মীনগ্লাস চা বাগিচা-১/গৌতম চক্রবর্তী
মীনগ্লাস চা বাগিচা/প্রথম পর্ব
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
মে- জুন মাস। প্রায় দেড় মাস বিদ্যালয় বন্ধ। রাজ্যের মাধ্যমিক শিক্ষার মানচিত্রে জলপাইগুড়ি জেলার স্থান ১৯ নম্বরে। বিষয়টা একজন শিক্ষক হিসাবে আমাকে গভীরভাবে ব্যাথিত করে। তাই বাগিচা সফরে গিয়ে সমস্যার রুট কোন জায়গাতে খোঁজার চেষ্টা করি আমার মত করে। এবারের “সহজ উঠোনে” তাই মালবাজার মহকুমার গুডরিকস গ্রুপের একটি অন্যতম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান মীনগ্লাস চা বাগিচার ক্ষেত্রসমীক্ষাকে দুটি দিক থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। একটি
বাগিচাকেন্দ্রিক ইকো তথা টি টুরিজম এবং অপরটি বাগিচাতে করোনাকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত শিক্ষার হালচাল। তাই আজকের লেখনীতে নিপাট গদ্যের ক্ষেত্রসমীক্ষার মধ্য দিয়ে বাগিচাতে শিক্ষা সমস্যা এবং সমাধানের কিছু দিক নির্দেশ করার চেষ্টা করেছি। যাতে এতটুকু ভেজাল নেই। পরের দিন সবুজ গালিচার ইকো টুরিজমের গল্প শোনাবো দ্বিতীয় পর্বে। ২০২০ এর আগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যাবস্থাতে যাও বা ছিল, করোনাকালে লকডাউন তথা পড়ুয়াদের অনলাইন পড়াশুনা কার্যত বন্ধই করে দিয়েছিল বাগিচার লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর পড়াশুনা। ভাবের ঘরে চুরি করে কোন লাভ নেই। নাগরাকাটা, মালবাজার, বীরপাড়া বা মাদারিহাটের মত জায়গার হাতেগোনা দু-একটি স্কুলে অনলাইন ব্যবস্থা চালু থাকলেও জলপাইগুড়ি জেলার গ্রামীণ ও চা বাগান অধ্যুষিত এলাকার লক্ষাধিক স্কুল পড়ুয়া কোনও ধরনেরই পড়াশোনার মাধ্যম না পেয়ে সম্পূর্ণ দিশাহীন হয়ে পড়েছিল করোনাকালে। রাজ্যের উদ্যোগে টেলিভিশনে পড়াশোনার একটি কর্মসূচি নেওয়া হলেও হিন্দী মাধ্যমের পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য সেটা কতটুকু সুফল দিল তার খোঁজখবর কোন ঠান্ডা ঘরে বসা “অচিনপুরের আমলা” করেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। তবে সর্বশিক্ষা দপ্তর সক্রিয় ছিল। বই-খাতা কিংবা মাসে মাসে মিড-ডে মিলের সামগ্রী মিললেও আসল লেখাপড়াটাই হয় নি। উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা মহৎ হলেও পরিকল্পনা, প্রণয়ণ, তার সুফলে যে ফাঁক ও ফাঁকি থেকে গেল তা কি ধরতে পারলেন সরকারের শিক্ষা দপ্তরের পদস্থ আধিকারিকেরা? উত্তর দেওয়ার দায় আর নাই বা নিলাম।
ক্ষেত্রসমীক্ষাতে এসে কথা বলেছিলাম নাগরাকাটার আবাসিক একলব্য মডেল স্কুলের অধ্যক্ষ অমরজিৎ সিংহ চৌহানজীর সঙ্গে। বিষয় ছিল বাগিচাতে অন লাইন পড়াশুনা। পরিষ্কার জানিয়েছিলেন, “পড়াশোনার অনলাইন ব্যবস্থায় অনেক চা বাগানের পড়ুয়া স্বচ্ছন্দ নয়।” চা বলয়ে অনেকেই বিরক্ত হয়ে সরব অন লাইন ব্যাবস্থার বিরূদ্ধে। শ্রমিকদের বক্তব্য ছিল,” অনলাইন ক্লাসের সময় সমস্যা হয়। তখন তো বাগানের কাজ থাকে। মোবাইল প্রয়োজনে আনতে হয়। বাড়িতে খাওয়া জোটে না। কটা মোবাইল কিনব? কত টাকার রিচার্জ করাবো?” ছাত্রদের কাছ থেকে জেনেছিলাম অনেক কষ্টে বাবা-মা