ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর-২০/মৈনাক ভট্টাচার্য
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-২০)
মৈনাক ভট্টাচার্য
রাম ভাঞ্জি সুতারের ‘ঐক্যের মূর্তি’ঃ সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল
ইতালীয় ভাস্কর মিকেলেঞ্জেলোকে মনের মতো পাহাড় কেটে নিজের কাজের জায়গায় নিয়ে আসতে হয়েছিল। পাহাড় থেকে গন্তব্য পর্যন্ত এত ভারী পাথর আনার জন্য রাস্তার নকশাও তৈরি করতে হয়েছিল তাকেই। প্রথাগত বাস্তুকারী শিক্ষা না থাকলেও একজন দক্ষ বাস্তুকারের মত পারদর্শিতায় এই কাজটি করেছিলেন তিনি। জিনিয়াস সব সময়ই জিনিয়াস। সেই কবেকার কথা, ষোড়শ শতকের দোরগোড়ায়। মিকেলেঞ্জেলো তখন আমাদের গভীর ভাবে অনুভব করিয়েছিলেন ভাস্কর্য আর বাস্তুকারী দুটোর মধ্যে পরিপূরক সংবেদনশীলতার কত বড় সহাবস্থান থাকে।
রামকিঙ্করের ‘সাঁওতাল পরিবার’ বানাতে গিয়ে দুর্বল কাঠামো ভেঙ্গে শুরুতে যে ভোগান্তি হয়েছিল সে গল্প আগেই এসেছে। একজন ভাস্করের আর্মেচার বা কাঠামো নিয়ে সমস্যা নুতন নয়। একটু বড় ভাস্কর্য নির্মাণ করতে হলে সব চেয়ে আগে তার কাঠামো ঠিক আছে কিনা সেটা যদি বুঝে না নেওয়া যায় ভাস্করের ভাগ্যে যে অসীম দূর্ভোগ এটা ভাস্কর মাত্রেই জানে। দেশে বিদেশের সব বড় ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে মূল ভাস্কর্যের পাশাপাশি সেই ভাস্কর্যের স্টাকচারাল ডিজাইন একটা বড় বিষয়। এই ক্ষেত্রে ভাস্কর এবং বাস্তুকারকে এক ছাতার তলায় কাজ করতেই হয়। দুজনের এই মেলবন্ধন একটা সফল কাজের পরিপূরক। গল্প যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্যের যা কিনা স্ট্যাচু অফ লিবার্টির প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতার একশ বিরাশি মিটার লম্বা। ভাবা যেতে পারে প্রায় ষাট তলা ভবনের সমান উঁচু। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের এই ভাস্কর্য তৈরির ক্ষেত্রে এমন বন্ধনও যে অনিবার্য হবে এতে আর সন্দেহ কোথায়।
প্রশ্ন উঠতেই পারে কেন এই প্যাটেল ভাস্কর্য। কেনই বা এই মূর্তির নাম ‘ঐক্যের মূর্তি’ বা ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর মন্ত্রী সভার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন পৃথিবীর দীর্ঘতম ভাস্কর্য হবে ভারতের ‘লৌহ মানব’ সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের পূর্ণাবয়ব ব্রোঞ্জ মূর্তি। নিজের দলের ভেতরেই তিনি সমালোচিত হয়ে উঠলেন। এই মানুষটাই তো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে নিষিদ্ধ করেছিলেন গান্ধী হত্যার অভিযোগে। এই মানুষটাই সঙ্ঘের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিষ ছড়ানোর অভিযোগ করেছিলেন। তারই কিনা বিশালাকার মূর্তি বানাবেন আর এস এসএর ভূমিপুত্র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে সর্দার প্যাটেল দর্শণ ভাবনার এটা একটা দিক যদি হয় আর একটা দিক বোধ হয়, স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে