পইলা সাঞ্ঝির কথা/২০
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব : ২০
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
অ্যাকশোইরে হা
~~~~~~~~~
সকালে উঠে মাকে আবার কাদা-মাটি হাতে দেখে সুষেণের রাগ হয়ে গেল।
"তোর কি দিনাও ঘর-বাড়িলা না মুছিলে হয়ে না? এত এখেরে চকচকা নাগে?"
ছেলের রাগকে পাত্তা না দিয়ে রসবালা উল্টে গরম দিতে যাবে দেখে বসমতী উঠোনে দাঁড়িয়ে। বসমতীর হাতেও কাদা গোলানোর আভাস। শাঁখা-পলায় লেপ্টে আছে গোবর-মাটি।
"হ, দি কত্থন আসিলু। বইস চা খা।"
"না খাং মুই এলা চা। এলায় তোর দাদাক বানে দিলুং। সাকালিয়া খাবার উটি বোলে খায়, করি থুয়া আইসোছোং।"
রসবালা তবু একটা পিঁড়ি পেতে দেয়। বলে,
"বইসখেনে, খারায় এলায় হবে। মুইও এখেরে এইলা শ্যাষ করি খাবার করিম। চাইট্টা ভোত্তা ভাত আন্দি দ্যাং। তুই আসিলু তে খাই কোনেক চাহা।"
বসমতী বসতে বসতে বলে,
"আসিলুং কোনেক বাউঘরেরঠে। ধল ছিটির নাগে যে। তোমার আইনসে? এলায় অউদোত না দিলে শুকাবেকে না। ঝনঝন করি না শুকালে হয়? গুন্ডায় হবে না।"
রসবালা ছেলেদের উদ্দেশ্যে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলে,
"সাকাল থাকি কোবারে ধোচ্চুং দি, ওই তো শুনে না। কি বড়, কি ছোট -দোনোয় সামান। কাথাটা কয় না, গোর যেদি যায় আগাল সেদি। গোরটা হামার নাহয় ভাল।"
সুষেণ এবার আশ্বস্ত করে,
"যাছোং, যাছোং। যে অউদ আজি, এক খারায় এলায় শুকাবে। যেনা জিনিসগিলা। যেটে সেঠে পাওয়া যায়। জামুরির পাত, ব্যালের পাত। এইলায় তো! আর খইল তো বাড়িতে আছে!"
তারপর গামছাটা কোমরে বাঁধতে বাঁধতে বলে,
"বাঙালি মানষির কি যে হিলা নিয়াম।"
ছেলের কথা শুনে সুষেণের বাপ মাথা নাড়ে। বলে,
"না হয় রে বাউ, হিলা নিয়াম ফ্যালে দিবার না হয়। এইলা হামার আগিলা মানষিগিলার বাতে দ্যাওয়া নিয়াম। আগেকার দিনোত এলকার মতোন অ্যাতো কি আর ইচিত-বিচিত ঔষধ-পাতি ছিল জমিত দিবার? তে এইলায় আছিল। আশ্বিন মাসের দোমাসীত এই ডাকনক্কী পূজা করি জমি-বাড়ির পোকা খেদায়। অ্যায় যে এলা চাইরো পাখে পোকার ওইত্যাচারখান হবে, এইলা দিয়ায় না আগেকার মানষি আবাদ তুইলসে। তে এইলাক ফ্যালে দিলে হয়!"
সুষেণ আর কথা খুঁজে পায় না। মাথা নিচু করে "হুটা তো হয়" বলে বাইরে যায় সব জোগাড় করতে।
বসমতী চা-টা কোনোমতে গলায় ঢেলেই উঠে পড়ে। রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। আবার দুপুরের রান্না। বসমতী যেতে রসবালাও কাজে নেমে পড়ে। এমন সময় দেখে সুকারুর বউ দাঁড়িয়ে। সঙ্গে আঁচল ধরে ছেলেটা। রসবালা হাঁক পাড়ে,
"কি দেওয়ানি, মোক নিগির আসিলু? তে মাক ধরি কেনে? বাইজ্যে-বাজনে আসিবু, তেই সেনা মুই যাং। অমতন করি নিগালে না যাং মুই তোর বাড়ি।"
শুকারুর ছেলে লজ্জায় লাল হয়ে আরো বেশি করে মার আঁচলে মুখ লুকায়। ওর কান্ড দেখে সবাই হেসে ফেলে। শুকারুর বউ বলে,
"না কন বারে মাও, দেখেছেন না হামরা সরম খাই।"
তারপর ছেলেকে জোর করে টেনে সামনে আনতে আনতে বলে,
"তুই কোবার না পাছিত, যে এলা এংকরি চল, পরে না হয় ব্যাং পাট্টি আনিমু এলায়। ক বোলে বড় হং, পাইসা কামাই করং সেলা নিগাইম।"
ছেলে মায়ের এ হেন আশ্বাস বাণীতে মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারল না। উল্টে বলল,
"মুই বিয়াও না করং।"
হাসতে হাসতে শুকারুর বউ বলে,
"নে নানাগে বিয়াও করির। হামরা বটের গোড়ের বুড়িটাক আনিমু, চেংরিয়ে আছে।"
রসবালা প্রতিবাদ করে,
"উঁ, মুই বেশি ঢক। কাজও করং। মোর মোতোন বউ কোনোটে পাবেন না।"
কথা শুনে যতই সবাই হাসে শুকারুর ছেলে তত লজ্জায় কুঁকড়ে মাকে জড়িয়ে কোলের ভেতর মুখ লুকায়।
সুকারুর বউ অবশ্য এই কাজের সময় বেড়াতে আসেনি। হাসি-মস্করার মধ্যেই একটু যেন নিজেকে গুছিয়ে নেয় তারপর রসবালাকে বলে,
"তোমার দুই কোশ পাটা আছে তে দ্যাও তো মা। সইঞ্জাত ভোগা দিমু।"
সামান্য থেমে বলে,
"হামার তো জমি-জাগা নাই। এই সুলকি-ঘাটা, গোয়ালি ঘরটাত কোনেক না দিলে হয়! তে তারে পাটা নাই। ঘিউ কোনেক আছে ঠাকুর থানোত, পূজার না বাঁচিশে। তাকে দিয়ায় কোনেক করি মাখিলে হবে।"
রসবালা একটা মোটা পাটের মুঠা এনে দিলে অবাক হয়,
"এঠে একটা হাফাল গোটায় আছে যে মাও! তামাল্লায় নিগাইম!"