পড়ুয়াদের স্মার্ট ফোন কিনে দিচ্ছে। কিন্তু তাতে কী! চা বলয়ে নেটওয়ার্ক পাওয়াটা খুবই কঠিন। স্কুলও দীর্ঘদিন বন্ধ। ফলে কেউ বাড়ির হাল সামলাতে, কেউ আবার নিজের দু’বেলার খাবার জোগানের তাগিদে ডুয়ার্স ও তরাইয়ের বাগানে দৈনিক কাজে লেগে গিয়েছে। ভগতপুর চা বাগানের বাসিন্দা শচীন ওরাওঁ নাগরাকাটা হাইস্কুলে একাদশ শ্রেণিতে পড়ত। তার কথায়, “স্কুল বন্ধ, অন লাইন ক্লাস হয়। বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তাই ঘরে বসে না থেকে সুযোগ পেলেই চা পাতা তুলতে যাই।” কিছু ছাত্রদের বক্তব্য ছিল “স্কুল নেই, পড়াশোনা নেই। যতটা পড়েছি তা-ও ভুলতে বসেছি।” নাগরাকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পিণাকী সরকারের সঙ্গে একান্ত আলোচনাতে জেনেছিলাম, অভাবের তাড়নায় পড়ুয়াদের অনেকেই চা বাগানে অস্থায়ীভাবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের এবং অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে প্রত্যেককে পড়ায় ফেরানোর চেষ্টা করছিলেন শিক্ষক শিক্ষিকারা। আলিপুরদুয়ারের বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) আশানুরুল করিমের কাছ থেকে জেনেছিলাম, “এই পরিস্থিতির জন্য পড়ুয়াদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা বড় কারণ। তবু ওই পড়ুয়াদের সকলকে বুঝিয়ে যাতে পড়াশোনার ব্যস্ততায় ফিরিয়ে আনা যায় শিক্ষক শিক্ষিকারা সেই চেষ্টাই করছেন।” তফসিলি জনজাতি প্রধান চা বলয়ের পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বুলু চিক বরাইকও যিনি নিজেও চা বলয়ের বাসিন্দা।
জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলায় অসংখ্য জনজাতিভুক্ত ও ভিন্নভাষী মানুষের বসবাস। চা বাগানের তপশিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের অনেকেই স্কুল ছুট কিংবা বেকার। চা বাগিচার প্রথম জেনারেশনের বহু পড়াশুনা না জানা চিন্তিত অভিভাবককে সমানভাবে চিন্তিত শিক্ষা আধিকারিকরা সমগ্র শিক্ষা অভিযানের পক্ষ থেকে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের মিড-ডে মিলের সঙ্গে মডেল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন স্কুলগুলি বাংলার শিক্ষা পোর্টাল থেকে এই টাস্ক প্রিন্ট করে নেবে। সমাধান করা ওই টাস্ক পরের মাসের মিড-ডে মিলের সামগ্রী বণ্টনের সময় অভিভাবকদের মাধ্যমে স্কুলগুলি জমা নেবে। এতে পড়ুয়ারা পড়াশোনার মধ্যে থাকতে পারবে। এই বাবদ যা খরচ হবে তা কম্পোজিট গ্রান্টের তহবিল থেকে প্রধান শিক্ষকরা খরচ করতে পারবেন বলেও জানানো হয়। তবে হ্যা, প্রণাম জানাই শিক্ষক সমাজকে এবং বিশেষত জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন, শিক্ষা দপ্তর এবং সর্বশিক্ষা মিশনকে “শিক্ষার পরশ” প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পঠন পাঠনের কিছুটা সুফল পৌঁছে দেওয়ার জন্য। করোনাকালে বাগিচাগুলিতে শিক্ষার প্রাথমিক নির্যাস এইটুকুই। কিন্তু কোন জায়গাটাতে জোর দেওয়া প্রয়োজন শিক্ষাকর্তারা সেটাই ধরতে পারেন না। এটাই সমস্যার। অসমের চা বাগানের শ্রমিক ঘরের ছেলে মেয়েদের জন্য কর্মসংস্থানের কোর্স চালু করেছিল টি বোর্ড পরীক্ষামূলকভাবে। অসম মডেলকে অনুসরণ করে উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলিতে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প গ্রহণ করা খুব জরুরী। