বিবাহযোগ্য ছেলেটিকে সংসারী করে তুলতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। সত্যপ্রিয়র অনুপস্থিতিতে সুনয়নীকে নানা জায়গা থেকে পাত্রীর ছবি এনে দেখাতে শুরু করলেন। যদিও ছবিগুলো প্রাথমিক দেখাতেই খারিজ করে দেন সুনয়নী। ছেলের সামনে একটিও পেশ করেননি। এদিকে সত্যপ্রিয় সারাদিন কাজ সেরে রোজ বিকেল হতেই চলে যায় বন্ধুদের আড্ডায়। ফিরে এসে গভীর রাত অবধি পড়াশোনা করে। বড় ছেলে বিশ্বপ্রিয় চলে যাওয়ার পর বাড়িতে মাত্র তিনটি প্রাণী। কুমুদরঞ্জন অসুস্থ। সারাদিন শয্যাশায়ী। কথা বলার মানুষ না পেয়ে এক এক সময় হাঁপিয়ে উঠতেন সুনয়নী। কাজ আর বই এই দুই জগত ছাড়া সংসারের কোনও বিষয়ে ছেলের আগ্রহ নেই। বিয়ের কথা উত্থাপন করলেও কোনও উৎসাহ দেখায় না। সংসারের জোয়াল কাঁধে না পড়লে নাকি ছেলেদের দায়িত্ববোধ বাড়ে না। তাছাড়া একটা বয়সের পর ছেলেদের মনের কথা খুলে বলার মতোও তো একজন মনের মানুষেরও প্রয়োজন হয়। যে তার খেয়াল রাখবে। যখন যা দরকার এগিয়ে দেবে হাতের কাছে। কিন্তু ছেলেকে সে সব বোঝাবে কে। বুঝিয়ে বলেও বিশেষ লাভ হয় না।
ঠিক এই সময় সুনয়নীর দুর্ঘটনাটা ঘটে । থমকে যায় সংসারের চাকা। চাকা সচল করতে আর একটি নারীর ভূমিকা অনিবার্য হয়ে পড়ে। যা এড়াতে পারে না সত্যপ্রিয়। যে কারণে শামুকতলা থেকে যোগেশ ঘটকের আনা পাত্রীর ছবি দেখে আর অমত না করে ছাদনাতলার দিকে পা বাড়াতেই হয় তাকে। ততদিনে সুনয়নী দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়ে বিছানা নিয়েছেন। দু'বেলা বাগানের হাসপাতাল থেকে নার্স রোহিল এক্কা এসে তার শুশ্রূষা করে দিয়ে যায়। প্রতিবেশী টাইপিস্ট-বাবুর স্ত্রী তাদের কাজের-বউকে ধরে তার বড় বোনকে ঠিক করে দেন বাড়ির কাজের জন্য। সেই বউটির ছেলের নাম ছিল খেন। সেই 'খেনের-মাসি' জটেশ্বর থেকে এসে, ধসে পড়া সংসারটার দায়দায়িত্ব একপ্রকার কাঁধে তুলে নিয়েছিল বলা যায়। মাঝবয়েসি মহিলাটি রান্নাবান্না, ঘর পরিস্কার, কাপড় কাচা থেকে শুরু করে কুমুদকে চান করানো খাওয়ানো অবধি সব কাজ করে দিত। থাকতে থাকতে অসুস্থ মানুষগুলোর প্রতি হয়ত তার মায়া জন্মে গেছিল। যে কারনে জটেশ্বরের বাড়িতেও সে যেত না । বারান্দার এক কোণে খাটিয়া পেতে ঘুমোত। রাতে রোহিল নার্স কখনও বাড়ি চলে গেলে রাত জাগত সুনয়নীর পাশে। কোনও দিন কুমুদ চেঁচামেচি শুরু করলে বায়না মেটাতে ছুটতে হত তাঁর কাছেও।
সুনয়নীর দুর্ঘটনাটা বোধহয় বিশ্বপ্রিয় ও তার স্ত্রীর বিবেকে আঘাত করেছিল। সেজন্যই হোক অথবা চক্ষুলজ্জার খাতিরে কিছুটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তারা বিয়ের ব্যাপারে এগিয়ে আসে। যদিও বৌদিকে কোনদিনই মনে জায়গা দিতে পারেনি সত্যপ্রিয়। বলা ভালো, বৌদিই সেই জায়গা করে নিতে পারেনি। অসুস্থ কুমুদকে ফেলে বিশ্বপ্রিয়র ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার পেছনে যে বৌদিটির বিশেষ ভুমিকা ছিল সেটা বোঝার পর থেকেই তার প্রতি শ্রদ্ধা চলে যায় । দাদা-বৌদি, এক মাসতুতো দিদি-জামাইবাবু, দু একজন দূরসম্পর্কের আত্মীয় এবং সর্বোপরি যোগেশ ঘটকের সক্রিয় প্রচেষ্টায় বিয়েটা অবশেষে উৎরে গেছিল। বিয়ের পর দু'ঘরে নির্জীব দুই জীবন্মৃত মানুষের মাঝে সংসার নামক রুক্ষ উপত্যকায় পা রেখেছিল নববধূ কাবেরী।