প্রায় পাঁচশ ষাটটি রাজ্যকে ভারত সরকারের অধীনে এনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। তিনিই সেই ব্যক্তি, যিনি ভারতমাতাকে টুকরো টুকরো করার চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। সেই সময় যাঁরা স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবীদার ছিলেন, প্যাটেল ছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির একজন। গান্ধীজির অনুরোধেই স্বাধীনতা লাভের পর, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আবার নিজেকে সরিয়েও নিয়েছিলেন। বহু মতভেদ থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সুষ্ঠু শাসন চালাতে হয়, সেটা সর্দার প্যাটেল করে দেখিয়েছিলেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, প্যাটেল ছিলেন প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী। তাঁর ছায়া আজও ভারতীয় রাজনীতিতে ‘লৌহমানব’ উপাধির মধ্য দিয়ে উজ্জ্বল। ভারতবর্ষ তো দাঁড়িয়েই আছে বৈচিত্রের মধ্যেই ঐক্যের ভাবধারায়। অবিচ্ছিন্ন ভাবে তা আবার প্রতিষ্ঠিত উপনিষদের মহান সেই বাণী ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর উপর।
সে যাক ঐক্যের এই মূর্তি বানানোর সহমত হতেই ডাক পড়ল ভাস্কর রাম ভাঞ্জি সুতারের। কেননা তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমে আছে পঁয়তাল্লিশ ফুট লম্বা চম্বল স্মৃতিস্তম্ভ, সেই সাথে ভারতের পার্লামেন্টের বিখ্যাত মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্য। তাঁরই করা গান্ধীর একটি আবক্ষ মূর্তিকে অনুলিপি করে অন্যান্য দেশেও পাঠানো হয়েছিল। বেঙ্গালুরু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একশ আট ফুট লম্বা কেম্পে গৌড়া মূর্তির ডিজাইনও তাঁরই করা। এই কাজের জন্য তাই ভাস্কর সুতার নি:সন্দেহে একটি নির্ভরযোগ্য নাম।
স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হল গুজরাতের নর্মদা নদীর পাশের ১২ বর্গ কিঃ মিঃ ক্ষেত্র বিশিষ্ট সাদু বেট আইল্যান্ডেকে। এই কৃত্রিম হ্রদের প্রায় ২০,০০০ বর্গ মিটারের কিছু বেশি জায়গা জুড়ে তৈরি করা হবে এই মূর্তি। এমন বড় কাজ, এমন খোলা মেলা পরিবেশ। একজন ভাস্করের কাছে এই কাজের বরাত পাওয়া স্বপ্নের মতো।
যদিও এই বরাত ভাস্কর সুতার পেলেন ভারতের বিখ্যাত নির্মান সংস্থা লারসেন এন্ড টুব্রো কোম্পানীর মাধ্যমে। কেননা এই কাজে ভাস্করের ভূমিকা প্রধান হলেও ষাটতলা প্রায় সমান লম্বা এই নির্মান ধরে রাখার জন্য যে কারিগারী কৌশল দরকার সেটা একজন অভিজ্ঞ বাস্তুকারী সংস্থা ছাড়া সম্ভবই নয়। এই সব ক্ষেত্রে কাজের বরাতের নিয়ম বিশ্বজুড়ে কাজটির বরাত চাওয়া বা ‘গ্লোবাল টেন্ডারিং’। শুরুতে ভারত সরকারের তরফ থেকে এই প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় নির্ধারণ করা হয় তিন হাজার কোটি টাকা। পরবর্তীতে লারসেন এন্ড টুব্রো তার সর্বনিম্ন দর দুইহাজার নয়শ উননব্বুই কোটি দরপত্র দিয়ে নকশা, নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার বরাত