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের গোড়া থেকেই টি বোর্ড এরকম একটা পরিকল্পনা নিয়েছিল শুনেছিলাম। শিখন এর কাজ শুরু হয়ে যাবে বলে কথাও ছিল। ২০২২ সালে খোঁজখবর নিতে গিয়ে দেখলাম পরিকল্পনাই হয়েছে। প্রণয়ন হয়নি।
ডুয়ার্সের চা বাগানে বিশেষত জলপাইগুড়ি, বানারহাট, মালবাজার, বানারহাট, মেটেলি, মাদারিহাট, বীরপাড়া, কালচিনি, আলিপুরদুয়ার এবং কুমারগ্রামের চা বাগিচা বলয়ে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করে আদিবাসী যুবক যুবতীদের মোবাইল মেরামতি, কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের উপর প্রশিক্ষণ, ডেটা এন্ট্রি (বেসিক কম্পিউটার এবং সফ্টওয়্যার) এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্র মেরামতি (ইলেকট্রিক্যাল ট্রেনিং) এর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাবস্থা টি বোর্ড এবং রাজ্য সরকারের বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্রম বিষয়ক দপ্তরের করা প্রয়োজন। টি বোর্ড সূত্রে জানা গিয়েছিল ২০১৯ সালে প্রাথমিক যখন পরিকল্পনা হয়েছিল তখন কেন্দ্রীয় খরচের ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৮ লক্ষ টাকা করে এক একটি সার্কিটে মোট ২৪ লক্ষ টাকা। কথা ছিল তিন মাসের কোর্স এর মেয়াদ শেষে পরীক্ষা হবে। উত্তীর্ণদের দেওয়া হবে সরকারি শংসাপত্র। কিন্তু ২০২০ সাল থেকেই করোনার গ্রাসে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। দূরভাসে ধরেছিলাম টি বোর্ডের তৎকালীন ডেপুটি ডিরেক্টর চন্দ্রশেখর মিত্রকে যিনি স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প তৈরি করে টি বোর্ডের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকে জেনেছিলাম মোবাইল সারাতে বাগান এলাকার মোবাইল গ্রাহকদের শহরে আসতে হয়। হাতের কাছে মোবাইল রিপেয়ারিং এর দোকান হলে একাধারে যেমন গ্রাহকদের সুবিধা হবে তেমনই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের স্থানীয় স্তরে মোবাইল রিপেয়ারিং এর দোকান করবার সুযোগ সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই এই সিদ্ধান্ত। কম্পিউটার হার্ডওয়ারের কাজও স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যুক্তি হিসাবে তিনি বলেছিলেন বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোতেও ডেটা এন্ট্রি অপারেটর এর প্রয়োজন হয়। ডেটা এন্ট্রির প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর বাগানের আদিবাসী ছেলেমেয়েরা এই ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ পাবে। পাশাপাশি হার্ডওয়্যার রিপেয়ারিং প্রশিক্ষণও এর ওপরেও জোর দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে বলে তিনি জানিয়েছিলেন।
