তোর্সার ঘরবাড়ি-২০
তোর্সার ঘর বাড়ি/বিংশ পর্ব
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
-------------------------------------
'এই সেই নদী
এই নদীর জলেই একদিন
পুণ্যস্নান করতেন আমার মা
আবক্ষ ভেজা শাড়িতে দাঁড়িয়ে তাঁর মন্ত্র জপ আজো শুনি...'
জল... সে কি সব ভাসিয়ে নেবে বলেই বয়ে যায় ধীরে! কে জানে, এমনই মনে হত ওদের, ঐ ছেলে মেয়েগুলোর, যারা আজন্ম চরের ধুলো বালি মেখে হুড়মুড় জলে গা ভেজায়। সাঁতরে যায় আজো কাঠ ধরে। ডাকাবুকোর মতো ঐ কাঠের উপর চড়েই পাড়ি দেয় এপার থেকে ওপার। পশারিহাট বা শুটকাবাড়ি থেকে ঘুরে আসে কেউ। মিনিরা চিরকালের তুলে রাখা। 'পাছে ব্যথা পায়...' কেন এত যত্ন! কেন এমন, সেই তো একা হতে হয়...জীবনের সিংহভাগ পেরিয়ে মিনি ভালোবাসে একলার ঘর আর নিজস্ব স্বাধীনতা। যাকে সে নিংড়ে নেবে, যে স্বাধীনতার যষ্ঠি রু এর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে সে।রোহিনীর ও নেশা লেগেছে চোখে। সে সেই উঠোনের মাটি খুঁজবেই। যেখানে জন্ম নাড়িটুকু পোঁতা আছে। সে সব লীন হলেও মিশে থাকে পাখির গানে। যে জবাগাছের ঝোপে দোয়েল ডিম পেড়েছে বার বার। বাঁচাতে পারেনি হুলো বেড়ালের উৎপাতে। রোহিনীকে ওড়া না শেখানো পর্যন্ত নিবৃত্তি নেই মিনির।ওর যেটুকু ভালোমানুষী, বুকে কষ্ট, মুখে লুকিয়ে ফেলা সেসব রোহিনী পেলেও রু নিজেকে চিনে নিক আগেই। মুখ আর মুখোশের ফারাক বুঝে নিক। ভাললোবাসুক প্রত্ন মাটি, মাটির টান থাক শরীর ঘিরে। ইতিহাস হয়ে যাওয়া ব ইয়ের পৃষ্ঠাকে সঙ্গী করেছে, খুঁজছে এ মাটির ইতিহাস, রাজবাড়ি কথা, মানুষের কথা, রাস্তা ঘেরা নতুন মুখের গল্প মা ফিরলেই হাঁ করে শোনে। শুনেছে ১৯৫৪ র কাহিনী।বন্যা আসার আগে আর পরের কথা। দাদুর বন্ধুরা আর দাদু তখন তরুন। পাশের ডুবে যাওয়া পাড়ার মানুষদের উদ্ধারে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। শুশ্রূষা আর পলি সরিয়ে মানুষের কাজে লাগার কথা যখন রাজ শহর সংক্রান্ত বইয়ের পৃষ্ঠায় ইতিহাস প'ড়ে তার ও মায়ের মাটির উপর মনে মনে অধিকার বোধ ফুঁসতে থাকে। ঠিক নদীর গর্ভ থেকে ফুলে ওঠা জোয়ারের মত।
ঐ বন্যার পরই শান্ত সমাহিত তোর্সা এগিয়ে এসেছে ঘরের কাছে। শুধু কি মিনির বাড়ি, মিনির পাড়া? পাশের পাড়া? তোর্সা দক্ষিণমুখী হয়ে ঘুঘুমারি পেরিয়ে যে গ্রামে ঢুকেছে তা হল ঘেঘির ঘাটা, কত গান কত সৃষ্টি সেই চলার পথ নিয়ে আজো মুখে মুখে।