মায়ের দুর্ঘটনাটা এখনও চোখে ভাসে সত্যপ্রিয়র। ভয়াবহ দৃশ্যটা এখনও ভুলতে পারে না। মায়ের যন্ত্রণাকাতর দিনগুলোর কথা মনে পড়লে একটা নীরব ব্যথা এখনও চেতনা অবশ করে রাখে। কানে বাজে মায়ের সেই ভয়ার্ত চিৎকার। শরীরটা কদিন থেকেই একটু খারাপ যাচ্ছিল সুনয়নীর। অসুস্থ স্বামীর সেবা করতে করতে মনের সাথে শরীরের কলকব্জাগুলোও যেন নিঃশব্দে নদীভাঙনের মত ভেঙে পড়ছিল । সেটা ব্যক্ত না করলেও নজর এড়ায়নি সত্যপ্রিয়র। বাগানের ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনবে কিনা জিজ্ঞেস করলে সুনয়নী বলেছিলেন,
-' ও কিছু না-রে। বয়স হলে ওর'ম একটু আধটু হয়। তুই ঘরে বউ নিয়ে এলেই দেখবি তোর মা এমনিতেই সুস্থ হয়ে উঠেছে। '
-' কেন, বউ কী এমন যাদু করবে শুনি যে তুমি তাকে দেখেই সুস্থ হয়ে উঠবে? ওসব কথা রাখো মা, আমি আজই ডাক্তারদাদাবাবুকে খবর দিচ্ছি... '
-' তুই মিছিমিছিই ব্যস্ত হচ্ছিস সতু। একটু বিশ্রাম নিলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কার হাতে সংসারটা ছেড়ে বিশ্রাম নেব বলতো? তুই বরং এক কাজ কর। বিশ্বকে খবর দে। যোগেন ঠাকুরপো একটা মেয়ের ছবি এনেছে শামুকতলা থেকে। মেয়ে আলিপুরদুয়ারে পিসির বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করে। ভালো ঘর। ওকে একটু পাঠাব খোঁজখবর নিতে। বৌমাকেও আসতে বলিস। কতদিন ওদের দেখি না। '
সত্যপ্রিয় বুঝতে পারে এই সুযোগে বড়ছেলেকে দেখার ইচ্ছেটাও পূর্ণ করতে চান সুনয়নী। খবর পেয়ে আগের দিন সন্ধেয় বউকে রেখে বিশ্বপ্রিয় একাই এসেছিল। রাতে মা-ছেলেতে সত্যপ্রিয়র বিয়ে সম্পর্কিত নানান কথাবার্তা হচ্ছিল। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা বিয়ের টুকরো টুকরো পরিকল্পনার বহর শুনে সত্যপ্রিয়র মনে হচ্ছিল বড় ছেলের বিয়ে দিতে না পারার অপূর্ণ সাধ ছোট ছেলেকে বিয়েতে পূর্ণ করতে চান সুনয়নী।
পরদিন সকালে স্নান সেরে ডিউটিতে যাবে সত্যপ্রিয়। শরত পড়তে না পড়তেই ঠান্ডা পড়ত সেসময় ডুয়ার্সে। ভোরে উঠে তাই পাকঘরে 'লকড়ি' জ্বালিয়ে ছেলের জন্য জল গরম করতে গেছিলেন সুনয়নী। কেরোসিনের ছোঁয়া পেয়ে দাউদাউ জ্বলে ওঠা লকড়িটা উনুনে আরেকটু না ঠেলেই পেছন ফিরে চায়ের জোগাড় করছিলেন । আগুন কখন যে পেছন থেকে অসাবধানে খসে পড়া শাড়ির আঁচল ছুঁয়ে ফেলেছে সুনয়নী টের পাননি। যখন পেলেন ততক্ষণে আগুন কোমর ছাড়িয়ে চুল স্পর্শ করে ফেলেছে। চিৎকার শুনে বিছানা ছেড়ে বাইরে আসতেই