চন্দ্রশেখর মিত্রের কাছ থেকে জেনেছিলাম সেই সময়ে এই পরিকল্পনাটি উত্তরবঙ্গে ছিল প্রথম। এর ফলে চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা কর্মসংস্থানের নতুন দিশা খুঁজে পাবে। কারণ যে কোর্সগুলি করানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল তার সবগুলোই ছিল বৃত্তিমূলক। কোর্সগুলির সাফল্য দেখে পরবর্তীতে চা বলয়ের অন্য জায়গাগুলিতে কোর্সগুলি করানো হবে বলে প্রাথমিকভাবে ভেবে রেখেছিল টি বোর্ড। টি বোর্ড এবং ভারত সরকারের অনুমোদিত সংস্থা ইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইসিআইএল) এর যৌথ উদ্যোগে চা বলয়ে এই উদ্যোগ ছিল প্রথম। পরিকল্পনা ছিল প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তিন মাস করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণ চলাকালীন শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকে ১৫০০ টাকা করে ভাতা পাবেন। প্রশিক্ষণ শেষে সফল শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে সাহায্য করবে টি বোর্ড। উত্তরবঙ্গের চা শিল্পের নিরিখে টি বোর্ডের এমন উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল করোনা এবং লকডাউন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখন আবার নতুন করে কেন এই স্কিমে কাজ শুরু করা যাবে না? টি বোর্ড এর পক্ষ থেকে চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের পড়ুয়াদের বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি এবং পুরস্কার দেওয়া হয়। চা বাগানে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারী পরিবারের যে সমস্ত পড়ুয়া বেসরকারি স্কুল এবং কলেজে রেগুলার কোর্সে পড়াশোনা করছে পরিবার পিছু এইরকম সর্বোচ্চ দুজনকে স্কুলের বাৎসরিক টিউশন ফি টি বোর্ডের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়ে থাকে যার সর্বোচ্চ পরিমাণ কুড়ি হাজার টাকা। এর বাইরে হোস্টেলে থেকে যারা পড়াশোনা করে তাদেরকেও এই বাবদ সারা বছরের খরচ হিসাবে সর্বোচ্চ কুড়ি হাজার টাকা টি বোর্ডের পক্ষ থেকে পড়ুয়ার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দিয়ে দেওয়া হয়। তা ছাড়াও রাজ্য সরকারের প্রচুর স্কিম রয়েছে তপশিলী জাতি এবং উপজাতিদের জন্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে চা বাগিচার হতদরিদ্র শ্রমিকেরা এই প্রকল্পগুলো জানবে কি করে? না টি বোর্ড, না ম্যানেজমেন্ট, না ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব এইসব ব্যাপারে শ্রমিক পরিবারগুলিকে সাহায্য করে। এমনকি চা বাগিচার শিক্ষিত যুবক যুবতীরাও এই সমস্ত স্কিম সম্পর্কে জানে না। এর ফলে সাংঘাতিক রকমের বঞ্চিত হচ্ছে বাগিচার পড়ুয়ারা।
এক উল্টো পুরাণের কাহিনী শোনাবো। ২০১৯ সাল। লোকসভা নির্বাচন হয়ে গেছে। উত্তরের বাগিচাতে আশা নিরাশার এক নতুন ওয়েভ। কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপির দাপাদাপি উত্তরের মাটিতে। দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুরের চা বলয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য ভারতীয় জনতা পার্টির। গিয়েছিলাম ডুয়ার্সের চা বাগানকেন্দ্রিক আমার দ্বিতীয় বইটির জন্য বানারহাট সার্কিটের