অন্তহীন আকাশের নীচে-২১/দেবপ্রিয়া সরকার
অন্তহীন আকাশের নীচে
পর্ব ২১
দেবপ্রিয়া সরকার
------------------------------
“বউ কথা কও”, “বউ কথা কও”, বলে গলা ফুলিয়ে সুর করে পাখিটা ডেকে যাচ্ছে। শান্ত দুপুরের নীরবতা ভেঙে কানে আসছে তার কলরব। দোতলার জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পাখিটাকে। ফুলে ঢাকা একটা জারুল গাছের ডালে বসে ডেকেই চলেছে সে। ইন্দ্রায়ুধ একলা ঘরে স্বয়ংদ্যুতিকে জড়িয়ে ধরে বলল, বলো তো পাখিটা কী বলছে?
স্বয়ংদ্যুতি মুখ বিকৃত করে বলল, ওই পাখিটা? পিউ কাঁহা, পিউ কাঁহা, বলছে মনে হচ্ছে।
বাহুবন্ধন আরও একটু শক্ত করে ইন্দ্রায়ুধ বলল, ধুস্! তুমি কিচ্ছু জানো না। পাখিটা বলছে “বউ কথা কও”। শোনো মন দিয়ে।
-তাই তো! এই পাখির ডাক আমি আগেও অনেকবার শুনেছি কিন্তু বোলটা খেয়াল করিনি সেভাবে।
-ও বুঝতে পেরেছে হবু বউয়ের পায়ের ধুলো পড়েছে এ’বাড়িতে। তাই চিৎকার করে সকলকে জানিয়ে দিচ্ছে।
-ইস্! পাগল একটা! ছাড়ো আমাকে। আন্টি এসে পড়বেন এখুনি।
-উঁহু, আসবে না। কারণ মা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে পারে না। হাঁটুর ব্যথা। তাই তো তোমাকে ঘর দেখানোর বাহানায় এখানে নিয়ে এলাম।
-ও রে পাজি ছেলে! তলে তলে এতো বুদ্ধি!
-বাহ্, এটুকু বুদ্ধি থাকবে না? মাত্র দু’দিন হল প্রেম করছি এর মধ্যেই প্রেমিকা আমায় ছেড়ে পালাচ্ছে, এটা কী কোনও কথা হল? আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, তারপরেই কয়েক শো মাইলের দূরত্ব!
ইন্দ্রায়ুধকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল স্বয়ংদ্যুতি। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে বলল, তুমি তো কলকাতায় আসছ আগামী সপ্তাহে? আমি থাকব ওখানে। তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
স্বয়ংদ্যুতিকে ছেড়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল ইন্দ্রায়ুধ। চিন্তিত স্বরে বলল, ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু জানিনা ভাগ্যে কী আছে। যদি একটা সম্মানজনক পেশা জোটাতে না পারি, তবে তোমার সামনে দাঁড়াব কোন্ মুখে?
ইন্দ্রায়ুধের কাছে এসে তার চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল স্বয়ংদ্যুতি। তারপর একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, একটা কাজ করব, দু’জনে দুটো ইউটিউব চ্যানেল খুলে ফেলব। তারপর আমাদের রোজকার জীবনের ঝগড়াঝাটি, হাসিকান্না, প্রেম-ভালবাসার বৃত্তান্ত দেখাব পাবলিককে। রিয়েল লাইফ ডেইলি সোপ, আর কী! এখন এসব খুব চলছে। গাদা গাদা মোবাইলের ডেটা খরচ করে লোকজন দেখছে সেগুলো আর হু হু করে ইনকাম বাড়ছে ইউটিউবারদের।
আইডিয়াটা মন্দ না, তবে রাধাকান্তজেঠু কি মেনে নেবেন একজন ইউটিউবার জামাইকে, যেখানে আরেক জামাই বিদেশে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার?