রসবালা নাতির গালটা একটু জোর করে টিপে দিয়ে বলে,
"নিগাও। দড়ি-দোতা বানেরও না পাটা কোনেক নাগে বাড়িত।"
ঝিমিয়ে পড়া একটা বিকেল ম্লান হওয়ার আগে আজ হৈ হৈ করে জেগে ওঠে। চারদিকে থেকে সাম-গাইনের ধুপ-ধাপ, মানুষের হাঁক-ডাকে, কোলাহলে ভরে ওঠে চার-পাশ। সুষেণের বাপও তুলসি মঞ্চের কাছে বসে দু'হাতে পাট নিয়ে ভালো করে খুলে খুলে পাতলা আঁশ বের করে আবার সব মিশিয়ে নিচ্ছে, আবার খুলে খুলে পাতলা করছে। একদম মিহি করা হয়ে গেলে কলা পাতায় রাখা ঘি পাটের মধ্যে মেখে আরো মিহি করে তুলছে। পাশে বসা ছেলেকে দেখিয়ে বলল,
"এংকরি আউলিয়া ঠেসেমা বানের নাগে। তাহালে ভোগা জ্বলিবে ভাল।"
আচ্ছা করে ঘি মাখিয়ে মাখিয়ে পাশে কেটে রাখা বাঁশের তৈরি লম্বা মতোন লাঠির মাথায় পাটের আঁশ জড়িয়ে তৈরি হল ভোগা। বেশ কয়েকটা ভোগা বানিয়ে একটা ছোট বাঁশের টুকরিতে ধল নিল। রসবালা তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে তারপর বাড়ির সামনে, খিড়কি দরজায় ভোগাবাতি ধরিয়ে দিল। এবার সবাইমিলে ধানক্ষেতের দিকে চলল। সুন্দর গন্ধ আর মানুষের কোলাহলে চারদিক আমোদিত। সুষেণ আর ওর ভাইও গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল,
"অ্যাকশোইরে হা/পোকা-মাকড় দূর যা।
সোগারে ধান টনেয়া মনেয়া/হামার ধান কাঞ্চা সোনা।
সোগারে ধান নড়েচড়ে/হামার ডুলি উথুলি পড়ে।"
সঙ্গে সঙ্গে মাঠের আর এক কোণ থেকে আরো জোরে চেঁচিয়ে কেউ উত্তর দেয়
"ছোট নাঙ্গলের বড় ঈশ/হামার ধানের লম্বা লম্বা শিষ।"
রসবালা মাঠের কোণে একটা ধূপ ধরিয়ে ফুল-জল দিয়ে প্রণাম করে। সুষেণ বাঁশের টুকরিটা নিয়ে ধান ক্ষেতে ধলের গুঁড়া ছিটোতে থাকে। পাশ থেকে ওর বাবা বলে,
"দেখিস, কোনেক সামান করি ছিটা। সবলা জমিতে দিবার নাগিবে বোল। ভাল করি ছিটা।"
কে শোনে কার কথা। দু-ভাই পেয়েছে মজা। দুজনে মনের আনন্দে চিৎকার করছে আর ছিটাচ্ছে।
............................................................
ধল - বড় লেবুর পাতা, বেলপাতা শুকিয়ে তার সঙ্গে সর্ষেখোল বা খইল মিশিয়ে তৈরি প্রাকৃতিক কীটনাশক।
হাফাল - এক আঁটি পাটে যতটা পাটের আঁশ থাকে।
ভোগা - পাটের আঁশ ছেনে আঁশ তুলে নরম করে ঘি মাখিয়ে পাটকাঠি বা বাঁশের সরু লাঠির মাথায় জড়িয়ে তৈরি হয় ভোগা
............................................................
ছবি - ময়ূখ রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