মিনির একা চলার পথের রসদ জমতে থাকে। চর্যাপদের 'সোনে ভরিতি করুনা নাবি/ রূপা থোই নাহিক ঠাবি...' মনে মনে আওড়ায় মিনি আর পথে পথে খোঁজে চেনা মুখ এধার ওধার।
মোষের পিঠে যে বাউদিয়া যুবক বাঁশি বা দোতরা বাজাত নদীর পাড়ে, ...এই নগরায়নে সব বদলে গেছে।কসমোপলিটান সংস্কৃতি শহরের আনাচ কানাচে। নদী পথে যাতায়াত কম, সেখানকার পরিবহন নির্ভরতাও কম। শুধু বাঁশের স়াকো বিনি সুতোর মালা গাঁথছে এপারে ওপারে।
তোর্সার পূর্ববাহিনী মূঊলধধারা খুঁজে নিতে সেই ঘরঘরা, মরাতোর্সা মিলে মিশে কালজানি ধারার কাছে দাঁড়ায় মিনি। হাতের আধুনিক ফোনে ছবিও তোলে। সোজা রাস্তা ধরে চকচকা পেরিয়ে ঝিনাইডাঙার দিকে চলে যায়।
* * *
মধ্য শহরের একধারে বাস এখন। রবাহুত অনাহুত। কাছাকাছি হাত বাড়ালেই শহরের প্রাণকেন্দ্র ছুঁয়ে দেওয়া যায়। প্রতি রাতে খাবার সন্ধানী প্রাণীর মত রুটির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে শহরের হাল হকিকত জানতে ইচ্ছে করে। কত পরিচিত মুখের অল্পবয়সী চেনা চোখে চোখ পড়েছে, দেখেছে পেরিয়ে আসা সময়ের বলীরেখা। সহজে চেনা যায়না। হঠাৎ কে যেন বলে,...দিদি, আপনি হাজরাপাড়ার না?...একটু হাসে মিনি।...না। আমি দেবীবাড়ির। যন্ত্রণাগুলো প্রেতাত্মার মত সেই নদীর তীরেই দাঁড় করিয়ে রাখে। নিজের গন্ডীটুকু শক্ত প্রাচীরটা ভাঙতে চায় না।
বেশ কয়েকমাস পেরিয়ে বছর গড়াতে চলেছে। ভাল লাগা মা'টিতে ঘুরে গেছে ছোটবেলার গন্ধ মেখে নিতে রোহিনী। গড়ে ওঠা নতুন শহরের সংস্কৃতি মঞ্চ খুঁজেছে। ছশো আসনের উৎসব মঞ্চ। ঠিক ডি এম অফিসের পাশের চত্বরেই। মিনিও অবাক। আরে! এমন জায়গা ছিল নাকি আগে! পাশে যমুনা দীঘি। যা লোকের মুখে মুখে 'লম্বা দীঘি।'খুব স্বচ্ছ কাকের চোখের মত নয়, আবর্জনা এখনো আছে,'হেরিটেজ' তকমা দিয়ে যাওয়ার পরেও। খুব আনন্দে মঞ্চের অনুষ্ঠানে সেদিন গেয়েছিল রোহিনী 'ঐ মহামানব আসে...'স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীর মাঝখানে মাটির মিনি তখন প্রজ্ঞা সান্যাল। কে চেনে ওকে! কেউনা। ডি এম অফিস চত্বরেপরিবেশ দিবসে সেদিন যে গাছ লাগিয়েছিল সেটা অমলতাস। পাশেই ধিকি ধিকি বেড়ে উঠছে জারুল আর নিম। তিনটে গাছ হাত ধরাধরি। একবছরে কত বড় হয়ে উঠেছে! প্রতিদিন সন্ধেয় ঘরে ফেরার সময় দীঘির জল আর অস্ত সূর্য আলো এসে পড়ে কচি কিশলয়ে।নিম আর জারুল লাগিয়েছেন যিনি গতবছর তিনি সেই জেলাসমাহর্তা বদলী হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
