আমি এক যাযাবর-২১/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর (একবিংশতি পর্ব)
শৌভিক কুন্ডা
আগের পর্বে পরিচয় দেওয়া বৃদ্ধ ভদ্রলোক মিলিটারি পুলিশে চাকরি করতেন। বহুদিন হ'ল অবসর নিয়েছেন। ওঁর বড়ো ছেলে নীরজও তাই। অবসরের পর নীরজ কোলকাতায় থাকেন সপরিবার, গ্রামের বাড়িতে এই হোমস্টে তৈরির ভাবনাটিও তাঁরই। প্রেম এ প্রজন্মের ছোট ছেলে। আর এক দাদা-বৌদির সাথে এই থেকে হোমস্টের ভালোই বোঝে। শান্ত বৌ'দি টিও তাই।
গত পর্বে বলেছি যে পুজোর কথা, একে একে আমাদের ছ'জনের বাকিরাও সেখানে এসেছিলো। এরপর স্নান, দুপুরের খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম। এর মধ্যেই আলোচনা হচ্ছিলো বিকেলে সানসেট/ভিউ পয়েন্টে যাওয়ার। সুশীলদার শরীর সাথ দেয় না, এদিকে মন নাচতেই থাকে! ঠিক হ'ল মিনু-সুশীলদা আর চুমকি গাড়িতে যাবে যতদূর চাকা গড়াতে পারে, তারপর যেটুকু হাঁটা সম্ভব, হাঁটবে। জোনাক-জিশান আর আমি হেঁটেই যাবো পাহাড়ি রাস্তায়। প্রেম নিজেই বললো এই হাঁটা পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে সে। সাড়ে চারটেয় বের হতে হবে, এই ফরমানও দিয়ে রাখলো। গুগলে দেখে নিয়েছি এখানে আজ সূর্যাস্ত বিকেল ৫টা ২৪য়ে।
সময়মতোই তৈরী হয়েছিলাম সকলে। গাড়ি চলবে সড়ক ধরে। আবারও প্রেমের পিঠে সুশীলদা, দোতলা থেকে গাড়ির সীট। বাকি দু'জনও জায়গায় বসলে ইঞ্জিন গর্জে উঠলো। আর প্রেমের ইশারায় আমরা তিনজন ওর সাথে রওনা হলাম এক্কেবারে উল্টো মুখে। দু'পা এগিয়েছি কি এগোই নি, পেছন থেকে মিনুর ডাক, "দাঁড়াও, দাঁড়াও"। সুশীলদাকে চুমকি বাপির হেফাজতে রেখে তিনি নেমে পড়েছেন, হেঁটেই যাবেন বলে! জিশান সাবধান করবার চেষ্টা করলো, " এসো না আন্টি, এ রাস্তা কিন্তু খুব টাফ হবে, প্রেমভাই বলেছে। পারবে না তুমি।" আমি থামালাম ওর উদ্বেগ। খুশীও হলাম। বছর তিনেক আগে এই বান্ধবীটি আর আমি বক্সা ফোর্টের রাস্তায় হেঁটে উঠেছিলাম, জিরো পয়েন্টে বাকিরা থেমে যাওয়ার পর। আমার হৃদয় কাটাছেঁড়া, মিনু দক্ষিণ ভারতে নার্ভের চিকিৎসা সেরে এসে হুইলচেয়ার ছেড়েছে সদ্য! জিশানের এটা জানার কথা নয়।
অল্প কিছুটা বাঁধানো সড়কে হাঁটা। আমরা পাঁচজন ছাড়া আগে পিছে নানা শেডের সবুজ ছাড়া আর কিছু নেই, কেউ নেই। হঠাৎই প্রেম মূল রাস্তা ছেড়ে বামপন্থী সিঁড়ি ধরলো, পিছে পিছে অতএব আমরাও। সিঁড়ি বলতে কোনো এক কালে হয়তো কংক্রিটের ছিলো, এখন ভাঙাচোরা, ফাঁকফোকড়ে পাতা-শেকর, বুকের ওপর ঘাস, শ্যাওলা। এলাচের বাগান, মকাইয়ের জমিন, কমলাগাছের ঢাল, কোথাও শুধুই ঘাসবন কাটিয়ে সরিয়ে ওপরদিকে চলা। পায়ের নীচে কোথাও ভাঙা ভাঙা আদিমকালের সিঁড়ি, কোথাও নুড়িমাখা মাটিই কেবল। প্রাগৈতিহাসিক এক সরীসৃপ যেন মহাপ্রস্থানের পথ হয়ে শুয়ে আছে। এরই মধ্যে শুরু হ'ল বৃষ্টি। দুটো ছাতা সঙ্গে ছিলো, একটার অধিকারী বাকি সকলের কোরাস নির্দেশে আমি একা (আমি নাকি হাফ লাং নিয়ে বেঁচে