পায়। দুইহাজার তের সালের শেষের দিকে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রথমে এলঅ্যান্ডটি কোম্পানি উনিশশো ঊনপঞ্চাশ সালের প্যাটেলের একটি আলোকচিত্রকে ভিত্তি হিসেবে নেয়। এই আলোকচিত্র দেখে প্রথমে আঠারো ফুট উঁচু ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য তৈরি করেন ভাস্কর রাম ভি সুতার। সেই ভাস্কর্য প্যাটেলের জন্মস্থান গুজরাতের আনন্দ জেলার কারামাসাদে নিয়ে জনসমক্ষে প্রদর্শন করা হয়। মূলত, প্যাটেলের বাস্তব জীবনের সঙ্গে ভাস্কর্যের মিল আছে কি না, সেটা যাচাইয়ে স্থানীয় জনতার মতামত ও পরামর্শের জন্য এটি করা হয়েছিল। জনতার প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন করে রাম সুতার পরবর্তি পর্যায়ে আবার একটি ত্রিশ ফুট উচ্চতার ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। বিভিন্ন গোষ্ঠীর পরামর্শের ভিত্তিতে সেটাই চূড়ান্ত করা হয়।
দুইহাজার তের সালের ডিসেম্বরে ভারত জুড়ে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল রাষ্ট্রীয় একতা ট্রাস্ট নামের একটি সংস্থাও গঠন করা হয়। এই সংস্থার মাধ্যমে প্রচার কার্যক্রম চালানো হয় ঐক্যের এই মূর্তি প্রতিষ্ঠার সমর্থনে। এই সংস্থার তরফ থেকে দেশ ব্যাপি একটি অভিযানও চালানো হয় যার নাম দেওয়া হয় 'ঐক্যের মূর্তি আন্দোলন'।
এইবার মূল কাজ করবেন ভাস্কর সুতার এল এন্ড টির তত্বাবধানে। ভাস্কর সুতার ভাবনায় পড়লেন এত বিশাল মাপের কাজ তিনি করবেন কিভাবে। তথ্য ঘেঁটে দেখা গেল উচ্চতার দিক থেকে এর আগে সর্বোচ্চ প্রতিমূর্তি বানানোর রেকর্ড রয়েছে চীনের। বুদ্ধের ‘বসন্ত মন্দির’ নামের মূর্তি, যার উচ্চতা একশ তেপান্ন মিটার। অনেক ভাবনা এবং এলএন্ডটি কোম্পানির সাথে পরামর্শের পর চীনের জিয়াংজি টোকাইন কোম্পানি বা জেটিকিউ এর কারিগারি সহযোগিতা নেওয়ার কথা ভাবলেন শিল্পী। ঠিক হল কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাম সুতার চীনে গিয়ে জেটিকিউয়ের কাজ পর্যবেক্ষণ করবেন। এই কাজের জন্য শিল্পীকে বার চারেক চীনে যেতে হল। বিভিন্ন সাইজের প্রায় সাত হাজার ব্রোঞ্জ প্লেট ভাস্কর্যটিতে স্থাপন করা হয়। ভাস্কর্যের স্টাকচারাল ডিজাইনার হিসেবে এলএন্ডটির বিশেষজ্ঞরা ভাস্কর্যটিকে তিন স্তরবিশিষ্ট কাঠামোয় বিন্যস্ত করলেন। অভ্যন্তরীণ স্তরে একশ সাতাশ মিটার উঁচু পর্যন্ত দুটি টাওয়ার দেওয়া হল, যা ভাস্কর্যের বুক পর্যন্ত বিস্তৃত। এই টাওয়ার দেওয়ার কারণ লম্বা মূর্তি উইন্ড প্রেসার বা প্রাকৃতিক হাওয়ার চাপ থেকে মূর্তিকে রক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতে সহযোগিতা করবে। দ্বিতীয় স্তরটিতে দেওয়া হল স্টিলের কাঠামো ও তার ভেতরে সিমেন্ট কংক্রিট এবং তৃতীয় স্তর বা ভাস্কর্যের বাইরের ভাগে দেওয়া হল আট মিলিমিটার পুরু ব্রোঞ্জের আস্তরন। এর সাথে যুক্ত করা হল ভাস্কর্যের আপাদমস্তক দর্শনের জন্য ছাব্বিশ জন করে এক সাথে যেতে পারে এমন দুইটি লিফ্ট। যার একটি সাধারণ লিফ্ট এবং অন্যটি ফায়ার লিফ্ট। যেই লিফটের মাধ্যমে খুব দ্রুততার সাথে যাতে মূর্তির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায়।
