নানা রঙের গানগুলি-২০/শৌভিক কুন্ডা
নানা রঙের গানগুলি (২০)
শৌভিক কুন্ডা
--------------------------------
১৯৮৪। সেদিনের আমি এ আমি নই। এত পাঁক, এত বিষ জমে নি শরীরমনে। দরজা জানালা সব সময় খোলা। ভালোমন্দ সকল বাতাসই ছুঁয়ে যেতো ভেতরঘর। আর, সে সময়ই মফস্বলি গন্ডী ছেড়ে প্রথম একা মহানগরীর বুকে। ভয়, দ্বিধা, সংকোচ নিয়ে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি। একটু একটু করে বন্ধুত্ব শুরু হ'ল। তেমনই একজন গৌতম। গৌতম সেন। আমি ইংরেজি, ইউজি ওয়ান, গৌতম বাংলায়, ইউজি টু। আমি জলপাইগুড়ি ছেড়ে সদ্য যাওয়া, গৌতমের দত্তপুকুর থেকে যাতায়াত একবছর আগে থেকে। বন্ধুত্ব হ'ল কবিতার জন্য। ও তখন তেড়েফুঁড়ে লিখছে, পত্রিকা বের করছে। আমি টুকটাক। যাইহোক, গৌতম যে ইউনিয়ন ঘেঁষা বিপ্লবী, সে পরিচয় জানা ছিলো না। তখন যাদবপুরে আর্টস আর ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ডিএসএফ-এর দখলে। সায়েন্সে এসএফআই। গৌতমই একদিন সন্ধ্যের দিকে নিয়ে গেল ইউনিয়ন রুমে। পরিচয় হল অনেকের সাথে। যাদের মধ্যে শ্যামল ভট্টাচার্যকে বিশেষ করে মনে আছে দুটো কারণে, এক তো চেহারা, আর দুই, লোকসংগীতের ভান্ডার, সাথে দোতারা, ডুবকিতে প্রাণের দখল। পরে, অনেক পরে শ্যামলদার সাথে নূতন করে যোগাযোগ হয় ফেসবুকের মাধ্যমে। যাই হোক, তখন আর্টস ফ্যাকাল্টি ইউনিয়ন রুম সন্ধ্যের পর সরগরম থাকতো। প্রথম দু তিন দিন গৌতমের সাথেই গেছিলাম। তারপর থেকে সন্ধ্যে হলেই মহানগরীতে একা এই মফস্বলি সদ্য তরুণকে ঐ ঘরটা হাতছানি দিতো। না, রাজনৈতিক কারণে নয়। গানের জন্য। শ্যামল দা, গৌতম, পার্থ, নীলদা যেমন ছিলো, তেমনই আবার রুনু, শিবু(শিবানী)দি, সারি: সকলে মিলে গান গাইতো। সবারই যে সুর-ছন্দে শ্যামল দার মতো দখল ছিলো, তেমন নয়, তবে যেটা ছিলো, এই অদীক্ষিত শ্রোতার কাছে আজও গান ভালোলাগানোর চাবিকাঠি সেটাই: প্রাণ, প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত সুর বাওয়া। সেখানেই, সেই ১৯৮৪তে সমবেত স্বরে প্রথম শুনলাম আশ্চর্য গানটি,
পূবের আকাশ
রাঙা হ'ল সাথী
ঘুমায়ো না আর জাগো রে
ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে সাথী রে
ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে....
বলেছি আগেই, তখনও মন কিছুটা হলেও নরম, সেখানে অনেক ছাপ গেঁথে যেতে থাকে। যেমন চিরস্থায়ী হয়ে গেল সুরে কথায় মায়াজাল বিছিয়ে দেওয়া এই গান। তখনও অবধি জানি, ওরা এই ইউনিয়ন ঘরে এমন যে অনেক গান গায়, একসাথে গলা মিলিয়ে, আমার ততদিন অবধি অজানা, এও তেমনই এক মন ছুঁয়ে থাকা অর্জন।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়। বলতেই সবার আগে যে গানটির কথা মনে হানা দেয়,
"আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই"
এ নিয়ে প্রতুলের অভিমানও রয়েছে কিছুটা। সত্যিই তো, কেবল এই একটি গানের সৃষ্টিতেই তাঁকে থামিয়ে রাখা তাঁর প্রতি অবিচার। "আমি কিন্তু আরও গান গেয়েছি", অনুক্ত রেখেছেন প্রতুল, " সে সব গানও প্রাণজাগানিয়া
অথচ....."! সত্যিই, যত শুনেছি প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে, যত শুনি, বুঝতে পারি নিছক গায়ক বা গীতিকার হিসেবেই মাঠে নামেন নি তিনি। প্রতুল চেতনায় আঘাত হানার গান করেন। এবং তাতে ছড়িয়ে যায় দিগন্তস্পর্শী নানা পথ। এদের ভেতর আছে,
"কিসের ভয় সাহসী মন",
" সব মরন নয় সমান", "আমাদের যেতে হবে", " সাপের মাথায় পা দিয়ে কে নাচে," "আমি গাছকে বলছি"
"খিলখিল্লির মুল্লুকেতে" এমন অজস্র গান। মনে পড়ছে একটা সময় দিয়ে আমার চাকরিস্থল এই প্রান্তিক স্কুলটি রাজ্যের নাটক মানচিত্রে পোক্ত আসন করে নিয়েছিলো। একবার "আলোকসন্ধান" নামের নাটকে পরিচালক আমি প্রতুলের ঐ "আমাদের যেতে হবে, দূরে, বহুদূরে" গানটি ব্যবহার করেছিলাম। গোটা নাটকে একটিই 'গান' ছিলো। কোনো যন্ত্রানুসঙ্গ ছাড়া কেবল স্বরকেই নাটকটির আবহে সাজিয়েছিলো পরিকল্পক সৌরজ্যোতি ঘোষ। আর নাটকের একমাত্র গানের গলাটি ছিলো সেদিনের এক ছোট মেয়ে (সম্ভবত কলেজ তখন) মালিনী গৌতম। সৌরজ্যোতিরই ছাত্রী সে।
আজ মনে হয়, প্রতুল যেমন যন্ত্র অনুষঙ্গ ছাড়া গানকে নাটকীয়তার চরমে পৌঁছে দেন, আমাদের সামান্য প্রয়াস যেন তাঁর নিজস্ব ধারাটির প্রতি এক বিনম্র শ্রদ্ধা।
এসব গানকে প্রতুল চারিয়ে দিতে চেয়েছেন মানবজমিনে। কিন্তু হয়ে রইলেন শুধুমাত্র
"বাংলার গান"-এর জন্মদাতা! আমার কাছে প্রতুল মুখোপাধ্যায় অবশ্য "হাতের কলম জনমদুখী,
তাকে বেচো না"র ঋত্বিক। আর, শুরু করেছি যে গান দিয়ে -
"পাল তুলে দাও, হাল ধর হাতে
দুস্তর সাগর হবো পার
জাগায়ে মাতন
ঢেউয়ের নাচন
মরন বাঁচন একাকার.....
ভাসাও রে ডিঙ্গা সাগরে
ভা-সাও রে ডিঙ্গা সাগরে...
পূবের আকাশ রাঙা হ'ল সাথী
ঘুমায়ো না আর জাগো রে..."
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