আছি, ডাক্তার বলেছেন প্রথম কোভিডকালে), আর একটায় মিনু-জোনাক। মাচো জিশান ছাতা নেবে না, আর প্রেমের তো পোষা কুকুর, ওকে কামড়াবে না! এই করতে করতে পাইনবনের আতিথ্যে। সানসেট তো দূরকথা, যা মেঘ আকাশে, ভিউ পয়েন্টটাই আদৌ দেখা যাবে কি না, কে জানে! কিন্তু ফিরে যাওয়ার কথা কারোরই মাথায় আসে নি। অতএব, ঢাল তুই কতো ঢালতে পারিস, পানসি চলে বেলঘড়িয়া! কতক্ষণ হেঁটেছি খেয়াল রইলো না, মাঝপথে একটুকরো সমান জমিতে ভুলভাল ভলিবল পাহাড়ি ছেলেদের। ঐটুকুই শুধু মানুষস্পর্শ, বাকি সবটাই সবুজের সাম্রাজ্য। তার ফাঁকে ফাঁকে দু চারটি চলতি নির্মানকাজ, প্রেম জানালো এ সবই হোমস্টে হতে চলেছে কোলকাতার মালিকদের! দার্জিলিং চা পাতার নামে যেমন লোক ঠকানো ব্যবসা, উত্তরের পাহাড়ি জমিনে ঠিক সেরকমই হোমস্টের ফাঁকিবাজি। মালিকদের কারোরই 'হোম' নয় এগুলো, তবু।
ভিউপয়েন্ট একসময় পৌঁছনো গেল। সেখান থেকে বৃষ্টিধোওয়া ১৮০° দেখতে দেখতে আফসোসও এলো, আমাদের ভাগ্যে এই ক্যানভাসে সূর্যাস্ত আঁকা নেই! মনের খেদ কিছুটা মিটলো ফেরার পথে পথচলতি দোকানে মোমোর অথেন্টিসিটি। এখন যে চত্বরে, চারখোলের এই প্রাণকেন্দ্রে, দু তিনটে দোকান, তিন চারটি বাড়ি, চার পাঁচটা কুকুর, পাঁচ ছ'টা হোমস্টে, ছ'সাতজন স্থানীয় মানুষ, আমরা ছাড়াও সাত আটজন ভ্রমণার্থী। আর বৃষ্টি ধরে এলে একা একটা চাঁদ আকাশে।
হোমস্টেতে ফিরে দারচিনি এলাচ লবণ দিয়ে লাল চা এই দশ/বারো কিলোমিটার হাঁটার শ্রম অনেকটাই জুড়িয়ে দিলো। পথচলতি মোমো পেটে আর জায়গা রাখে নি, ফলে চায়ের সঙ্গী 'টা'গুলো বিফল মনে ফিরে গেল। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়া। মিনু বলেই যাচ্ছে "অনেকদিনের অনভ্যাস, দেখো, পা ব্যথা করবে"। না, করে নি। তবে চোখ খানিক লেগে এসেছিলো। ঐ, খানিকই। জেগে উঠে জিশানকে না দেখতে পেয়ে বাইরে বের হলাম। আর, আমার শহরে যখন এসি চলছে, বাইরে বের হয়ে টের পেলাম, এদেশে উইন্ডচিটার অন্তত গায়ে চাপাতেই হচ্ছে!
নীচে নেমে দেখি জিশান 'তুম্বা'য় মজেছে! পরিবারের একজন হয়ে আড্ডায় আছে জোনাকও, আর মাঝে মাঝেই কড়া নজরদারি ভাইএর দিকে, বাড়াবাড়ি যাতে না করে ফেলে। এই, এই পারিবারিক আড্ডাটাই হোমস্টের আসল ফ্লেভার আমার কাছে। মনখুশ আরও হ'ল, এঁরাও আমাদের আপন মনে করেই রাতের পাতে ছুরপির আচার জুড়ে দিলেন। খাওয়ার পরে আর এক প্রস্ত আড্ডা। ছেলে চুপিচুপি রক্সির যোগাড়ও করে ফেলেছে এর মধ্যেই! পুরনো পাপী আমি, তুম্বা আর রক্সির ভয়ংকর কম্বিনেশন কি হতে পারে ভালোই জানি। চোখের ইশারাই যথেষ্ট ছিলো প্রেমের জন্য। জিশানও খুব আক্ষেপ করার সময় পায় নি, বিছানায় শরীর রাখতে না রাখতে তুম্বা-ঘুম!
মাঝরাতে চারখোলের আকাশে আকাশে চাঁদ যেন ক্ষেপে উঠেছিল। লাল টকটকে চোখ মেলে কাকে যে খুঁজে চলেছিলো কে জানে! আরও একবার আফসোস হয়েছিলো আমার, একটা ভালো ক্যামেরা নেই বলে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