সত্যপ্রিয় দেখে শরীরে আগুন নিয়ে মা উঠোনে ছুটোছুটি করছেন। ভয়াবহ দৃশ্যটা মুহুর্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয় সত্যপ্রিয়কে। নিমেষে ঘর থেকে কম্বল নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসে মাকে সেটা দিয়ে জড়িয়ে মাটিতে ফেলে দেয় বিশ্বপ্রিয়। আগুন নিভে যেতেই সুনয়নীকে পাঁজাকোলা করে তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সে ছোটে ডাক্তারবাবুকে খবর দিতে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব সত্যপ্রিয় তখনও বারান্দায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। চেঁচামেচি শুনে পাশের কোয়ার্টার থেকে কানুজ্যেঠা, ভালোজ্যেঠিমারা সব ছুটে এসেছিলেন। কেউ ভেবে পাচ্ছেন না কি করা উচিত। ভালোজ্যেঠিমা কেবল একবার করে ঘরে যাচ্ছেন আর একবার করে বাইরে ছুটে আসছেন। হাউমাউ চিৎকারে বাড়ি মাথায় তুলে বলে চলেছেন,
-' ও দিদি, কী করে এমন হল গো তোমার... কেমন করে হল...হায় ভগবান...ওরে সতু তুই দাঁড়িয়ে আচিস কেন বাবা... শিগগির যা... ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনতে গে যা... '
বিরক্ত কানুজ্যেঠা তাকে ধমক দেন, ' আঃ চেঁচাচ্ছ কেন...চুপ কর... বিশ্ব গেছে ডাক্তারবাবুকে আনতে। '
শব্দ শুনে কুমুদেরও ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা ছেড়ে উঠে এসে দরজার চৌকাঠে দাঁড়ান। হাঁ করে সকলের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বোঝবার চেষ্টা করেন কি ঘটেছে। বুঝতে না পেরে কানুজ্যেঠাকে দেখে বলেন, ' কী-ক্.. ক্কী হয়েছে কানুদা, এত চিৎকার কিসের...! '
কানুজ্যেঠা এগিয়ে গিয়ে কুমুদের হাত ধরে বলেন, ' ও কিছু নয়, তুমি ভেতরে যাও মাস্টার।'
-' কিছু নয় বললেই হল... আমি স্পষ্ট শুনলাম কেউ যেন কাঁদছে। '
-' কাঁদছে...! কই না তো... 'কানুজ্যেঠা ভোলানোর চেষ্টা করেন।
ঠিক তখনই ডাক্তার মিত্র এসে ঘরে ঢোকেন। ডাক্তার দেখে কুমুদ বিচলিত হয়ে পড়েন। নার্ভাস গলায় প্রশ্ন করেন, 'ডাক্তার কেন কানুদা....কার কী হল...? '
বাধ্য হয়ে কানুজ্যেঠাকে বলতে হয় ঘটনাটা। সব শুনে থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন কুমুদরঞ্জন। তারপর ' হায় ভগবান' বলে কেঁপে ওঠা গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টলোমলো পায়ে ঢুকে যান নিজের ঘরে।
ডাক্তার মিত্রের পেছন পেছনই এসে পড়েছিলেন হাসপাতালের অভিজ্ঞ নার্স রোহিল এক্কা । যার অসামান্য সেবা-র কথা আজও ভুলতে পারে না সত্যপ্রিয়। সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন ডাক্তারবাবু। সেই যুগে চা-বাগানে রোগীকে চটজলদি স্থানান্তরিত করার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। কত সামান্য পরিকাঠামো ছিল। চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল সীমিত। তবু কি অনবদ্য চিকিৎসা করে মাকে সারিয়ে তুলেছিলেন ডাক্তার মিত্র, ভাবলে আজও অবাক হতে হয়। কাঞ্চনপুরের ছোকরা আর.