বাগানিয়া জার্নাল-২০
বাগানিয়া জার্নাল – তৃতীয় ভাগ
পর্ব।। চার।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
ভারতে চা-চাষ করার মত উপযুক্ত জলবায়ু ও মাটি আছে জানার পর ‘টি কমিটি’ তার সেক্রেটারী জর্জ জেমস গর্ডনকে জুলাই, ১৮৩৪ সালে চিনদেশে পাঠায় চিনা চায়ের বীজ, চারা ও চিনা চা-কারিগর জোগাড় করে আনার জন্য।
গর্ডন ‘ওয়াটার উইচ’ জাহাজে চিন যাত্রা করেন - সঙ্গী এক মিশনারি পাদ্রী রেভ.চার্লস গুৎস্লাফ (Rev. Charls Gutzlaff) । পথে জলদস্যুদের আক্রমণ সমেত এক রোমাঞ্চকর যাত্রার ভিতর দিয়ে তারা চিনে পৌঁছয়।
চিনে তারা এ্যাংকয় (Ankoy) নামের এক পার্বত্য চা-অঞ্চলে পৌঁছলেও চিনের ভিতরের দিকের সবুজ-চায়ের (Green Tea) জন্য বিখ্যাত অঞ্চলগুলোতে পৌঁছতে পারল না। আসলে সেসব অঞ্চলে কোন ইউরোপিয়ানেরই প্রবেশ তখন নিষিদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও গর্ডন প্রচুর পরিমাণে চায়ের বীজ সংগ্রহ করতে সমর্থ হল।
সেইসব বীজ দিয়ে পরীক্ষামূলক নার্সারী তৈরির জন্য কুমায়ুনের কমিশানার ও সাহারানপুরে বোটানিকাল গার্ডেনকে গাড়োয়াল এবং সিরমুর(Sirmoor) পার্বত্য অঞ্চলে উপযুক্ত জায়গা বাছার জন্য নির্দেশও দেওয়া হল। সেইমতো ১৮৩৫ সালের শেষ দিকে গাড়োয়ালের চিজুরি (Cheejooree), কোথ (Koth), রামা সেরাই (Rama Serai-) এবং সিরমুরের রুরু (Ruroo) ও বেন্চের বাগ (Bencher Baugh) –এ চায়ের নার্সারী তৈরির কাজ শুরু করা হল। একই সঙ্গে যমুনা এবং গঙ্গার মধ্যবর্তী অঞ্চলে চা-নার্সারী গড়ে তোলার উপযুক্ত জায়গা খোঁজার জন্য সাহারানপুর বোটানিকাল গার্ডেনের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ড.ফ্যালকোনার (Dr. Falconer)-এর সাহয্য চাওয়া হল।
এদিকে ১৮৩৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আসামে স্বাভাবিক ভাবে জাত জংলি চা-গাছ সম্বন্ধে টি কমিটি নিশ্চিত হয়ে সরকারকে লিখল ‘that the Tea shrub beyond all doubt indigenous in Upper Assam…’
আসামে দেশী চা-গাছ আবিষ্কারের পর আর চিনা বীজের দরকার হবে না বলে গর্ডনকে চিন থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসতে বলা হল।কিন্তু সে চিঠি তার হাতে পৌঁছবার আগেই গর্ডন তিন কিস্তি বীজ পাঠিয়ে দিয়েছেন – যার কিছু কলকাতায় এসে পৌঁছেছে এবং কিছু আসছে।
এসময়ে টি কমিটির সভ্যদের মধ্যে দুটো ব্যাপারে বেশ ব্যাপক মতভেদ হল। ভারতে কোন বীজ লাগানো হবে –চিনা চায়ের নাকি আসামের জংলি চা-গাছের।উদ্ভিদবিজ্ঞানী ওয়ালিচ সাহেবের অভিমত ছিল যে চিন থেকে বীজ এনে লাগালেও, প্রকৃতি ও পরিবেশ ভিন্ন বলে, তা থেকে ভালো চা গাছ জন্মানোর সম্ভবনা কম। অন্যদিকে আর এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী গ্রিফিথ সাহেবের মত ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশ ভিন্ন হলেও ভালো জাতের চা-বীজ থেকে ভালো জাতের চা-গাছই জন্মাবে।
এ ছাড়া সেসময়ে কারও স্পষ্ট ধারনা ছিল না যে ‘কালো চা’ আর ‘সবুজ চা’ একই গাছের পাতা থেকে তৈরি হয় না আলাদা আলাদা গাছ থেকে।
এই মতভেদের কারণে গর্ডনকে আরও চারমাসের জন্য চিনে থেকে যেতে বলা হল -কালো-চা ও সবুজ-চা তৈরি করার উপযুক্ত সুলুক-সন্ধান এবং বীজ ও কারিগর ধরে আনার জন্য যারা ভারতে চা-চাষের দেখভাল করবে, চা বানাবে।