-বাবা! ওটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমি বাবাকে যা বলব, বাবা তাতেই রাজি হবে, চাপ নিও না। বাট জোকস্ অ্যাপার্ট, আমি জানি খুব ভাল হবে তোমার ইন্টারভিউ। তুমি যথেষ্ট ভাগ্যবান যে এতদিন পর শীতঘুম কাটিয়ে জেগে উঠেছেন কর্তৃপক্ষ এবং ফাইনালি আবার কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে রিক্রুটমেন্ট প্রসেস শুরু হয়েছে।
-সেটাই সান্ত্বনা। বেশ কয়েকটা প্রাইভেট কলেজেরও অফার আছে আমার কাছে। তবে আমি এখনও সেগুলোর কোনও রিপ্লাই দিই নি। আগে সি এস সিটা দেখে নিই, তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে।
-আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি ইন্দ্র, সত্যিকারের ট্যালেন্ট আর অনেস্টি যাদের থাকে তারা জীবনে কখনও থেমে থাকে না, ঠিক একটা না একটা রাস্তা বেরিয়ে যায়। এতো ভেবো না তো, পরিস্থিতি যেমনই হোক আমি আছি তোমার সঙ্গে, প্রমিস।
ইন্দ্রায়ুধের দুটো হাত শক্ত মুঠিতে ধরে তার গভীর চোখের অতলে ডুব দিল স্বয়ংদ্যুতি। হালকা লিপস্টিক লাগানো তার খানিক ভেজা ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে ফেলল ইন্দ্রায়ুধের পুরুষালি অধরকে। প্রেমের সুধাপানে মত্ত হয়ে উঠল তারা। অনেকটা ভালবাসা বুকে ভরে নিয়ে স্বয়ংদ্যুতি বলল, এবার যেতে হবে ইন্দ্র। নাহলে বাড়ির সকলে চিন্তা করবে।
অনিচ্ছা সত্বেও দু’হাতের বন্ধন আলগা করল ইন্দ্রায়ুধ। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসে ইন্দ্রায়ুধের মায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল স্বয়ংদ্যুতি। তিনি পরম মমতায় তার চিবুক ছুঁয়ে বললেন, খুব ভাল লাগল, মা। আবার এসো। রাধাকান্ত ঠাকুরপোকে বলো তার কন্যাটিকে আমাদের ভারী ভাল লেগেছে। যশো বলছিল তার সঙ্গেও নাকি ফোনে কথা হয়েছে তোমার?
স্বয়ংদ্যুতি উত্তর দেওয়ার আগেই ইন্দ্রায়ুধ বলে উঠল, হ্যাঁ মা, দিদির সঙ্গে ভিডিও কলে পরিচয় হয়েছে ওর।
-আজকাল কত কী যে হয়েছে বাপু! ও’সব আমার ঠিক মাথায় ঢোকে না। একবারটি যাবে নাকি ওর সঙ্গে দেখা করতে?
আলপনার প্রশ্নের উত্তরে স্বয়ংদ্যুতি বলল, যশোধরাদি ওঁর বাড়ি যেতে বলেছিলেন বটে, কিন্তু আজ আর সময় হবে না আন্টি। পরের বার এসে নিশ্চয়ই যাব। তুমি ভাল থেকো, কেমন? আমি ফোন করব মাঝে মাঝে।
-বেশ মা, তাই করো। আর এই পাগল ছেলেটাকেও একটু শাসন টাসন করো। নাওয়া-খাওয়ার কোনও সময়জ্ঞান নেই। বড্ড অবাধ্য হয়েছে। আমার কথা একদম শোনে না আজকাল।
হাসি মুখে আলপনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল স্বয়ংদ্যুতি। ইন্দ্রায়ুধ তাকে নামিয়ে দিয়ে এল মামাবাড়িতে। স্নান, খাওয়া সেরে তৈরি হয়ে নিল স্বয়ংদ্যুতিরা। স্টেশনে রওনা হবার আগে সকলে জড়ো হল ঊষারানীর ঘরে। উদাসীন চোখে ঊষারানী সকলকে জরিপ করছিলেন। সঞ্জীবনী তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমরা আসি মা।