এই ভাস্কর্যের নিচ থেকে পঁচিশ মিটার উঁচু বা আটতলা অব্দি পৌনে পাঁচ হাজার বর্গ মিটার জুড়ে রয়েছে সর্দার প্যাটেলের জাতীয় জীবনের কৃতিত্ব ধরে রাখা আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনী হল ও চলচ্চিত্র কেন্দ্র। মূর্তির পাদদেশে আছে ভ্রমণকারীদের জন্য হাঁটার পথ, ফুট কোর্ট, বড় বাজার ও অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা।
'ঐক্যের মূর্তি আন্দোলন'এর মাধ্যমে ভাস্কর্য এবং অন্যান্য কাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় লোহা সংগ্রহে সারা ভারতে গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে তাদের ব্যবহৃত কৃষি উপকরণ দান করার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। এসভিপিআরইটি ভারত জুড়ে এই লোহা সংগ্রহের জন্য ৩৬ টি অফিসও স্থাপন করেছিলেন। আনুমানিক পাঁচ লক্ষাধিক কৃষক এতে লোহা দান দেন। ভাস্কর্য নির্মাণে ছয় লক্ষ গ্রামে লোহার টুকরা সংগ্রহের জন্য তিন মাস ধরে দেশব্যাপী প্রচারণা চালানো হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার টন লোহা সংগ্রহ করা হয়। শুরুতে বলা হয়েছিল সংগৃহীত লোহা মূল মূর্তির নির্মাণে ব্যবহৃত হবে, যদিও পরবর্তিতে এই লোহা মূল মূর্তির পরিবর্তে এই প্রকল্পের অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়।
দুইহাজার আঠারো সালে বিশ্ব দ্রষ্টব্যের পালকে বিশ্বের সব চেয়ে উঁচু মূর্তির কৃতিত্ব উঠে আসার সাথে সাথে সমুদ্র মন্থনে কালকূট হলাহলের মত উঠে আসে অনেক বিতর্কও। দেশের অর্থনীতি এই মূহুর্তে ‘ঐক্যের মূর্তি’র জন্য কি সত্যিই স্বাস্থ্যকর, কতটা লাভবান হবে এই অঞ্চল বিশ্ব পর্যটনের বিদেশী মুদ্রা টেনে আনতে আমাদের তাজমহলের মত। এই মূর্তি তৈরির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ স্থানীয় আদিবাসী ও কৃষকদের একটা অংশ। তারা বলেছেন, ফসলের দাম পাওয়া যাচ্ছে না, চাষের জল নেই - অথচ বিপুল অর্থ খরচ করে এই মূর্তি বানানো হল।
শুধু দীর্ঘতম মূর্তি বাদ দিলে নতুন কী নান্দনিকতা দিতে পারলেন ভাস্কর সুতার যার জন্য খোলা চোখের তিন হাজার কোটি খরচ হয়ে গেল। এই মূর্তি উদ্বোধনে যেই মানুষটিকে নিয়ে প্রধান মন্ত্রী গর্ব ভরে বললেন “কৌটিল্যের কূটনীতি এবং শিবাজী মহারাজের শক্তি একত্র হয়েছিল তার মধ্যে। লৌহ মানব বেঁচে থাকলে তিনি কি তাঁর কৌটিল্য কূটচালে সায় দিতেন এই ভাবে নিজের শুধু মাত্র দৈহিক উচ্চতা দিয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম ভাস্কর্য করবার দায়ে এত খরচ। কালের নিয়মে হয়ত একদিন বিশ্ববাজারে অবশ্যই এর চেয়ে বড় মূর্তি তৈরি হবে, পৃথিবীর দীর্ঘতম মূর্তির তকমাও হারিয়ে ফেলবে এই ভাস্কর্য। কিন্তু এই সময়ে এই মূর্তি নির্মাণের ভেতর কোনো কৌটিল্য তত্ত্ব সত্যিই লুকিয়ে ছিল কিনা তার উত্তরের অপেক্ষায় এখন শুধু বসে থাকা কালের অতলেই......।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