দ্বিতীয় মতভেদ হল-কোন জায়গায় এইসব নার্সারী তৈরি করার কাজটা শুরু করা হবে। ওয়ালিচ সাহেবের পছন্দ অব-হিমালয় (Sub-Himalayan) অঞ্চল - যেমন কাংড়া, নৈনিতাল, দেরাদুন ইত্যাদি ও দক্ষিণভারতের নীলগিরি অঞ্চল। আর, গ্রিফিথ সাহেবের পছন্দ আসাম অঞ্চল যেখানে জংলি চা-গাছ স্বাভাবিক ভাবে জন্মায়।
যা হোক, টি কমিটি শেষ অবধি গর্ডনের পাঠানো প্রথম কিস্তির বীজ পাঠালো কুমায়ুন, সিরমুর আর আসামে।
চার্লস ব্রুসকে মাসিক ১৫০ টাকা বেতনে উচ্চ-আসামের সাদিয়া ও অন্যান্য জায়গায় সরকারী ভাবে পরীক্ষামূলক নার্সারি গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হল ১১ই ফেব্রুয়ারী,১৮৩৫।
কিন্তু সরকার চাইল এর পাশাপাশি নীলগিরি, কুর্গ,মহীশূর এবং মাদ্রা্জের হর্টি কালচার সোসাইটিতেও সে সব বীজ লাগিয়ে দেখা হোক। সেইমতো গর্ডনের পরবর্তী কিস্তির বীজ পাঠানো হল নীলগিরি (৬ বাক্স),কুর্গ (৬ বাক্স), মহীশূর (৬ বাক্স) এবং মাদ্রাজ (২ বাক্স)।
১৮৩৫ সালের মে মাসে লেঃ চার্লটন আসামের জংলি চাপাতা থেকে বানানো এক প্যাকেট ‘কালো চা’ পাঠালো টি কমিটির কাছে। ভালোভাবে প্যাকিং না করায় ঘোর বৃষ্টির জল ঢুকে সেই চা ‘মিইয়ে’ গিয়েছিল। তবে তাকে রৌদ্রে শুকিয়ে যা পাওয়া গেল – তা যে ভালো চায়ের ইঙ্গিত তা বোঝা গেল।
আগষ্ট মাসে লেঃ চার্লটন আবার কিছু ‘কালো চা’ পাঠাল কমিটিতে।যদিও আগের চা এবং এবারের চা – কোনটাই সঠিক পদ্ধতি মেনে তৈরি হয়নি তবু এবার ভালো ভাবে প্যাক করায় চায়ের সুগন্ধ ও স্বাদ অনেকটাই ঠিকঠাক পাওয়া গেল। আসামের চা নিয়ে কমিটির আত্মবিশ্বাস বাড়ল।
ওদিকে সাদিয়াতে লোহিত নদী আর কুন্দিল নদীর সঙ্গমস্থল ‘কুন্দিলমুখ’(Kundilmikh)–এর চরে এবং তার মুখোমুখি লোহিতের এপারের চরে, মোট দুই জায়গায়, চিনা বীজ ও চারা দিয়ে প্রথম পরীক্ষামূলক নার্সারী শুরু করা হল।
[আসামের ‘ধলা-সাদিয়া’ বা ‘ড.ভূপেন হাজারিকা’ সেতুর উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের কাছে এই ‘কুন্দিলমুখ’।]
দেখা গেল আসামের চিনা চা-গাছগুলো অব-হিমালয়ের থেকে অনেক বেশী ভালভাবে বাড়ছে। কিন্তু নার্সারীর জায়গাটা বাছা হয়েছিল খুব ভুল; কেননা সেটা ছিল বালির চর যার ওপরে মাত্র ইঞ্চি কয়েক পলিমাটি ছিল। তাই গাছেদের প্রধানমূল (Tap root) যেই বালির স্তর ছুঁয়ে ফেলল ওমনি মরে যেতে লাগল। এজন্য ১৮৩৬ সালের শেষের দিকে এই নার্সারী পরিত্যক্ত হল। এবং বেঁচে থাকা গাছগুলোকে বুড়ি ডিহিং-এর পাশে জয়পুরে (আসাম) সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল।
এরমধ্যে, ১৮৩৫ সালে, ‘টি কমিটি’ আসামে গিয়ে সরোজমিনে ‘সমীক্ষা’ করার জন্য ড.ওয়ালিচ -ড. ম্যাকক্লেল্যান্ড -ড. গ্রিফিথ ((Dr. N Wallich-Dr. J M’Clelland-Dr.W.Griffith) এই তিনজনকে নিয়ে একটা ‘বৈজ্ঞানিক দল’ তৈরি করে - যাতে আসামের দেশী জংলি চা-গাছ এবং পরীক্ষামূলক ভাবে সেই চা-চাষের জন্য উপযুক্ত জায়গা সম্পর্কে একটা মতামত পাওয়া যায়।
১৮৩৬ সালে সেই দল আসামে আসে এবং চার্লস ব্রুস পথপ্রদর্শক হয়ে তাদের নাগা পর্বত ও পাটকাই পর্বতের বিভিন্ন চা-এলাকা ঘুরিয়ে দেখান। এবং সঙ্গে আরও কিছু নদী-উপত্যকা দেখান যেখানে প্রচুর জংলি চাগাছ ঝাড় বেঁধে হয়েছে। এবং যা ভাবা হয়েছিল আসামে জংলী-চা যে তার থেকে অনেক বেশী অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো – তা নিয়ে বিজ্ঞানী দলের আর কোন সন্দেহ আর রইল না।
------------------------------------------------------------
ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