ঊষারানী খানিকক্ষণ আধবোজা চোখে তাঁর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, যাচ্ছিস সঞ্জু? আবার আসিস। আমারও ডাক চলে এসেছে রে। এবার আমাকেও যেতে হবে। ওই আকাশের পাড়ে অনেকদিন ধরে একলা বসে আছে আমার দেবু। আর কতদিন সে মাকে ছেড়ে থাকবে বলতে পারিস? তোদের সকলের সঙ্গে দেখা হল, এবার আমি দেবুর কাছে যাব।
গত দু’দিন ধরে মাঝে মধ্যেই অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন ঊষারানী। এখন সকলকে একসঙ্গে চলে যেতে দেখে তাঁর বুকের ভেতর জমে থাকা আধো-অন্ধকারের ঘোরটা আরও বেশি করে চাগাড় দিয়েছে যেন। সঞ্জীবনী কান্না ভেজা গলায় বললেন, অমন করে বলো না মা।
ঊষারানীর পা ছুঁয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন সঞ্জীবনী। একে একে রাধাকান্ত, অরুন্ধতী, সত্যেন্দ্র, ডাববু, সোহাগ এবং সবশেষে স্বয়ংদ্যুতি এসে প্রণাম করল ঊষারানীকে। সকলকে করুণ চোখে দেখছিলেন তিনি। স্বয়ংদ্যুতি হাসিমুখে বলল, এসব সেন্টু মার্কা কথাবার্তা আমায় বলে কোনও লাভ হবে না, বুঝলে? পরের বার যখন আসব, তখন ঠিক এখানে এভাবেই দেখতে চাই তোমাকে।
ঊষারানীর মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেল। বললেন, আমার হবু নাত জামাইকে বলবি রোজ এসে এই বুড়ির একবার করে খোঁজ নিয়ে যেতে, কেমন?
এভাবে সকলের সামনে ঊষারানী কথাটা বলবেন আন্দাজ করেনি স্বয়ংদ্যুতি। লজ্জায় লাল হয়ে সে বলল, সে তো এখানেই থাকবে, তুমিই ডেকে বলে দিও না।
কান্নাহাসির আবহে রাঘবেন্দ্র আর জয়শীলার কাছ থেকে বিদায় নিল সঞ্জীবনীরা। দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে আঁচলের খুঁটে চোখ মুছল বকুল। স্টেশনে ঢুকতেই স্বয়ংদ্যুতি দেখতে পেল ইন্দ্রায়ুধকে। একটা কালো জিন্সের ওপর হালকা সবুজ পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছে প্ল্যাটফর্মে। তাকে দেখেই রাধাকান্ত আর সত্যেন্দ্র হৈ হৈ করে এগিয়ে গেলেন। সকলের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বললেও তার বিষণ্ণ চোখ ফিরে ফিরে দেখছিল স্বয়ংদ্যুতিকে। ট্রেন আসতে এখনও মিনিট দশেক দেরী আছে। সত্যেন্দ্র, ডাববু, রাধাকান্তরা ইন্দ্রায়ুধকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই ইচ্ছে থাকলেও সে বা স্বয়ংদ্যুতি কেউই একে অপরের কাছাকাছি যাবার সুযোগ পাচ্ছিল না। অবস্থা আন্দাজ করে অরুন্ধতী ইন্দ্রায়ুধের সামনে গিয়ে বলল, ইন্দ্র, ভাই একবার এদিকে এসো তো।
অরুন্ধতীর ডাক শুনে এগিয়ে এল ইন্দ্রায়ুধ। তার হাত ধরে নিয়ে এসে স্বয়ংদ্যুতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিল অরুন্ধতী। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, এদের নিয়ে আর পারা যায়না! কোথায় নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে তোমাদের দু’টিকে একটু কথা বলার চান্স করে দেবে, তা নয়, বকবক করেই যাচ্ছে! নাও আর মিনিট সাতেক সময় পাবে যা যা বলার বা শোনার আছে সব মিটিয়ে নাও।