চা বাগিচাগুলির হাল হলিকত জানতে। গ্রাসমোর, গাঠিয়া, লুকসান হয়ে রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচাতে কাজ সারতে সারতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। যে বাগিচাগুলিতে কাজ করলাম অর্থনৈতিকভাবে সেগুলি পিছিয়ে পড়া বাগিচা এবং একটি পরিপূর্ণভাবে বন্ধ অনেকদিন ধরেই। দেখেছিলাম শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে আন্দোলন, সরকারি স্তরে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব এবং তাকে ঘিরে মিটিং এসবের মধ্যেই বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে অনেকেই বাগান ছেড়ে দিয়ে নানারকমভাবে দু’পয়সা রোজগারের চেষ্টা করছে। কিন্তু কাজের সুযোগ খুবই কম। রেডব্যাঙ্কে কাজ করতে করতেই জয়েন্ট ম্যানেজমেন্ট এর সদস্য রানা সরকারের কাছ থেকে শুনেছিলাম ডায়না চা-বাগানের বিনোদ গুরুং এবং বিশাল কুমালের কথা। ডুয়ার্সে নিজেদের চা-বাগানে বিকল্প রোজগারের পথ দেখানোর ক্ষেত্রে চা-বাগানে কার্যত নজির গড়েছে তারা। কৌতূহল হল। রানার কাছ থেকে ঘটনার নির্যাস হিসাবে যেটা পেয়েছিলাম সেটা হল একটা সময় চা বাগানের আর পাঁচটা যুবকের মত ডায়নার কুম্ভিগছ শ্রমিক মহল্লার বিনোদ আর বিশাল দিল্লি পাড়ি দিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে। কয়েক বছর কাজ করার পর সেখান থেকে ফের বাড়িতে ফিরে আসেন। ২০১৮ সালে ওই বাগানেই দুজনে মিলে শুরু করে হাওয়াই চটি তৈরীর কাজ। ভিন রাজ্যে কাজ করে যে সঞ্চয় হয়েছিল তার পুরোটাই তাঁরা লাগিয়ে দেন কারখানার পেছনে। তাদের হাতে তৈরি হাওয়াই চটির কারখানার গল্প পৌঁছে গিয়েছিল দেশের রাজধানীর প্রশাসনিক অলিন্দে। বাগানটিতে গিয়ে ওই জুটির কর্মকাণ্ড নিজের চোখে দেখেছিলেন ভারতীয় রাবার বোর্ডের চেয়ারম্যান ডঃ সওয়ার ধনানিয়া। পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ডুয়ার্সে যে রাবার নির্ভর শিল্প স্থাপন সম্ভব তা দুই যুবক প্রমাণ করেছেন।
পৌঁছেছিলাম ডায়নার কুম্ভিগছ শ্রমিক মহল্লার বিনোদ আর বিশালের ফ্যাক্টরিতে। নিজেদের শ্রমিক আবাসনের পেছনে ১২ ফুট বাই ১৮ ফুটের এক চিলতে ঘরে তাদের ফ্যাক্টরি। বিনোদের কাছ থেকে জেনেছিলাম প্রাথমিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। কাঁচামাল হিসেবে রাবার শিট নিয়ে আসেন দিল্লি থেকে। মেশিন আনেন গুজরাট থেকে। সেখানে তারা দিনভর ব্যস্ত থাকেন চটি তৈরিতে। নিজেদের নামের আদ্যাক্ষর এর সঙ্গে মিল রেখে চটির নাম রেখেছিলেন বিবিসি স্লিপার। শিশু থেকে বুড়ো সব বয়সীদের চটি তারা তৈরি করছিলেন। কাজ দিয়েছিলেন স্থানীয় আরো তিনজনকে। রাবার শিট থেকে একটি চটি কাটলে তাদের মেলে ৮০ পয়সা করে। মেশিনের উৎপাদনক্ষমতা ৮ ঘণ্টায় ৪০০ চটি। সেই হিসেবে সারাদিন কাজ করলে সুনীল প্রধান, প্রকাশ ভুজেল এবং সুজিত ছেত্রী নামে তিন কর্মীর ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হত। কখনো কখনো তারও বেশি। খুশি ছিলেন তারাও। একবছর বয়সী ওই শিল্প সাড়া ফেলেছিল ডুয়ার্স থেকে শুরু করে পাহাড়েও। নানাস্থান থেকে বরাতও আসতে শুরু করেছিল। সেই বছর পুজোর বরাত হিসাবে চাহিদা ছিল ৮০০০ জোড়া। যদিও সময়মতো জোগান দেওয়া সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না তাদের। কারণ অন্তত চার লক্ষ টাকার শিট প্রয়োজন ছিল। পকেট থেকে খরচ করে কারখানা তৈরির পর হাতে তখন আর টাকা ছিল না। প্রথমদিকে যে উৎপাদন হতো তা শুধু মার্কেটিংয়ের জন্য। বিনা পয়সাতেই বিতরণ করতে হয়েছে নানা স্থানে। তার সুফল পেতে ব্যবসা শুরু করার পর তখন অর্থসংকট। চা বাগানে প্রতিবছর শ্রমিকদের চটি দেওয়া হয়। স্থানীয় যুবকদের তৈরি যদি চা বাগান কর্তৃপক্ষ কিনে নেয় বাগানে তবে সেটাও বেশ ভালই হবে তাদের পক্ষে। সেটা নিয়েই বুক বেঁধে এগিয়ে চলেছিলেন তারা। কিন্তু সর্বনাশা করোনার পর তাদের ব্যাবসার হালহকিকত জানতে আর যেতে পারিনি। “সহজ উঠোনের” বানারহাট বা নাগরাকাটা অঞ্চলের সহৃদয় কোন পাঠক যদি একটু খোঁজ দিতে পারেন তাহলে কথা দিলাম আপডেট তথ্য নিয়ে আসব।
বছর তিনেক আগেও ছবিটা এমন ছিল না। কেউ সবুজ সাথী সাইকেল নিয়ে স্কুলে যেত। কেউ বা কলেজে ক্লাস করে বাড়ি ফিরত বিকেলবেলায়। দিন আনি দিন খাই পরিবারে ওদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লড়াই ছিল। কিন্তু তার পাশাপাশি স্কুল-কলেজে যাওয়ার, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার আনন্দও ছিল৷ করোনা সব ছিনিয়ে নিয়েছিল। ওদের দিনমজুর বাবা-মায়ের কাজ, ওদের স্কুল-কলেজ সবকিছু। তবু ওরা হার মানেনি। নতুন লড়াই শুরু করেছিল। পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর লড়াই। পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়ির কাজ করতে হত। করোনার পর তার পাশাপাশি রোজগারের কথা ভাবতে হয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই ওরা হয়ে উঠেছে সংসারে দশভুজা। বন্ধ রেডব্যাংক চা বাগানের মেয়ে ওরা। বাগান তো বন্ধ হয়েছে প্রায় এক দশক হল। বাবা-মা দিনমজুরি করে বা অন্য বাগানে কাজ করে ওদের বড় করেছেন। আর্থিক অনটন ওদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু ঘরে যেটুকু চালডাল আসত তাও তো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল করোনা পর্বে। বাবা-মায়ের কাজ নেই ছিল না। চেয়েচিন্তে কোনমতে কয়েকমাস চলেছিল। তারপর আর তো চলে না। তাই ওরা এগিয়ে এসেছিল পরিবারের পাশে। রেডব্যাংক চা বাগানের কয়েকশো “কন্যাশ্রী” তখন আশপাশের চা বাগানে গিয়ে কাঁচা পাতা তোলার কাজ করেছে। দিনের শেষে যা আয় হয়েছে তা তুলে দিয়েছে মা-বাবার হাতে। একসময় টানা শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় গোটা দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলে দেওয়া রেডব্যাংকে খোলা
বন্ধ থাকার পর্ব চলেছিল ২০০৩ সাল থেকে। ২০১২-র দেবীপক্ষে বোনাস ইস্যুতে সেখানকার মালিকপক্ষ সেই যে বাগান ছেড়ে চলে যায় তারপর থেকে আর ফেরেনি। এরপর পাশের ডায়না নদী দিয়ে বয়ে গিয়েছে বহু জল। বন্ধ বাগানের ফ্যাক্টরির তালায় শুধু মরচে ধরেছে। চাবির সন্ধান দিতে পারেননি দেশ বা রাজ্যের তাবড় মন্ত্রী আমলাদের কেউই। ডুয়ার্সে এই ধরণের মরচে পড়া তালার সংখ্যা কিন্তু কম নয়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