এম.পি ডাক্তারকে একদিন প্রসঙ্গক্রমে ঘটনাটা শোনাতে সে মনে হচ্ছিল রূপকথা শুনছে। অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিল সত্যপ্রিয় যেন রঙ চড়িয়ে গল্প শোনাচ্ছে তাকে। অভিজ্ঞতা যাদের সীমিত, আত্মবিশ্বাস তলানিতে, সামান্য বেগতিক দেখলেই যারা রোগীকে বাইরে রেফার করে দেয়--তাদের কাছে ঘটনাটা অবাস্তব মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল সত্যপ্রিয়র।
সুনয়নীর শরীরের প্রায় সত্তর শতাংশ পুড়ে গেছিল। প্রাথমিক ভাবে বিনয়ভূষণ যেভাবে রোহিলকে নির্দেশ দিয়ে গেলেন, রোহিল তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছিলেন। নিজে হাতে নানান ওষুধ মিশিয়ে একটা মলম তৈরি করেছিলেন ডাক্তার মিত্র। দুর্ঘটনার সাথে সাথে তাঁর নির্দেশ মতো একটা বাঁশের খাঁচাও তৈরি করা হয়েছিল। শরীরের ওপর সেই বাঁশের খাঁচাটা রেখে তার ওপর চাদর দিয়ে নিরাবরণ সুনয়নীকে ঢেকে রাখা হতো । দিনে দুবার করে এসে ড্রেসিং করিয়ে সেই মলমটা লাগিয়ে দিতেন রোহিল। ওষুধ খাইয়ে যেতেন। ডাক্তারবাবুও নিয়ম করে দেখে যেতেন দু'বেলা। একটু একটু করে মাসখানেকের মধ্যে শুকোতে লাগল শরীরের ক্ষত। ক্ষত যত শুকোত সুনয়নী তত যন্ত্রণায় ছটফট করতেন। নির্জন ঘরে সেই যন্ত্রণার আওয়াজ বিভীষিকার মতো শোনাতো। মায়ের কষ্টটা সহ্য হত না সত্যপ্রিয়র। তাই পারতপক্ষে মায়ের কাছে আসতে ইচ্ছেও হত না তার। যন্ত্রণা খুব বাড়লে রোহিল তখন কী যেন একটা খাওয়াতেন। শেকড় অথবা জড়িবুটি জাতীয় কিছু। ডাক্তার মিত্র সেটা জানতেও পারতেন না। কাতরাতে কাতরাতে একসময় ঘুমিয়ে পড়তেন সুনয়নী। দূর থেকে তখন সত্যপ্রিয় মাকে দেখত। শরীরটা ঝলসে গেলেও সুন্দরী, স্নেহময়ী মায়ের মুখটা অবিকৃতই রয়ে গেছিল। ঘুমন্ত সুনয়নীকে দেখে মনেই হত না শরীরে কোথাও এতটুকু যন্ত্রণা রয়েছে তাঁর।
আস্তে আস্তে সেরে উঠলেও স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারতেন না সুনয়নী। নিজে হাতে খেতেও পারতেন না। খেনের-মাসি রান্না করে দিলে সেই খাবার যত্ন করে খাইয়ে দিতেন রোহিল নার্স। সুনয়নীর দুর্ঘটনার পর কদিন হঠাৎ করে ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছিলেন কুমুদরঞ্জন। খেতে দিলে নিজেই চামচ করে খেয়ে নিতেন বাধ্য ছেলের মতো। স্নান করাতে গেলে বেগড়বাঁই করতেন না। কারনে অকারনে ক্ষেপে ওঠাটাও বন্ধ হয়ে গেছিল। কিন্তু সুনয়নী যত সেরে উঠতে লাগলেন তার দৌরাত্ম্যও ফের বেড়ে যেতে লাগল। সুনয়নীর অনুপস্থিতিতে খেনের-মাসিকেই সেসব ঝক্কি পোয়াতে হতো। এক একদিন অতিষ্ট হয়ে সে গজগজ করতে শুরু করে দিত,
-" কায় এনং করিবার ধৈচ্চেন দাদাবাবু...এলায় এনং করিলে মুই কাম ছাড়ি দিম কই দিছু... মোর আবস্থাখান হৈছে যেন্ 'মুই মানষি একখান পিঠা ভাজি খানখান'..."