রাত বাড়ে, নতুন নতুন নম্বর থেকে ফোন আসে মিনির হ্যান্ডসেটে।খুব পরিচিত প্রাজ্ঞ এক সম্পাদককে সে ফোন করেছিল, কলেজে একখানা পুরনো পুঁথি আর ইতিহাসের পৃষ্ঠা নিয়ে সংগ্রহ শালা করা যায় কিনা জানতে। তিনি ব্যস্ত ছিলেন।...এখন ফোন করেছেন। নানা পরিচয় কথা আর পুরোনো অভিজাত পাড়া আর পরিবারের কথা উঠে আসতেই মিনির বাড়ির প্রসঙ্গ এল,আর এল যথানিয়মে তোর্সার কথা।সেখানে বাঁধ তৈরির নানা ইতিহাস।কথার ফাঁকে একখানা লেখার অনুরোধ করলেন সম্পাদক।
'উত্তরের উল্লেখনীয় নারী নাম আর কথা' এ বিষয়ে লেখার অনুরোধ।ইচ্ছের ফাঁকে ফাঁকে বহু মুখ উঁকি দেয়। রাজশহর রাজ পরিবারই তো প্রথম উদাহরণ। ...ভাবনার সুতো ছেঁড়ে। সম্পাদক বলছেন, জানেন, ঐযে বালির বস্তা দিয়ে, বোল্ডার দিয়ে বেঁধে রাখা বাঁধ আপনার ঘরের কাছের, প্রতি বর্ষায় কেমন ফুলে ফেঁপে ওঠে। চরের মানুষ প্রতিবছর বিপদগ্রস্ত হয়, উঠে আসে তীরে কারো বাড়ির আশ্রয়ে।
- সে আর আপনি বলবেন কি, এ তো আমার চোখে দেখা ছবি। লম্বা বাঁশের কাঠি পুঁতে দেওয়া হত, জল প্লাবনে ডুবছে আর ডুবছে, ওদিকে ভাসছে মানুষের ঘর বাড়ি। আমাদের বারান্দায় তারা শরণার্থী কতবার। চিহ্নধারী কাঠি উধাও।
প্রবল সেই বন্যার পর জওহরলাল নেহেরুর আনুকূল্যেই গড়ে উঠেছিল বাঁধ। সে বাঁধে অবাধ বিচরণ ছিল ওদৈর পাড়া, পাশের পাড়া, শ্মশান রোড সমস্ত দিকের ছেলে থেকে বৃদ্ধ সকলের। আর বড় পাথরের তার জালের শক্ত স্পার কখন যে নিজের হয়ে উঠে খেজুর, ধুতুরা, ভাঁটফুলে একাকার হয়ে যেত, সে শুধু সময়ের অধিকারী মানুষরাই জানে।খুব ছোটবেলার সূর্য অস্তের ছবি তুলতে গিয়ে মিনিকে কোলে নিয়ে ফুলজেঠু একখানা ছবি তুলেছিল। ওর মাথায় ছিল লাল নীল ছাতা। কিন্তু সেসময়তো রঙীন ফটোর কাল নয়। তাই কালো সাদায় তোর্সা বয়ে যায় পটভূমি জুড়ে। আজ যে এতদিন পর তোর্সার ছবি তুলছে, সেখানে পটভূমিতে বিপুলা তোর্সা শুধু নয় একসঙ্গে চর এলাকার বিপুল জন জীবন, তাদের ঘরবাড়ি,বড় বড় বেশকিছু গাছ, কোথাও বাঁশের সাঁকো প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।.. বিপুল জনজীবন এখন। সেই পরিচিত মহীরুহ, কৃষ্ণচূড়া, খেজুর সব কোথায়! সেই মাটির পোক্ত বাঁধ বদলে গেছে হাওয়ায়, জন জীবনের বিপুল চাহিদায়। চার পাঁচ দশক পেরিয়ে যাওয়া বিপুলা তোর্সার সে ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজে নেওয়া দুষ্কর। চর এলাকার জনসংখ্যা স্ফীতি এক নতুন লোকালয় তৈরি করেছে। সরকারী ভাবে বিদ্যুতের খুঁটিও বসেছে। ফাঁসীর ঘাটের কাছে ব্রিজ তৈরির দাবী উঠলে হবে কি! ঐ প্রাজ্ঞ সম্পাদক বলছিলেন, ওটা পাকা ব্রীজ হলে বিশাল তোর্সার জলের ঝাপট সহ্য করতে পারবেনা বাঁধ।