অরুন্ধতী চলে যেতে একটা থামের পাশে এসে দাঁড়াল ইন্দ্রায়ুধরা। স্বয়ংদ্যুতির দু’চোখ ভারী হয়ে আছে। ইন্দ্রায়ুধের বিষাদ মাখা মুখ দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন একপোঁচ কালি লেপে দিয়েছে। নীরবে তারা চেয়ে থাকল একে অপরের দিকে। পাশের বকুল গাছ থেকে হঠাৎ ডেকে উঠল আবার সেই ‘বউ কথা কও’। আসন্ন বিচ্ছেদের দুঃখের মাঝেও সামান্য খুশি ছুঁয়ে গেল তাদের। পাখির ডাক শুনে হেসে উঠল দু’জনেই।
দূর থেকে ভেসে এল ট্রেনের হুইসল। আশেপাশের মানুষজন সজাগ হল। মালপত্র কাঁধে নিয়ে তৈরি হল যাত্রীরা। স্বয়ংদ্যুতিরাও ফিরে এল নিজেদের জায়গায়। বিরাট এক সাপের আকৃতির ট্রেন এসে দাঁড়াল প্ল্যাটফর্মের প্রান্তে। অন্য যাত্রীদের সঙ্গেই স্বয়ংদ্যুতির পরিবারের সকলে ঝটপট মালপত্র নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল। অন্যরা ভেতরে চলে গেলেও স্বয়ংদ্যুতি গেল না, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। ইন্দ্রায়ুধ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। স্বয়ংদ্যুতির বুকের ভেতরটা ক্রমশ ফাঁকা হয়ে আসছে। দু’চোখ ভরে উঠছে জলে। ইন্দ্রায়ুধ এগিয়ে এসে তার হাতটা ধরতেই সে ধরা গলায় বলল, তাড়াতাড়ি চলে এসো ইন্দ্র। আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্যে।
ইন্দ্রায়ুধের বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাওয়া কান্নাটাকে প্রাণপণ চেপে রেখে সে বলল, আসছি টুপুর। আর মাত্র তিন’ চারটে দিন। তারপরেই দেখা হচ্ছে আমাদের। সাবধানে যেও।
মিনিট কয়েক পরেই কেঁপে উঠল স্বয়ংদ্যুতির পায়ের তলাটা। ধীরে ধীরে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। যতক্ষণ সম্ভব হল ততক্ষণ তার হাত ধরে রইল ইন্দ্রায়ুধ। তারপর বাড়তে থাকল গতি, বাড়তে থাকল দূরত্বও। একসময় ইন্দ্রায়ুধের দৃষ্টিপথের সীমা ছাড়িয়ে গেল স্বয়ংদ্যুতি। অন্তহীন আকাশের প্রান্তে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল ট্রেনটা।
ইন্দ্রায়ুধের পা দুটো আটকে গিয়েছে প্ল্যাটফর্মে। বুকের ওপর কেউ যেন একটা ভারী বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। ধীর পায়ে স্টেশন চত্বর ছেড়ে সে বেরিয়ে এল। কোথা থেকে একফালি মেঘ এসে ঢেকে দিয়েছে ঝলমলে আকাশটাকে। বাইকে উঠে ইঞ্জিন চালু করল ইন্দ্রায়ুধ। গত কয়েকটা দিন তার স্বপ্নের মতো কেটেছে। স্বয়ংদ্যুতির সঙ্গে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলোর কথা ভেবে তার মনের মেঘলা আকাশে একচিলতে খুশির রোদ উঠল। মাঝে মাত্র কয়েকটা দিন, তারপর স্বয়ংদ্যুতিকে সঙ্গে নিয়ে অপার সুখের পথে পা বাড়াবে সে। আসন্ন রঙিন দিনগুলোর কথা ভেবে একটা লম্বা শ্বাস নিল সে, তারপর গতি বাড়িয়ে শেষ দুপুরের ফাঁকা রাস্তায় বাইক ছোটাল ইন্দ্রায়ুধ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