সুনয়নী কিছুটা সেরে উঠতেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হল। যোগেশ ঘটক মেয়ে দেখতে যাওয়ার দিন ঠিক করলেন। সত্যপ্রিয়র সাথে চারজন গেছিল মেয়ে দেখতে। টেলিফোন অপারেটর বন্ধু পরেশ, দলগাঁও বাগানের এক বন্ধু ,আর যোগেশ ঘটক নিজে। আলিপুরদুয়ারে মেয়ের পিসতুতো দাদারা বেশ অবস্থাপন্ন। ব্যবসায়ী মানুষ। তাদের বাড়িতেই মেয়ে দেখার বন্দোবস্ত হলো। মেয়ে দেখে পছন্দ হল সকলেরই। ফিরে এসে সেকথা জানাতেই একদিন মেয়েপক্ষের আত্মীয়রা এলেন ছেলের চাকরিস্থল দেখতে। দিনটা ছিল রবিবার। এখনও মনে আছে সত্যপ্রিয়র, আগের দিন যোগেশ ঘটক বলে গেছিল বাড়িতে এসে,
-' সতু, কাল মেয়ের বাড়ির লোকজন আসবে। এ বাড়িতে তো সম্ভব নয়। তাই আমার বাড়িতেই ব্যবস্থা করেছি। ওখানেই উঠবেন ওরা। দুপুর নাগাদ চলে আসিস। ওখানেই খাওয়া দাওয়া করবি। ওদের সাথে আলাপ পরিচয়ও হবে। বিশ্বকেও খবর দিয়েছি। ও-ও আসবে। '
কথা দিয়েও সেদিন সময়মতো যাওয়া হয়নি। আগের দিন ফ্যাক্টরীর টিনশেড খুলে চা চুরি হয়েছিল। খবর পেয়ে ছুটির দিনে সকালেই সেন্ট্রাল এক্সাইজ ইনস্পেক্টর এসে হাজির। সকাল থেকে শুরু হল চায়ের স্টক মেলানোর কাজ। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত সত্যপ্রিয়কে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল চা ওজনের সামনে। স্টক মিলিয়ে বিকেল নাগাদ ইন্সপেক্টর সাহেব চলে যেতেই ছুটি পেয়ে যোগেশ ঘটকের বাড়ি ছুটতে হয়েছিল। মালবাবু পুরোহিতও ডেকে রেখেছিলেন। বিয়ের দিনক্ষণ সেদিনই ঠিক হয়। অঘ্রাণের সাতাশ। ইংরেজি ১৪ই ডিসেম্বর। লগ্ন রাত আটটায়।
বরযাত্রী যাওয়ার জন্য বাস ঠিক করা হয়েছিল। বরের গাড়ি পাঠিয়েছিলেন বীরপাড়ার এক মাড়োয়ারি ঠিকেদার। যার একটা ল্যান্ড রোভার জিপ ছিল। সেই জিপে বরের সঙ্গী হয়েছিল বন্ধু অতীন, পরেশ, রমেন, শিক্ষক শশীভূষণ পাল। বরকর্তা হয়েছিলেন হেডমাস্টার শ্যামাদাসবাবু। ধুতি-পাঞ্জাবি, চাদর, পায়ে পাম শ্যু পরিহিত রাশভারী শ্যামাদাসবাবুকে বরকর্তা হিসেবে মানিয়েছিল বেশ। বরের ধুতি-পাঞ্জাবি পরানোর দায়িত্ব ছিল পরেশের। বিয়ের পর বাসরঘরে গানে গল্পে জমে উঠেছিল আসর। ছেলের তরফে শশীভূষণ পাল হারমোনিয়াম বাজিয়ে আসর জমিয়ে দিয়েছিল। কনেপক্ষে কনের পিসতুতো ভাই আর এক বৌদির সুরেলা কন্ঠ মুগ্ধ করেছিল সকলকে। এককোনে চুপ করে বসে শুনছিল কনের ছোটবোন শর্বরী। সেই আসরেই নিভৃতে অতীন আর শর্বরীর মধ্যেও মুগ্ধ দৃষ্টি বিনিময় হয়েছিল কিনা সেটা আজও রহস্যই রয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে নীরবতাটুকু আজও রক্ষা করে চলেছে ওরা দুজনেই।