রোহিনী সেই মাটির বাঁধ আর বাঁধ সংলগ্ন মামাবাড়ি, দাদুর বাড়ি...তখনো দুটো উঠোন এগুলো ঠিক চেনে।ছোটবেলার আবছায়া স্মৃতিই তো মূলধন। চারদিকের কংক্রিটে উন্নয়নের নাম লেখা থাকলেও বুকের কষ্টটা মার মতো তার শিরাতেও বয়ে যায়।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। দাদুর মতো মা যেমন কষ্ট পেয়েছিল একে একে গাছেদের নিধনে, রোহিনী তেমন করেই আগলে রাখতে চায় যতটুকু আছে সব। মিনি মা অনেকগুলো ছবি পাঠিয়েছে আজ নদী আর নদীর পাড় জুড়ে তার সবুজ বাঁধের মাটির অংশ জুড়ে বড় বড় ইমারত গড়ে ওঠার ছবি, রাজবাড়ির পিছন দিকের অনেকটা অংশের ছবি, কেমন পঞ্চবটী বন ঘেরা মন্দির যেন।...প্রকৃতি তো সচল সজীব। জগদীশ বসু, রবীন্দ্রনাুথ গাছেদের সঙ্গে একাত্ম হতেই তো শিখিয়েছেন। পুরো খ তবিতানের প্রকৃতি পর্যায় অথবা ছিন্নপত্র কিংবা গল্প গুচ্ছের গল্পগুলো এমনভাবে মনে পড়ে কেন! ভরা বর্ষায় বা ঘাস জমিতে হাঁটতে হাঁটতে মার এখনকার আবাস স্থল, দেবীবাড়ি, রানী বাগান ঘেঁষা বাঁধ, বাঁধের পাকা পোক্ত কালো রাস্তা হাইওয়ে সবদিকে। যেন ঘিরে আছে রক্ষী হয়ে।
আধুনিক সভ্যতা তো এগিয়ে আসবেই। নদী, বাঁধ, জল, গাছের প্রণ হানি, নিজেদের মধ্যে বিভেদ সব ই তো মনুষ্য সৃষ্ট। মিনির মত ওও ভাবে প্রকৃতি একদিন ফুঁসে উঠবেই।
তোর্সার নাব্যতা কমেছে একথা বলে চলেছেন বিশেষজ্ঞগন। প্রায় সব নদী সম্পর্কেই একথা বলা হয়। তোর্সার জন্য আরো একবার সবাই মিলে দল বাঁধা যায়না! কোন রাজনৈতিক দল নয়। পাশে দাঁড়ানোর সৎ ইচ্ছা নিয়ে একসঙ্গে হওয়া মানুষ! সে সম্পাদককে মিনির জিজ্ঞাসা ছিল এতদিন পর অবাক হয়ে যাওয়ার পর,...আপনি কি বলেন, এভাবে বাঁধ বাঁধিয়ে জাতীয় সড়ক করে দেওয়া...এটা কবে থেকে? আপনি কি বলেন? এতে ক্ষতি নেই!
...কেন, বোঝেন না উপকার? মিনি বোঝো পরিণত নগরী কথা, অধ্যাপিকা প্রজ্ঞা বোঝে। ...কে ফিরিয়ে দেবে তাকে ফেলে আসা চর কথা মাটির বাঁধের সে খেলার পাথর গুচ্ছ আর ঘনারামের অস্পষ্ট ধোঁয়ার ঘর....
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