বৌভাতের আয়োজন হয়েছিল বড়বাবু শ্রীনাথবন্ধু ঘোষের কোয়ার্টারে । কোয়ার্টারটি বড়সড় বাংলো আকারের। ভেতরে, বাইরে প্রশস্ত বারান্দা। সামনে লন। বাগান কর্তৃপক্ষ রীতি অনুসারে যোগান দিয়েছিল বড় বড় তারপোলিন শিট, খাবার রাখার জন্য চা ওজন করার বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের গামলা, জল ধরে রাখার ড্রাম, জলের গাড়ি। জটেশ্বর থেকে রান্নার ঠাকুর, বীরপাড়া থেকে মুদির জিনিস, ফালাকাটা থেকে মাছ, দৈ-মিষ্টি সব আয়োজন শ্রীনাথবাবুই করেছিলেন। অতিথিদের খাওয়ানো হয়েছিল বারান্দায় তারপোলিন শিট পেতে কলাপাতায়। পরিবেশনের দায়িত্বে ছিল বাগানের বাবুরা। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে অতিথি আপ্যায়ন করেছিলেন শ্রীনাথবন্ধু বোস। কনেকে বসানো হয়েছিল তাঁর বাড়ির বৈঠকখানায় ফরাস পেতে। বাগানের মাঈজি ও তাদের মেয়ে- বৌরা ঘিরে ছিল নববধূকে। বধূসাজে অপূর্ব লাগছিল দেখতে কাবেরীকে।
অনেক রাতে প্রীতিভোজ শেষে অতিথিরা চলে যেতেই সকলে মিলে বর-কনেকে পৌঁছে দিয়েছিল তাদের ঘরে। কুমুদরঞ্জন ঘুমিয়ে পড়লেও জেগেছিলেন সুনয়নী আর খেনের মাসি। বিশ্বপ্রিয় তার স্ত্রীকে নিয়ে পাশের বাড়িতে চলে গেছিল। ঘরে ঢুকে শাশুড়ি মায়ের সাথে দেখা করতে তার ঘরে ঢুকতেই সুনয়নী বিছানায় উঠে বসার চেষ্টা করেন। খেনের-মাসি ধরে ধরে বসিয়ে দেয় তাকে। সুনয়নী ইশারায় পুত্রবধূকে বসতে বলেন। তারপর খেনের-মাসিকে ইশারা করেন কিছু। সে বালিশের তলা থেকে একটি ছোট গয়নার কৌটো বের করে। সেটা খুলে একটা পাতলা সোনার চেন বের করে। সুনয়নী সেটা ইশারা করে পরিয়ে দিতে বলেন তাকে পুত্রবধূর গলায়। পরিয়ে দিতেই শাশুড়ি মাকে প্রণাম করে কাবেরী। কিছু বলতে চান সুনয়নী। জড়িয়ে যাওয়া কথাগুলো স্পষ্ট না হলেও সত্যপ্রিয় বুঝতে পারে মা বলতে চাইছেন, 'সুখী হও। ভাল থাকো। '
মায়ের ঘর ছেড়ে কাবেরীকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে সত্যপ্রিয়। ঘরটায় নাইট ল্যাম্প জ্বালানো। কেউ পরিপাটি করে বিছানায় সাদা চাদর বিছিয়ে টগর, গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে গেছে। জানালার পর্দা সরানো সরানো । কাচের শার্সি ভেদ করে শুক্লপক্ষের চতুর্দশীর চাঁদের আলোয় এসে পড়েছে বিছানায়। সেই মায়াবী আলো আঁধারির ভেতর সত্যপ্রিয় মনে হচ্ছিল কাবেরীকে কত কথাই যেন তার বলবার আছে। কিন্তু সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। নির্জন সৈকতে আছড়ে পড়া সমুদ্রের ঢেউ যেমন তার সবটুকু উচ্ছাস একলহমায় নিঃশেষ করে দিয়ে ফিরে যায় তেমনি করে সব না বলা কথা একরাতে নিঃশেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল। বলা হয় না। আবেগে বুজে আসা গলায় সত্যপ্রিয় সেদিন কাবেরীর হাতে হাত রেখে শুধু এটুকুই বলতে পেরেছিল, 'আমি বড় একা কাবেরী। আজ থেকে তুমি আমার পাশে এলে। আশা করব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তুমি আমার পাশেই থাকবে। '
কথা রাখেনি কাবেরী। দীর্ঘ যৌথযাপনের কলরব হঠাৎ থামিয়ে, করতলে নিঃসঙ্গতার বিবর্ণ পাপড়িটা ফের গুঁজে দিয়ে সে দিব্যি নিঃশব্দে আড়াল করেছে নিজেকে ভোরের কুয়াশা মাখা বনজোৎস্নায়। যেখানে ঘাসের আগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুতে পড়ে আছে রোদ ঠিকরানো একরাশ স্মৃতি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